![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
যদিও সন্ধ্যা আসিছে মন্দ মন্থরে ,সব সংগীত গেছে ইংগিতে থামিয়া - তবু বিহঙ্গ ওরে বিহঙ্গ মোর এখনি অন্ধ বন্ধ করনা পাখা-----
ছেলেবেলায় বড় বোনের চয়নিকা বই থেকে পড়া ‘ক্ষান্তবুড়ির দিদিশাশুড়ির পাঁচ বোন থাকে কাল্নায়’ ছড়াটির মজার স্মৃতি আজও মাথায় গেঁথে আছে । পাঁচ বুড়ির উল্টাপাল্টা কাহিনী পড়ে ভীষণ রোমাঞ্চিত হতাম ! এছাড়াও রামগরুড়ের ছানা , নোলক কবিতার ছোট মেয়েটির মায়ের নোলক খুঁজে বেড়ানো , নদীর স্বপ্নে - নদীর সাথে ঘুরে বেড়ানোর আকুলতা -
নৌকা তোমার ঘাটে বাঁধা আছে-
যাবে কি অনেক দূরে?
পায়ে পড়ি, মাঝি, সাথে নিয়ে চলো
মোরে আর ছোকানুরে।
আমারে চেনো না? আমি যে কানাই।
ছোকানু আমার বোন।
তোমার সঙ্গে বেড়াবো আমরা
মেঘনা,পদ্মা,শোন।
কুটীর কবিতায় -
কুটিরের কোল ঘেঁষে একটু উঠোন,
নেচে নেচে খেলা করি ছোট দুটি বোন। ( তখন আমরাও ছোট দুটি বোন ছিলাম )
বনভোজন কবিতার
নুরু, পুশি, আয়েশা, শফি সবাই এসেছে
আম বাগিচার তলায় যেন তারা হেসেছে।
রাঁধুনিদের শখের রাঁধার পড়ে গেছ ধুম,
বোশেখ মাসের এই দুপুরে নাইকো কারো ঘুম। -
পড়ে কল্পনার বনভোজনে হারিয়ে যেতাম - কি এক মজার ভুবনে আচ্ছন্ন হয়ে ছিলাম ! ছেলেবেলার সেই মজার জগতটিকে এই ছোট্ট ফ্রেমে বন্দি করতে চেয়েছি । মজার উল্টোপাল্টা ছড়ার পাশাপাশি কয়েকটি ভাললাগা হারিয়ে যাওয়া ছড়া - কবিতাও সংযোজন করলাম ।সুকুমার রায় তার আবোল তাবোল কাব্য গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন, ‘যাহা আজগুবি, যাহা উদ্ভট, যাহা অসম্ভব,তাহাদের লইয়াই এই পুস্তকের কারবার। ইহা খেয়াল রসের বই। সুতরাং সে রস যাঁহারা উপভোগ করিতে পারেন না, এ পুস্তক তাহাদের জন্য নহে।’ আমার সংকলনটিতেও সেই উল্টোপাল্টা ,আজগুবি ,উদ্ভট বিষয় গুলোই প্রাধান্য পেয়েছে। পাশাপাশি শৈশবের স্মৃতি জাগানিয়া কিছু ছড়া – কবিতা যা আমার ছেলেবেলাটিকে সমৃদ্ধ করেছে !!
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
খাপছাড়া - ১
ক্ষান্তবুড়ির দিদিশাশুড়ির
পাঁচ বোন থাকে কাল্নায় ,
শাড়িগুলো তারা উনুনে বিছায় ,
হাঁড়িগুলো রাখে আল্নায় ।
কোনো দোষ পাছে ধরে নিন্দুকে
নিজে থাকে তারা লোহাসিন্দুকে ,
টাকাকড়িগুলো হাওয়া খাবে ব ' লে
রেখে দেয় খোলা জাল্নায় —
নুন দিয়ে তারা ছাঁচিপান সাজে ,
চুন দেয় তারা ডাল্নায় ।
২
অল্পেতে খুশি হবে
দামোদর শেঠ কি ।
মুড়কির মোয়া চাই ,
চাই ভাজা ভেট রকি ।
আনবে কট্কি জুতো ,
মট্কিতে ঘি এনো ,
জলপাইগুঁড়ি থেকে
এনো কই জিয়োনো —
চাঁদনিতে পাওয়া যাবে
বোয়ালের পেট কি ।
চিনেবাজারের থেকে
এনো তো করমচা ,
কাঁকড়ার ডিম চাই ,
চাই যে গরম চা ,
নাহয় খরচা হবে
মাথা হবে হেঁট কি ।
মনে রেখো বড়ো মাপে
করা চাই আয়োজন ,
কলেবর খাটো নয় —
তিন মোন প্রায় ওজন ।
খোঁজ নিয়ো ঝড়িয়াতে
জিলিপির রেট কী ।
১৯
ভয় নেই , আমি আজ
রান্নাটা দেখছি ।
চালে জলে মেপে , নিধু ,
চড়িয়ে দে ডেকচি ।
আমি গণি কলাপাতা ,
তুমি এসো নিয়ে হাতা ,
যদি দেখ , মেজবউ ,
কোনোখানে ঠেকছি ।
রুটি মেখে বেলে দিয়ো ,
উনুনটা জ্বেলে দিয়ো ,
মহেশকে সাথে নিয়ে
আমি নয় সেঁকছি ।
৪৪
কন্কনে শীত তাই
চাই তার দস্তানা ;
বাজার ঘুরিয়ে দেখে ,
জিনিসটা সস্তা না ।
কম দামে কিনে মোজা
বাড়ি ফিরে গেল সোজা —
কিছুতে ঢোকে না হাতে ,
তাই শেষে পস্তানা ।
৫০
আয়না দেখেই চমকে বলে ,
‘ মুখ যে দেখি ফ্যাকাশে ,
বেশিদিন আর বাঁচব না তো — '
ভাবছে বসে একা সে ।
ডাক্তারেরা লুটল কড়ি ,
খাওয়ায় জোলাপ , খাওয়ায় বড়ি ,
অবশেষে বাঁচল না সেই
বয়স যখন একাশি ।
৬৩
ভোলানাথ লিখেছিল ,
তিন-চারে নব্বই —
গণিতের মার্কায়
কাটা গেল সর্বই ।
তিন চারে বারো হয় ,
মাস্টার তারে কয় ;
‘ লিখেছিনু ঢের বেশি '
এই তার গর্বই ।
৯৬
ঝিনেদার জ্ঞানদার
ছেলেটার জন্যে
ত্রিচিনাপল্লী গিয়ে
খুঁজে পেল কন্যে ।
শহরেতে সব-সেরা
ছিল যেই বিবেচক
দেখে দেখে বললে সে —
‘ কিবে নাক , কিবে চোখ ;
চুলের ডগার খুঁত
বুঝবে না অন্যে । '
১০৩
নাম তার চিনুলাল
হরিরাম মোতিভয় ,
কিছুতে ঠকায় কেউ
এই তার অতি ভয় ।
সাতানব্বই থেকে
তেরোদিন ব'কে ব'কে
বারোতে নামিয়ে এনে
তবু ভাবে , গেল ঠকে ।
মনে মনে আঁক কষে ,
পদে পদে ক্ষতি-ভয় ।
কষ্টে কেরানি তার
টিঁকে আছে কতিপয় ।
বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর
দিনের আলো নিবে এল,
সুয্যি ডোবে-ডোবে।
আকাশ ঘিরে মেঘ জুটেছে
চাঁদের লোভে লোভে।
মেঘের উপর মেঘ করেছে--
রঙের উপর রঙ,
মন্দিরেতে কাঁসর ঘন্টা।
বাজল ঠঙ ঠঙ।
ও পারেতে বিষ্টি এল,
ঝাপসা গাছপালা।
এ পারেতে মেঘের মাথায়
একশো মানিক জ্বালা।
বাদলা হাওয়ায় মনে পড়ে
ছেলেবেলার গান--
"বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর,
নদেয় এল বান।'
আকাশ জুড়ে মেঘের খেলা,
কোথায় বা সীমানা!
