![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
যদিও সন্ধ্যা আসিছে মন্দ মন্থরে ,সব সংগীত গেছে ইংগিতে থামিয়া - তবু বিহঙ্গ ওরে বিহঙ্গ মোর এখনি অন্ধ বন্ধ করনা পাখা-----
এ পর্বে যাদের কবিতা রয়েছে - নির্মলেন্দু গুণ, নবারুণ ভট্টাচার্য , শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় , যতীন্দ্র মোহন বাগচী, নীরেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী , রফিক আজাদ, রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ , শহীদ কাদরী।
কাশফুলের কাব্য - নির্মলেন্দু গুণ
ভেবেছিলাম প্রথম যেদিন
ফুটবে তুমি দেখব,
তোমার পুষ্প বনের গাঁথা
মনের মতো লিখব।
তখন কালো কাজল মেঘ তো
ব্যস্ত ছিল ছুটতে,
ভেবেছিলাম আরো ক’দিন
যাবে তোমার ফুটতে।
সবে তো এই বর্ষা গেলো
শরৎ এলো মাত্র,
এরই মধ্যে শুভ্র কাশে
ভরলো তোমার গাত্র।
ক্ষেতের আলে, নদীর কূলে
পুকুরের ঐ পাড়টায়,
হঠাৎ দেখি কাশ ফুটেছে
বাঁশবনের ঐ ধারটায়!
আকাশ থেকে মুখ নামিয়ে
মাটির দিকে নুয়ে,
দেখি ভোরের বাতাসে কাশ
দুলছে মাটি ছুঁয়ে।
কিন্তু কখন ফুটেছে তা
কেউ পারে না বলতে,
সবাই শুধু থমকে দাঁড়ায়
গাঁয়ের পথে চলতে।
পুচ্ছ তোলা পাখির মতো
কাশবনে এক কন্যে,
তুলছে কাশের ময়ূর চূড়া
কালো খোঁপার জন্যে।
যেন শরত-রানী কাশের
বোরখাখানি খুলে,
কাশবনের ঐ আড়াল থেকে
নাচছে দুলে-দুলে।
প্রথম কবে ফুটেছে কাশ
সেই শুধু তা জানে,
তাই তো সে তা সবার আগে
খোঁপায় বেঁধে আনে।
ইচ্ছে করে ডেকে বলি:
‘ওগো কাশের মেয়ে,
আজকে আমার চোখ জুড়ালো
তোমার দেখা পেয়ে।
তোমার হাতে বন্দী আমার
ভালোবাসার কাশ,
তাই তো আমি এই শরতে
তোমার ক্রীতদাস।’
ভালোবাসার কাব্য শুনে
কাশ ঝরেছে যেই,
দেখি আমার শরত-রানী
কাশবনে আর নেই।
যাত্রা-ভঙ্গ -নির্মলেন্দু গুণ
হাত বাড়িয়ে ছুঁই না তোকে,
মন বাড়িয়ে ছুঁই,
দুইকে আমি এক করি না
এক কে করি দুই৷
হেমের মাঝে শুই না যবে,
প্রেমের মাঝে শুই
তুই কেমন করে যাবি?
পা বাড়ালেই পায়ের ছায়া
আমাকেই তুই পাবি৷
তবুও তুই বলিস যদি যাই,
দেখবি তোর সমুখে পথ নাই৷
তখন আমি একটু ছোঁব,
হাত বাড়িয়ে জড়াব তোর
বিদায় দুটি পায়ে,
তুই উঠবি আমার নায়ে,
আমার বৈতরনী নায়ে৷
নায়ের মাঝে বসব বটে,
না-এর মাঝে শোব৷
হাত দিয়েতো ছোঁব না মুখ,
দু:খ দিয়ে ছোঁব৷
তুই কেমন করে যাবি?
দিনমজুরের কাব্য – নির্মলেন্দু গুণ
মুগুর উঠছে মুগুর নামছে
ভাঙছে মাটির ঢেলা,
আকাশে মেঘের সাথে সূর্যের
জমেছে মধুর খেলা।
ভাঙতে ভাঙতে বিজন মাঠের
কুয়াশা গিয়েছে কেটে,
কখন শুকনো মাটির তৃষ্ণা
শিশির খেয়েছে চেটে।
অতটা খেয়াল রাখেনি কৃষক
মগ্ন ছিল সে কাজে,
হঠাৎ পুলক পবনে হৃদয়
পুষ্পিত হলো লাজে।
ফিরিয়া দেখিল বধূটি তাহার
পেছনে আলের ’পরে
বসে আছে যেন ফুটে আছে ফুল
গোপনে চুপটি ক’রে।
সামনে মাটির লাল সানকিটি
জরির আঁচলে বাঁধা,
আজ নিশ্চয় মরিচে-রসুনে
বেনুন হয়েছে রাঁধা।
হাসিয়া কৃষক মরাল বাঁশের
মুগুর ফেলিয়া দিয়া
কামুক আঁখির নিবিড় বাঁধনে
বাঁধিল বধূর হিয়া।
বরুন গাছের তরুণ ছায়ায়
দু’জনে সারিল ভোজ,
বধূর ভিতরে কৃষক তখন
পাইল মনের খোঁজ।
মেঘ দিল ছায়া, বনসঙ্গমে
পুরিল বধূর আশা;
মনে যাই থাক, মুখে সে বলিল:
‘মরগে’ বর্গা চাষা।’
শব্দটি তার বক্ষে বিঁধিল
ঠিক বর্শার মতো।
‘এই জমিটুকু আমার হইলে
কার কিবা ক্ষতি হতো?’
কাতর কণ্ঠে বধূটি শুধালো:
‘আইছ্যা ফুলির বাপ,
আমাগো একটু জমিন হবে না?
জমিন চাওয়া কি পাপ?’
‘খোদার জমিন ধনীর দখলে
গেছে আইনের জোরে,
আমাগো জমিন অইব যেদিন
আইনের চাকা ঘোরে।’
অসহায় বধূ জানে না নিয়ম
কানুন কাহারে বলে;
স্বামীর কথায় চোখ দু’টি তার
সূর্যের মতো জ্বলে।
‘বলদে ঘোরায় গাড়ির চাক্কা,
নারীর চাক্কা স্বামী;
আইনের চাকা আমারে দেখাও
সে-চাকা ঘুরামু আমি।’
কৃষক তখন রুদ্র বধূর
জড়ায় চরণ দু’টি
পা-তো নয় যেন অন্ধের হাতে
লঙরখানার রুটি।
যতটা আঘাত সয়ে মৃত্তিকা
উর্বরা হয় ঘায়ে-,
ততটা আঘাত সইল না তার
বধূর কোমল পায়ে।
পা দু’টি সরিয়ে বধূটি কহিল:
‘কর কী, কর কী? ছাড়ো,
মানষে দেখলি জমি তো দেবি না,
দুন্যাম দেবি আরও।’
পরম সোহাগে কৃষক তখন
বধূর অধর চুমি,
হাসিয়া কহিল: ‘ভূমিহীন কই?
আমার জমিন তুমি।’
আকাশে তখনও সূর্যের সাথে
মেঘেরা করিছে খেলা,
মুগুর উঠছে মুগুর নামছে
ভাঙছে মাটির ঢেলা।
তোমার চোখ এতো লাল কেন?– নির্মলেন্দু গুণ
আমি বলছি না ভালোবাসতেই হবে , আমি চাই
কেউ একজন আমার জন্য অপেক্ষা করুক,
শুধু ঘরের ভেতর থেকে দরোজা খুলে দেবার জন্য ।
বাইরে থেকে দরোজা খুলতে খুলতে আমি এখন ক্লান্ত ।
আমি বলছি না ভালোবাসতেই হবে, আমি চাই
কেউ আমাকে খেতে দিক । আমি হাতপাখা নিয়ে
কাউকে আমার পাশে বসে থাকতে বলছি না,
আমি জানি, এই ইলেকট্রিকের যুগ
নারীকে মুক্তি দিয়েছে স্বামী -সেবার দায় থেকে ।
আমি চাই কেউ একজন জিজ্ঞেস করুক :
আমার জল লাগবে কি না, নুন লাগবে কি না,
পাটশাক ভাজার সঙ্গে আরও একটা
তেলে ভাজা শুকনো মরিচ লাগবে কি না ।
এঁটো বাসন, গেঞ্জি-রুমাল আমি নিজেই ধুতে পারি ।
আমি বলছি না ভলোবাসতেই হবে, আমি চাই
কেউ একজন ভিতর থেকে আমার ঘরের দরোজা
খুলে দিক । কেউ আমাকে কিছু খেতে বলুক ।
কাম-বাসনার সঙ্গী না হোক, কেউ অন্তত আমাকে
জিজ্ঞেস করুক : ‘তোমার চোখ এতো লাল কেন ?’
কাল সে আসিবে – নির্মলেন্দু গুণ
আর কিছু নয়, রাজ্য চাই না,
চাই না তিলক, চাই না তালুক;
চাই শুধু মন-মানুষে মিলুক
কবিতা আমার। সেই বিশ্বাসে
যারা কাছে আসে, আর মাঝে মাঝে
অপমানিতের হয়ে কথা বলি ।
বাঁশি যে বাজায় সে তো কংকাল,
প্রাণের ভিতরে আপনি সে গায়;
আপনার মাঝে নিজেকে সাজায় ।
শোনাতে চায় না, তবু যারা শোনে,
চারপাশে যারা শ্রম ঘামে বুনে
পৃথিবী সাজায়, তাদের পারি না
উপেক্ষা করে পায়ের দলে পিষে
নির্মল বিষে নিমগ্ন হতে ।
এই গ্রন্থটি লেখা হয়ে যাক,
গান শোনে যারা তারা কিছু পা’ক
আমার জন্য অশেষ না থাক
রেশটা তো রবে, তাই দিয়ে হবে
তোমার অর্ঘ্য তোমার উত্তরীয় ।
ঘৃণা করে যারা তারা পিছু যায়,
ভালোবাসে যারা তারা কিছু পায় ।
এই স্বাভাবিক, আমি তবু ঠিক
কুলকলরব যে নদী হারায়;
তার স্তবগানে হই না মুখর ।
খর-বৈশাখে আমি আনি ঝড়,
আমি ভালোবাসি সাহসের স্বর ।
প্রতিঘাতময় মুখর জীবন
সোনামুখী সূচে শিল্প সীবন ।
আর কিছু নয়, আমার গগন-
চুম্বী বাসনা মেলিয়াছে ডানা
গানের ভিতরে, তার ভাষা চাই ।
আশা দিয়ে রোজ যে-মুখ সাজাই
তার কাছে পাই যেটুকু শ্রান্তি
ত্রুর কাল এসে তার সে ভ্রান্তি
ধুয়ে মুছে দেয়, চিহ্ন রাখে না ।
এই ভেবে কত প্রেম ফেলে দেই
আপন ভাবিয়া বুকে তুলে নেই
অপরের ব্যথা, কতো ব্যর্থতা
পায়ে দলে চলি সমুখের ডাকে;
গতিচঞ্চল জীবনের বাঁকে
তবু বহু ভুল থেকে যায় জানি ।
সতর্ক চিতে যতো যতি টানি,
মানুষের লাগি যতো গীত ভানি
কাল সে আসিবে, মুখখানি তার
যতই দেখিব ভালোবাসিবার
বাসনা জাগিবে চিতে, আসিবে না
জানি, কাল চিরকালে ধরা দিতে ।
আগামী কালের সতনু শিখাটি
পোড়াবে আমার শ্রেষ্ঠ লিখাটি ।
তবু কথা লিখি, তবু গান গাই,
মনের ভিতরে যে মানুষ চাই
তার কিছু পাই গূঢ়-চেতনায়
অন্ধ প্রাণের বন্ধ বন্দী কূপে-;
কিছু রেখে যাই ব্যর্থ-শিল্পরূপে ।
শিয়রে বাংলাদেশ -নির্মলেন্দু গুণ
আমার যখন পঁচিশ বছর পূর্ণ হয়েছিলো,
তুই তখনও ছিলি আমার স্বপনে।
আমি পাঁজর খুলে বলেছিলাম তোকে,
আমার বুকে যা আছে তুই সব নে ॥
আমার যখন পঁচিশ বছর পূর্ণ হয়েছিলো,
তুই তখনও ছিলি মায়ের ভ্রণে।
আমি অস্ত্রজ্ঞানে আড়াল করে তোকে
তীর বানিয়ে রেখেছিলাম তূণে ॥
আমার যখন পঁচিশ বছর পূর্ণ হয়েছিলো,
তুই তখনও ছিলি জন্ম-আশায়।
তোকেই তখন বড় করে দেখেছিলাম বলে
সঁপিনি মন নারীর ভালোবাসায় ॥
আমার যখন পঁচিশ বছর পূর্ণ হয়েছিলো,
অস্ত্র তুলে নিয়েছিলাম হাতে।
যুদ্ধ করতে গিয়েছিলাম দূরপাহাড়ী বনে
যদিও সায় ছিলো না হত্যাতে ॥
আমার যখন পঁচিশ বছর পূর্ণ হয়েছিলো,
টগবগে লাল রক্ত ছিলো বক্ষে।
তখন তোকে নরক থেকে মুক্ত করা ছাড়া
আর কী শ্রেয় ছিলো আমার পক্ষে ?
