নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সাদা কালো দর্পণে আঁকাআঁকি

আকিব আরিয়ান

রাত্রির নির্জনতায় নিঃসঙ্গ কেঁদে কেঁদে, একদিন হয়তো তুই অজান্তেই মরে যাবি, তবুও তুই জানবি না পাষাণ এ বুকে কতটুকু ভালবাসা তোর জন্যে জমা রাখি।

আকিব আরিয়ান › বিস্তারিত পোস্টঃ

বাসন্তী বিসর্জন (গল্প)

০১ লা মার্চ, ২০১৩ রাত ৮:৩১

বিশাল বারান্দার এক পাশে চেয়ারে বসে আছেন অবনীশ বাবু। এক হাতে চায়ের কাপ, একটু পর পর থেমে থেমে আয়েশ করে চুমুক দিচ্ছেন। অন্যহাতে দামী সিগারেট। এটাই তার সকালের নাস্তা। দীর্ঘ আটত্রিশ বছরের অভ্যাস। বারান্দার গ্রীল গলে সকালের রোদ তীর্যক ভাবে এসে তার গায়ে পড়ছে। শীতের সকালে গা গরম করতে মৃদু রোদের তাপে বসে চা খেতে হয় তার। সামনে একটা ছোট টি-টেবিলে কয়েকটা লেখার কাগজ, কলম ও একটা ডায়রী। ও পাশে পড়ে আছে আরেকটা খালি চেয়ার। চা খাওয়া শেষ করে সিগারেটে জোরে জোরে দম নিয়ে চিন্তা করছেন সামনের কাজগুলোর ব্যাপারে। অনেক লেখা পড়ে আছে। বয়স দিন দিন বাড়ার সাথে সাথে অসমাপ্ত লেখাগুলো বাড়ছে। সামনে পূজো উপলক্ষে বিশেষ সংখ্যা বের করছে কয়েকটা পত্রিকা। লেখা চাইছে সবাই। বয়স হয়ে গেছে আর লিখতে পারছেন না একথাটা কাউকে বুঝাতে পারছেন না। সবার একই কথা তাঁর লেখা চাই। দেশ বরণ্য সাহিত্যিক হলে আসলে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়। হাতে থাকা কয়েকটা অসমাপ্ত উপন্যাস নিয়ে খুব দুশ্চিতায় সময় কাটাচ্ছেন ইদানীং। একটা নির্দিষ্ট সময় লেখায় বিরতি আসলে তিনি গল্পের ধারা হারিয়ে ফেলেন। এই কারনে অনেক চমত্‍কার শুরুর উপন্যাস শেষ না করার যন্ত্রণায় ভুগছেন। এ মূহুর্তে 'বাসন্তী-বিসর্জন' উপন্যাসের মধ্যের কাহিনীটা ভাবছেন। জট পেকে যাচ্ছে ঘটনাগুলো মাথার ভিতরে।







তখন সবে কুড়ি বছর বয়স অবনীশ বাবুর। তরতাজা জোয়ান ছেলে। কাজ করার অদম্য আকাঙ্খা। লেখালেখিটা সেই বয়সেই শুরু করেছিলেন। অবশ্য তার পিছনে একটা ঘটনাও ছিল। ঘটনাটা না ঘটলে হয়তো আজকে অবনীশ বাবুকে কেউ চিনত না। তিনি হয়তো পড়ে থাকতেন কোন পাড়াগাঁয়ের স্কুলশিক্ষক হয়ে।