দেশে দেশে খেলে বেড়ায়,
কেউ করে না মানা।
কত নতুন ফুলের বনে
বিষ্টি দিয়ে যায়,
পলে পলে নতুন খেলা
কোথায় ভেবে পায়।
মেঘের খেলা দেখে কত
খেলা পড়ে মনে,
কত দিনের নুকোচুরি
কত ঘরের কোণে।
তারি সঙ্গে মনে পড়ে
ছেলেবেলার গান --
"বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর,
নদেয় এল বান।'
মনে পড়ে ঘরটি আলো
মায়ের হাসিমুখ,
মনে পড়ে মেঘের ডাকে
গুরুগুরু বুক।
বিছানাটির একটি পাশে
ঘুমিয়ে আছে খোকা,
মায়ের 'পরে দৌরাত্মি সে
না যায় লেখাজোখা।
ঘরেতে দুরন্ত ছেলে
করে দাপাদাপি,
বাইরেতে মেঘ ডেকে ওঠে --
সৃষ্টি ওঠে কাঁপি।
মনে পড়ে মায়ের মুখে
শুনেছিলেম গান --
"বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর,
নদেয় এল বান।
মনে পড়ে সুয়োরানী
দুয়োরানীর কথা,
মনে পড়ে অভিমানী
কঙ্কাবতীর ব্যথা।
মনে পড়ে ঘরের কোণে
মিটিমিটি আলো,
একটা দিকের দেয়ালেতে
ছায়া কালো কালো।
বাইরে কেবল জলের শব্দ
ঝুপ্ ঝুপ্ ঝুপ্ --
দস্যি ছেলে গল্প শোনে
একেবারে চুপ।
তারি সঙ্গে মনে পড়ে
মেঘলা দিনের গান --
"বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর,
নদেয় এল বান।'
কবে বিষ্টি পড়েছিল,
বান এল সে কোথা।
শিবঠাকুরের বিয়ে হল,
কবেকার সে কথা।
সেদিনও কি এম্নিতরো
মেঘের ঘটাখানা।
থেকে থেকে বাজ বিজুলি
দিচ্ছিল কি হানা।
তিন কন্যে বিয়ে ক'রে
কী হল তার শেষে।
না জানি কোন্ নদীর ধারে,
না জানি কোন্ দেশে,
কোন্ ছেলেরে ঘুম পাড়াতে
কে গাহিল গান --
"বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর,
নদেয় এল বান।'
বিজ্ঞ
খুকি তোমার কিচ্ছু বোঝে না মা,
খুকি তোমার ভারি ছেলেমানুষ।
ও ভেবেছে তারা উঠছে বুঝি
আমরা যখন উড়েয়েছিলেম ফানুস।
আমি যখন খাওয়া - খাওয়া খেলি
খেলার থালে সাজিয়ে নিয়ে নুড়ি,
ও ভাবে বা সত্যি খেতে হবে
মুঠো করে মুখে দেয় মা, পুরি।
সামনেতে ওর শিশুশিক্ষা খুলে
যদি বলি, ‘খুকি, পড়া করো'
দু হাত দিয়ে পাতা ছিঁড়তে বসে—
তোমার খুকির পড়া কেমনতরো।
আমি যদি মুখে কাপড় দিয়ে
আস্তে আস্তে আসি গুড়িগুড়ি
তোমার খুকি অম্নি কেঁদে ওঠে,
ও ভাবে বা এল জুজুবুড়ি।
আমি যদি রাগ করে কখনো
মাথা নেড়ে চোখ রাঙিয়ে বকি—
তোমার খুকি খিল্খিলিয়ে হাসে।
খেলা করছি মনে করে ও কি।
সবাই জানে বাবা বিদেশ গেছে
তবু যদি বলি ‘আসছে বাবা'
তাড়াতাড়ি চার দিকেতে চায়—
তোমার খুকি এম্নি বোকা হাবা।
ধোবা এলে পড়াই যখন আমি
টেনে নিয়ে তাদের বাচ্ছা গাধা,
আমি বলি ‘আমি গুরুমশাই',
ও আমাকে চেঁচিয়ে ডাকে ‘দাদা'।
তোমার খুকি চাঁদ ধরতে চায়,
গণেশকে ও বলে যে মা গানুশ।
তোমার খুকি কিচ্ছু বোঝে না মা,
তোমার খুকি ভারি ছেলেমানুষ।
বীরপুরুষ
মনে করো যেন বিদেশ ঘুরে
মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে।
তুমি যাচ্ছ পালকিতে মা চড়ে
দরজা দুটো একটুকু ফাঁক করে,
আমি যাচ্ছি রাঙা ঘোড়ার ‘পরে
টগ্বগিয়ে তোমার পাশে পাশে।
রাস্তা থেকে ঘোড়ার খুরে খুরে
রাঙা ধুলোয় মেঘ উড়িয়ে আসে।
সন্ধে হল, সূর্য নামে পাটে,
এলেম যেন জোড়াদিঘির মাঠে।
ধূধূ করে যে দিক - পানে চাই,
কোনোখানে জনমানব নাই,
তুমি যেন আপন - মনে তাই
ভয় পেয়েছ— ভাবছ, ‘এলেম কোথা!'
আমি বলছি, ‘ভয় কোরো না মা গো,
ওই দেখা যায় মরা নদীর সোঁতা। '
চোরকাঁটাতে মাঠ রয়েছে ঢেকে,
মাঝখানেতে পথ গিয়েছে বেঁকে।
গোরু বাছুর নেইকো কোনোখানে,
সন্ধে হতেই গেছে গাঁয়ের পানে,
আমরা কোথায় যাচ্ছি কে তা জানে,
অন্ধকারে দেখা যায় না ভালো।
তুমি যেন বললে আমায় ডেকে,
‘দিঘির ধারে ওই যে কিসের আলো!'
এমন সময় ‘হাঁরে রে রে রে রে,'
ওই যে কারা আসতেছে ডাক ছেড়ে।
তুমি ভয়ে পালকিতে এক কোণে
ঠাকুর - দেবতা স্মরণ করছ মনে,
বেয়ারাগুলো পাশের কাঁটাবনে
পালকি ছেড়ে কাঁপছে থরোথরো।
আমি যেন তোমায় বলছি ডেকে,
‘আমি আছি, ভয় কেন মা কর। '
হাতে লাঠি, মাথায় ঝাঁকড়া চুল,
কানে তাদের গোঁজা জবার ফুল।
আমি বলি, ‘দাঁড়া, খবর্দার!
এক পা কাছে আসিস যদি আর—
এই চেয়ে দেখ্ আমার তলোয়ার,
টুকরো করে দেব তোদের সেরে। '
শুনে তারা লম্ফ দিয়ে উঠে
চেঁচিয়ে উঠল, ‘হাঁরে রে রে রে রে। '
তুমি বললে, ‘যাস নে খোকা ওরে,'
আমি বলি, ‘দেখো না চুপ করে। '
ছুটিয়ে ঘোড়া গেলেম তাদের মাঝে,
ঢাল তলোয়ার ঝন্ঝনিয়ে বাজে,
কী ভয়ানক লড়াই হল মা যে,
শুনে তোমার গায়ে দেবে কাঁটা।
কত লোক যে পালিয়ে গেল ভয়ে,
কত লোকের মাথা পড়ল কাটা।
এত লোকের সঙ্গে লড়াই করে
ভাবছ খোকা গেলই বুঝি মরে।
আমি তখন রক্ত মেখে ঘেমে
বলছি এসে, ‘লড়াই গেছে থেমে,'
তুমি শুনে পালকি থেকে নেমে
চুমো খেয়ে নিচ্ছ আমায় কোলে—
বলছ, ‘ভাগ্যে খোকা সঙ্গে ছিল!