আমার যখন পঁচিশ বছর পূর্ণ হয়েছিলো,
বিজয়-গর্ব ছিলো না তোর স্বরে।
আমি তোকে বিজয় দিয়ে বিজয়বতী করে
দিয়েছিলাম ষোলোই ডিসেম্বরে ।
এখন যখন পঁচিশ বছর পূর্ণ হলো তোর,
আমি তখন তোকে রেখে পঞ্চাশে দেই দৌড়।
রজতে নয়, সুবর্ণতে এ-দৌড় হবে শেষ,
তখনও তুই থাকবি আমার শিয়রে বাংলাদেশ।
এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না -নবারুন ভট্টাচার্য
যে পিতা সন্তানের লাশ সনাক্ত করতে ভয় পায়
আমি তাকে ঘৃণা করি-
যে ভাই এখনও নির্লজ্জ স্বাভাবিক হয়ে আছে
আমি তাকে ঘৃণা করি-
যে শিক্ষক বুদ্ধিজীবী কবি ও কেরাণী
প্রকাশ্য পথে এই হত্যার প্রতিশোধ চায় না
আমি তাকে ঘৃণা করি-
আটজন মৃতদেহ
চেতনার পথ জুড়ে শুয়ে আছে
আমি অপ্রকৃতিস্থ হয়ে যাচ্ছি
আট জোড়া খোলা চোখ আমাকে ঘুমের মধ্যে দেখে
আমি চীৎকার করে উঠি
আমাকে তারা ডাকছে অবেলায় উদ্যানে সকল সময়
আমি উন্মাদ হয়ে যাব
আত্মহ্ত্যা করব
যা ইচ্ছা চায় তাই করব।
কবিতা এখনই লেখার সময়
ইস্তেহারে দেয়ালে স্টেনসিলে
নিজের রক্ত অশ্রু হাড় দিয়ে কোলাজ পদ্ধতিতে
এখনই কবিতা লেখা যায়
তীব্রতম যন্ত্রনায় ছিন্নভিন্ন মুখে
সন্ত্রাসের মুখোমুখি-ভ্যানের হেডলাইটের ঝলসানো আলোয়
স্থির দৃষ্টি রেখে
এখনই কবিতা ছুঁড়ে দেওয়া যায়
’৩৮ ও আরো যা যা আছে হত্যাকারীর কাছে
সব অস্বীকার করে এখনই কবিতা পড়া যায়
লক-আপের পাথর হিম কক্ষে
ময়না তদন্তের হ্যাজাক আলোক কাঁপিয়ে দিয়ে
হত্যাকারীর পরিচালিত বিচারালয়ে
মিথ্যা অশিক্ষার বিদ্যায়তনে
শোষণ ও ত্রাসের রাষ্ট্রযন্ত্রের মধ্যে
সামরিক-অসামরিক কর্তৃপক্ষের বুকে
কবিতার প্রতিবাদ প্রতিধ্বনিত হোক
বাংলাদেশের কবিরাও
লোরকার মতো প্রস্তুত থাকুক
হত্যার শ্বাসরোধের লাশ নিখোঁজ হওয়ার স্টেনগানের গুলিতে সেলাই হয়ে
যাবার জন্য প্রস্তত থাকুক
তবু কবিতার গ্রামাঞ্চল দিয়ে কবিতার শহরকে ঘিরে ফেলবার
একান্ত দরকার।
এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না
এই জল্লাদের উল্লাসমঞ্চ আমার দেশ না
এই বিস্তীর্ণ শ্মশান আমার দেশ না
এই রক্তস্নাত কসাইখানা আমার দেশ না
আমি আমার দেশকে ফিরে কেড়ে নেব
বুকের মধ্যে টেনে নেব কুয়াশায় ভেজা কাশ বিকেল ও ভাসান
সমস্ত শরীর ঘিরে জোনাকি না পাহাড়ে পাহাড়ে জুম
অগণিত হৃদয় শস্য, রূপকথা ফুল নারী নদী
প্রতিটি শহীদের নামে এক একটি তারকার নাম দেব ইচ্ছে মতো
ডেকে নেব টলমলে হাওয়া রৌদ্রের ছায়ায় মাছের চোখের মত দীঘি
ভালোবাসা-যার থেকে আলোকবর্ষ দুরে জন্মাবধি অচ্ছুৎ হয়ে আছি-
তাকেও ডেকে নেব কাছে বিপ্লবের উৎসবের দিন।
হাজার ওয়াট আলো চোখে ফেলে রাত্রিদিন ইনটারোগেশন
মানি না
নখের মধ্যে সূঁচ বরফের চাঙড়ে শুইয়ে রাখা
মানি না
পা বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা যতক্ষণ রক্ত ঝরে নাক দিয়ে
মানি না
ঠোঁটের ওপরে বুট জ্বলন্ত শলাকায় সারা গায় ক্ষত
মানি না
ধারালো চাবুক দিয়ে খন্ড খন্ড রক্তাক্ত পিঠে সহসা আ্যালকোহল
মানি না
নগ্নদেহে ইলেকট্রিক শক কুৎসিৎ বিক্রত যৌন অত্যাচার
মানি না
পিটিয়ে পিটিয়ে হত্যা খুলির সঙ্গে রিভলবার ঠেঁকিয়ে গুলি
মানি না
কবিতা কোন বাধাকে স্বীকার করে না
কবিতা সশস্ত্র কবিতা স্বাধীন কবিতা নির্ভীক।
চেয়ে দেখো মায়কোভস্কি হিকমেত নেরুদা আরাগঁ এলুয়ার
তোমাদের কবিতাকে আমরা হেরে যেতে দিইনি
বরং সারাটা দেশ জুড়ে নতুন একটা মহাকাব্য লেখবার চেষ্টা চলছে
গেরিলা ছন্দে রচিত হতে চলেছে সকল অলংকার।
গর্জে উঠুক দল মাদল
প্রবাল দ্বীপের মত আদিবাসী গ্রাম
রক্তে লাল নীলক্ষেত
শঙ্খচূড়ের বিষ-ফেনা মুখে আহত তিতাস
বিষাক্ত মৃত্যুসিক্ত তৃষ্ঞায় কুচিলা
টণ্কারের সূর্য অন্ধ উৎক্ষিপ্ত গান্ডীবের ছিলা
তীক্ষ্ম তীর হিংস্রতম ফলা-
ভাল্লা তোমার টাঙ্গি পাশ
ঝলকে ঝলকে বল্লম চর-দখলের সড়কি বর্শা
মাদলের তালে তালে রক্তচক্ষু ট্রাইবাল টোটেম
বন্দুক কুরকি দা ও রাশি রাশি সাহস
এত সাহস যে আর ভয় করে না
আরো আছে ক্রেন, দাঁতালো বুলডজার বনভয়ের মিছিল
চলামান ডাইনামো টারবাইন লেদ ও ইনজিন
ধ্বস-নামা কয়লার মিথেন অন্ধকারে কঠিন হীরার মতো চোখ
আশ্চর্য ইস্পাতের হাতুড়ি
ডক জুটমিল ফার্ণেসের আকাশে উত্তোলিত সহস্র হাত
না ভয় করে না
ভয়ের ফ্যাকাশে মুখ কেমন অচেনা লাগে
যখন জানি মৃত্যু ভালোবাসা ছাড়া কিছু নয়।
আমাকে হ্ত্যা করলে
বাংলার সব কটি মাটির প্রদীপে শিখা হয়ে ছড়িয়ে যাব
আমার বিনাশ নেই-
বছর বছর মাটির মধ্য হতে সবুজ আশ্বাস হয়ে ফিরে আসব
আমার বিনাশ নেই-
সুখে থাকব, দুঃখে থাকব সন্তান-জন্মে সৎকারে
বাংলাদেশ যতদিন থাকবে ততদিন
মানুষ যতদিন থাকবে ততদিন।
যে মৃত্যু রাত্রির শীতে জ্বলন্ত বুদবুদ হয়ে উঠে যায়
সেই দিন সেই যুদ্ধ সেই মৃত্যু ডেকে আনো
সেভেন্থ ফ্লিটকে রুখে দিক সপ্তডিঙা মধুকর
শিঙা ও শঙ্খে যুদ্ধারম্ভ ঘোষিত হয়ে যাক
রক্তের গন্ধ নিয়ে বাতাস যখন মাতাল
জ্বলে উঠুক কবিতা বিস্ফোরক বারুদের মাটি
আলপনা গ্রাম নৌকা নগর মন্দির
যখন তরাই থেকে সমুদ্রের সীমা
সারা রাত্রি কান্নার পর শুষ্ক দাহ্য হয়ে আছে
যখন জন্মভূমি ও বধ্যভূমির কাদা এক হয়ে গেছে
তখন আর দিধ্বা কেন
সংশয় কীসের
ত্রাস কী
আটজন স্পর্শ করেছে
গ্রহণের অন্ধকারে ফিসফিস করে বলছে কোথায় কখন প্রহরা
তাদের কন্ঠে অযুত তারকাপুঞ্জ ছায়াপথ সমুদ্র
গ্রহ থেকে গ্রহে ভেসে বেরাবার উত্তরাধিকার
কবিতার জ্বলন্ত মশাল
কবিতার মলটভ ককটেল
কবিতার টলউইন অগ্নিশিখা
এই আগুনের আকাঙ্ক্ষাতে আছড়ে পড়ুক।
বুক তার বাংলাদেশের হৃদয় -শামসুর রাহমান
সারারাত নূর হোসেনের চোখে এক ফোঁটা ঘুমও
শিশিরের মতো জমেনি, বরং তার শিরায় শিরায়
জ্বলেছে আতশবাজি সারারাত, কী এক ভীষণ
বিস্ফোরণ সারারাত জাগিয়ে রেখেছে
ওকে, ওর বুকে ঘন ঘন হরিণের লাফ,
কখনো অত্যন্ত ক্ষীপ্র জাগুয়ার তাকে
প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে জ্বলজ্বলে
চোখে খর তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকে,
এতটুকু ঘুমাতে দেয়নি।
কাল রাত ঢাকা ছিল প্রেতের নগরী,
সবাই ফিরেছে ঘরে সাত তাড়াতাড়ি। চতুর্দিকে
নিস্তব্ধতা ওঁৎ পেতে থাকে,
ছায়ার ভেতরে ছায়া, আতঙ্ক একটি
কৃষ্ণাঙ্গ চাদরে মুড়ে দিয়েছে শহরটিকে আপাদমস্তক।
মাঝে মাঝে কুকুরের ডাক নৈঃশব্দ্যকে
আরো বেশি তীব্র করে তোলে
প্রহরে প্রহরে, নূর হোসেনের চোখে
খোলা পথ ওর
মোহন নগ্নতা দিয়ে আমন্ত্রণ জানায় দুর্বার। অন্ধকার
ঘরে চোখ দুটি অগ্নিঘেরা
জানালা, কব্জিতে তার দপদপ করে ভবিষ্যৎ।
এমন সকাল তার জীবনে আসেনি কোনোদিন,
মনে হয় ওর; জানালার কাছে পাখি
এ-রকম সুর
দেয়নি ঝরিয়ে এর আগে, ডালিমের
গাছে পাতাগুলি আগে এমন সতেজ
কখনো হয়নি মনে। জীবনানন্দের
কবিতার মায়াবী আঙুল
তার মনে বিলি কেটে দেয়। অপরূপ সূর্যোদয়,
কেমন আলাদা,
সবার অলক্ষে নূর হোসেনের প্রশস্ত ললাটে
আঁকা হয়ে যায়,
যেন সে নির্ভীক যোদ্ধা, যাচ্ছে রণাঙ্গনে।
উদোম শরীরে নেমে আসে রাজপথে, বুকে-পিঠে
রৌদ্রের অক্ষরে লেখা অনন্য শ্লোগান,
