নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ফেসবুকঃ ওসমান আহমেদ সাকিব

"" It is a difficult thing to tell the story of a life;and yet more difficult when that life is one's own. ""

নীল_সুপ্ত

সাহিত্যে ব্যাপক আগ্রহ, আমি কবিতা পড়তে (কদাচিৎ লিখতেও) পছন্দ করি। ইতিহাস আমাকে আলোড়িত করে... আর রাজনীতি আমাকে দর্শন শেখায়।

নীল_সুপ্ত › বিস্তারিত পোস্টঃ

হারিয়ে যাওয়া গল্প !

০৮ ই আগস্ট, ২০১৩ রাত ১:৩৫

১,

“আম্মা, আপনে কই? ও আম্মা...” খুশিতে টগবগিয়ে থাকা মুকিত সজোরে বলে উঠলো। গায়ে সফেদ পাঞ্জাবী আর পায়জামা। পরিধেয় বস্ত্রগুলো দেখেই বোঝা যাচ্ছে খুব একটা ধৌত না কিংবা ধৌত হলেও কাঁচা হাতের কাজ; ধুতে হয় বলেই ধোয়া। প্রায় বছর খানেক পর বাড়িতে এসেছে। শেষ এসেছিল গত রোজার ঈদে, কোরবানির ঈদে বাড়িতে আসার সুযোগ ই হয়না। কওমি মাদ্রাসার ছাত্র। কোরবানির ঈদে মাদ্রাসার এতিম ছাত্রদের জন্য যাকাত কিংবা চামড়ার টাকা সংগ্রহে খুব ব্যস্ত সময় যায়। হাফেজি পড়ছে ছেলেটা। গায়ের রঙ ঈষৎ শ্যামলা, উচ্চতা মধ্যম। শরীরটা লিকলিকা, বাতাসের টোকা লাগলেই যেন পড়ে যাবে। বাবা নেই, ছোট এক ভাই আর মা থাকেন গ্রামের বাড়িতে, ছোট ভাইয়ের বয়স ১০ বছর, তার থেকে বছর আটেক ছোট। অজপাড়া গাঁ। বড় সড়ক থেকে প্রায় দু ক্রোশ হেঁটে বাড়ি আসতে হয়। বাড়ি এসেই প্রথমেই মাকে খোজাখোজি শুরু করলো। বাড়ির ভিতর থেকে দৌড়িয়ে বের হলো তার ছোট ভাই জামিল। “ভাইজান, আপনে কহন আইলেন?” কন্ঠে তার মধুর আবেগ আর আনন্দের স্রোত, “আম্মায় তো পানি আনতে গ্যাছে মুন্সী বাড়ির টিউবয়েল থেইকা।” “তোরে না আগেরবার কইছিলাম যে তুই গিয়া আনবি, আম্মারে যাইতে দিছস ক্যান?”,মুকিতের কন্ঠে রাগের স্পন্দন। “আম্মারে বহুত কইছি, কয় আমি নাকি ছুডো পোলা, পারুম না।” এরই মধ্যে জামিল এসে মুকিতকে জড়িয়ে ধরলো, "কত্তোদিন পর বাড়ি আইছেন, এইবার কয়দিন থাকবেন?” ছোট ভাইটার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো, “ সপ্তাহ তো থাকুমই।” “জানেন ভাইজান, পুকুড় পাড়ের খেলার মাঠে মেলা বইছে, অর মইধ্যে দোলনা লইয়া আইছে, ঐ যে, মাথা চক্কর দ্যায় যে, খুব উপরে উডে ঐডা, আমি কাইলকা চড়ছি, যেই ডর পাইছি, চড়বেন আপনে?” অনেকদিন পর ভাইকে পেয়ে এতদিনের জমা গল্পগুলো বৃষ্টির মত ঝড়া শুরু করলো। কিছু সময় যাওয়ার মধ্যেই চলে আসলেন জামিল-মুকিতের আম্মা। মুকিতকে দেখেই চিৎকার দিয়ে উঠলেন, কোমর থেকে কলসটা নামাতেই মুকিত দৌড়ে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরলো। মা ও তার ছেলেকে জড়িয়েই ধরে রাখলেন, আর ছাড়েন না। মা প্রায় কেঁদেই ফেললেন, ছেলে কিছু বলার আগেই। মুকিত জিগ্যেস করলো, “ক্যামন আছেন আম্মা, আপনার শরীরডা ভালা নি?” “হ বাবা, তুই এতো শুকাইছস ক্যামনে? খাওয়া দাওয়া করছ না নাকি? কখন আইলি? আইতে কুনো সমস্যা হইছে? শইরে এতো ময়লা ক্যান? ঠকমত নাওয়া দাওয়া করছ না? আর চক্ষু এতো ভিতরে ঢুকছে ক্যামনে? হাতের মধ্যে এতো দাগ ক্যান? কই দুক পাইছস? ঠিক আছস তো?... ... ...” এরকম অজস্র না করা প্রশ্নের ঝাপি খুলে ফেললেন মুকিতের মা।