কী দুর্দশাই হত তা না হলে। '
রবিবার
সোম মঙ্গল বুধ এরা সব
আসে তাড়াতাড়ি ,
এদের ঘরে আছে বুঝি
মস্ত হাওয়া - গাড়ি ?
রবিবার সে কেন , মা গো ,
এমন দেরি করে ?
ধীরে ধীরে পৌঁছয় সে
সকল বারের পরে ।
আকাশ - পারে তার বাড়িটি
দূর কি সবার চেয়ে ?
সে বুঝি মা তোমার মতো
গরিব - ঘরের মেয়ে ?
সোম মঙ্গল বুধের খেয়াল
থাকবারই জন্যেই ,
বাড়ি - ফেরার দিকে ওদের
একটুও মন নেই ।
রবিবারকে কে যে এমন
বিষম তাড়া করে ,
ঘণ্টাগুলো বাজায় যেন
আধ ঘণ্টার পরে ।
আকাশ - পারে বাড়িতে তার
কাজ আছে সব - চেয়ে ?
সে বুঝি , মা , তোমার মতো
গরিব - ঘরের মেয়ে ।
সোম মঙ্গল বুধের যেন
মুখগুলো সব হাঁড়ি
ছোটো ছেলের সঙ্গে তাদের
বিষম আড়াআড়ি ।
কিন্তু শনির রাতের শেষে
যেমনি উঠি জেগে ,
রবিবারের মুখে দেখি
হাসিই আছে লেগে ।
যাবার বেলায় যায় সে কেঁদে
মোদের মুখে চেয়ে ।
সে বুঝি , মা , তোমার মতো
গরিব ঘরের মেয়ে ?
অন্য মা
আমার মা না হয়ে তুমি
আর - কারো মা হলে
ভাবছ তোমায় চিনতেম না ,
যেতেম না ঐ কোলে ?
মজা আরো হত ভারি ,
দুই জায়গায় থাকত বাড়ি ,
আমি থাকতেম এই গাঁয়েতে ,
তুমি পারের গাঁয়ে ।
এইখানেতেই দিনের বেলা
যা - কিছু সব হত খেলা
দিন ফুরোলেই তোমার কাছে
পেরিয়ে যেতেম নায়ে ।
হঠাৎ এসে পিছন দিকে
আমি বলতেম , ' বল্ দেখি কে ?'
তুমি ভাবতে , চেনার মতো
চিনি নে তো তবু ।
তখন কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে
আমি বলতেম গলা ধরে —
' আমায় তোমার চিনতে হবেই ,
আমি তোমার অবু !'
ঐ পারেতে যখন তুমি
আনতে যেতে জল ,
এই পারেতে তখন ঘাটে
বল্ দেখি কে বল্ ?
কাগজ - গড়া নৌকোটিকে
ভাসিয়ে দিতেম তোমার দিকে ,
যদি গিয়ে পৌঁছোত সে
বুঝতে কি , সে কার ?
সাঁতার আমি শিখিনি যে
নইলে আমি যেতেম নিজে ,
আমার পারের থেকে আমি
যেতেম তোমার পার ।
মায়ের পারে অবুর পারে
থাকত তফাত , কেউ তো কারে
ধরতে গিয়ে পেত নাকো ,
রইত না একসাথে ।
দিনের বেলায় ঘুরে ঘুরে
দেখা - দেখি দূরে দূরে —
সন্ধেবেলায় মিলে যেত
অবুতে আর মাতে ।
কিন্তু হঠাৎ কোনোদিনে
যদি বিপিন মাঝি
পার করতে তোমার পারে
নাই হত মা রাজি ।
ঘরে তোমার প্রদীপ জ্বেলে
ছাতের ‘পরে মাদুর মেলে
বসতে তুমি , পায়ের কাছে
বসত ক্ষান্তবুড়ি ,
উঠত তারা সাত ভায়েতে ,
ডাকত শেয়াল ধানের খেতে ,
উড়ো ছায়ার মতো বাদুড়
কোথায় যেত উড়ি ।
তখন কি মা , দেরি দেখে
ভয় হত না থেকে থেকে
পার হয়ে মা , আসতে হতই
অবু যেথায় আছে ।
তখন কি আর ছাড়া পেতে ?
দিতেম কি আর ফিরে যেতে ?
ধরা পড়ত মায়ের ওপার
অবুর পারের কাছে ।
দুষ্টু
তোমার কাছে আমিই দুষ্টু
ভালো যে আর সবাই ।
মিত্তিরদের কালু নিলু
ভারি ঠাণ্ডা ক - ভাই !
যতীশ ভালো , সতীশ ভালো ,
ন্যাড়া নবীন ভালো ,
তুমি বল ওরাই কেমন
ঘর করে রয় আলো ।
মাখন বাবুর দুটি ছেলে
দুষ্টু তো নয় কেউ —
গেটে তাদের কুকুর বাঁধা
করতেছে ঘেউ ঘেউ ।
পাঁচকড়ি ঘোষ লক্ষ্মী ছেলে ,
দত্তপাড়ার গবাই ,
তোমার কাছে আমিই দুষ্টু
ভালো যে আর সবাই ।
তোমার কথা আমি যেন
শুনি নে কক্খনোই ,
জামাকাপড় যেন আমার
সাফ থাকে না কোনোই !
খেলা করতে বেলা করি ,
বৃষ্টিতে যাই ভিজে ,
দুষ্টুপনা আরো আছে
অমনি কত কী যে !
বাবা আমার চেয়ে ভালো ?
সত্যি বলো তুমি ,
তোমার কাছে করেন নি কি
একটুও দুষ্টুমি ?
যা বল সব শোনেন তিনি ,
কিচ্ছু ভোলেন নাকো ?
খেলা ছেড়ে আসেন চলে
যেমনি তুমি ডাকো ?
