![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
রাত্রির নির্জনতায় নিঃসঙ্গ কেঁদে কেঁদে, একদিন হয়তো তুই অজান্তেই মরে যাবি, তবুও তুই জানবি না পাষাণ এ বুকে কতটুকু ভালবাসা তোর জন্যে জমা রাখি।
চোখের সামনে একটা মানুষ হুট করে বিখ্যাত হয়ে গেলে কেমন জানি লাগে। অথচ কালকে পর্যন্ত এত বিখ্যাত ছিল না সাকি। আজ প্রতিটা চ্যানেলে চ্যানেলে নিউজ বুলেটিনে তার নাম। আজকের পত্রিকার প্রথম পাতার ডান কোণায় তার ছবিসহ খবর। আমার নিজেরই কেমন হিংসে হচ্ছে আবার হিংসে ছাপিয়ে আমার কষ্ট হচ্ছে। শত হোক বন্ধু বলে তো কথা। বেডের কোণায় টেবিলের উপর কয়েকটা আজকের পত্রিকা রাখা। আমি সাকির পাশ থেকে উঠে গিয়ে পত্রিকা হাতে নিলাম। প্রত্যেকটা পত্রিকাতে সাকির ছবি এসেছে।
খবরঃ ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৩
'দাবি আদায়ের আগুন শাহবাগে'
কাদের মোল্লাসহ সকল রাজাকারের ফাঁসির দাবি জানিয়ে আন্দোলনরত শাহবাগ চত্বরে সকলের সামনে আগুনে আত্নাহুতি দিয়েছে এক যুবক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞানে পড়ুয়া সাকাওয়াত হোসেন সাকি (২৩) নামক যুবক শরীরে আগুন ধরিয়ে আত্নাহুতি দিতে চেষ্টা করে গতকাল রাতে।
বিস্তারিত খবরের বরাতে, গত ০৫ ফেব্রুয়ারি আন্তজার্তিক ট্রাইবুনাল-২ এর রায়ে মিরপুরের কসাই খ্যাত কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেওয়া হয়। এর প্রতিবাদে ঐদিন দুপুর দুইটা থেকে শাহবাগ চত্বরে জমায়েত হতে থাকে সর্বস্তরের মানুষ। প্রতিবাদ চলতে থাকে টানা রাতভর এবং পরদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত প্রতিবাদ চলতে থাকে। সন্ধ্যার দিকে বিশাল মশাল মিছিল বের হয়। এতে সামনের দিকে আরও কয়েকজনের সাথে ছেলেটি। হঠাত্ করে কেরোসিনের পাত্রে থাকা শেষটুকু গায়ে ঢেলে মশালের আগুন ধরিয়ে দেয় যুবকটি। তখন মিছিলের মধ্যে হুলস্থুল শুরু হয়ে যায়। কেউ কেউ আসেন আগুন নিভাতে কিন্তু সে চিত্কার করে সবাইকে বলতে থাকে, 'প্লীজ কেউ আমার গায়ের আগুন নিভাতে আসবেন না। যে স্বাধীন রাষ্ট্রে যুদ্ধপরাধীর সঠিক বিচার হয় না, আর সে 'ভি' চিহ্ন দেখায়, আমি বাঁচতে চাই এই লজ্জায়। আমি আগুনে আত্নাহুতি দিলাম যেন আমার মৃত্যুতে সবার টনক নড়ে এবং রাজাকারদের ফাঁসি হয়।'
তবুও তার কিছু বন্ধুবান্ধবের ঝাপটা ঝাপটি করে আগুন নেভানোর চেষ্টা করে। তাকে দ্রুত নিয়ে আসা হয় ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে। ডাক্তাররা তার অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানান। শরীরের ৭০ভাগ তার ঝলসে গেছে। এদিকে.......