বীরের মুদ্রায় হাঁটে মিছিলের পুরোভাগে এবং হঠাৎ
শহরে টহলদার ঝাঁক ঝাঁক বন্দুকের সীসা
নূর হোসেনের বুক নয়, যেন বাংলাদেশের হৃদয়
ফুটো করে দেয়; বাংলাদেশ
বনপোড়া হরিণীর মতো আর্তনাদ করে, তার
বুক থেকে অবিরল রক্ত ঝরতে থাকে, ঝরতে থাকে।
স্বাধীনতা তুমি- শামসুর রাহমান
স্বাধীনতা তুমি
রবিঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান।
স্বাধীনতা তুমি
কাজী নজরুল ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো
মহান পুরুষ, সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাঁপা-
স্বাধীনতা তুমি
শহীদ মিনারে অমর একুশে ফেব্রুয়ারির উজ্জ্বল সভা
স্বাধীনতা তুমি
পতাকা-শোভিত শ্লোগান-মুখর ঝাঁঝালো মিছিল।
স্বাধীনতা তুমি
ফসলের মাঠে কৃষকের হাসি।
স্বাধীনতা তুমি
রোদেলা দুপুরে মধ্যপুকুরে গ্রাম্য মেয়ের অবাধ সাঁতার।
স্বাধীনতা তুমি
মজুর যুবার রোদে ঝলসিত দক্ষ বাহুর গ্রন্থিল পেশী।
স্বাধীনতা তুমি
অন্ধকারের খাঁ খাঁ সীমান্তে মুক্তিসেনার চোখের ঝিলিক।
স্বাধীনতা তুমি
বটের ছায়ায় তরুণ মেধাবী শিক্ষার্থীর
শানিত কথার ঝলসানি-লাগা সতেজ ভাষণ।
স্বাধীনতা তুমি
চা-খানায় আর মাঠে-ময়দানে ঝোড়ো সংলাপ।
স্বাধীনতা তুমি
কালবোশেখীর দিগন্তজোড়া মত্ত ঝাপটা।
স্বাধীনতা তুমি
শ্রাবণে অকূল মেঘনার বুক
স্বাধীনতা তুমি পিতার কোমল জায়নামাজের উদার জমিন।
স্বাধীনতা তুমি
উঠানে ছড়ানো মায়ের শুভ্র শাড়ির কাঁপন।
স্বাধীনতা তুমি
বোনের হাতের নম্র পাতায় মেহেদীর রঙ।
স্বাধীনতা তুমি বন্ধুর হাতে তারার মতন জ্বলজ্বলে এক রাঙা পোস্টার।
স্বাধীনতা তুমি
গৃহিণীর ঘন খোলা কালো চুল,
হাওয়ায় হাওয়ায় বুনো উদ্দাম।
স্বাধীনতা তুমি
খোকার গায়ের রঙিন কোর্তা,
খুকীর অমন তুলতুলে গালে
রৌদ্রের খেলা।
স্বাধীনতা তুমি
বাগানের ঘর, কোকিলের গান,
বয়েসী বটের ঝিলিমিলি পাতা,
যেমন ইচ্ছে লেখার আমার কবিতার খাতা।
পরানের গহীন ভিতর - সৈয়দ শামসুল হক
১
জামার ভিতর থিকা যাদুমন্ত্রে বারায় ডাহুক,
চুলের ভিতর থিকা আকবর বাদশার মোহর,
মানুষ বেবাক চুপ, হাটবারে সকলে দেখুক
কেমন মোচর দিয়া টাকা নিয়া যায় বাজিকর।
চক্ষের ভিতর থিকা সোহাগের পাখিরে উড়াও,
বুকের ভিতর থিকা পিরীতের পুন্নিমার চান,
নিজেই তাজ্জব তুমি একদিকে যাইবার চাও
অথচ আরেক দিকে খুব জোরে দেয় কেউ টান।
সে তোমার পাওনার এতটুকু পরোয়া করে না,
খেলা যে দেখায় তার দ্যাখানের ইচ্ছায় দেখায়,
ডাহুক উড়াইয়া দিয়া তারপর আবার ধরে না,
সোনার মোহর তার পড়ে থাকে পথের ধুলায়।
এ বড় দারুণ বাজি, তারে কই বড় বাজিকর
যে তার রুমাল নাড়ে পরানের গহীন ভিতর।।
২
আন্ধার তোরঙ্গে তুমি সারাদিন কর কি তালাশ?
মেঘের ভিতর তুমি দ্যাখ কোন পাখির চক্কর?
এমন সরল পথ তবু ক্যান পাথরে টক্কর?
সোনার সংসার থুয়া পাথারের পরে কর বাস?
কি কামে তোমার মন লাগে না এ বাণিজ্যের হাটে?
তোমার সাক্ষাৎ পাই যেইখানে দারুণ বিরান,
ছায়া দিয়া ঘেরা আছে পরিস্কার তোমার উঠান
অথচ বেবাক দেখি শোয়া আছে মরনের খাটে।
নিঝুম জঙ্গলে তুমি শুনছিলা ধনেশের ডাক?
হঠাৎ আছাড় দিয়া পড়ছিল রূপার বাসন?
জলপির গাছে এক কুড়ালের কোপের মতন
তাই কি তোমার দেহে ল্যাখা তিন বাইন তালাক?
এমন বৃক্ষ কি নাই, যার ডালে নাই কোন পরী?
এমন নদী কি নাই, যার বুকে নাই কোন তরী?
৩
সে কোন বাটিতে কও দিয়াছিলা এমন চুমুক
নীল হয়া গ্যাছে ঠোঁট, হাত পাও শরীল অবশ,
অথচ চাও না তুমি এই ব্যাধি কখনো সারুক।
আমার জানতে সাধ, ছিল কোন পাতার সে রস?
সে পাতা পানের পাতা মানুষের হিয়ার আকার?
নাকি সে আমের পাতা বড় কচি ঠোঁটের মতন?
অথবা বটের পাতা অবিকল মুখের গড়ন?
তুঁতের পাতা কি তয়, বিষনিম, নাকি ধুতুরার?
কতবার গেছি আমি গেরামের শ্যাষ সীমানায়
আদাড় বাদার দিয়া অতিঘোর গহীন ভিতরে,
কত না গাছের পাতা কতবার দিয়াছি জিহ্বায়,
এমন তো পড়ে নাই পানি এই পরানে, শিকড়ে।
তয় কি অচিন বৃক্ষ তুমি সেই ভুবনে আমার,
আমারে দিয়াছো ব্যাধি, নিরাময় অসম্ভব যার?
৪
আমি কার কাছে গিয়া জিগামু সে দুঃখ দ্যায় ক্যান,
ক্যান এত তপ্ত কথা কয়, ক্যান পাশ ফিরা শোয়,
ঘরের বিছান নিয়া ক্যান অন্য ধানখ্যাত রোয়?
অথচ বিয়ার আগে আমি তার আছিলাম ধ্যান।
আছিলাম ঘুমের ভিতরে তার য্যান জলপিপি,
বাঁশির লহরে ডোবা পরানের ঘাসের ভিতরে,
এখন শুকনা পাতা উঠানের পরে খেলা করে,
এখন সংসার ভরা ইন্দুরের বড় বড় ঢিপি।
মানুষ এমন ভাবে বদলায়া যায়, ক্যান যায়?
পুন্নিমার চান হয় অমাবস্যা কিভাবে আবার?
সাধের পিনিস ক্যান রঙচটা রদ্দুরে শুকায়?
সিন্দুরমতির মেলা হয় ক্যান বিরান পাথার?
মানুষ এমন তয়, একবার পাইবার পর
নিতান্ত মাটির মনে হয় তার সোনার মোহর।।
৫
তোমার দ্যাশের দিকে ইস্টিশানে গেলেই তো গাড়ি
সকাল বিকাল আসে, এক দন্ড খাড়ায়া চম্পট,
কত লোক কত কামে দূরে যায়, ফিরা আসে বাড়ি-
আমার আসন নাই, যাওনেরও দারুন সংকট।
আসুম? আসার মতো আমি কোনো ঘর দেখি নাই।
যামু যে? কোথায় যামু, বদলায়া গ্যাছে যে বেবাক।
কেমন তাজ্জব সব পাল্টায়া যায় আমি তাই
দেইখাছি চিরকাল। পরানের ভিতরে সুরাখ-
সেখানে কেবল এক ফরফর শব্দ শোনা যায়,
পাখিরা উড়াল দিয়া গ্যাছে গিয়া, এখন বিরান,
এখন যতই আমি ছড়া দেই কালিজিরা ধান,
সে কি আর আঙিনায় ফিরা আসে? আর কি সে খায়?
সকাল বিকাল গাড়ি, চক্ষু আছে তাই চক্ষে পড়ে;
পলকে পলকে গাড়ি সারাদিন মনের ভিতরে।।
৬
তোমার খামাচির দাগ এখনো কি টকটাকা লাল,
এখনো জ্বলন তার চোৎরার পাতার লাহান।
শয়তান, দ্যাখো না করছ কি তুমি কি সোন্দর গাল,
না হয় দুপুর বেলা একবার দিছিলাম টান?
না হয় উঠানে ছিল লোকজন কামের মানুষ,
চুলায় আছিল ভাত, পোলাপান পিছের বাগানে,
তোমারে পরান দিছি, তাই বইলা দেই নাই হুঁশ,
আমি তো তোমারে নিতে চাই নাই ঘরের বিছানে।
হ, জানি নিজের কাছে কোনো কথা থাকে না গোপন।
দিনের দুফুর বেলা যেই তুমি আসছিলা ঘরে
আতখা এমন মনে হইছিল- আন্ধার যেমন,
আতখা এমন ছায়া সোহাগের আর্শির ভিতরে।
আবার ডাকলে পরে কিছুতেই স্বীকার হমু না।
বুকের পাষাণ নিয়া দিমু ডুব শীতল যমুনা।।
৭
নদীর কিনারে গিয়া দেখি নাও নিয়া গ্যাছে কেউ
অথচ এই তো বান্ধা আছিল সে বিকাল বেলায়।
আমার অস্থির করে বুঝি না কে এমন খেলায়,
আমার বেবাক নিয়া শান্তি নাই, পাচে পাছে ফেউ।
পানির ভিতরে য্যান ঘুন্নি দিয়া খিলখিল হাসে
যত চোর যুবতীরা, গ্যারামের শ্যাষ সীমানায়
বটের বৈরাগী চুল, ম্যাঘে চিল হারায় বারায়,
বুকের ভিতরে শিস দিয়া সন্ধা হাঁটে আশেপাশে।
এখন কোথায় যাই, এইখানে বড় সুনসান,
মানুষের দুঃখ আছে, জগতের আছে কিনা জানি না-
জগৎ এমনভাবে হয়া যায় হঠাৎ অচিনা।
মনে হয় আমার থিকাও একা বৃক্ষের পরান,
আমার থিকাও দুঃখী যমুনার নদীর কিনার।
আমার তো গ্যাছে এক, কত কোটি লক্ষ গ্যাছে তার।।
৮
আমারে তলব দিও দ্যাখো যদি দুঃখের কাফন
তোমারে পিন্ধায়া কেউ অন্যখানে যাইবার চায়
মানুষ কি জানে ক্যান মোচড়ায় মানুষের মন,
অহেতুক দুঃখ দিয়া কেউ ক্যান এত সুখ পায়?
