![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সাহিত্যে ব্যাপক আগ্রহ, আমি কবিতা পড়তে (কদাচিৎ লিখতেও) পছন্দ করি। ইতিহাস আমাকে আলোড়িত করে... আর রাজনীতি আমাকে দর্শন শেখায়।
তখন খুব ছোট, বয়স ৭ কিংবা ৮ বছর। মাত্র রিমোট কন্ট্রোল ওয়ালা খেলনা গাড়ি বের হয়েছে, আমার দুই-তিনজন বন্ধু কিনেছে, আমিও বাসায় এসে বায়না ধরলাম যে আমাকে কিনে দিতেই হবে,আম্মু বললো,"যা গিয়ে তোর বাবাকে বল", আমি আব্বুকে বললাম। আব্বু বলে,"নাহ, সম্ভব না এখন, তুমি আগে ক্লাসে ফার্স্ট হও বার্ষিক পরীক্ষায় তখন কিনে দিবো।" আমি তো হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দিলাম, আব্বু পাশে বসে আমাকে এটা সেটা বুঝানোর চেষ্টা করলো, একপর্যায়ে আব্বু বললো,"বাবা,এখন মাসের শেষ দিক, আগামী মাসে বেতন পেয়েই তোমাকে কিনো দিবো, প্রমিজ।" কিছুটা শান্ত হলাম, আব্বু তখন উঠে গিয়ে একটা বই নিয়ে আসলেন, পৃষ্টা উল্টাতে উল্টাতে এক জায়গায় থামলেন, আর আবৃত্তি করা শুরু করলেন।
" কষ্ট নেবে কষ্ট
হরেক রকম কষ্ট আছে
কষ্ট নেবে কষ্ট !
লাল কষ্ট নীল কষ্ট কাঁচা হলুদ রঙের কষ্ট
পাথর চাপা সবুজ ঘাসের সাদা কষ্ট,
আলোর মাঝে কালোর কষ্ট
‘মালটি-কালার’ কষ্ট আছে
কষ্ট নেবে কষ্ট ।"
সেই থেকে হেলাল হাফিজের সাথে আমার সম্পর্কের যাত্রা শুরু;বাবার হাত ধরে। তারপর ক্লাস টুতে থাকতে শিশু একাডেমীর কবিতা আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় "নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়" আবৃত্তি করে পেয়েছি সারা ঢাকায় ২য় পুরষ্কার। অনেক গল্প হয়েছে, এবার গুরুকে নিয়ে কিছু কথা।
হেলাল হাফিজ কেমন কবিতা লিখেন? তিনি কি প্রেমের কবিতা লিখেন নাকি বিপ্লবের নাকি জীবনের? অনেক খুঁজেছি উত্তর, নির্দিষ্ট ধাঁচে তাকে ফেলতে পারিনি, কারণ তার কবিতায় সব ছোঁয়া পেয়েছি।
এই ধরুন প্রেম পাবেনঃ
" ইচ্ছে ছিলো
ইচ্ছে ছিলো তোমাকে সম্রাজ্ঞী করে সাম্রাজ্য বাড়াবো
ইচ্ছে ছিলো তোমাকেই সুখের পতাকা করে
শান্তির কপোত করে হৃদয়ে উড়াবো।
ইচ্ছে ছিলো সুনিপূণ মেকআপ-ম্যানের মতো
সূর্যালোকে কেবল সাজাবো তিমিরের সারাবেলা
পৌরুষের প্রেম দিয়ে তোমাকে বাজাবো, আহা তুমুল বাজাবো।
ইচ্ছে ছিলো নদীর বক্ষ থেকে জলে জলে শব্দ তুলে
রাখবো তোমার লাজুক চঞ্চুতে,
জন্মাবধি আমার শীতল চোখ
তাপ নেবে তোমার দু’চোখে।
ইচ্ছে ছিল রাজা হবো
তোমাকে সাম্রাজ্ঞী করে সাম্রাজ্য বাড়াবো,
আজ দেখি রাজ্য আছে
রাজা আছে
ইচ্ছে আছে,
শুধু তুমি অন্য ঘরে।"
কবিতার লাইনে লাইনে আকুল প্রেমের আবদার পাওয়া যায়। তবে প্রেমেরকবিতার ক্ষেত্রে হেলাল হাফিজের হয়তো সীমাবদ্ধতা আছে, তার সব প্রেমের কবিতায় তিনি অসীম প্রেম নিয়েও হেরে যাওয়া সৈনিকের ন্যায় আচরণ করেছেন। হতে পারে এটা তাঁর ব্যক্তিগত জীবন থেকে পাওয়া শিক্ষা, তারপরও... এই ধরুন,
"দুঃখের আরেক নাম" কবিতার শেষ লাইন দুটো
" এতোদিন নারী ও রমনীহীন ছিলাম বলেই ছিলো
দুঃখের আরেক নাম হেলাল হাফিজ।"
কিংবা "সম্প্রদান" কবিতায় "এই নে হারামজাদী একটা জীবন"
কিংবা "প্রতিমা" কবিতার
"তুমি জানো, পাড়া-প্রতিবেশী জানে পাইনি তোমাকে,
অথচ রয়েছো তুমি এই কবি সন্নাসীর ভোগে আর ত্যাগে।"
এরকম আরো উদাহরণ দেয়া যাবে।
তবে আধুনিক কবিদের মধ্যে জীবনবোধকে হেলাল হাফিজ যতটা প্রাঞ্জলতা আর সহজবোধ্যতায় ফুটিয়ে তুলেছেন সম্ভবত আর কেউ তেমন পারেন নি, আমি তো এখনো বার বার মুগ্ধ হয়ে যাই যখন পড়ি
"নিউট্রন বোমা বোঝ
মানুষ বোঝো না !"
