![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
রাত্রির নির্জনতায় নিঃসঙ্গ কেঁদে কেঁদে, একদিন হয়তো তুই অজান্তেই মরে যাবি, তবুও তুই জানবি না পাষাণ এ বুকে কতটুকু ভালবাসা তোর জন্যে জমা রাখি।
সময় দেখাটা খুবই জরুরী। আর কতটা সময় বাকী আছে তা দেখতে হবে। শফিক ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে লাগল আশেপাশে কেউ আছে কিনা যাকে সময় জিজ্ঞেস করা যায়। একটা মানুষ যখন জেনে যায় তার মৃত্যু একটা নির্দিষ্ট সময় পরে হবে, তখন তার ভিতর থেকে মৃত্যুভয় চলে যায়। সে অধীরভাবে অপেক্ষা করতে থাকে তার মৃত্যু কিভাবে হবে। মৃত্যু তাকে কতটা কষ্ট দিয়ে গ্রাস করবে। অবশ্য ইচ্ছামৃত্যুর ক্ষেত্রে এমন হয় না। যখন ইচ্ছা তখনই মৃত্যুকে বরণ করে নেওয়া যায়। শফিকও মৃত্যুর জন্যে সে অধীরভাবে অপেক্ষা করছে। তার সময় জানা নাই। জানতে পারলে ভালো হতো কতটা সময় হাতে আছে বুঝতে পারত। মৃত্যুর আগে কি কি করা যেতে পারে তা চিন্তা করতে পারত। একজন কনস্টেবলকে দেখল এগিয়ে আসছে তার সেলের দিকে। হাত বাড়িয়ে তাকে ডাকল।
'ভাই কয়টা বাজে?'
'কয়টা বাজে তা দিয়া কি করবা?' বিরক্তি রেখা চেহারায় ফুটিয়ে কনস্টেবল জিজ্ঞেস করল।
'না দেখতাম কতটা সময় বাকি আছে।'
'এগারোটা ছাব্বিশ বাজে।'
'ভাই আপনের কাছে তো মোবাইলও আছে, এককাজ করেন না হাত ঘড়িটা আমারে দিয়া যান। একটু পর পরই সময় দেখতে ইচ্ছে হয়।
শফিক ঘড়িটা চোখের সামনে ধরে তাকিয়ে আছে একদৃষ্টিতে। সেকেন্ডের কাটাগুলো ঘুরছে খুব আস্তে আস্তে। টাইম ডাইলেশনের ব্যাপারটা এখন তার বেলায় ঘটছে। প্রতিটা মূহুর্তকে অনেক বেশি লম্বা মনে হচ্ছে। একেকটা মিনিট যেন একেকটা যুগ। এগারোটা চুয়াল্লিশ বাজে। আজ রাত একটার সময় তার ফাঁসি কার্যকর করা হবে। সময়ের হিসাবে বাকী আছে আরও তের ঘন্টা। অনেক সময়। এই সময়ের মাঝে অনেক কাজ করা যেত কিন্তু তার হাতে তেমন কোন কাজ নেই। সেলের এক কোনায় দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে পড়ল।
হেলান দিয়ে বসে থাকতে থাকতে তার তন্দ্রামত হলো। চোখের সামনেই যেন দেখতে পেল, তার বাড়িতে খুব হইচই হচ্ছে। বাড়িটাকে খুব সাজানো হয়েছে ঠিক বিয়ে বাড়ির মত করে। এত হইচই কিন্তু সে কাউকে খুঁজে পাচ্ছে না। ঘরের মধ্যে ঢুকে দেখতে পেল তার মৃত বাবাকে। তিনি যেন আরও সুন্দর ও লম্বা হয়ে গেছেন। বাবাকে দেখে সালাম দিল শফিক।
'সারাদিন থাকছ কই? খোঁজখুজি করেও তোকে পাওয়া যায় না।'
শফিক আজ খুব ভদ্র ভাষায় কথা বলল, 'না বাবা একটু বাইরে গেছিলাম। আর যাব না। এখন থেকে আপনার সাথেই থাকব।'
'যা তর মায়ের কাছে যা। সেই কখন থেকে বিয়ের শাড়ি পরে বসে আছে। আমার লজ্জা করছে কিছু বলতে পারছি না।'
শফিক মাকে খুঁজতে গিয়ে দেখে মা একটা ঘরে খাটের উপর বসে আছেন। তার গা ভর্তি গহনা। হাতে মেহেদী দিয়ে দিচ্ছে তার ছোটবোন শেলী।
'মা কি ব্যাপার? এত সাজগোজ করছো কেন?'