ছড়া - ৪
বাসাখানি গায়ে-লাগা আর্মানি গির্জার—
দুই ভাই সাহেবালি জোনাবালি মির্জার।
কাবুলি বেড়াল নিয়ে দু দলের মোক্তার
বেঁধেছে কোমর, কে যে সামলাবে রোখ তার
হানাহানি চলছেই একেবারে বেহোঁশে,
নালিশটা কী নিয়ে যে, জানে না তা কেহ সে।
সে কি লেজ নিয়ে, সে কি গোঁফ নিয়ে তকরার,
হিসেবে কি গোল আছে নখগুলো বখরার।
কিংবা মিয়াঁও ব’লে থাবা তুলে ডেকেছিল—
তখন সামনে তার দু ভাইয়ের কে কে ছিল।
সাক্ষীর ভিড় হল দলে দলে তা নিয়ে,
আওয়াজ যাচাই হল ওস্তাদ আনিয়ে।
কেউ বলে ধা-পা-নি-মা, কেউ বলে ধা-মা-রে—
চাঁই চাঁই বোল দেয়, তবলায় ঘা মারে।
ওস্তাদ ঝেঁকে ওঠে, প্যাঁচ মারে কুস্তির—
জজসাব কী ক’রে যে থাকে বলো সুস্থির।
সমন হয়েছে জারি, কাবুলের সর্দার
চলে এল উটে চড়ে— পিছে ঝাড়ুবরদার।
উটেতে কামড় দিল, হল তার পা টুটা—
বিলকুল লোকসান হয়ে গেল হাঁটুটা।
খেসারত নিয়ে মাথা তেতে ওঠে আমিরের,
ফউজ পেরিয়ে এল পাঁচিলটা পামিরের।
বাজারে মেলে না আর আখরোট-খোবানি,
কাঁউসিল ঘরে আজ কী নাকানিচোবানি।
ইরানে পড়েছে সাড়া গবেষণাবিভাগে—
এ কাবুলি বিড়ালের নাড়িতে যে কী ভাগে
বংশ রয়েছে চাপা, মেসোপোটোমিয়ারই
মার্জারগুষ্টির হবে সে কি ঝিয়ারি।
এর আদি মাতামহী সে কি ছিল মিশোরি—
নাইল-তটিনী-তট-বিহারিণী কিশোরী
রোঁয়াতে সে ইরানী যে নাহি তাহে সংশয়,
দাঁতে তার এসীরিয়া যখনি সে দংশয়।
কটা চোখ দেখে বলে পণ্ডিতগণেতে,
এখনি পাঠানো চাই Wim বিল্ডনেতে।
বাঙালি থিসিসওলা পড়ে গেছে ভাবনায়—
ঠিকুজি মিলবে তার চাটগাঁ কি পাবনায়।
আর্মানি গির্জার আশেপাশে পাড়াতে
কোনোখানে এক তিল ঠাঁই নাই দাঁড়াতে।
কেম্ব্রিজ খালি হল, আসে সব স্কলারে—
কী ভীষণ হাড়কাটা করাতের ফলা রে।
বিজ্ঞানীদল এল বর্লিন ঝাঁটিয়ে,
হাতপাকা জন্তুর-নাড়িভুঁড়ি-ঘাঁটিয়ে।
জজ বলে, বিড়ালটা কী রকম জানা চাই,
আইডেন্টিটি তার আদালতে আনা চাই।
বিড়ালের দেখা নাই— ঘরেও না, বনে না;
মিআঁউ আওয়াজটুকু কেউ আর শোনে না।
জজ বলে, সাক্ষীরে কোন্খানে ঢুকোলো,
অত বড়ো লেজের কি আগাগোড়া লুকোলো।
পেয়াদা বললে, লেজ গেছে মিউজিয়মে
প্রিভিকৌঁসিলে-দেওয়া আইনের নিয়মে।
জজ বলে, গোঁফ পেলে রবে মোর সম্মান
পেয়াদা বললে, তারো নয় বড়ো কম মান।
মিউনিকে নিয়ে গেছে ছাঁটা গোঁফ যত্নেই,
তারে আর কোনোমতে ফেরাবার পথ নেই।
বিড়াল ফেরার হল, নাই নামগন্ধ;
জজ বলে, তাই ব’লে মামলা কি বন্ধ।
তখনি চৌকি ছেড়ে রেগে করে পাচারি,
থেকে থেকে হুংকারে কেঁপে ওঠে কাছারি।
জজ বলে, গেল কোথা ফরিয়াদী আসামী!
হজুর, পেয়াদা বলে, বেটাদের চাষামি!
শুনি নাকি দুই ভাই উকিলের তাকাদায়
বলে গেছে, আমাদের বুঝি বেঁচে থাকা দায়!
কণ্ঠে এমনি ফাঁস এঁটে দিল জড়িয়ে,
মোক্তারে কী করিবে সাক্ষীরে পড়িয়ে।
লুকোচুরি
আমি যদি দুষ্টুমি করে
চাঁপার গাছে চাঁপা হয়ে ফুটি,
ভোরের বেলা মা গো, ডালের ‘পরে
কচি পাতায় করি লুটোপুটি,
তবে তুমি আমার কাছে হারো,
তখন কি মা চিনতে আমায় পারো।
তুমি ডাক, ‘খোকা কোথায় ওরে। '
আমি শুধু হাসি চুপটি করে।
যখন তুমি থাকবে যে কাজ নিয়ে
সবই আমি দেখব নয়ন মেলে।
স্নানটি করে চাঁপার তলা দিয়ে
আসবে তুমি পিঠেতে চুল ফেলে;
এখান দিয়ে পুজোর ঘরে যাবে,
দূরের থেকে ফুলের গন্ধ পাবে—
তখন তুমি বুঝতে পারবে না সে
তোমার খোকার গায়ের গন্ধ আসে।
দুপুর বেলা মহাভারত-হাতে
বসবে তুমি সবার খাওয়া হলে,
গাছের ছায়া ঘরের জানালাতে
পড়বে এসে তোমার পিঠে কোলে,
আমি আমার ছোট্ট ছায়াখানি
দোলাব তোর বইয়ের ‘পরে আনি—
তখন তুমি বুঝতে পারবে না সে
তোমার চোখে খোকার ছায়া ভাসে।
সন্ধেবেলায় প্রদীপখানি জ্বেলে
যখন তুমি যাবে গোয়ালঘরে
তখন আমি ফুলের খেলা খেলে
টুপ্ করে মা , পড়ব ভুঁয়ে ঝরে।
আবার আমি তোমার খোকা হব,
‘গল্প বলো' তোমায় গিয়ে কব।
তুমি বলবে, ‘দুষ্টু, ছিলি কোথা। '
আমি বলব, ‘ বলব না সে কথা। '
মজার দেশ
যোগীন্দ্রনাথ সরকার
এক যে ছিলো মজার দেশ,
সব রকমে ভালো ,
রাত্তিরেতে বেজায় রোদ ,
দিনে চাঁদের আলো ।
আকাশ সেথা সবুজ বরন
গাছের পাতা নীল ,
ডাঙায় চরে রুই কাতলা
জলের মাঝে চিল !
সেই দেশেতে বেড়াল পালায় ,
নেংটি-ইঁদুর দেখে ;
ছেলেরা খায় ক্যাস্টর-অয়েল-
রসগোল্লা রেখে !
মন্ডা-মিঠাই তেতো সেথা ,
ওষুধ লাগে ভালো ;
অন্ধকারটা সাদা দেখায় ,
সাদা জিনিষ কালো !
ছেলেরা সব খেলা ফেলে
বই নিয়ে বসে পড়ে ;
মুখে লাগাম দিয়ে ঘোড়া
লোকের পিঠে চড়ে
ঘুড়ির হাতে বাঁশের লাটাই ,
উড়তে থাকে ছেলে
বরশি দিয়ে মানুষ গাঁথে ,
মাছেরা ছিপ ফেলে ;
জিলিপি সে তেরে আসে ,
কামড়ে দিতে চায় !
কচুরি আর রসগোল্লা
ছেলে ধরে খায় !
পায়ে ছাতা দিয়ে লোকে
হাতে হেঁটে চলে !
ডাঙায় ভাসে নৌকা জাহাজ ,
গাড়ি ছোটে জলে !
মজার দেশের মজার কথা
বলবো কত আর ;
চোখ খুললে যায় না দেখা
মুদলে পরিষ্কার ।
কাজের ছেলে
যোগিন্দ্রনাথ সরকার
দাদখানি চাল, মুসুরির ডাল, চিনি-পাতা দৈ,
দু’টা পাকা বেল, সরিষার তেল, ডিমভরা কৈ।
পথে হেঁটে চলি, মনে মনে বলি, পাছে হয় ভুল;
ভুল যদি হয়, মা তবে নিশ্চয়, ছিঁড়ে দেবে চুল।
দাদখানি চাল, মুসুরির ডাল, চিনি-পাতা দৈ,
দু’টা পাকা বেল, সরিষার তেল, ডিমভরা কৈ।
বাহবা বাহবা – ভোলা ভুতো হাবা খেলিছে তো বেশ!