-আআআ

-আম্মা, আজকে মাছের ঝোলডা খুউউব মজা হইছে, আরেকটু দ্যান তো?

-তগো ঐহানে খাওয়ন ক্যামন দ্যায়?

-খাইতে সমস্যা হয় না?

-খাওয়ন ভালাই দ্যায়, তয় ঝোলডা না তেল ভর্তি থাহে আর ঝাল থাহেই না।

- ও, তুই তো আবার ত্যাল খাইতেই পারছ না, আর বাড়িত ঝালছাড়া তরকারি খাস ই না।

- আপনেই কন, ঝাল ছাড়া ঝোল খাইয়া লাভ কি।

- হ বুঝছি, তোর হাফেজির আর কয়দিন?

- সামনের রমজানের আগেই শ্যাস হইবো ইনশাআল্লাহ।

- আরেকটু ঝোল নে,বাপ। আর মাছের লেঞ্জা কার লাইগা রাখছস? খাস না ঐডা।

- না আম্মা, আপনে খান ঐটা, আপনার শইরও তো ভাইঙ্গা গেছে, না খাইলে অইবো?

- অতো খেয়ালের জরুরত নাই, তুই আর কি খাবি, ক বাপ। সেহরির লাইগা রান্ধুম নে।

- ঐ যে, পুঁইশাক রানবেন, ঝোল ঝোল কইরা, আর ডাইল রানবেন ঘন কইরা, পাতলা ডাইল খাইতে খাইতে মুখে বেরুচি আইছে, ও আম্মা, মকা মাছ আছে না, ঐডারে ভুনা কইরেন তো, কত্তোদিন আপনের রান্ধা মকা খাইনা।

-আইচ্ছা, রান্ধুম নে।



ছেলের আহলাদ আর কথা শুনতে শুনতে মায়ের চোখ আর কন্ঠ দুটোই জড়িয়ে যায়। পাঁচ বছর ধরে ছেলেটা হাফেজি শিখছে, তাই বছরে একবার মাত্র বাড়ি আসে, আসলেই নানান আবদার করে বসে। কার মায়ের মন, ছেলের আবদার মেটানো যে কত্ব আনন্দের, তিনি ছাড়া কি ভালো বুঝবেন?







- মুকিত, ও মুকিত, কইরে তুই বাপ?

- এইতো আম্মা, কি অইছে, কন, বাইরে যামু, আবুলের লগে মেলা দিন দেহা হয়না, কথা কইয়া আহি। জলদি কন।

- আরে বাপ, শুনবি তো আগে, তোর পাঞ্জাবীডা দ্যাখলাম পুরান হইয়া গ্যাছে, তাই তোর লাইগা নতুন একখান পাঞ্জাবী আনছি, ঈদেও পড়লি আবার মাদ্রাসায় গিয়াও পড়লি। (মায়ের মুখে হাসির দীপ্তি)

- আপনেরে কে কইছে এইডা করতে, কই জামিলরে দিবেন, তা না, আমারেই দেওন লাগবো।

- আরে অয় তো ছুডো, অর লাইগাও আছে একটা, তয় তুই শহরে থাহস, কেলাস করছ, পাঞ্জাবি তোর তো বেশি পিন্দা লাগে।