নদীরে জীবন কই, সেই নদী জল্লাদের মতো
ক্যান শস্য বাড়িঘর জননীর শিশুরে ডুবায়?
যে তারে পরান কই, সেই ব্যাক্তি পাইকের মতো
আমার উঠানে ক্যান নিলামের ঢোলে বাড়ি দ্যায়?
যে পারে উত্তর দিতে তার খোঁজে দিছি এ জীবন,
দ্যাখা তার পাই নাই, জানা নাই কি এর উত্তর।
জানে কেউ? যে তুমি আমার সুখ, তুমিই কি পারো
আমারে না দুঃখ দিয়া? একবার দেখি না কেমন?
কেমন না যায়া তুমি পারো দেখি অপরের ঘর?-
অপর সন্ধান করে চিরকাল অন্য ঘর কারো।।
৯
একবার চাই এক চিক্কুর দিবার, দিমু তয়?
জিগাই কিসের সুখে দুঃখ নিয়া তুমি কর ঘর?
আঙিনার পাড়ে ফুলগাছ দিলে কি সোন্দর হয়,
দুঃখের কুসুম ঘিরা থাকে যার, জীয়ন্তে কবর।
পাথারে বৃক্ষের তরে ঘন ছায়া জুড়ায় পরান,
গাঙের ভিতরে মাছ সারাদিন সাঁতরায় সুখে,
বাসরের পরে ছায়া য্যান দেহে গোক্ষুর জড়ান,
উদাস সংসারে ব্যথা সারাদিন ঘাই দেয় বুকে।
তবুও সংসার নিয়া তারে নিয়া তুমি কি পাগল,
তোলো লালশাক মাঠে, ফসফস কোটো পুঁটিমাছ,
সাধের ব্যাঞ্জন করো, রান্ধো ক্ষীর পুড়ায়া আঞ্চল,
বিকাল বেলায় কর কুঙ্কুমের ফোঁটা দিয়া সাজ।
ইচ্ছা করে টান দিয়া নিয়া যাই তোমারে রান্ধুনি,
তোমার সুতায় আমি একখান নীল শাড়ি বুনি।।
১০
কে য্যান কানতে আছে- তার শব্দ পাওয়া যায় কানে,
নদীও শুকায়া যায়, আকালের বাতাস ফোঁপায়,
মানুষেরা বাড়িঘর বানায় না আর এই খানে,
গোক্ষুর লতায়া ওঠে যুবতীর চুলের খোঁপায়।
বুকের ভিতর থিকা লাফ দিয়া ওঠে যে চিক্কুর,
আমি তার সাথে দেই শিমুলের ফুলের তুলনা,
নিথর দুফুর বেলা, মরা পাখি, রবি কি নিষ্ঠুর,
আগুন লাগায়া দিবে, হবে খাক, তারি এ সূচনা।
অথচ আমারে কও একদিন এরও শ্যাষ আছে-
আষাঢ়ের পুন্নিমার আশা আর এ দ্যাশে করি না,
চক্ষু যে খাবলা দিয়া খায় সেই পাখি বসা গাছে,
অথচ খাড়ায়া থাকি, এক পাও কোথাও নড়ি না।
সকল কলস আমি কালঘাটে শূণ্য দেইখাছি,
তারে না দেইখাছি তাই দ্যাখনের চক্ষু দিতে রাজি।।
১১
কি আছে তোমার দ্যাশে? নদী আছে? আছে নাকি ঘর?
ঘরের ভিতরে আছে পরানের নিকটে যে থাকে?
উত্তর সিথানে গাছ, সেই গাছে পাখির কোটর
আছে নাকি? পাখিরা কি মানুষের গলা নিয়া ডাকে?
যখন তোমার দ্যাখা জানা নাই পাবো কি পাবো না,
যখন গাছের তলে এই দেহ দিবে কালঘুম,
যখন ফুরায়া যাবে জীবনে নীল শাড়ি বোনা,
তখন কি তারা সব কয়া দিবে আগাম-নিগুম?
আমার তো দ্যাশ নাই, নদী নাই, ঘর নাই, লোক,
আমার বিছানে নাই সোহাগের তাঁতের চাদর,
আমার বেড়ায় খালি ইন্দুরের বড় বর ফোক,
আমার বেবাক ফুল কাফনের ইরানি আতর।
তোমার কি সাধ্য আছে নিয়া যাও এইখান থিকা,
আমার জীবন নিয়া করো তুমি সাতনরী ছিকা?
১২
উঠানের সেই দিকে আন্ধারের ইয়া লম্বা লাশ,
শিমের মাচার নিচে জোছনার সাপের ছলম,
পরীরা সন্ধান করে যুবতীর ফুলের কলম,
তারার ভিতরে এক ধুনকার ধুনায় কাপাশ,
আকাশে দোলায় কার বিবাহের রুপার বাসন,
গাবের বাবরি চুল আলখেল্লা পরা বয়াতির,
গাভির ওলান দিয়া ক্ষীণ ধারে পড়তাছে ক্ষীর,
দুই গাঙ্গ এক হয়া যাইতাছে- কান্দন, হাসন।
একবার আসবা না?- তোমারেও ডাক দিতে আছে
যে তুমি দুঃখের দিকে একা একা যোজন গিয়াছো?
একবার দেখবা না তোমারেও ডাক দিতে আছে
যে তুমি আঘাত নিয়া সারাদিন কি তফাত আছো?
যে নাই সে নাই সই, তাই সই, যা আছে তা আছে,
এমন পুন্নিমা আইজ, কোন দুঃখে দুয়ার দিয়াছো?
১৩
তোমার বিয়ার দিন মনে হইল, সত্য নিও মনে,
এত বড় এত গোল কোনোদিন দেখি নাই চান।
তুলার মতন ফুল, রাণী য্যান দরবারে বসা,
নদীর গহীন তলে জোছনায় দিয়া সে প্রাসাদ।
পাথারে নিরালা গাছ আলগোছে একখানা হাত
আমার আন্ধার পিঠে দিয়া কয়, 'তোমারে সহসা
দেখাই কিভবে সব মানুষের নিজের বানান,
পরীর সাক্ষাৎ নাই গেরস্তের বাড়ির পিছনে।'
দিঘল নায়ের মতো দুঃখ এক নদী দিয়া যায়-
মাঝি নাই, ছই নাই, নাই কোনো কেরায়া কি লোক।
না হয় অনেকে কয়- এক গেলে অন্য আর আসে,
অন্যের মধ্যে কি সেই পরানের এক পাওয়া যায়?-
তাই না সচ্ছল দ্যাশ অথচ কি বিরান সড়ক।
মানুষ বোঝে না বইলা পুন্নিমার চান এত হাসে।।
১৪
কি কামে মানুষ দ্যাখে মানুষের বুকের ভিতরে
নীল এক আসমান- তার তলে যমুনার ঢল,
যখন সে দেখে তার পরানের গহীন শিকড়ে
এমন কঠিন টান আচানক পড়ে সে চঞ্চল?
কিসের সন্ধান করে মানুষের ভিতরে মানুষ?
এমন কি কথা আছে কারো কাছে না কইলে নাই?
সুখের সকল দানা কি কামে যে হইয়া যায় তুষ?
জানি নাই, বুঝি নাই, যমুনারও বুঝি তল নাই।
তয় কি বৃক্ষের কাছে যামু আমি? তাই যাই তয়?
বনের পশুর কাছে জোড়া জোড়া আছে যে গহীনে?
যা পারে জবাব দিতে, গিয়া দেখি শূণ্য তার পাড়া,
একবার নিয়া আসে আকালের কঠিন সময়,
আবার ভাসায় ঢলে খ্যাতমাঠ শুকনার দিনে,
আমার আন্ধার নিয়া দেয় না সে একটাও তারা।
১৫
আমারে সোন্দর তুমি কও নাই কোনো একদিন,
আমার হাতের পিঠা কও নাই কি রকম মিঠা,
সেই তুমি তোমারেই দিছি আমি যুবতীর চিন-
চোখ-কানা দেখ নাই বিছানায় আছে লাল-ছিটা?
তয় কি তোমারে আমি ফাঁকি দিয়া পিছন বাড়িতে
যামু তার কাছে কও আমারে যে দিতে যায় পান?
অথবা জিগার ডালে ফাঁসি নিয়া নিজের শাড়িতে
ভূত হয়া তোমার গামছায় দিমু আন্ধারে টান?
তখন আমারে তুমি দেখি হেলা করো কি রকম,
শরীল পাথর হয়া যায় কি না পানের ছোবলে,
আমারে হারায়া দেখি জমিহারা চাষী হও কি না?
এমন দেখতে বড় সাধ হয় আল্লার কসম,
দেখার বাসনা করে কালপোকা তোমার ফসলে,
অথচ ঘরেই থাকি, পোড়া ঘরে থাকতে পারি না।।
১৬
যমুনার পারে আসলে তার কথা খালি মনে হয়,
এমন পরান পড়ে- সব কিছু বিকাল-বিকাল,
লোকের চেহারা দেখি, হাত নাড়ে, নাড়ে তারা পাও,
কথা কয়, তাও বোঝা যায় না যে কি কয় কি কয়।
চক্ষের ভিতরে নাচে হাটবারে বাঁওহাতি খাল,
নায়ের উপরে দাগ- একদিন রাখছিল পাও।
জলে ভেঁজা, কত বর্ষা গ্রীষ্মকাল গ্যাছে তারপর,
কতবার নাও নিয়া পাড়ি দিছি এ কুল ও কুল,
তাও সেই পাড় আমি চিনি নাই, দেখি নাই গাঙ্গে।
বুকের ভিতরে ঢেলা সারাদিন কিষানেরা ভাঙ্গে,
রাখাল নষ্টামি করে, পড়ে লাল শিমুলের ফুল,
জলের ভিতরে নড়ে মনে বান্ধা আছিল যে ঘরে।
কইছিল সে আমারে- সেই পাড়ে নিবা না আমারে?
কোন পাড়? ইচ্ছা তার আছিল সে যায় কোন পাড়ে?
১৭
এমন অদ্ভুতভাবে কথা কয়া ওঠে কে, আন্ধারে?-
য্যান এক উত্তরের ধলাহাঁস দক্ষিণের টানে
যাইতে যাইতে শ্যাষে শুকনা এক নদীর কিনারে
ডাক দিয়া ওঠে, ‘আগো, চেনা কেউ আছো কোনোখানে?’
আমি তো নিরালা মনে আছিলাম আমার সংসারে,
তার সেই ডাক, সেই কান্দনের আওয়াজটা কানে
যাইতেই দেখি য্যান একা আমি চৈতের পাথারে-
আমারে আমার সব নিদারুণ তীর হয়া হানে।
আমি তা্রে কি দিব উত্তর? তারে কোন কথা কই?
সে ক্যান আমারে ডাক দিয়া গেল, বুঝিনা ইয়াও।
আমি কি করবার পারি? কতটুকু ক্ষমতা আমার?
উপস্থিত মনে হয়, তারে আমি ডাক দিয়া লই,
ঝাপাইয়া ছিনতাই করি যমুনার ছিপছিপা নাও,
সকল ফালায়া দিয়া নিরুদ্দেশ সাথে যাই তার।।
১৮
এ কেমন শব্দ, এ কেমন কথার আদব?