দেখিব খেলাতে, কে হারে কে জেতে, কেনা হলে শেষ।
দাদখানি চাল, মুসুরির ডাল, চিনি-পাতা দৈ,
ডিম-ভরা বেল, দু’টা পাকা তেল, সরিষার কৈ।‘
ওই তো ওখানে ঘুরি ধরে টানে, ঘোষদের ননী;
আমি যদি পাই, তা হলে উড়াই আকাশে এখনি!
দাদখানি তেল, ডিম-ভরা বেল, দুটা পাকা দৈ,
সরিষার চাল, চিনি-পাতা ডাল, মুসুরির কৈ!
এসেছি দোকানে-কিনি এই খানে, যত কিছু পাই;
মা যাহা বলেছে, ঠিক মনে আছে, তাতে ভুল নাই!
দাদখানি বেল, মুসুরির তেল, সরিষার কৈ,
চিনি-পাতা চাল, দুটা পাকা ডাল, ডিম ভরা দৈ।
ঠিক আছে
সুকুমার বড়ুয়া
অসময়ে মেহমান
ঘরে ঢুকে বসে যান
বোঝালাম ঝামেলার
যতগুলো দিক আছে
তিনি হেসে বললেন
ঠিক আছে ঠিক আছে।
রেশনের পচা চাল
টলটলে বাসি ডাল
থালাটাও ভাঙাচোরা
বাটিটাও লিক আছে
খেতে বসে জানালেন
ঠিক আছে ঠিক আছে।
মেঘ দেখে মেহমান
চাইলেন ছাতা খান
দেখালাম ছাতাটার
শুধু কটা শিক আছে
তবু তিনি বললেন
ঠিক আছে ঠিক আছে।
এমন যদি হতো
সুকুমার বড়ুয়া
এমন যদি হতো
ইচ্ছে হলে আমি হতাম
প্রজাপতির মতো
নানান রঙের ফুলের পরে
বসে যেতাম চুপটি করে
খেয়াল মতো নানান ফুলের
সুবাস নিতাম কতো ।
এমন হতো যদি
পাখি হয়ে পেরিয়ে যেতাম
কত পাহাড় নদী
দেশ বিদেশের অবাক ছবি
এক পলকের দেখে সবই
সাতটি সাগর পাড়ি দিতাম
উড়ে নিরবধি ।
এমন যদি হয়
আমায় দেখে এই পৃথিবীর
সবাই পেতো ভয়
মন্দটাকে ধ্বংস করে
ভালোয় দিতাম জগৎ ভরে
খুশির জোয়ার বইয়ে দিতাম
এই দুনিয়াময় ।
এমন হবে কি ?
একটি লাফে হঠাৎ আমি
চাঁদে পৌঁছেছি !
গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে
দেখে শুনে ভালো করে
লক্ষ যুগের অন্ত আদি
জানতে ছুটেছি ।
ডাটা সংবাদ
সুকুমার বড়ুয়া
পুঁইয়ের ডাঁটা লাউয়ের ডাঁটা
বায়োডাটার ঝোল,
ডাটা প্রসেস করতে হলে
কম্পিউটার খোল।
ডাঁটার পাগল বুড়োবুড়ি
ক্যালসিয়ামে ভরা,
শজনেডাঁটায় গুণ বেশি তাই
বাজার ভীষণ চড়া।
উচ্চতর ডিগ্রি নিতে
ডাটাই পরম ধন,
সারা বছর খেটে করেন
ডাটা কালেকশন।
ডালের সাথে মাছের সাথে
যেমন ডাঁটা চলে,
গবেষকের ডাটা আবার
অন্য কথা বলে।
হাসি
রোকনুজ্জামান খান
হাসতে নাকি জানেনা কেউ
কে বলেছে ভাই?
এই শোন না কত হাসির
খবর বলে যাই।
খোকন হাসে ফোঁকলা দাঁতে
চাঁদ হাসে তার সাথে সাথে
কাজল বিলে শাপলা হাসে
হাসে সবুজ ঘাস।
খলসে মাছের হাসি দেখে
হাসে পাতিহাঁস।
টিয়ে হাসে, রাঙ্গা ঠোঁটে,
ফিঙ্গের মুখেও হাসি ফোটে
দোয়েল কোয়েল ময়না শ্যামা
হাসতে সবাই চায়
বোয়াল মাছের দেখলে হাসি
পিলে চমকে যায়।
এত হাসি দেখেও যারা
গোমড়া মুখে চায়,
তাদের দেখে পেঁচার মুখেও
কেবল হাসি পায়।
কাজের লোক
নবকৃষ্ণ ভট্টাচার্য
মৌমাছি, মৌমাছি,
কোথা যাও নাচি' নাচি'
দাঁড়াও না একবার ভাই।
ওই ফুল ফুটে বনে,
যাই মধু আহরণে,
দাঁড়াবার সময় তো নাই।
ছোট পাখি, ছোট পাখি,
কিচি-মিচি ডাকি ডাকি'
কোথা যাও, বলে যাও শুনি ?
এখন না ক'ব কথা,
আনিয়াছি তৃণলতা,
আপনার বাসা আগে বুনি।
পিপীলিকা, পিপীলিকা,
দল-বল ছাড়ি একা
কোথা যাও, যাও ভাই বলি।
শীতের সঞ্চয় চাই,
খাদ্য খুঁজিতেছি তাই,
ছয় পায় পিল্ পিল্ চলি।
চড়ুইভাতি
আবদার রশীদ
চড়ুইভাতির পাশেই নদীর কূল ছিল,
আনন্দে তাই সবার গলাই খুলছিল ।
ফুর্তিতে, খোশ গপ্পেতে মশগুল ছিল,
মাথায় তাদের হাল ফ্যাশানের চুল ছিল ।
জনাচারেক আলুর খোসা ছুলছিল,
গলায় তাদের রুমাল কি টাই ঝুলছিল ।
দলের সাথে তিনঠেঙে এক টুল ছিল,
সেটায় বসে দলের নেতা ঢুলছিল ।
আরো ক’জন বালতিতে জল তুলছিল
জল তোলাতেও অনেক হুলুস্থুল ছিল,
কেউবা গাছে দোলনা ছাড়াই দুলছিল,
খানিক দূরে খালের ওপর পুল ছিল
সেই খানে এক ডালিম গাছে ফুল ছিল,
ডালিম গাছের মগডালে বুলবুল ছিল।
সবাই তখন বাড়ির কথা ভুলছিল,-
চড়ুইভাতির আনন্দটাই মূল ছিল ।
জানতো না কেউ কোথায় যে ভীমরুল ছিল,
কামড় খেয়ে বুঝলো, তাদের হুল ছিল।।
বনভোজন
গোলাম মোস্তফা
নুরু, পুশি, আয়েশা, শফি সবাই এসেছে
আম বাগিচার তলায় যেন তারা হেসেছে।
রাঁধুনিদের শখের রাঁধার পড়ে গেছ ধুম,
বোশেখ মাসের এই দুপুরে নাইকো কারো ঘুম।
বাপ মা তাদের ঘুমিয়ে আছে এই সুবিধা পেয়ে,
বনভোজনে মিলেছে আজ দুষ্টু কটি মেয়ে।
বসে গেছে সবাই আজি বিপুল আয়োজনে,
ব্যস্ত সবাই আজকে তারা ভোজের নিমন্ত্রণে।
কেউবা বসে হলদি বাটে কেউবা রাঁধে ভাত,
কেউবা বলে দুত্তুরি ছাই পুড়েই গেল হাত।
বিনা আগুন দিয়েই তাদের হচ্ছে যদিও রাঁধা,
তবু সবার দুই চোখেতে ধোঁয়া লেগেই কাঁদা।
কোর্মা পোলাও কেউবা রাঁধে, কেউবা চাখে নুন,
অকারণে বারে বারে হেসেই বা কেউ খুন।
রান্না তাদের শেষ হল যেই, গিন্নী হল নুরু,
এক লাইনে সবাই বসে করলে খাওয়া শুরু।
ধূলোবালির কোর্মা-পোলাও আর সে কাদার পিঠে,
মিছিমিছি খেয়া সবাই, বলে- বেজায় মিঠে।
এমন সময় হঠাৎ আমি যেই পড়েছি এসে,
পালিয়ে গেল দুষ্টুরা সব খিলখিলিয়ে হেসে।
বৃষ্টির ছড়া
ফররুখ আহমদ
বিষটি এলো কাঁশবনে,
জাগলো সাড়া ঘাসবনে,
বকের সাড়ি কোথা-রে,
লুকিয়ে গেলো বাঁশ বনে..