কারো জীবনবোধ কত বেশি হলে এতো নিগুঢ় একটা কথাকে এতো সহজে ফুটিয়ে তুলতে পারেন !
তবে, জীবনবোধ শব্দটাকে আমি যদি আরো নির্দিষ্ট করি তাহলে বলতে পারি যে হেলাল হাফিজ জীবনে কষ্টের যাতনা যেভাবে কবিতায় ফুঁটাতে পেরেছেন তা একশব্দে অনিন্দ্য। শুরুতেই দেয়া "ফেরিওয়ালা" কবিতাটার বিকল্প কবিতা সম্ভবত আরেকটা নেই।
"ইদানিং জীবন যাপন" কবিতায় তিনি অসম্ভব নিপুণতার সাথে ফুটিয়ে তুলেছেন কষ্টের গাঁথা, চলুন না কবিতার অংশবিশেষ পড়ে নেইঃ
"মাঝে মাঝে কষ্টেরা আমার
সারাটা বিকেল বসে দেখেন মৌসুমী খেলা,
গোল স্টেডিয়াম যেন হয়ে যায় নিজেই কবিতা।"
হেলাল হাফিজের কবিতার বৈপ্লবিক চিন্তাধারাগুলো আকর্ষণীয়, একেবারে খুব সাদামাটা কথা কিন্তু ওজনের দিক থেকে গাম্ভীর্যে ভরপুর। যেমন তাঁর বিখ্যাত কবিতা "নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়" এর দুই কিংবদন্তিতুল্য লাইনঃ
"এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়
এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়"
হেলাল হাফিজের বৈপ্লবিক চিন্তায় কমিউনিজমের বীজ নিহিত বলেই আমার ধারণা, তিনি সাম্যতায় বিশ্বাসী, তিনি দারিদ্য-কষ্টের জীর্নতায় ক্লিষ্ট, তিনি সমাজের প্রথা ভেঙ্গে নতুন স্বপ্নে কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে বিভোর। ভাবছেন , এই গুল মারছি কেন? "একটি কবিতা পেলে" কবিতাটা কথাই ধরুনঃ
"কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে
আমি আর লিখবো না বেদনার অঙ্কুরিত কষ্টের কবিতা
কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে
ভজন গায়িকা সেই সন্ন্যাসিনী সবিতা মিস্ট্রেস
ব্যর্থ চল্লিশে বসে বলবেন,–’পেয়েছি, পেয়েছি’।
কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে
পাতা কুড়োনির মেয়ে শীতের সকালে
ওম নেবে জাতীয় সংগীত শুনে পাতার মর্মরে।
কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে
ভূমিহীন মনুমিয়া গাইবে তৃপ্তির গান জ্যৈষ্ঠে-বোশেখে,
বাঁচবে যুদ্ধের শিশু সসন্মানে সাদা দুতে-ভাতে।
কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে
আমাদের সব দুঃখ জমা দেবো যৌথ-খামারে,
সম্মিলিত বৈজ্ঞানিক চাষাবাদে সমান সুখের ভাগ
সকলেই নিয়ে যাবো নিজের সংসারে।"
"যৌথ-খামারে" , "সম্মিলিত বৈজ্ঞানিক চাষাবাদে সমান সুখের ভাগ" শব্দপুঞ্জের প্রতি খেয়াল রাখুন, কমিনিউজমের ভিত্তি-ই হলো সম্পদের সুষম বন্টন যেখানে ব্যক্তি মালিকানার অস্তিত্ব বিলোপ পায়। হেলাল হাফিজের এই কবিতায় তিনি সেই আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন বলেই আমার ধারণা ।
উপমা এবং শব্দ চয়ন নিয়ে আলোচনা না করলে একজন কবির স্বাতন্ত্র্যটা ই বাদ পড়া যায়। হেলাল হাফিজ যে অনন্য কিংবা নিত্য নতুন উপমা বা শব্দ ব্যবহার করে আমাদের চমকে দিয়েছেন তা মোটেই নয়, উপমার দিক থেকে তিনি খুব সাদাসিধেই থেকেছেন, তবে সেই সাদাসিধে উপমার প্রয়োগগুলো ছিল চমকপ্রদ। "সম্প্রদান" কবিতার শেষ লাইনটা খেয়াল করুন
" এই নে হারামাজাদী একটা জীবন।" হারামজাদী শব্দটা গালিসূচক হলেও এই কবিতার শেষ লাইনে এটার চেয়ে উপযোগী উপমা সম্ভবত সম্ভব ই নয়; কতটা ক্ষোভ-ঘৃণা-কষ্টে ভরপুর থাকলে এই শব্দ চয়ন মাথায় আসে তা ভাবতেই বিস্মিত হয়েছি।
অনেক হয়েছে, এবার নাহয় ক্ষান্ত দেই, তবে শেষ করবার আগে আমার পড়া হেলাল হাফিজের শ্রেষ্ট ৫ না বললেই নয়।
১) ফেরীঅলা
২) যার যেখানে জায়গা
৩) নিরাশ্রয় পাচঁটি আঙুল
৪) একটি পতাকা পেলে
৫) কবিতার কসম খেলাম
শুভ জন্মদিন, হে কবি, শুভ জন্মদিন।
©somewhere in net ltd.