অঞ্জলী মূখার্জী। বয়স সবে ষোল পেরিয়েছে তখন। চোখ ধাঁধানো তার রূপ যৌবন। বিশাল বাড়িতে দাদা কাকা পিসীর মাঝে এক মাত্র সন্তান। ততদিনে অঞ্জলীর কাকা পিসীরও বিয়ে হয় নি। বাড়িতে আর বাচ্চা কাচ্চা নেই। সারাদিন একা একাই থাকত সে। রমাকান্ত বাবু হঠাত্‍ করে মারা গেলেন। তাই উত্তরাধিকার সূত্রে অবনীশের ভাগ্যে জুটে গেল কাকার চাকরী। অঞ্জলীকে প্রতি বিকেলে গিয়ে পড়াতে হত অবনীশের। একমাত্র অবনীশের সাথে অঞ্জলী মনের সকল কথা ঝাড়তে পারত। কিছুদিনের মধ্যে অবনীশ আবিষ্কার করতে পারল নিজেকে যে সে অঞ্জলীর প্রেমে পড়ে গেছে। যেন তেন প্রেম নয় একবারে কঠিন প্রেমে। অঞ্জলী গানের রেওয়াজ করত প্রতিদিন সকালে তাই গলা অনেক মধুর ছিল। কবিতা আবৃত্তি করাটা তার নেশা ছিল কিন্তু কবিতা সে লেখতে পারত না। অঞ্জলীকে খুশি করতে গিয়ে অবনীশ কবিতা লেখতে শুরু করে। প্রথম দিকে বাজে বাজে কবিতা লেখলেও আস্তে আস্তে সময়ের সাথে তা পরিপক্কতা লাভ করে।







দিন দিন সময় গড়িয়ে যায়। অবনীশের আর বলা হয়ে উঠে না মনের কথা। অঞ্জলী বিরাট বড়লোকের মেয়ে আর সে কোথাকার চালচুলাহীন। জন্মের পর মাকে দেখতেও পেল না। বাবা বিয়ে করলেন আরেকটা। সত্‍ মার চোখের বালি হয়ে অত্যাচার সহ্য করলেও শেষ পর্যন্ত কাকা রমাকান্ত বাবু নিজের কাছে নিয়ে এলেন তাকে। স্ত্রীহীন বৃদ্ধ রমাকান্ত বাবুর দেখাশোনা করত আর পাশাপাশি একটা কলেজে পড়ালেখা করত। নিজের অবস্থানের কথা চিন্তা করে কখনো সাহস হত না মুখ ফুটে বলবার, 'অঞ্জলী, আমি তোমাকে ভালবাসি। চাই মালা বদল করবার।'









এদিকে অঞ্জলীও ততদিনে কলেজ পাস করে ফেলে, বিহারের মেসো আসলেন এক বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। ছেলে নাকি বিয়ে করে বউকে নিয়ে বিলেত চলে যাবে। অঞ্জলীর বাবা কৃষ্ণেন্দু মূখার্জী পাকা কথা সেরে ফেলবার অনুরোধ করলেন অঞ্জলীর মেসোকে। মেসো বিহার চলে গেলেন বিয়ে পাকা করতে। একদিন বিকেলে অবনীশ এসে জানতে পারল যে, তাকে আর পড়াতে আসতে হবে না। সামনের মাসে অঞ্জলীর বিয়ে। সেদিন অবনীশের কানে কথাটা সূঁচের মতো বিঁধেছিল। মগজে চিনচিনে ব্যাথায় আর বুকের ভিতরের কষ্টে পাটাকে টানতে পারছিল না। সেখানে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। অঞ্জলীর বাবা জিজ্ঞেস করেছিলেন, 'মাস্টার শরীর খারাপ নাকি?' অবনীশ অস্পষ্ট গলায় বলেছিল, 'পানি খাব।'







অঞ্জলীর সাথে আর দেখা হয় নি তার। বিয়ের সময় দূর থেকে লাল নীল মরিচা বাতিতে সাজানো বাড়িটা দেখেছিল অবনীশ। অঞ্জলীকে নিয়েই প্রথম উপন্যাসটা লিখে ফেলেন তিনি। 'চার দুয়ারী ঘর' উপন্যাসটা বেশ সাড়া ফেলে দেয়। সমালোচকেরাও বেশ প্রশংসা করেন তার। এরপর আর পিছু ফিরে তাকাতে হয় নি। একের পর এক লিখে গিয়েছেন। ফাল্গুনী বইমেলায় বের হলো 'উদাস দিনরাত্রি'।

জেলখানার আসামীদের নিয়ে লেখা উপন্যাসটা অনেকেরই ভালো লাগলো। ঐ বইমেলায় পরিচয় হয়েছিল অবনীশের এক মেয়ের সাথে। কাগজের টুকরা ব্যাগ থেকে বের করে দিয়ে অটোগ্রাফ চেয়েছিল। অনেকক্ষণ তাকিয়েছিলেন মেয়েটার দিকে। শুভ্রনীল রঙের কামিজ পরা মেয়েটি তার ঠিকানাও জেনে নিল।