- বুঝছি। অহন আমি যাই,

- খাড়া, চিরুনিটা আন, জিন্দেগিতেও চুল আর আচড়াবি না তুই, বাইরে যাইতেছস, চুল তো আচড়ায়া যাবি, যা চিরুনিটা আন্‌।



ছেলেটা বড় হইলেও এখনো নিজের খেয়াল করা ঠিকমত শিখে নাই, এই যেমন চুল আঁচড়ানো, ঠিকমত গোসল করা, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা ইত্যাদি। এখনো অবুঝ শিশুর মতন মায়ের ধমক খেয়েই এগুলো করতে হয়।







ঈদের দিন সকাল বেলা, একটু আগেই ঈদের নামাজ শেষ হল, হন্তদন্ত করে মুকিত বাড়ি আসলো। মায়ের কিনা দেয়া নতুন পাঞ্জাবী গায়ে। সেমাই খেয়েই গ্রামের বন্ধুদের বাড়ি বাড়ি ঘুরবে।



- আম্মা, ও আম্মা, সেমুই আনেন, আর আপনের লাইগাও আনবেন।

- নারে বাপ, আমি অহন খামু না, তুই খা।

- আপনে জানেন না যে ঈদের নামাজ পইড়া আইসা আপনার লগে সেমুই না খায়া আমি কুত্থাও যামুনা।

- ও মোর জ্বালা, তুই খায়া ঘুইরা আয়, আমি পড়ে খামু নে।

- তাইলে আমিও পরে যামু নে।



মুকিতের কন্ঠে ক্ষোভ। তার মা খুব ভাল করেই জানেন যে এখন ছেলের সাথে এক চামচ হলেও সেমাই খেতেই হবে, নতুবা তার ছেলে এভাবেই গোস্বা ধরে বসে থাকবে, বাধ্য হয়ে ছেলেকে দেয়া সেমাইয়ের বাঁটি থেকে চামচ দুয়েক খেয়ে নিলেন। ওদিকে তার ছেলের মুখে ভুবন ভোলানো হাসি যেন সে কি জয় করে ফেলেছে। খুশি গদগদ হয়ে তাড়াতাড়ি করে সেমাই খেয়ে বাইরে ঘুরতে গেল। ছেলের এইরকম খুশি ই যে মায়ের কাছে ঈদ !







বছর খানেক পরের ঘটনা। সেই অজপাড়া গ্রামের জামিল-মুকিতের বাড়ির কথাই বলছি। আজ চাঁদ দেখা দিলে কাল নতুবা পরশু আবারো রোজার ঈদ। পুরো রোজা শেষ হয়ে যাচ্ছে, তাও মুকিত বাড়ি আসেনি। এই দুঃখে জামিল মেলায় যায়নি, মন মরা হয়ে বসে আছে। এবারের মেলায় আবার সেই দোলনা এসেছে, কিন্ত আগেরবার খুব ভয় পেয়েছিল, তাই ভেবেছিল যে মুকিত আসলে তাকে নিয়ে যাবে, বড় ভাইকে কত গল্প বলবে, সে যে এখন কোরআন তেলাওয়াত করতে পারে বলবে, তারপর গ্রামের শেষ মাথার নদীতে মাছ ধরার ঘটনা বলবে, মুন্সীর বাড়িতে টিভি আনার গল্প করবে,আরো কত কি ! আর বড়ভাই এবারো যে তাকে এসেই বকা দিবে এটাও সে জানে কেননা এখনো মা ই গিয়ে মুন্সীর পুকুর থেকে পানি আনেন। মনে মনে ঠিক ও করে রেখেছে ভাইকে কি উত্তর দিবে। মাস তিনেক আগে তার বড় ভাইকে কয়েকজন হুজুর ঘুমন্ত অবস্থায় খাটিয়ায় করে নিয়ে এসেছিল, “ভাইজান ভাইজান” বলে অনেকবার ডেকেছিল ও, কিন্তু মুকিত আর ঘুম থেকে উঠেনি। জড়ো হওয়া লোকজনকে জিগ্যেস ও করেছিল, “ভাইজান উডে না ক্যান?" কাঁদতে কাঁদতে একজন বলেছিল, “শইর খারাপ হের লাইগা।” সেদিন মাকে খুব খুব কাঁদতে দেখেছিল, মায়ের পাশে গিয়ে বলেছিল, “এতো কাইন্দেন না আম্মা, হেরা কইছে ভাইজানরে কার কাছে দিয়া আইতেছে, সব ঠিক অইয়া যাইবো।” কিন্তু সেই যে লোকগুলো নিয়ে গেল বড়ভাই আর আসেনা। মাকে কতবার বলল, “ভাইজান কবে আইবো?” মার কোন উত্তর নাই, ফ্যালফ্যালিয়ে থাকে শুধু।