কাতারে কাতার খাড়া, আমি তার ভেদ বুঝি নাই।
নিজের চিন্তার পাখি উড়ায়া যে দিমু কি তাজ্জব,
খানিক হুকুম মানে, তারপর বেবাক নাজাই।
শব্দের ভিতর থিকা মনে হয় শুনি কার স্বর,
একজন, দুইজন, দশজন, হাজার হাজার-
আমার মতন যারা ছিল এই মাটির উপর,
এখন কবরে গ্যাছে, করি আমি তাদেরই বাজার।
এরেই বন্ধন কয়? এর থিকা মুক্তি কারো নাই।
যখনি তোমার ভাষা আমি কই, তুমি ওঠো কয়া,
আমার মূর্তির মুখ আলগোছে বদলায়া দ্যাও।
যদিবা চেতনা পায়া কিছু করি হাতে লাগে ছ্যাও।
আসলে তোমার মতো এতখানি কেউ না নিদয়া,
যার দ্যাশ তার দ্যাশে চলে তার নিজের টাকাই।।
১৯
পথের উপরে এক বাজপড়া তালগাছ খাড়া,
পিছের জঙ্গল থিকা কুড়ালের শব্দ শোনা যায়,
যমুনার জলে দ্যাখে নাও তার নিজের চেহারা,
বাতাসের কোলে মাথা কুশালের ফসল ঘুমায়,
ধুলায় চক্কর দিয়া খেলা করে বিরান পাথার,
তুলার অনেকগুলা ফুল আটকা জিগার আঠায়,
দমের ভিতরে থামা বুকরঙ্গি মাছের কাতার,
আতখা বেবাক য্যান গিয়া পড়ছে অচিনঘাটায়।
আমিও সেবার এক সুনসানে গিয়া পড়ছিলাম-
য্যান সব টান দিয়া নিয়া গ্যাছে সে কার বারুন,
যেইদিকে চাই দেখি ভয়ানক নিঝুম নিথর,
নিয়া গ্যাছে নাম ধাম আর ইচ্ছার নায়ের বাদাম,
অঙ্গের কুসুম নিয়া খেলা করছে দুফর দারুণ,
যেদিন ফালায়া গেল আমারে সে আমার ভিতর।।
২০
কি কামে দুফর বেলা পাতাগুলা উড়ায় বাতাস?
আবার সে কার স্বর মাঠাপাড়ে ফোঁপায় এমন?
কি কামে আমার চক্ষে পড়ে খালি মানুষের লাশ?
যা দ্যাখার দেইখাছি, বাকি আছে আর কি দ্যাখন?
সময় দেখায়া গ্যাছে বাল্যকালে আমের সুঘ্রাণে?
যৈবন অন্যের হাতে য্যান এক কাচের বাসন,
দুঃখের পাখিরে আমি দেইখাছি বিয়ার বিহানে,
কিভাবে কালির লেখা হয়া যায় জলের লিখন।
আমারে ছাড়ান দিয়া যায় না সে যেখানেই যাই,
দ্যাশ কি বিদ্যাশ কও, চিনা কিংবা অচিনাই হও,
দুঃখের বাদাম তোলা সেই এক নাও সব গাঙ্গে।
পালায়া নিস্তার কই? সবখানে সেই না শানাই।
যেইখানেই যাই গিয়া, খাড়া দেখি সেই শও শও
পুরান মিস্তিরি- তারা মনোযোগ দিয়া সব ভাঙ্গে।।
২১
হাজার দক্ষিণ দিকে যাও তুমি গাঙ্গের মোহানা
পাও যদি কইও আমারে। আমি না অনেক দিন
আমার যৈবন আমি মোহানার খোঁজে না দিলাম,
তাও তারে দেখি নাই, শুনি আছে ধলা গাঙচিল,
মাছের পাহারা ঘেরা খিজিরের অতল আস্তানা,
আছে তার ইশারায় আগুনের দেহ এক জ্বীন-
যদি ইচ্ছা করে তার অসম্ভব নাই কোন কাম,
যারে না পাইতে পারি তারো সাথে দিতে পারে মিল।
তুমি যে মনের মতো ঘরে আছো এই কথা কও-
সেই ভাগ্য মনে হয় খিজিরের বিশেষ অছিলা।
আমার হিসাবে কয়- মানুষের সাধ্য নাই পায়।
যতই সাধনা কর, পরানের যত কাছে রও
সে জন দুরেই থাকে, তুমি থাকো যেখানে আছিলা।
আমার জানতে সাধ, মোহানায় গ্যাছে কোন নায়।।
২২
এক্কেরে আওয়াজ নাই, নদী খালি চাপড় দিতাছে
গেরামের পিঠে আর ফিসফাস কইতাছে, ‘ঘুম,
ঘুমারে এখনতরি সাতভাই পূর্বদিকে আছে।‘
এক ফোঁটা ঘুম যে আসে না তার আমি কি করুম?
অখনো খেজুরগাছে টুপটুপ রস পড়তে আছে,
এত যে কান্দন আছে- তয় চক্ষু ভেজে না কেমন?
ঘাটের যুগল নাও য্যান ঠোঁটে ঠোঁট দিয়া আছে,
আমার দক্ষিণ পাশে সরে নাই চান্দের গেরন।
আধান শীতলপাটি ভরা এক আমাবস্যা নিয়া
দেখি রোজ উত্তরের একদল ধলাহাঁস নামে,
বুকের ভিতরে চুপ, তারপর আতখা উড়াল-
এ দ্যাশে মানুষ নাই, অন্যখানে তাই যায় গিয়া।
এখানে কিসের বাড়ি? এত দ্রব্য আসে কোন কামে?
কেউ না দেখুক, তারা দেইখাছে দুঃখের কুড়াল।।
২৩
আমারে যেদিন তুমি ডাক দিলা তোমার ভাষায়
মনে হইল এ কোন পাখির দ্যাশে গিয়া পড়লাম,
এ কোন নদীর বুকে এতগুলা নায়ের বাদাম,
এত যে অচিন বৃক্ষ এতদিন আছিল কোথায়?
আমার সর্বাঙ্গে দেখি পাখিদের রাতির পালক,
নায়ের ভিতর থিকা ডাক দ্যায় আমারে ভুবন,
আমার শরীলে য্যান শুরু হয় বৃক্ষের রোপণ,
আসলে ভাষাই হইল একমাত্র ভাবের পালক।
তাই আমি অন্যখানে বহুদিন ছিলাম যদিও,
যেদিন আমারে তুমি ডাক দিলা নিরালা দুফর,
চক্ষের পলকে গেল পালটায়া পুরানা সে ঘর,
তার সাথে এতকাল আছিল যে ভাবের সাথীও।
এখন আমার ঠোঁটে শুনি আমি অন্য এক স্বর,
ভাষাই আপন করে আর সেই ভাষা করে পর।।
২৪
আবার তোমার কোলে ফিরা যায় তোমার সন্তান,
আবার তোমার কোলে, খালি কোল, উথলায়া পড়ে
দুধের ঘেরানে ভরা, জননী গো, পুন্নিমার চান-
আবার সে ঘরে ফিরা আইসাছে সারাদিন পরে।
আবার সে আইসাছে করালের ঘুম চক্ষে নিয়া,
চক্ষের ভিতরে তার গেরেপ্তার বিহানের সোনা,
তবনের নীল খোপে শিমুলের লাল রঙ নিয়া,
আবার সে আইসাছে, জননী গো, তুমি কাইন্দো না।
তোমার সন্তান গ্যাছে জননী গো, সে আমার না ভাই,
আমার দেহের থিকা একখানা কাটা গ্যাছে হাত,
উঠানে খাড়ায়া আছি, খুলবা না তোমার দুয়ার?
আমার মতন যারা হারায়াছে আইজ তার ভাই,
য্যান শিলাবিষ্টি শ্যাষে পরিস্কার আকাশ হঠাৎ ,
হাজার হাজার তারা ঘিরা আছে পুন্নিমা তোমার।।
২৫
কত না দুধের ক্ষীর খায়া গ্যাছে কালের গোপাল,
কতবার কত রোয়া কারবালা খ্যাতের খরায়,
কন না রঙিলা নাও নিয়া গ্যাছে কাল যমুনায়,
অঘোরে হারায়া গাভি ফেরে নাই নিজস্ব রাখাল।
কত না পুকুর দিতে পারে নাই পানি গ্রীষ্মকালে,
বাসকের ছাল কত ভালো করতে পারে নাই রোগ,
দেহের কত না রক্ত খায়া গ্যাছে কত ছিনাজোঁক,
কুসুম উধাও হয়া গ্যাছে কত শিমুলের ডালে।
তাই কি ছাড়ান দিমু বিহানের ধবল দোহান?
কামারের কাছে বান্ধা দিমু এই রূপার লাঙ্গল?
আমার বৃক্ষেরে তাই দিতে কমু জহরের ফল?
বাদ দিয়া দিমু কও পরানের গহীন কথন?
আমার তিস্তারে দেখি, সেও পোষ মানে না ভাটিতে,
কি তার উথাল নাচ গেরস্তের সমান মাটিতে!
২৬
ক্যান তুই গিয়াছিলি?- আমি তরে জিগামু অখন
চান্দের ভিতর ফের, যেইখানে জটিলতা বাড়ে,
অশথ জড়ায়া থাকে নদী নিয়া জলের কিনারে,
আমার গেরাম ঘিরা যেইখানে খালি পলায়ন-
মানুষের, মানুষের, আর তর চক্ষের কাজল,
যেইখানে মেলা দেয় একখান সুনসান নাও,
যে নায়ে সোয়ার নাই, ‘কেডা যাও, কেডা বায়া যাও?’
বেকল আছাড় দিয়া ওঠে কালা যমুনার জল?
কেউ নাই, কেউ তর নাই, তুই নিজেই জানস,
তবু ক্যান গিয়াছিলি? ক্যান তুই দিয়াছিলি ফাল?
কিসের কি বাদ্যে তর রক্ত করে উথাল পাথাল
আমারে ক’ দেখি তুই? ক’না দেখি, কি চিল মানস?
ল’যাই জলের ধারে দ্যাখ ছায়া আমার কি তর?
মানুষে মানুষে নাই কোনো ভেদ দুঃখের ভিতর।।
২৭
আউসের খ্যাতে মাঠে যুবতীরা দিতাছে সাঁতার,
দ্যাখো না কেমন তারা চিতলের মতো খেলা করে,
কি তারা তালাশ করে দিনমান নাগর ভাতার-
যারা ডুব দিয়া আছে এই ধান বানের সাগরে;
বিছনের মতো পড়ে তারাবাজি চুমার চুমার,
কি ঘাই আতখা মারে খলবল এই হাসে তারা
একজন দুইজন সাতজন নাকি বেশুমার
বুকের ভিতরে ভাঙ্গে নিশীথের শরমের পাড়া।
আমি যেই সেইখানে আচানক গিয়া পড়লাম
চক্ষের নিমেষে তারা নাই আর কোনোখানে নাই,
আমি যেই সেইখানে তোমারেনি খোঁজ করলাম-
কিছু না দেইখা নিজে বেয়াকুফ বড় শরমাই।
এই ছিল এই নাই, কই গেল, কই যার তারা?
বেমালুম কই তুমি যাও গিয়া খা’বের ইশারা?
২৮
ঝকঝক ঝকঝক সারাদিন করে আয়নাটা-
বুকে নাই ছবি নাই পড়ে নাই একখানা ছবি,
বেবাক একাকী য্যান সুনসান ইস্কুরুপে আঁটা,
যা চাই তা নাই তয় চমৎকার আছে আর সবি।
আছে সবি আছে এক মইষের শিঙ্গের চিরুনি,
রুমাল, চুলের ফিতা জবজবা এখনোনি ত্যালে।
বিবাহের বাসরে শ্যাষ য্যান গেছে সে ফিরুনি-
ফেরার আশাও নাই, ফেরা নাই একবার গ্যালে।
গেছে তো আমারে যদি বেরহম নিয়া যায় সাথে,
আমি তো এমন ঘরে বাস করি আশা করি নাই;
য্যান হাত দিয়া আছি ইন্দুরের বিষআলা ভাতে,
তবু তো ধরে না বিষ মুখে তুলি যত লোকমাই।
নিজেরও পড়ে না ছবিকাটা সেই আয়নায়,
সে নাই চেহারা নাই, খালি বড় খালি তড়পায়।।
২৯
তোমারে যে ভালোবাসে এর থিকা আরো পাঁচগুন
আল্লার কসম আমি দিমু তারে এই জামাখান,
আমার কলম আমি দিমু তারে, শরীলের খুন
দোয়াত ভরায়া দিমু, অনুরোধ খালি একখান-
সে য্যান আমার থিকা আরো ভালো পদ্য লেখে আর
যাদুমন্ত্রে রূপার শিকল হাতে দিতে পারে তার।
তোমারে যে ভালোবাসে এর থিকা আরো দশগুন
আল্লার কসম আমি দিমু তারে এই বাড়িখান,
আমার উঠান আমি দিমু তারে, শীতের আগুন-
নিজেই সাজায়া দিমু, অনুরোধ খালি একখান-
সে য্যান আমার থিকা আরো ভালো নিদ্রা যায় আর
তারেই নিকটে পায় কথা যার নিকটে থাকার।
নচেৎ নষ্টামি জানি, যদি পাছ না ছাড়ে আমার,
গাঙ্গেতে চুবান দিয়া তারে আমি শুকাবো আবার।।
৩০
আরে ও ইসের বেটি, চুলে দিয়া শিমুলের ফুল
যাস কই, কই যাস? যুবকের মাঝখান দিয়া?