স্বর্ণা তার ডাকনাম। পুরো নাম দেবলীনা দাশগুপ্ত। চেহারায় মায়া মায়া ভাবটা কেন জানি পঁচিশের পর তরুণীদের থাকে না। স্বর্ণার চেহারায় মায়া মায়া ভাবটা অপ্রত্যাশিতভাবে তখন ছিল। বছর দুয়েক একছেলের সাথে তার মন দেওয়া নেয়া ছিল। ছেলেটা হঠাত্‍ করেই তাকে ছেড়ে চলে যায়। তেমন কোন কারণও প্রদর্শন করাতে পারেনি তখন। সদ্য হৃদয় ভাঙ্গা তরুণী অবনীশের 'উদাস দিনরাত্রি' উপন্যাস পড়ে অনেক কেঁদেছিল। প্রায়ই বলত অবনীশকে, 'আপনি এত ভালো লিখেন কি করে? আমাকে একটু শেখাবেন। আপনার গল্প পড়লে মনে হয় না এটা গল্প ছিল, বাস্তব কাহিনী মনে হয়।' অবনীশ তখন লাজুক মুচকি হেসে ভদ্রতা প্রকাশ করে যেত। কিছুদিন পর অবনীশ লক্ষ্য করে দেখল যে মেয়েটা তার অনেকটা জুড়ে মিশে গেছে। হালকা শাসন আর ভালবাসা মেশানো বকুনিতে অবনীশের বাউন্ডুলে জীবনে অনেকটা স্থিরতা চলে এসেছিল।









বছর ঘুরে আরেকটা ফাল্গুন আসার আগেই গাঁটবদ্ধ হলেন দুজন। ছোট্ট সংসার অবনীশ আর স্বর্ণার। ভালবাসায় মূখরিত প্রতিটা মূহুর্ত। স্বর্ণা সবসময় সহ্য করতে পারত না অন্য মেয়েদের অবনীশ-আসক্তি। বিয়ের পর একটা উপন্যাসে হাত দিলেন, 'মালঞ্চের ত্রিসীমা'।

বেশ কয়েকটা কবিতাও ছিল ঐ উপন্যাসের ফাঁকে ফাঁকে। গল্পটা ছিল এক মেয়েকে কেন্দ্র করে। উপন্যাস প্রকাশ হওয়ার পর গাল ফুলিয়ে দিল স্বর্ণা, 'এটা কোন মেয়ের গল্প? এটা তো আমি নই? কোন মেয়ে তোমার মনে বসত করে? কে সে? আমাকে বললে না কেন আগে? বিষ খেয়ে মরে যেতাম এসব দেখার আগে।' সেকি কান্না। অবনীশ বাবুর কাছে সেদিন কোন উত্তর ছিল না। লেখকদের এই এক সমস্যা অবাস্তব কল্পনা করে লেখা জিনিসগুলো অনেকেই বাস্তবে টেনে আনে। অবনীশ বাবু স্বর্ণার কান্না থামাতে ব্যর্থ হলেন। খেসারত হিসেবে টানা তিন দিন আলাদা কক্ষে ঘুমানো আর বাইরে হোটেলে খাওয়া দাওয়া।







এভাবেই ভালবাসার খুনসুটিতে দুঃখসুখ ভাগাভাগি করে চলছিল তাদের জীবন। সময়মত স্বর্ণাও গর্ভধারণ করল। ডাক্তারের কাছে যেতেই অনাকাঙ্খিত দুঃখজনক একটা খবর পেলেন তিনি। লুকোতে চেষ্টা করলেন স্বর্ণার কাছ থেকে কিন্তু পারলেন না। ডাক্তার সেদিন জানিয়েছিল, 'মাথার পিছনে ব্রেইনে একটা টিউমার ধরা পড়েছে দেবলীনার। এটা হতে পারে ক্যান্সারের।' দীর্ঘদিন ধরে একটা মাথাব্যাথা লেগেছিল স্বর্ণার। বিয়ের অনেক আগ থেকেই। পাত্তা দেয় নি কখনো ব্যাপারটা। শেষ পর্যন্ত সেটাই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল তার জন্যে। সেবার ডাক্তারের নিষেধে গর্ভপাত করানো হয় তার। গর্ভে আগমনকারী বাচ্চার শারীরিক ত্রুটির আশঙ্কা থেকে এ পদক্ষেপ। এরপর অবনীশ বাবু অনেকখানি ভেঙ্গে পড়েছিলেন। স্বর্ণার সামনে প্রকাশ করতেন না মনের কথা। এদিকে দিন দিন স্বর্ণার শরীর খারাপ হতে লাগল।