নদীতে নাই খেয়া যে,
ডাকলো দূরে দেয়া যে,
কোন সে বনের আড়ালে,
ফুটলো আবার কেয়া যে..
গাঁয়ের নামটি হাটখোলা,
বিষটি বাদল দেয় দোলা,
রাখাল ছেলে মেঘ দেখে,
যায় দাড়িয়ে পথ ভোলা..
মেঘের আকাশ মন টানে ,
যায় সে ছুটে কোন খানে,
আউশ ধানের মাঠ ছেড়ে,
আমন ধানের দেশ পানে..
সফদার ডাক্তার
হোসনে আরা
সফদার ডাক্তার
মাথা ভরা টাক তার
খিদে পেলেপানি খায় চিবিয়ে।
চেয়ারেতে রাত দিন
বসে গুনে দুই তিন
পড়ে বইআলোটারে নিভিয়ে।
ইয়া বড় গোফ তার
নাই তার জুড়ি দার
শুলে তারভুড়ি ঠেকে আকাশে।
নুন দিয়ে খায় পান
সারাক্ষন গায় গান
বুদ্ধিতেঅতি বড় পাকা সে।
রোগী এলে ঘরে তার
খুশিতে সে চার বার
কষে দেয় ডন আর কুস্তি।
তার পর রোগীটারে
গোটা দুই চাটি মারে
যেন তার সাথে কত দোস্তি।
ম্যালেরিয়া রোগী এলে
তার নাই নিস্তার
ধরে তারে দেয় কেচো গিলিয়ে।
আমাশার রোগী এলে
ই হাতে কান ধরে
পেটটারে ঠিক করে কিলিয়ে।
কলেরার রোগী এলে
দুপুরের রোদে ফেলে
দেয় তারে কুইনিন খাইয়ে।
তারপরে দুই টিন
পচা জলে তারপিন
ঢেলে তারে দেয় শুধু নাইয়ে।
ডাক্তার সফদার
নামডাক খুব তার
নামে গাও থরথরি কম্প,
নাম শুনে রোগীসব
করে জোরে কলরব
পিঠটান দেয় দিয়ে লম্ফ।
একদিন সক্ কাল
ঘটল কী জঞ্জাল
ডাক্তারে ধরে এসে পুলিশে,
হাত কড়া দিয়ে হাতে
নিয়ে গেল থানাতে
তারিখটা আষাঢ়ের উনিশে।
কুটীর
অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত
ঝিকিমিকি দেখা যায় সোনালি নদীর,
ওইখানে আমাদের পাতার কুটির।
এলোমেলো হাওয়া বয়,
সারা বেলা কথা কয়,
কাশফুলে দুলে ওঠে নদীর দু'পার,
রূপসীর শাড়ি যেন তৈরি রূপার।
কুটিরের কোল ঘেঁষে একটু উঠোন,
নেচে নেচে খেলা করি ছোট দুটি বোন।
পরনে খড়কে-ডুরে,
বেণী নাচে ঘুরে ঘুরে,
পায়ে পায়ে- 'রুনু ঝুনু' হালকা খাড়ুর,
কেন নাচি নাই তার খেয়াল কারুর।
আকাশে গড়িয়া ওঠে মেঘের মিনার,
তারি ফাঁকে দেখা যায় চাঁদের কিনার।
গাছের পাতার ফাঁকে,
আকাশ যে চেয়ে থাকে,
গুনগুন গান গাই, চোখে নাই ঘুম।
চাঁদ যেন আমাদের নিকট কুটুম।...
নৌকারা আসে যায় পাটেতে বোঝাই,
দেখে কী যে খুশি লাগে কী করে বোঝাই।
কত দূর দেশ থেকে,
আসিয়াছে এঁকে বেঁকে,
বাদলে 'বদর' বলে তুলিয়া বাদাম,
হাল দিয়ে ধরে রাখে মেঘের লাগাম।...
দু কদম হেঁটে এস মোদের কুটির,
পিলসুজে বাতি জ্বলে মিটির মিটির।
চাল আছে ঢেঁকি ছাঁটা,
রয়েছে পানের বাটা,
কলাপাতা ভরে দেব ঘরে-পাতা দই,
এই দেখ আছে মোর আয়না কাঁকই।
যদি আস একবার, বলি --মিছা না,
মোদের উঠোনটুকু ঠিক বিছানা।
পিয়াল, পেয়ারা গাছে--
ছায়া করে রহিয়াছে,
ধুঁধুলের ঝাঁকা বেয়ে উঠিতেছে পুঁই,
খড়কুটো খুঁজে ফেরে দুষ্টু চড়ুই।
এস এস আমাদের সোনার কুটির,--
ঝিকিমিকি করে জল নিটোল নদীর।
ঝিঙের শাখার পরে
ফিঙে বসে খেলা করে,
বেলা যে পড়িয়া এল, গায়ে লাগে হিম,
আকাশে সাঁঝের তারা, উঠানে পিদিম।
খুকু ও খোকা
অন্নদাশঙ্কর রায়
তেলের শিশি ভাঙল বলে
খুকুর পরে রাগ করো
তোমরা যে সব বুড়ো খোকা
ভারত ভেঙে ভাগ করো !
তার বেলা?
ভাঙছ প্রদেশ ভাঙছ জেলা
জমিজমা ঘরবাড়ী
পাটের আড়ত্ ধানের গোলা
করখানা আর রেলগাড়ী !
তার বেলা ?
চায়ের বাগান কয়লাখনি
কলেজ থানা আপিস-ঘর
চেয়ার টেবিল দেয়ালঘড়ি
পিয়ন পুলিশ প্রোফেসর !
তার বেলা ?
যুদ্ধ জাহাজ জঙ্গী মোটর
কামান বিমান অশ্ব উট
ভাগাভগির ভাঙাভাঙির
চলছে যেন হরির-লুট !
তার বেলা ?
তেলের শিশি ভাঙল বলে
খুকুর পরে রাগ করো
তোমরা যে সব বুড়ো খোকা
বাঙলা ভেঙে ভাগ করো !
তার বেলা?
ভর দুপুরে
আল মাহমুদ
মেঘনা নদীর শান্ত মেয়ে তিতাসে
মেঘের মত পাল উড়িয়ে কী ভাসে!
মাছের মত দেখতে এ কোন পাটুনি
ভর দুপুরে খাটছে সখের খাটুনি।
ওমা এ-যে কাজল বিলের বোয়ালে
পালের দড়ি আটকে আছে চোয়ালে
আসছে ধেয়ে লম্বা দাড়ি নাড়িয়ে,
ঢেউয়ের বাড়ি নাওয়ের সারি ছাড়িয়ে।
কোথায় যাবে কোন উজানে ও-মাঝি
আমার কোলে খোকন নামের যে-পাজি
হাসেছ, তারে নাও না তোমার নায়েতে
গাঙ-শুশুকের স্বপ্নভরা গাঁয়েতে;
সেথায় নাকি শালুক পাতার চাদরে
জলপিপিরা ঘুমায় মহা আদরে,
শাপলা ফুলের শীতল সবুজ পালিশে
থাকবে খোকন ঘুমিয়ে ফুলের বালিশে।
নোলক
আল মাহমুদ
আমার মায়ের সোনার নোলক হারিয়ে গেল শেষে
হেথায় খুঁজি হোথায় খুঁজি সারা বাংলাদেশে।
নদীর কাছে গিয়েছিলাম, আছে তোমার কাছে?