মানুষ গাঙ্গের মতো, বানে ভাসে তারো দুই কুল-
সে পানি কাতান বড়, খলবল রঙ তার সিয়া।
আরে থাম, কই যাস? তবু যায় ঘুরনান দিয়া?
শিমুল যতই লাল সেই লাল তবু কিছু কম
যত লাল যেইখানে দেহ তর লুকায় শরম।
খাড়া না করুক দেখি একবার কেউ তরে বিয়া।
বেবাক পানির টান সেইকালে নরোম সোঁতায়,
তখন পরীর রানী সেও কিনা অতি বাধ্য বশ,
তখন দেখিনা তুই আইলের বেড়া নি ভাঙ্গস,
তখন শরম দেখি থাকে তর কেমন কোথায়?
নষ্ট তর পায়ে পায়ে স্বন্নলতা আনন্তের মূল,
দিবিনে তখন তুই সিঙ্গারের আসল মাশুল।।
৩১
কে করে পরশ তার জীবনের এত জটিলতা?
তোমার অধিক টান দেয় বৃক্ষ দেয় বিষলতা;
একবার আমারে আছাড় দিয়া সোজা করে ফের,
আমারই মতন যারা বেশুমার সন্তান মায়ের।
কিসে যে চালনা করে এই দেহ এই ভবিষ্যৎ-
কিছুই বুঝি না, দেখি আচানক শেষ হয় পথ;
যে পথেই মেলা দেই সেই পথে ভয়ানক ভুত-
এ বড় কঠিন জাগা, বসবাস বড়ই অদ্ভুত।
তয় কি ছাড়ান দিমু হাতে ধরা শেষ রশিখান?
তয় কি পাথারে দিমু হাতে ধরা বেঘোরে পরান?
নাকি তুমি একবার হাত দিয়া ডাক দিবা কাছে
আমারেও আমার মতন যারা একা একা আছে,
সকলেরে একজোট কইরা নি তুলবা আবার?
তোমার নিকটে রাখি নিদানের এই দরবার।।
৩২
নিঝুম জঙ্গল দিয়া যাইতেই ধনেশের ডাক।
যেমন আতখা ভাঙ্গে কাঠুরার বুকের কাছাড়
চক্ষের পলকে তুমি দেখা দিয়া করো মেছমার;
রতির আগুনে সব দাউদাউ, পরিণামে খাক
আমার এ দেহ বটে, ভবিষ্যৎ পায় না নিস্তার;
সকল কিছুর পরে দ্যাও তুমি উড়ায়া বাদাম,
তীরের মতন তারা ধায়া যায় কও কোন ধাম?
বরং তোমার থিকা দয়াবতী জোয়ার নিস্তার।
তবুও আবার আমি ধনেশের মতো দিয়া ডাক
আবার পাথার বন পথ ঘাট বাজার সংসার
তালাশ করুম আর গাভীনের করুম সন্ধান,
আবার দেখুম আমি ছাই-পোকা মাজরার ঝাঁক
কিভাবে আমার খ্যাত করে সব শস্য ছারখার,
আবারো বুনুম আমি এই খ্যাতে কাউনের ধান।।
৩৩
এমন বৃক্ষ কি নাই ডালে যার নাই কোন পরী,
এমন নদী কি নাই জলে যার পড়ে না চেহারা,
এমন যাত্রা কি নাই যাতে নাই পবনের তরী,
এমন ডুলি কি নাই যাতে নাই নিষেধের ঘেরা,
এমন নারী কি নাই বুকে যার নাই ভালোবাসা,
এমন পত্র কি নাই বাক্যে যার নাই নিরাময়,
এমন শস্য কি নাই যার বীজ বোনে নাই চাষা,
এমন মৃত্যু কি নাই যাতে নাই খোয়াবের লয়?
এমন কি রূপ আছে রূপ যার গড়ে না কুমার,
এমন কি দেখা আছে দেখা যার চোখে না কুলায়,
এমন কি কথা আছে কথা যার থাকে না ধুলায়,
এমন কি নেশা আছে নেশা যার অধিক চুমার?
পরানে পরান যদি এই মতো হাজার সোয়াল
সারাদিন যমুনায় খলবল বিতল বোয়াল।।
নোট বই থেকে – সৈয়দ শামসুল হক
একদিন দুপুর-রোদ্দুরে তুমি নিয়ে এলে একখণ্ড নীল-
তোমার সূতির শাড়ি, সমুদ্রের সাথে যার অনিবার্য মিল;
আয়োজনে সে যেমন ঘিরে আছে পৃথিবীকে, শাড়িও তোমাকে
জীবনের বিপুল রহস্যগুলো সমুদ্রই চুরি করে রাখে।
আরো একজন – সৈয়দ শামসুল হক
যেখানেই যাও তুমি, যেখানেই যাও
সঙ্গে যায় আরো একজন;
যদিও অদূরে তবু তার দূরত্ব ভীষণ।
যেখানেই দৃষ্টি দাও, যেখানেই দাও
দৃষ্টি দেয় আরো একজন;
যদিও সুনীল তবু সেখানেই মেঘের গড়ন।
যাকেই যে কথা বলো, যাকেই যে কথা
শুনে যায় আরো একজন;
যদিও নিশ্চুপ তবু অবিরাম পদ্মার ভাঙন।
যেখানেই রাখো হাত, যেখানেই রাখো
রাখে হাত আরো একজন;
যদিও নিশ্চল তবু দ্রুত তার শিরায় স্পন্দন।
যখন শয্যায় তুমি, যখন শয্যায়
পাশে আছে আরো একজন;
যদিও ঘনিষ্ঠ তবু ঘুম কেড়ে নিয়েছে কখন।
তুমি কি দেখেছো তাকে ? চেনো তাকে ?
সচকিত মাঝে মাঝে তাই ?
তোমার সম্মুখে তবে আমি এসে আবার দাঁড়াই ?
যদি নির্বাসন দাও – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
যদি নির্বাসন দাও, আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরী ছোঁয়াবো
আমি বিষপান করে মরে যাবো ।
বিষন্ন আলোয় এই বাংলাদেশ
নদীর শিয়রে ঝুঁকে পড়া মেঘ
প্রান্তরে দিগন্ত নির্নিমেষ-
এ আমারই সাড়ে তিন হাত ভূম
যদি নির্বাসন দাও, আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরী ছোঁয়াবো
আমি বিষপান করে মরে যাবো ।
ধানক্ষেতে চাপ চাপ রক্ত
এইখানে ঝরেছিল মানুষের ঘাম
এখনো স্নানের আগে কেউ কেউ করে থাকে নদীকে প্রণাম
এখনো নদীর বুকে
মোচার খোলায় ঘুরে
লুঠেরা, ফেরারী ।
শহরে বন্দরে এত অগ্নি-বৃষ্টি
বৃষ্টিতে চিক্কণ তবু এক একটি অপরূপ ভোর,
বাজারে ক্রুরতা, গ্রামে রণহিংসা
বাতাবি লেবুর গাছে জোনাকির ঝিকমিক খেলা
বিশাল প্রাসাদে বসে কাপুরুষতার মেলা
বুলেট ও বিস্পোরণ
শঠ তঞ্চকের এত ছদ্মবেশ
রাত্রির শিশিরে কাঁপে ঘাস ফুল–
এ আমারই সাড়ে তিন হাত ভূমি
যদি নির্বাসন দাও, আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরী ছোঁয়াবো
আমি বিষপান করে মরে যাবো ।
কুয়াশার মধ্যে এক শিশু যায় ভোরের ইস্কুলে
নিথর দীঘির পারে বসে আছে বক
আমি কি ভুলেছি সব
স্মৃতি, তুমি এত প্রতারক ?
আমি কি দেখিনি কোন মন্থর বিকেলে
শিমুল তুলার ওড়াওড়ি ?
মোষের ঘাড়ের মতো পরিশ্রমী মানুষের পাশে
শিউলি ফুলের মতো বালিকার হাসি
নিইনি কি খেজুর রসের ঘ্রাণ
শুনিনি কি দুপুরে চিলের
তীক্ষ্ণ স্বর ?
বিষন্ন আলোয় এই বাংলাদেশ…
এ আমারই সাড়ে তিন হাত ভূমি
যদি নির্বাসন দাও, আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরী ছোঁয়াবো
আমি বিষপান করে মরে যাবো… ।
কেউ কথা রাখেনি – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর কাটলো, কেউ কথা রাখেনি
ছেলেবেলায় এক বোষ্টুমী তার আগমনী গান হঠাৎ থামিয়ে বলেছিল
শুক্লা দ্বাদশীর দিন অন্তরাটুকু শুনিয়ে যাবে
তারপর কত চন্দ্রভূক অমাবস্যা চলে গেলো, কিন্তু সেই বোষ্টুমী
আর এলোনা
পঁচিশ বছর প্রতিক্ষায় আছি।
মামা বাড়ির মাঝি নাদের আলী বলেছিল, বড় হও দাদাঠাকুর
তোমাকে আমি তিন প্রহরের বিল দেখাতে নিয়ে যাবো
সেখানে পদ্মফুলের মাথায় সাপ আর ভ্রমর
খেলা করে!
নাদের আলী, আমি আর কত বড় হবো? আমার মাথা এ ঘরের ছাদ
ফুঁড়ে আকাশ স্পর্শ করলে তারপর তুমি আমায়
তিন প্রহরের বিল দেখাবে?
একটাও রয়্যাল গুলি কিনতে পারিনি কখনো
লাঠি-লজেন্স দেখিয়ে দেখিয়ে চুষেছে লস্করবাড়ির ছেলেরা
ভিখারীর মতন চৌধুরীদের গেটে দাঁড়িয়ে দেখেছি
ভিতরে রাস-উৎসব
অবিরল রঙের ধারার মধ্যে সুবর্ণ কঙ্কণ পরা ফর্সা রমণীরা
কত রকম আমোদে হেসেছে
আমার দিকে তারা ফিরেও চায়নি!
বাবা আমার কাঁধ ছুঁয়ে বলেছিলেন, দেখিস, একদিন, আমরাও…
বাবা এখন অন্ধ, আমাদের দেখা হয়নি কিছুই
সেই রয়্যাল গুলি, সেই লাঠি-লজেন্স, সেই রাস-উৎসব
আমায় কেউ ফিরিয়ে দেবেনা!
বুকের মধ্যে সুগন্ধি রুমাল রেখে বরুণা বলেছিল,
যেদিন আমায় সত্যিকারের ভালবাসবে
সেদিন আমার বুকেও এ-রকম আতরের গন্ধ হবে!
ভালোবাসার জন্য আমি হাতের মুঠেয়ে প্রাণ নিয়েছি
দূরন্ত ষাঁড়ের চোখে বেঁধেছি লাল কাপড়
বিশ্বসংসার তন্ন তন্ন করে খুঁজে এনেছি ১০৮টা নীল পদ্ম
তবু কথা রাখেনি বরুণা, এখন তার বুকে শুধুই মাংসের গন্ধ
এখনো সে যে-কোনো নারী।
কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর কাটল, কেউ কথা রাখে না!
সত্যবদ্ধ অভিমান – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
এই হাত ছুঁয়েছে নীরার মুখ
আমি কি এ হাতে কোনো পাপ করতে পারি ?