স্বর্ণা বিছানায় শুয়ে শুয়ে বলত, 'কেন যে আমাকে মিথ্যে বাঁচার স্বপ্ন দেখাও? আমি বাঁচব না যে এটা জানি।' অলুক্ষণে কথা না শোনার জন্যে অবনীশ হাত দিয়ে তার মুখটা ধরে রাখতেন। 'তোমাকে কতদিন ধরে বলে আসছি আমাকে নিয়ে একটা গল্প লিখতে। তা লিখবে কেন? কোথাকার কোন মায়া না ফায়াকে নিয়ে লিখে বসে আছো।' স্বর্ণার অভিমানে অবনীশ বলেছিলেন, 'লিখে ফেলব কয়েকদিনের মাঝে। এখন লেখালেখিতে মন নেই তেমন।' স্বর্ণা স্ববেগে মুখ বাঁকিয়ে বলেছিল, 'আমি বেঁচে থাকতে তুমি গল্প লিখে শেষ করতে পারবে না। আমি যেদিন মরব তখন তুমি লিখবা।' অবনীশ তখন মুখটা তার চেপে ধরেছিলেন হাত দিয়ে। এর কয়েকদিন পরই অবনীশ খাতা কলম নিয়ে বসে পড়লেন। শুরু করলেন নতুন উপন্যাস লেখা স্বর্ণাকে নিয়ে, 'বাসন্তী-বিসর্জন'।

ব্যস্ততা আর স্বর্ণাকে নিয়ে হাসপাতাল বাসায় দৌড়াদৌড়ি করতে করতে লেখাটা আর শেষ হলো না। এক সন্ধ্যারাতে দেবলীনা দাশগুপ্ত স্বর্ণা হারিয়ে গেল অবনীশ বাবুর জীবন থেকে। চিতায় আগুন না ঐটা যেন জ্বলছিল তখন অবনীশের বুকে।







টেবিলের দিকে ঝুকে অনেকক্ষণ ধরে লিখছেন অবনীশ বাবু। মাথা তুলে তাকালেন সামনের দিকে। লিখতে লিখতে তিনি মিশে গেছেন চরিত্রের সাথে। দেখতে পেলেন বারান্দার ওপাশে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিষণ্ণ মনে। শুভ্রনীল রঙের কামিজ পরা মেয়েটিকে হঠাত্‍ করে স্বর্ণার মতো মনে হলে তাঁর। তার ইচ্ছে করছে উঠে গিয়ে মেয়েটার কাঁধে হাত রাখেন। চোখটা ঝাপসা হয়ে আসছে তার। আবার চশমাটা ঠিক করে লেখায় ঝুকে পড়লেন। টুপটুপ করে কয়েক ফোঁটা জল পড়ে খাতাটাকে ভিজিয়ে দিল।









ණ কিছুকথাঃ গল্পের নায়ক অবনীশ, নামটা নিয়েছি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের 'দর্পনে কার মুখ' উপন্যাসের নায়কের নাম থেকে। ঐ উপন্যাসে অবনীশ বাবু একজন লেখক ছিলেন। গল্পে ত্রুটি বিচ্যুতি মার্জনীয়।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ২০ শে মে, ২০১৪ দুপুর ১:২৩

অঘটনঘটনপটীয়সী বলেছেন: পছন্দ হয়েছে গল্পটা।

২০ শে মে, ২০১৪ দুপুর ১:২৯

আকিব আরিয়ান বলেছেন: ধন্যবাদ

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.