ওদিকে মুকিত-জামিলের মা কেমন জানি হয়ে গেছেন, বছর পেরিয়ে গেছে অথচ মুকিতের কন্ঠ শুনেননি, মুকিত তাকে বলে নি, “শইরের একডু খেয়াল করেন না ক্যান?" কিংবা “এই শইর লইয়া পানি আননের কি দরকার?” কিংবা "আমার যেইদিন টেকা হইবো সেইদিন আপনারে ঈদে দুইখান শাড়ি কিনা দিমু।” কিংবা বছর ধরে তার মুকিতের কন্ঠে পুঁইশাক,মকা মাছ কিংবা ঝালওয়ালা ঝোলের আবদার শোনেননি। তার ছেলের অগোছালো চুলে চিরুনির আঁচড় দিয়ে দেখেননি। মা ছেলের মধ্যে আর কত জমে থাকা ব্যাপার...কতটুকুই বা বর্ণণা করা যায় !



জামিলের হাজারো প্রশ্নেও মুখ ফুটে বলতে পারেন না, “আমার মুকিত নাইরে ,বাপজান। আমার মুকিতরে ওরা মাইরালাইছে।” মুকিতের কথা চিন্তা করেন আর কাঁদেন, কখনো ফুঁপিয়ে, কখনো সজোরে কখনো ঘুমের ঘোরে। পাষণ্ডের দল মুকিতকে যে মেরে ফেলেছে। যেই কোরআন হাফেজি করতে মুকিত গিয়েছিল সেই কোরআন আর আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত তার বাহক রাসূলের শান রক্ষা করতে গিয়েই তার ছেলেকে রাতের অন্ধকারে মেরা ফেলা হয়েছে নারকীয় কায়দায়। যেই মাথায় তার কোরআনের তাজ ধারণ করার কথা আর যেই বুকে কোরআনের শাশ্বত বাণী সেই মাথা আর বুকের ঠিক মধ্যেখানে দুটো গুলির আঘাতে তৈরি হয়েছে দুটো গর্ত। একেকটা গর্ত যেন বলে দিচ্ছে এই “মানবীয়” সমাজে “দানবীয়” আচরণ দাম্ভিকতার সাহায্যে রাজত্ব করছে।

এবারের ঈদেও মুকিতের মা একটা পাঞ্জাবী কিনে রেখেছিলেন আগেভাগেই, কিন্তু... ঠিক দুপুরবেলায় সেই পাঞ্জাবী বুকে নিয়ে বসে থাকেন উঠোনে, উদাস নয়নে, সেই মাঠের পথে চেয়ে, কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। তবুও পাঞ্জাবীটা শক্ত করে বুকে জড়িয়ে মাঝেমধ্যে চিৎকার দিয়ে উঠেন, “ও আল্লাহ, তোমার আরশ কাঁপে না ক্যান?”

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ০৮ ই আগস্ট, ২০১৩ রাত ৩:০২

সাহাদাত উদরাজী বলেছেন: দুঃখের গল্প।

০৮ ই আগস্ট, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:৪১

নীল_সুপ্ত বলেছেন: হারিয়ে যাওয়া গল্প যে... ছিনতাই হওয়া ঈদের গল্প...

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.