শেষ বিকেলের সেই ঝুল বারান্দায়
তার মুখে পড়েছিল দুর্দান্ত সাহসী এক আলো
যেন এক টেলিগ্রাম, মুহূর্তে উন্মুক্ত করে
নীরার সুষমা
চোখে ও ভুরুতে মেশা হাসি, নাকি অভ্রবিন্দু ?
তখন সে যুবতীকে খুকি বলে ডাকতে ইচ্ছে হয়–
আমি ডান হাত তুলি, পুরুষ পাঞ্জার দিকে
মনে মনে বলি,
যোগ্য হও, যোগ্য হয়ে ওঠো–
ছুঁয়ে দিই নীরার চিবুক
এই হাত ছুঁয়েছে নীরার মুখ
আমি কি এ হাতে আর কোনোদিন
পাপ করতে পারি ?
এই ওষ্ঠ বলেছে নীরাকে, ভালোবাসি–
এই ওষ্ঠে আর কোনো মিথ্যে কি মানায় ?
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে মনে পড়ে ভীষণ জরুরী
কথাটাই বলা হয়নি
লঘু মরালীর মতো নারীটিকে নিয়ে যাবে বিদেশী বাতাস
আকস্মিক ভূমিকম্পে ভেঙ্গে যাবে সবগুলো সিঁড়ি
থমকে দাঁড়িয়ে আমি নীরার চোখের দিকে….
ভালোবাসা এক তীব্র অঙ্গীকার, যেন মায়াপাশ
সত্যবদ্ধ অভিমান–চোখ জ্বালা করে ওঠে,
সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে
এই ওষ্ঠ বলেছে নীরাকে, ভালোবাসি–
এই ওষ্ঠে আর কোনো মিথ্যে কি মানায় ?
সেদিন বিকেলবেলা – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
সাতশো একান্নতম আনন্দটি পেয়েছি সেদিন
যখন বিকেলবেলা মেঘ এসে
ঝুঁকে পড়েছিল
গোলাপ বাগানে
এবং তোমার পায়ে ফুটে গেল লক্ষ্মীছাড়া কাঁটা!
তখন বাতাসে ছিল বিহ্্লতা, তখন আকাশে
ছিল কৃষ্ণক্লান্তি আলো,
ছিল না রঙের কোলাহল
ছিল না নিষেধ-
অতটুকা ওষ্ঠ থিকে অতখানি হাসির ফোয়ারা
মন্দিরের ভাস্কর্যকে ম্লান করে নতুন দৃুশ্যটি।
এর পরই বৃষ্টি আসে সাতশো বাহান্ন সঙ্গে নিয়ে
করমচা রঙের হাত, চিবুকের রেখা
চোখে চোখ
গোলাপ সৌরভ মেশা প্রতিটি নি:শ্বাস, যত্ন করে
জমিয়ে রাখার মতো-
সম্প্রতি ওল্টানো পদতলে
এত মায়া, বায়ু ধায় ন’শো ঊনপঞ্চাশের দিকে
নগ্ন প্রকৃতির
এত কাছাকাছি আর কখনো আসি নি মনে হয়
জীবন্ত কাঁটার কাছে হেরে যায় গোপন ঈশ্বর
রূপের সহস্র ছবি, বা আনন্দ একটি শরীরে?
নীরার অসুখ– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
নীরার অসুখ হলে কলকাতার সবাই বড় দুঃখে থাকে
সূর্য নিভে গেলে পর, নিয়নের বাতিগুলি হঠাৎ জ্বলার আগে জেনে নেয়
নীরা আজ ভালো আছে?
গীর্জার বয়স্ক ঘড়ি, দোকানের রক্তিম লাবণ্য–ওরা জানে
নীরা আজ ভালো আছে!
অফিস সিনেমা পার্কে লক্ষ লক্ষ মানুষের মুখে মুখে রটে যায়
নীরার খবর
বকুলমালার তীব্র গন্ধ এসে বলে দেয়, নীরা আজ খুশি
হঠাৎ উদাস হাওয়া এলোমেলো পাগ্লা ঘন্টি বাজিয়ে আকাশ জুড়ে
খেলা শুরু করলে
কলকাতার সব লোক মৃদু হাস্যে জেনে নেয়, নীরা আজ বেড়াতে গিয়েছে।
আকাশে যখন মেঘ, ছায়াচ্ছন্ন গুমোট নগরে খুব দুঃখ বোধ।
হঠাৎ ট্রামের পেটে ট্যাক্সি ঢুকে নিরানন্দ জ্যাম চৌরাস্তায়
রেস্তোরাঁয় পথে পথে মানুষের মুখ কালো, বিরক্ত মুখোস
সমস্ত কলকাতা জুড়ে ক্রোধ আর ধর্মঘট, শুরু হবে লণ্ডভণ্ড
টেলিফোন পোস্টাফিসে আগুন জ্বালিয়ে
যে-যার নিজস্ব হৃৎস্পন্দনেও হরতাল জানাবে–
আমি ভয়ে কেঁপে উঠি, আমি জানি, আমি তৎক্ষণাৎ ছুটে যাই, গিয়ে বলি,
নীরা, তুমি মন খারাপ করে আছো?
লক্ষ্মী মেয়ে, একবার চোখে দাও, আয়না দেখার মতো দেখাও ও-মুখের মঞ্জরী
নবীন জনের মতো কলহাস্যে একবার বলো দেখি ধাঁধার উত্তর!
অমনি আড়াল সরে, বৃষ্টি নামে, মানুষেরা সিনেমা ও খেলা দেখতে
চলে যায় স্বস্তিময় মুখে
ট্রাফিকের গিঁট খোলে, সাইকেলের সঙ্গে টেম্পো, মোটরের সঙ্গে রিক্সা
মিলেমিশে বাড়ি ফেরে যা-যার রাস্তায়
সিগারেট ঠোঁটে চেপে কেউ কেউ বলে ওঠে, বেঁচে থাকা নেহাৎ মন্দ না!
কাজলা দিদি- যতীন্দ্রমোহন বাগচী
বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই,
মাগো আমার শোলক-বলা কাজলা দিদি কই?
পুকুর ধারে লেবুর তলে থোকায় থোকায় জোনাক জ্বলে
ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না একলা জেগে রই-
মাগো আমার কোলের কাছে কাজলা দিদি কই?
সেদিন হতে কেন মা আর দিদিরে না ডাকো;-
দিদির কথায় আঁচল দিয়ে মুখটি কেন ঢাকো?
খাবার খেতে আসি যখন, দিদি বলে ডাকি তখন,
ওঘর থেকে কেন মা আর দিদি আসে নাকো?
আমি ডাকি তুমি কেন চুপটি করে থাকো?
বল মা দিদি কোথায় গেছে, আসবে আবার কবে?
কাল যে আমার নতুন ঘরে পুতুল-বিয়ে হবে!
দিদির মত ফাঁকি দিয়ে, আমিও যদি লুকাই গিয়ে
তুমি তখন একলা ঘরে কেমন করে রবে,
আমিও নাই-দিদিও নাই- কেমন মজা হবে।
ভুঁই চাপাতে ভরে গেছে শিউলি গাছের তল,
মাড়াস্ নে মা পুকুর থেকে আনবি যখন জল।
ডালিম গাছের ফাঁকে ফাঁকে বুলবুলিটি লুকিয়ে থাকে,
উড়িয়ে তুমি দিও না মা, ছিঁড়তে গিয়ে ফল,-
দিদি এসে শুনবে যখন, বলবি কি মা বল!
বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই-
এমন সময় মাগো আমার কাজলা দিদি কই?
লেবুর ধারে পুকুর পাড়ে ঝিঁঝিঁ ডাকে ঝোপে ঝাড়ে’
ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না, তাইতো জেগে রই
রাত্রি হলো মাগো আমার কাজলা দিদি কই?
উলঙ্গ রাজা-নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
সবাই দেখছে যে, রাজা উলঙ্গ, তবুও
সবাই হাততালি দিচ্ছে।
সবাই চেঁচিয়ে বলছে; শাবাশ, শাবাশ!
কারও মনে সংস্কার, কারও ভয়;
কেউ-বা নিজের বুদ্ধি অন্য মানুষের কাছে বন্ধক দিয়েছে;
কেউ-বা পরান্নভোজী, কেউ
কৃপাপ্রার্থী, উমেদার, প্রবঞ্চক;
কেউ ভাবছে, রাজবস্ত্র সত্যিই অতীব সূক্ষ্ম , চোখে
পড়ছে না যদিও, তবু আছে,
অন্তত থাকাটা কিছু অসম্ভব নয়।
গল্পটা সবাই জানে।
কিন্তু সেই গল্পের ভিতরে
শুধুই প্রশস্তিবাক্য-উচ্চারক কিছু
আপাদমস্তক ভিতু, ফন্দিবাজ অথবা নির্বোধ
স্তাবক ছিল না।
একটি শিশুও ছিল।
সত্যবাদী, সরল, সাহসী একটি শিশু।
নেমেছে গল্পের রাজা বাস্তবের প্রকাশ্য রাস্তায়।
আবার হাততালি উঠছে মুহুর্মুহু;
জমে উঠছে
স্তাবকবৃন্দের ভিড়।
কিন্তু সেই শিশুটিকে আমি
ভিড়ের ভিতরে আজ কোথাও দেখছি না।
শিশুটি কোথায় গেল? কেউ কি কোথাও তাকে কোনো
পাহাড়ের গোপন গুহায়
লুকিয়ে রেখেছে?
নাকি সে পাথর-ঘাস-মাটি নিয়ে খেলতে খেলতে
ঘুমিয়ে পড়েছে
কোনো দূর
নির্জন নদীর ধারে, কিংবা কোনো প্রান্তরের গাছের ছায়ায়?
যাও, তাকে যেমন করেই হোক
খুঁজে আনো।
সে এসে একবার এই উলঙ্গ রাজার সামনে
নির্ভয়ে দাঁড়াক।
সে এসে একবার এই হাততালির ঊর্ধ্বে গলা তুলে
জিজ্ঞাসা করুক:
রাজা, তোর কাপড় কোথায়?
অমলকান্তি – নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
অমলকান্তি আমার বন্ধু,
ইস্কুলে আমরা একসঙ্গে পড়তাম।
রোজ দেরি করে ক্লাসে আসতো, পড়া পারত না,
শব্দরূপ জিজ্ঞেস করলে
এমন অবাক হয়ে জানলার দিকে তাকিয়ে থাকতো যে,
দেখে ভারী কষ্ট হত আমাদের।
আমরা কেউ মাষ্টার হতে চেয়েছিলাম, কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল।
অমলকান্তি সে-সব কিছু হতে চায়নি।
সে রোদ্দুর হতে চেয়েছিল!