-হাত দিও না আমার শরীর ভরা বোয়াল মাছে।
বললো কেঁদে তিতাস নদী হরিণবেড়ের বাঁকে
শাদা পালক বকরা যেথায় পাখ ছাড়িয়ে থাকে।
জল ছাড়িয়ে দল হারিয়ে গেলাম বনের দিক
সবুজ বনের হরিৎ টিয়ে করে রে ঝিকমিক
বনের কাছে এই মিনতি, ফিরিয়ে দেবে ভাই,
আমার মায়ের গয়না নিয়ে ঘরেক যেতে চাই।
কোথায় পাবো তোমার মায়ের হারিয়ে যাওয়া ধন
আমরা তো সব পাখপাখালি বনের সাধারণ।
সবুজ চুলে ফুল পিন্দেছি নোলক পরি না তো।
ফুলের গন্ধ চাও যদি নাও, হাত পাতো হাত পাতো-
বলে পাহাড় দেখায় তাহার আহার ভরা বুক।
হাজার হরিণ পাতার ফাঁকে বাঁকিয়ে রাখে মুখ।
এলিয়ে খোঁপা রাত্রি এলেন, ফের বাড়ালাম পা
আমার মায়ের গয়না ছাড়া ঘরকে যাবো না।
না ঘুমানোর দল
আল মাহমুদ
নারকেলের ঐ লম্বা মাথায় হঠাৎ দেখি কাল
ডাবের মতো চাদঁ উঠেছে ঠান্ডা ও গোলগাল ।
ছিটকিনিটা আস্তে খুলে পেরিয়ে এলেম ঘর
ঘুমন্ত এই মস্ত শহর করছিলো থরথ ।
মিনারটাকে দেখছি যেন দাড়িয়ে আছেন কেউ,
পাথরঘাটার গির্জেটা কি লাল পাথরের ঢেউ ?
চৌকিদারের হাক শুনে যেই মোড় ফিরেছি বায় –
কোত্থেকে এক উটকো পাহাড় ডাক দিল আয় আয় ।
পাহাড়টাকে হাত বুলিয়ে লাল দিঘীটার পাড়
এগিয়ে দেখি জোনাকিদের বসেছে দরবার ।
আমায় দেখে কলকলিয়ে দীঘির কালো জল
বললো, এসো, আমরা সবাই না ঘুমানোর দল-
পকেট থেকে খুলো তোমার পদ্য লেখার ভাজঁ
রক্তজবার ঝোপের কাছে কাব্য হবে আজ ।
দীঘির কথায় উঠলো হেসে ফুল পাখিদের সব
কাব্য হবে, কাব্য হবে- জুড়লো কলরব ।
কী আর করি পকেট থেকে খুলে ছড়ার বই
পাখির কাছে, ফুলের কাছে মনের কথা কই ।
পাখির মতো
আল মাহমুদ
আম্মা বলেন, পড়রে সোনা
আব্বা বলেন, মন দে;
পাঠে আমার মন বসে না
কাঁঠালচাঁপার গন্ধে।
আমার কেবল ইচ্ছে জাগে
নদীর কাছে থাকতে,
বকুল ডালে লুকিয়ে থেকে
পাখির মতো ডাকতে।
সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে
কর্ণফুলীর কূলটায়,
দুধভরা ঐ চাঁদের বাটি
ফেরেস্তারা উল্টায়।
তখন কেবল ভাবতে থাকি
কেমন করে উড়বো,
কেমন করে শহর ছেড়ে
সবুজ গাঁয়ে ঘুরবো !
তোমরা যখন শিখছো পড়া
মানুষ হওয়ার জন্য,
আমি না হয় পাখিই হবো,
পাখির মতো বন্য।
রূপকথা
আহসান হাবীব
খেলাঘর পাতা আছে এই এখানে,
স্বপ্নের ঝিকিমিকি আঁকা যেখানে।
এখানে রাতের ছায়া ঘুমের নগর,
চোখের পাতায় ঘুম ঝরে ঝরঝর।
এইখানে খেলাঘর পাতা আমাদের,
আকাশের নীল রং ছাউনিতে এর।
পরীদের ডানা দিয়ে তৈরি দেয়াল,
প্রজাপতি রং মাখা জানালার জাল।
তারা ঝিকিমিকি পথ ঘুমের দেশের,
এইখানে খেলাঘর পাতা আমাদের।
ছোট বোন পারুলের হাতে রেখে হাত,
সাতভাই চম্পার কেটে যায় রাত।
কখনও ঘোড়ায় চড়ে হাতে নিয়ে তীর,
ঘুরে আসি সেই দেশ চম্পাবতীর।
এই খানে আমাদের মানা কিছু নাই,
নিজেদের খুশি মত কাহিনী বানাই।
সব-পেয়েছির দেশে
সুনির্মল বসু
গল্প না ভাই, কল্পনা নয়,
স্বপন-বুড়ো এসে
আমায় নিয়ে উধাও হোলো
সব-পেয়েছির দেশে।
স্বপন-বুড়োর লম্বা দাড়ি,
পোষাকটি তার রং-বাহারী,
আমায় নিয়ে দিচেছ পাড়ি
হাল্কা-হাওয়ায় ভেসে;
সব-পেয়েছির দেশে রে ভাই,
সব-পেয়েছির দেশে।
স্বপন-বুড়ো, রসিক-চূড়ো
নিদ্-মহলের রাজা,
থুর্থুরে তার শরীর বটে,
মনটি আজও তাজা;
সব-পেয়েছির দেশে চলো
সকল ছেলে মেয়ে,
উঠব মেতে সবাই সেথায়
সকল জিনিস পেয়ে,
সেথায় হাসির ঝর্ণা হাসে,
আমোদ খুশির বন্যা আসে,
মাতিয়ে তোলে শিশুর দলে
অসীম ভালোবেসে,
সব-পেয়েছির দেশে রে ভাই
সব-পেয়েছির দেশে।
বাংলাদেশের কিশোর-শিশু
তোমরা যারা আছো,
নাচার মতো নাচো তারা
বাঁচার মতো বাঁচো।
আধ-মরা আর ঘুণে ধরারা
বুড়োর কথা শুনবে যারা,-
সত্যিকারের মানুষ তারা
হবেই অবশেষে -
সব-পেয়েছির দেশে রে ভাই
সব-পেয়েছির দেশে।
রুপাই
জসীমউদদীন
এই গাঁয়ের এক চাষার ছেলে লম্বা মাথার চুল-
কালো মুখেই কালো ভ্রমর, কিসের রঙিন ফুল?
কাঁচা ধানের পাতার মত কচি-মুখের মায়া,
তার সাথে কে মাখিয়ে দেছে নবীন তৃণের ছায়া।
জালি লাউয়ের ডগার মত বাহু দুখান সরু।
গা-খানি তার শাঙন মাসের যেমন তমাল তরু।
বাদল-ধোয়া মেঘে কে গো মাখিয়ে দেছে তেল,
বিজলী মেয়ে পিছলে পড়ে ছড়িয়ে আলোর খেল।
কচি ধানের তুলতে চারা হয়ত কোনো চাষী
মুখে তাহার ছড়িয়ে গেছে কতকটা তার হাসি।
কালো চোখের তারা দিয়েই সকল ধরা দেখি,
কালো দতের কালি দিয়েই কেতাব কোরাণ লেখি।
জনম কালো, মরণ কালো, কালো ভূবনময় ;
চাষীদের ওই কালো ছেলে সব করেছে জয়।
সোনায় যে জন সোনা বানায়, কিসের গরব তার?