'আরে ভাইয়া তুমি জানো না আজকে বাবা মার বিয়ে।'
শফিক তাকাল তার মায়ের দিকে। তিনি একটা লাজুক হাসি দিয়ে মাথাটা নিচু করলেন। শফিকের হঠাত্ করে মনে হল তার মায়ের বয়স কমে গেছে। আঠারো বছরের কোন উচ্ছল মেয়ে মনে হচ্ছে যে কিনা নিজের বিয়ের জন্যে মুখ রাঙা লাজুক ভাব নিয়ে অপেক্ষা করে। শফিক বের হয়ে আসল ঘর থেকে। বাইরে এসে দেখে বিশাল ব্যান্ড পার্টি। তারা সুর তুলছে খুব তীক্ষ্ন ভাবে । শফিকের খুব কানে ধরছে। সে চাইছে আওয়াজ বন্ধ হোক কিন্তু কাউকে বলতে পারছে না আওয়াজ বন্ধ করার জন্য। তার কথা ব্যান্ডের আওয়াজের সাথে মিলিয়ে যাচ্ছে।
কে যেন তাকে ডাকছে। মাথা তুলে দেখলো দুপুরের ভাত দেয়া হয়েছে। কনস্টেবল এখনো দাঁড়িয়ে আছে। ধাতস্থ হতে একটু সময় নিল। বুঝতে পারল এতক্ষন ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখছিল।
'রাতে কি খাবা? পছন্দের কিছু আছে?' কনস্টেবলটা জিজ্ঞেস করল।
'একটু ইলিশ মাছের তরকারী পাওয়া যাবে? সরিষা দিয়ে ইলিশ?'
'দেখি ব্যবস্থা করতে পারি কিনা। আর মাগরিবের নামাযের পর জেল মসজিদের ইমাম সাব আসবেন। তওবা করবা তখন। অনেক পাপ কাজ তো জীবনে করছো। শেষ কোন ইচ্ছা আছে?'
প্রশ্নটা শুনে শফিক কিছুসময় চুপ করে রইল।
'কোন ইচ্ছা টিচ্ছা আছে কিনা? থাকলে বলতে পারো আর না থাকলে ঝামেলা কম।'
'আচ্ছা ভাই, একজনের সাথে দেখা করতে চাই। করানো যাবে?'
'কার লগে দেখা করবা? খবর দিলে কি আসবে?'
'খবর দিলে আসতে পারব না মাইয়া মানুষ তো।'
'আত্নীয় নাকি?'
'না আত্নীয় স্বজন কেউ না । মাফ চাইতাম তার কাছে। নাইলে মরলে পরে আল্লাহ আমারে ছাড়ব না।'
'আচ্ছা দেখি স্যাররে বইলা ব্যবস্থা করতে পারি কিনা।' বলেই কনস্টেবল চলে গেল। যাবার আগে সেলে তালা মেরে গেল।
শফিক খুব কান্নাকাটি করল তওবার সময়। ইমাম সাহেবের মনটাও কেমন নরম হয়ে গেল। শফিকের খুব খারাপ লাগছে তার মায়ের জন্য। বেচারী তার ছেলের মৃত্যুর খবরটা জানবেন না। লাশটাও দেখতে পারবেন না। শফিকের চাচারা লাশের ব্যাপারে তেমন আগ্রহ দেখান নি। তাই আঞ্জুমান এ মফিদুল ইসলাম এর লোকেরা তাকে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করবে। শফিকের খুব ইচ্ছা ছিল তার কবরটা যেন হয় বাবার কবরের পাশে। মা মরলে বাবার পাশেই কবর হবে। ইচ্ছা ছিল মৃত্যুর পর বাবামার কবরের পাশে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকবে। ছোটবেলায় যেমন দুজনের মাঝে গুটলি পাকিয়ে ঘুমাত। শেলীর জন্মের পর থেকে আর ঘুমায় নি বাবামার কাছে। কত বছর হয়েছে বাবামার কাছে ঘুমায় না। অথচ একসময় ঘুমানোর জন্য কান্নাকাটি করত। তারপর ফুফু এসে তাকে নিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতেন তার বিছানায়। শফিক অনেক দিন তার বাড়ি যায় না। আত্নীয়স্বজন কেউ তার সাথে যোগাযোগ রাখেনি। আজ সবার কথা মনে পড়ল, ছোটবেলায় সবাই কতই না আদর করত তাকে সবাই। একজন খুনীকে কেউ আপন করে নেয় না, ভালবাসা দেয় না। প্রত্যেক মানুষের মাঝেই একটা খুনী চরিত্র লুকায়িত থাকে। কেউ খুন করে আবেগকে, কেউবা অতীতকে। পার্থক্য এতটুকুই শফিক খুন করেছিল আবেগ আর অতীতকে মুছে ফেলার জন্য মোসাদ্দেককে। শফিকের চোখে ভাসছে মোসাদ্দেকের রক্তাক্ত চোখ। মরে পড়ে আছে তার বিছানার উপরে। মোসাদ্দেক তাকে ব্ল্যাকমেইল করে আসছিল দীর্ঘদিন ধরে। শফিক তার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারছিল না। বন্যার সাথে তার কিছু অন্তরঙ্গ ছবি ও ভিডিও ক্লিপ মোসাদ্দেক তন্নীকে দেখিয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে অনেক কাজ করিয়েছে শফিককে দিয়ে। শফিক চেয়েছিল বন্যার সাথে তার সব অতীত ভুলে তন্নীর সাথে নতুন করে জীবনটা সাজানোর। শেষ পর্যন্ত মোসাদ্দেক তন্নীকে সব দেখিয়ে দেয়।