ক্ষান্তবর্ষণ কাক-ডাকা বিকেলের সেই লাজুক রোদ্দুর,
জাম আর জামরুলের পাতায়
যা নাকি অল্প-একটু হাসির মতন লেগে থাকে।
আমরা কেউ মাষ্টার হয়েছি, কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল।
অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারেনি।
সে এখন অন্ধকার একটা ছাপাখানায় কাজ করে।
মাঝে মধ্যে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে;
চা খায়, এটা-ওটা গল্প করে, তারপর বলে, “উঠি তাহলে।”
আমি ওকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি।
আমাদের মধ্যে যে এখন মাষ্টারি করে,
অনায়াসে সে ডাক্তার হতে পারত,
যে ডাক্তার হতে চেয়েছিল,
উকিল হলে তার এমন কিছু ক্ষতি হত না।
অথচ, সকলেরই ইচ্ছেপূরণ হল, এক অমলকান্তি ছাড়া।
অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারেনি।
সেই অমলকান্তি–রোদ্দুরের কথা ভাবতে-ভাবতে
ভাবতে-ভাবতে
যে একদিন রোদ্দুর হতে চেয়েছিল।
মাটির হাতে - নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
এ কোন্ যন্ত্রণা দিবসে, আর
এ কোন্ যন্ত্রণা রাতে;
আকাশী স্বপ্ন সে ছুঁয়েছে তার
মাটিতে গড়া দুই হাতে।
বোঝেনি, রাত্রির ঝোড়ো হাওয়ায়
যখন চলে মাতামাতি,
জ্বলতে নেই কোনো আকাঙ্ক্ষায়
জ্বালাতে নেই মোমবাতি।
ভেবেছে, সবখানে খোলা দুয়ার
দ্যাখেনি দেয়ালের লেখা;
এবং বোঝেনি যে বারান্দার
ধারেই তার সীমারেখা।
তবু সে গিয়েছিল বারান্দায়,
কাঁপেনি তবু তার বুক;
তবু সে মোমবাতি জ্বেলেছে, হায়,
দেখেছে আকাশের মুখ।
এখন যন্ত্রণা দিবসে, আর
এখন যন্ত্রণা রাতে।
আকাশী স্বপ্ন সে ছুঁয়েছে তার
মাটিতে গড়া দুই হাতে।
নত হও, কুর্নিশ করো-রফিক আজাদ
“হে কলম, উদ্ধত হ’য়ো না, নত হও, নত হতে শেখো,
তোমার উদ্ধত আচরনে চেয়ে দ্যাখো, কী যে দু:খ
পেয়েছেন ভদ্রমহোদয়গণ,
অতএব, নত হও, বিনীত ভঙিতে করজোড়ে
ক্ষমা চাও, পায়ে পড়ো, বলো: কদ্যপি এমনটি হবে না, স্যার,
বলো: মধ্যবিত্ত হে বাঙালী ভদ্রমহোদয়গণ,
এবারকার মতো ক্ষমা করে দিন…
বলো হে কলম, হে বলপেন, হে আমার বর্বর প্রকাশ-ভঙিমা-
এই নাকে খত দিচ্ছি আর কখনো গালমন্দ পারবো না,
আপনাদের ভন্ডামিকে শ্রদ্ধা করতে শিখবো,
আপনাদের অপমান হজম করার অপরিসীম ক্ষমতাকে সম্মান করবো,
আর কোনদিন এমনটি হবে না, হে মহামান্য মধ্যবিত্ত রুচিবোধ,
আপনাদের মতো সব অপমান হ’জম করে, এখন থেকে,
নাইট সয়েল বানিয়ে ফেলে দেবো শরীরের বাইরে-
হে বন্য লেখনী, হে অমোচনীয় কালি, হে ইতর বলপেন,
নত হও, নত হতে শেখ..
শান্ত হও, ভদ্র হও ভদ্রলোকের মতো
আড়াল করতে শেখো অপ্রিয় সত্যকে,
প্রিয় মিথ্যা বলা শিখে নাও, বিক্রি করে দাও তোমার বিবেক-
উচ্চারন কোরো না এমন শব্দ, যা শুনে আহত হবেন তাঁরা-
নত হও, নত হ’তে শেখ;
তোমার পেছনে রয়েছে যে পবিত্র বর্বর মন ও মস্তিস্ক
তাকে অনুগত দাসে পরিণত হ’তে বলো,
হে আমার অবাধ্য কলম, ক্রোধ সংবরণ করো,
ভদ্রলোকের মতো লেখো, ভদ্রলোকদের দ্বারে ধর্না দিও-
শিখে নাও সাজানো-গোছানো প্রভুপ্রিয় বাক্যাবলি…
হে কলম, এইবার নত হও, নতজানু হও,
কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প – রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ
তাঁর চোখ বাঁধা হলো।
বুটের প্রথম লাথি রক্তাক্ত করলো তার মুখ।
থ্যাতলানো ঠোঁটজোড়া লালা-রক্তে একাকার হলো,
জিভ নাড়তেই দুটো ভাঙা দাঁত ঝরে পড়লো কংক্রিটে।
মা…..মাগো….. চেঁচিয়ে উঠলো সে।
পাঁচশো পঞ্চান্ন মার্কা আধ-খাওয়া একটা সিগারেট
প্রথমে স্পর্শ করলো তার বুক।
পোড়া মাংসের উৎকট গন্ধ ছড়িয়ে পড়লো ঘরের বাতাসে।
জ্বলন্ত সিগারেটের স্পর্শ
তার দেহে টসটসে আঙুরের মতো ফোস্কা তুলতে লাগলো।
দ্বিতীয় লাথিতে ধনুকের মতো বাঁকা হয়ে গেলো দেহ,
এবার সে চিৎকার করতে পারলো না।
তাকে চিৎ করা হলো।
পেটের ওপর উঠে এলো দু’জোড়া বুট, কালো ও কর্কশ।
কারণ সে তার পাকস্থলির কষ্টের কথা বলেছিলো,
বলেছিলো অনাহার ও ক্ষুধার কথা।
সে তার দেহের বস্ত্রহীনতার কথা বলেছিলো-
বুঝি সে-কারণে
ফর ফর করে টেনে ছিঁড়ে নেয়া হলো তার শার্ট।
প্যান্ট খোলা হলো। সে এখন বিবস্ত্র, বীভৎস।
তার দুটো হাত-
মুষ্টিবদ্ধ যে-হাত মিছিলে পতাকার মতো উড়েছে সক্রোধে,
যে-হাতে সে পোস্টার সেঁটেছে, বিলিয়েছে লিফলেট,
লোহার হাতুড়ি দিয়ে সেই হাত ভাঙা হলো।
সেই জীবন্ত হাত, জীবন্ত মানুষের হাত।
তার দশটি আঙুল-
যে-আঙুলে ছুঁয়েছে সে মার মুখ, ভায়ের শরীর,
প্রেয়সীর চিবুকের তিল।
যে-আঙুলে ছুঁয়েছে সে সাম্যমন্ত্রে দীক্ষিত সাথীর হাত,
স্বপ্নবান হাতিয়ার,
বাটখারা দিয়ে সে-আঙুল পেষা হলো।
সেই জীবন্ত আঙুল, মানুষের জীবন্ত উপমা।
লোহার সাঁড়াশি দিয়ে,
একটি একটি করে উপড়ে নেয়া হলো তার নির্দোষ নখগুলো।
কী চমৎকার লাল রক্তের রঙ।
সে এখন মৃত।
তার শরীর ঘিরে থোকা থোকা কৃষ্ণচূড়ার মতো
ছড়িয়ে রয়েছে রক্ত, তাজা লাল রক্ত।
তার থ্যাতলানো একখানা হাত
পড়ে আছে এদেশের মানচিত্রের ওপর,
আর সে হাত থেকে ঝরে পড়ছে রক্তের দুর্বিনীত লাভা-
গুচ্ছ কবিতা- রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
১.
থাকুক তোমার একটু স্মৃতি থাকুক
একলা থাকার খুব দুপুরে
একটি ঘুঘু ডাকুক
২.
দিচ্ছো ভীষণ যন্ত্রণা
বুঝতে কেন পাছো না ছাই
মানুষ আমি, যন্ত্র না!
৩.
চোখ কেড়েছে চোখ
উড়িয়ে দিলাম ঝরা পাতার শোক।
তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা – শহীদ কাদরী
ভয় নেই
আমি এমন ব্যবস্থা করবো যাতে সেনাবাহিনী
গোলাপের গুচ্ছ কাঁধে নিয়ে
মার্চপাস্ট করে চলে যাবে
এবং স্যালুট করবে
কেবল তোমাকে প্রিয়তমা।
ভয় নেই, আমি এমন ব্যবস্থা করবো
বন-বাদাড় ডিঙ্গিয়ে
কাঁটা-তার, ব্যারিকেড পার হয়ে, অনেক রণাঙ্গনের স্মৃতি নিয়ে
আর্মার্ড-কারগুলো এসে দাঁড়াবে
ভায়োলিন বোঝাই করে
কেবল তোমার দোরগোড়ায় প্রিয়তমা।
ভয় নেই, আমি এমন ব্যবস্থা করবো-
বি-৫২ আর মিগ-২১গুলো
মাথার ওপর গোঁ-গোঁ করবে
ভয় নেই, আমি এমন ব্যবস্থা করবো
চকোলেট, টফি আর লজেন্সগুলো
প্যারাট্রুপারদের মতো ঝরে পড়বে
কেবল তোমার উঠোনে প্রিয়তমা।
ভয় নেই…আমি এমন ব্যবস্থা করবো
একজন কবি কমান্ড করবেন বঙ্গোপসাগরের সবগুলো রণতরী
এবং আসন্ন নির্বাচনে সমরমন্ত্রীর সঙ্গে প্রতিযোগিতায়
সবগুলো গণভোট পাবেন একজন প্রেমিক, প্রিয়তমা!
সংঘর্ষের সব সম্ভাবনা, ঠিক জেনো, শেষ হবে যাবে-
আমি এমন ব্যবস্থা করবো, একজন গায়ক
অনায়াসে বিরোধীদলের অধিনায়ক হয়ে যাবেন
সীমান্তের ট্রেঞ্চগুলোয় পাহারা দেবে সারাটা বৎসর
লাল নীল সোনালি মাছি-
ভালোবাসার চোরাচালান ছাড়া সবকিছু নিষিদ্ধ হয়ে যাবে, প্রিয়তমা।
ভয় নেই আমি এমন ব্যবস্থা করবো মুদ্রাস্ফীতি কমে গিয়ে বেড়ে যাবে
শিল্পোত্তীর্ণ কবিতার সংখ্যা প্রতিদিন
আমি এমন ব্যবস্থা করবো গণরোষের বদলে
গণচুম্বনের ভয়ে
হন্তারকের হাত থেকে পড়ে যাবে ছুরি, প্রিয়তমা।
ভয় নেই,
আমি এমন ব্যবস্থা করবো
শীতের পার্কের ওপর বসন্তের সংগোপন আক্রমণের মতো
অ্যাকর্ডিয়ান বাজাতে-বাজাতে বিপ্লবীরা দাঁড়াবে শহরে,
ভয় নেই, আমি এমন ব্যবস্থা করবো
স্টেটব্যাংকে গিয়ে
গোলাপ কিম্বা চন্দ্রমল্লিকা ভাঙালে অন্তত চার লক্ষ টাকা পাওয়া যাবে
একটি বেলফুল দিলে চারটি কার্ডিগান।
ভয় নেই, ভয় নেই
ভয় নেই,
আমি এমন ব্যবস্থা করবো
নৌ, বিমান আর পদাতিক বাহিনী
কেবল তোমাকেই চতুর্দিক থেকে ঘিরে-ঘিরে
নিশিদিন অভিবাদন করবে, প্রিয়তমা।
কৃতজ্ঞতাঃ কবিতা সংক্রান্ত কয়েকটি ওয়েবসাইটের কাছে ।
১৮ ই মে, ২০১৫ সকাল ১০:২২
আলোরিকা বলেছেন: ধন্যবাদ ....... :-)
২| ১৪ ই মে, ২০১৫ বিকাল ৫:৪৪
মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম জসিম বলেছেন: অনেকটা পড়তে আমার খুব ভালো লেগেছে
১৮ ই মে, ২০১৫ সকাল ১০:২৪
আলোরিকা বলেছেন: ধন্যবাদ পড়ার জন্য ...... :-)
৩| ১৪ ই মে, ২০১৫ রাত ৯:২০
দীপংকর চন্দ বলেছেন: প্রিয়তে থাকলো।
আপাতত নবারুণ ভট্টাচার্য।
এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না
এই জল্লাদের উল্লাসমঞ্চ আমার দেশ না
এই বিস্তীর্ণ শ্মশান আমার দেশ না
এই রক্তস্নাত কসাইখানা আমার দেশ না
অনিঃশেষ শুভকামনা।
ভালো থাকবেন। সবসময়। অনেক।
১৮ ই মে, ২০১৫ সকাল ১০:২৬
আলোরিকা বলেছেন: ধন্যবাদ ..... ভাল থাকবেন ..... :-)
৪| ১৫ ই মে, ২০১৫ দুপুর ১:৩১
রূপা কর বলেছেন: নির্মলেন্দু গুণ প্রিয় কবি +++++্
১৮ ই মে, ২০১৫ সকাল ১০:২৮
আলোরিকা বলেছেন: ধন্যবাদ ..... +
©somewhere in net ltd.
১|
১৪ ই মে, ২০১৫ দুপুর ২:০৭
মনিরা সুলতানা বলেছেন: অনেক গুলি প্রিয় কবিতা এক সাথে .।
প্রিয়তে নিলাম