এতটুকু পড়ে আমার চোখটা ভিজে উঠল। একমাত্র বন্ধু আমার সাকি। দেশের স্বার্থে সে আত্নত্যাগ করতে যাচ্ছে।
আমাকে মূলতঃ কেবিনে ঢুকতে দেওয়া হয়েছিল সাকি অস্পষ্টভাবে বলেছে আমাকে কি যেন বলতে চায়। তার বাবা মা আর ভাইকে নিয়ে আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম কেবিনের বাইরে। এখানে প্রচুর লোকের ভিড়। নানাশ্রেণীর লোকজনে ভরা, মিডিয়া পত্রিকার প্রায় সব সাংবাদিক ভরা। আমাকে যখন ডাকা হয়েছিল আমি ধীর পায়ে কেবিনে ঢুকলাম। বাকিদের প্রবেশ নিষেধ। আমি বসে আছি অনেকক্ষণ ধরে। সাকি অচেতনের মতো পড়ে আছে। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ব্যান্ডেজ করা তবুও কিছু কিছু অংশ বেরিয়ে আছে। দেখতে খুব বিভত্স লাগছে। আমি পত্রিকা রেখে চোখ মুছলাম। দেখলাম সাকি আস্তে আস্তে নড়ছে। চোখ খুলে আমার দিকে তাকাল। চোখের ইশারায় আমাকে ডাকল। আমি কান নিয়ে গেলাম তার মুখের কাছে। খুব অস্পষ্ট হলেও সাকি বলছে,
'দোস্ত আমার জন্য মন খারাপ করিস না। আমাকে মাফ করে দিস।'
একটু থেমে,
'সারাজীবন আব্বা আম্মা গালি দিছে আমি কোন কাজের না কিন্তু আজকে তাদেরকে বলিস আমিও কাজের। দেশের জন্যে একটু হলেও করতে পেরেছি। আমি মরেও শান্তি পাব রে।'
'ধুর কে বলছে তুই মরবি। তুই ঠিকই সুস্থ হয়ে যাবি।'
মুচকি হাসার চেষ্টা করে ঠিক পারল না,
'দোস্ত আমার দেখা করতে ইচ্ছে করতেছে মাহরিনের সাথে। পারলে নিশাতকেও একটু বল না।'
আমি সরে আসলাম তার কাছ থেকে। সাকি আবার চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়েছে। বেরিয়ে পড়লাম কেবিন থেকে। ফোনলিস্ট থেকে মাহরিনের নাম্বারে ফোন দিলাম। মাহরিন বিবাহিত, আসতে পারবে কিনা তা নিয়ে আমার ভয় হচ্ছে। নিশাত হাসপাতালেই আছে তাকে খুঁজে বের করতে হবে। মাহরিনকে ফোন করে সব খুলে বললাম। সেও ব্যাপারটা জানে। সে জানাল এখনই বাসা থেকে বের হচ্ছে। সারারাত নাকি কান্না করেছে সাকির জন্যে। নিশাতকে খুঁজে বের করতে পা বাড়ালাম। দুজন ডাক্তার ও নার্স কেবিনে ঢুকলেন। সাকির বাবা মা বিলাপ করে কান্না করে যাচ্ছেন। সাকির ছোটভাইটি নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে কোণায়।
চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ মিনিট পরে মাহরিন আসল তার স্বামীকে নিয়ে। আমি নিশাতকে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম গেটের সামনে। তাড়াহুড়া করে এদেরকে নিয়ে আসলাম কেবিনের সামনে। কিন্তু এখানে এসে দেখি ভীষণ জটলা আর চিত্কার চেঁচামেচি। ভিড় ঠেলে সামনে গিয়ে শুনি ডাক্তাররা সাকিকে মৃত বলে ঘোষণা করেছেন। সাকির বাবা মা কাঁদছেন, দেখি ছোটভাইটাও কাঁদছে এতক্ষণ নিশ্চুপ ছিল। ভিড় ঠেলে বাইরে এসে দেখি নিশাত দেওয়ালে মাথা ঠেকিয়ে জোরে জোরে কাঁদছে আর মাহরিন মাটিতে বসে পড়েছে। গাল গড়িয়ে অশ্রু পড়ছে। আমার ভিতরটা কেমন যেন মুচড়ে উঠছে, আমি আটকাতে পারছি না। আমি সরে আসলাম বারান্দা থেকে গেটের সামনে। আমি কাঁদছি, অঝোরে কাঁদছি। বন্ধু তোর আশা যেন পূরণ হয়, রাজাকারদের যেন ফাঁসি হয়। মুক্তিযুদ্ধ না করেও তুই শহীদদের মর্যাদা পাবি।
[উত্সর্গঃ যারা এখনও পর্যন্ত শাহবাগ চত্বরে দাবি আদায়ের জন্যে প্রতিবাদ করে যাচ্ছেন একটানা। সবার সাথে সাথে আমার একই দাবি, রাজাকারদের ফাঁসি চাই।]
আমি জানি না কেন এই গল্পটা লেখলাম, এতে কোন মেসেজ নাই, থাকলেও থাকতে পারে, কেউ ধরতে পারলে আমারে ধরাইয়া দিয়েন।
©somewhere in net ltd.