দরজা খুলেই ভড়কে গেলেন মোতাসির আলী সাহেব। সন্ধ্যার পর বাসায় পুলিশ দেখলে যে কেউ ঘাবড়ে যাবে। আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করলেন, 'আপনারা? কোন সমস্যা নাকি?'জেলার মামুন সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, 'আপনার মেয়ে তন্নী কোথায়?''বাসায়ই আছে। কিন্তু কেন? কিসের দরকার?' মোতাসির সাহেব ভয়ে ঘেমে গেলেন।'আপনি ও আপনার মেয়েকে আমাদের সঙ্গে যেতে হবে।'সবকিছু শুনে তিনি কিছু উচ্চবাচ্য করলেন। তার মেয়েকে একটা খুনীর সাথে দেখা করতে দিবেন না। এই ছেলের জন্য তার মেয়ের জীবন প্রায় নষ্টের পথে। নিজের মেয়ের জীবন নষ্টের হাত থেকে বাঁচাতে তিনি মেয়ের বিয়ে ঠিক করেছেন। বিয়ের ব্যাপারে তন্নী কোন অমত করেনি। এখন যদি মাঝরাতে কোন খুনীর সাথে দেখা করতে যায় জেলে আর তা যদি বরপক্ষ জেনে যায়। তবে একটা গ্যাঞ্জাম বাঁধবে। এমনকি বরপক্ষ বিয়েও ভেঙ্গে দিতে পারে। এই ভয়ে তিনি মেয়েকে দিতে নারাজ। মামুন সাহেব ফিরে আসার জন্য পা বাড়ালেন। পিছন থেকে তন্নী ডেকে বলল, 'আমি যাব। চলুন আমাকে নিয়ে। বাবা না গেলে না যাক।'
শফিকের মুখটা অনেক শুকিয়ে গেছে। ভাঙ্গা গালে হালকা দাঁড়ি, চোখ দুটো যেন ফ্যাকাশে, ভাবলেশহীন। দেখলে চেনা যায় না। তন্নীর শফিকের এ চেহারা দেখে চিনতে কষ্ট হল এ কি সেই আগের শফিক। যে কিনা তাকে আগে ভালবাসার মিষ্টি মধুর স্বপ্ন দেখাত। সব স্বপ্ন ভেঙ্গে গেছে, মিশে গেছে ধুলোয়। তন্নী আসার পর থেকে শফিক নীরব। কোন কথা বলছে না। শফিকের নিবার্ক অবস্থা দেখে তন্নীও কিছু বলছে না। অনেকক্ষণ পর নিরবতা ভাঙ্গল শফিক।'আমাকে তুমি মাফ করে দিও তন্নী। আমি তোমায় লগে বাটপারি করছি। আসলে করতে চাইনি। জানাতে চাইছিলাম সবকিছু কিন্তু ভয় পেতাম যদি তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাও। আমি আসলেই স্যরি। তোমার জীবনটা আমার জন্য এরকম হলো।'তন্নী বলার মতো কোন কথা পাচ্ছে না। তার সব কথা যেন গলায় এসে আটকে যাচ্ছে। বুকের ভিতর কি যেন দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। কান্নায় দুচোখ ছলছল করছে। তীব্র চেষ্টা যেন জল গড়িয়ে না পড়ে। সে দেখাতে চায় না তার অশ্রু শফিককে। মুখ যতটা সম্ভব কঠিন করে রেখে তাকাল শফিকের দিকে। মাথাটা লোহার শিকে রেখে মাটির দিকে তাকিয়ে আছে সে।
মাথাটা তুলে শফিক বলল, 'আমার একটা শেষ অনুরোধ রাখবা? অনেক অনুরোধই তো রাখনি। একটু তোমার হাত দিয়ে আমার গালটা ছুঁইয়ে দেও, প্লীজ। 'তন্নী লোহার শিকের মধ্য দিয়ে দুহাত গলিয়ে শফিকের গাল ধরে রাখল। শফিকের কিছু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাললাগার মাঝে এটা একটা। প্রায়ই তন্নীকে একাজটা করতে হত। শফিকের গাল গড়িয়ে দুফোটা অশ্রু তন্নীর হাতে লাগল।'জানো? আমার না এখন খুব বাঁচতে ইচ্ছে করছে তোমাকে নিয়ে। তুমি যে বলেছিলে একটা ঘর বানাতে পাহাড়ের উপরে। থাকা হয়তো হবে না দুজনের ঐ ঘরে। আমাকে মাফ করে দিও। স্যরি।'তন্নী তার চোখের জল আটকাতে পারছে না। ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। হাতটা চেপে ধরে রাখল শফিকের গালে।
©somewhere in net ltd.