রঙ পেলে ভাই গড়তে পারি রামধণুকের হার।
সোনা নহে, পিতল নহে, নহে সোনার মুখ-
কালো-বরণ চাষীর ছেলে জুড়ায় যেন বুক |
পালের নাও
জসীমউদদীন
পালের নাও, পালের নাও, পান খেয়ে যাও -
ঘরে আছে ছোট বোনটি তারে নিয়ে যাও।
কপিল-সারি গাইয়ের দুধ যেয়ো পান করে'
কৌটা ভরি সিঁদুর দেব কপালটি ভরে'!
গুয়ার গায়ে ফুল চন্দন দেব ঘসে' ঘসে',
মামা-বাড়ীর বলব কথা শুনো বসে বসে!
কে যাওরে পাল ভরে' কোন্ দেশে ঘর
পাছা নায়ে বসে আছে কোন্ সওদাগর?
কোন্ দেশে কোন্ গাঁয়ে হিরে ফুল ঝরে।
কোন্ দেশে হিরামন পাখী বাস করে!
কোন্ দেশে রাজ-কনে খালি ঘুম যায়,
ঘুম যায় আর হাসে হিম্-সিম্ বায়।
সেই দেশে যাব আমি কিছু নাহি চাই,
ছোট মোর বোনটিরে যদি সাথে পাই!
পালের নাও, পালের নাও, পান খেয়ে যাও,
তোমার যে পাল নাচে ফুলঝুরি বাও।
তোমার যে না'র ছই আবের ঢাকনী
ঝলমল জ্বলিতেছে সোনার বাঁধনী।,
সোনার না বাঁধন্ রে তার গোড়ে গোড়ে
হিরামন পঙ্খীর লাল পাখা ওড়ে।
তারপর ওড়েরে ঝালরের ছাতি,
ঝলমল জলে জ্বলে রতনের বাতি।
এই নাও বেয়ে যায় কোন্ সদাগর,
কয়ে যাও - কয়ে যাও কোন্ দেশে ঘর?
পালের নাও, পালের নাও, পান খেয়ে যাও,
ঘরে আছে ছোট বোন্ তারে নিয়ে যাও, -
চেনা গাঙে সাত ধার করে গলাগলি,
সেথা বাস কেহেলার - লোকে গেছে বলি।
পারাপার দুই নদী - মাঝে বালুচর
সেইখানে বাস করে চাঁদ সওদাগর।
এ পারে ধুতুমের বাসা ও পারেতে টিয়া -
সেখানেতে যেও না রে নাও খানি নিয়া।
ভাইটাল গাঙ্ দোলে ভাটা গেঁয়ো সোতে,
হবে নারে নাও বাওয়া সেথা কোন মতে।
পাখি
বন্দে আলী মিঞা
খাঁচার দুয়ার আলগা পাইয়া উড়ে গেছে পাখি বনে,
ছোট কালো পাখি উড়ে গেছে দূর নীল নভ অঙ্গনে।
শূন্য খাঁচাটি অনাদরে হোথা পড়ে আছে এক ধারে,
খোকা বসি পাশে অশ্রুসজল চোখ মোছে বারে বারে।
একদা খোকন দূর দেশে গিয়ে এনেছিল এক পাখি,
সারাদিন তারে করিত যতন সযতনে বুকে রাখি।
ছোট কালো পাখি কুচকুচে দেহ-রেশম পালক তার,
দুটি চোখে তার বনের স্বপন জাগে দূর পারাবার।
এত ভালোবাসা, এত যে সোহাগ, পোষ তবু মানে নাই,
খাঁচার প্রাচীরে পাখা ঝাপটিয়া, পথ খুঁজিয়াছে তাই।
খোকা চায় পাখি - পাখি চায় বন - স্বাধীন মুক্ত প্রাণ,
কণ্ঠে তাহার জাগে ক্ষণে ক্ষণে নীল আকাশের গান।
খোকা ভাবে মনে, এ পাখি তাহার - গান সে শোনায় তায়
জানে না তো কভু কানড়বা তাহার সুর হয়ে বাহিরায়।
গান শুনি তার মুগ্ধ হইয়া ভেবেছিল খোকা মনে -
পোষ মানিয়াছে, ভুলে গেছে বন - রবে সে তাহার সনে।
আদর করিয়া খাঁচার দুয়ার দিল একেবারে খুলি
মন কভু কারো বশ নাহি মানে, সে কথা গেল যে ভুলি।
সহসা পাখিটি কালো ডানা মেলি উড়ে গেল দূর দেশে,
তারি শোকে আজ খোকার নয়ন অশ্রুতে যায় ভেসে।
পুরানো ধাঁধা
সুকান্ত ভট্টাচার্য
বলতে পারো বড়মানুষ মোটর কেন চড়বে?
গরীব কেন সেই মোটরের তলায় চাপা পড়বে?
বড়মানুষ ভোজের পাতে ফেলে লুচি-মিষ্টি,
গরীবরা পায় খোলামকুচি, একি অনাসৃষ্টি?
বলতে পারো ধনীর বাড়ি তৈরি যারা করছে,
কুঁড়েঘরেই তারা কেন মাছির মতো মরছে?
ধনীর মেয়ের দামী পুতুল হরেকরকম খেলনা,
গরীব মেয়ে পায়না আদর, সবার কাছে ফ্যালনা।
বলতে পারো ধনীর মুখে যারা যোগায় খাদ্য,
ধনীর পায়ের তলায় কেন থাকতে তারা বাধ্য?
'হিং-টিং-ছট' প্রশ্ন এসব, মাথায় মধ্যে কামড়ায়,
বড়লোকের ঢাক তৈরি গরীব লোকের চামড়ায়।
পণ্ডশ্রম
শামসুর রাহমান
এই নিয়েছে ঐ নিল যাঃ! কান নিয়েছে চিলে,
চিলের পিছে মরছি ঘুরে আমরা সবাই মিলে।
কানের খোঁজে ছুটছি মাঠে, কাটছি সাঁতার বিলে,
আকাশ থেকে চিলটাকে আজ ফেলব পেড়ে ঢিলে।
দিন-দুপুরে জ্যান্ত আহা, কানটা গেল উড়ে,
কান না পেলে চার দেয়ালে মরব মাথা খুঁড়ে।
কান গেলে আর মুখের পাড়ায় থাকল কি-হে বল?
কানের শোকে আজকে সবাই মিটিং করি চল।
যাচ্ছে, গেল সবই গেল, জাত মেরেছে চিলে,
পাঁজি চিলের ভূত ছাড়াব লাথি-জুতো কিলে।
সুধী সমাজ! শুনুন বলি, এই রেখেছি বাজি,
যে-জন সাধের কান নিয়েছে জান নেব তার আজই।
মিটিং হল ফিটিং হল, কান মেলে না তবু,
ডানে-বাঁয়ে ছুটে বেড়াই মেলান যদি প্রভু!
ছটতে দেখে ছোট ছেলে বলল, কেন মিছে
কানের খোঁজে মরছ ঘুরে সোনার চিলের পিছে?
নেইকো খালে, নেইকো বিলে, নেইকো মাঠে গাছে;
কান যেখানে ছিল আগে সেখানটাতেই আছে।
ঠিক বলেছে, চিল তবে কি নয়কো কানের যম?
বৃথাই মাথার ঘাম ফেলেছি, পণ্ড হল শ্রম।
আজিকার শিশু
সুফিয়া কামাল
আমাদের যুগে আমরা যখন খেলেছি পুতুল খেলা
তোমরা এ যুগে সেই বয়সেই লেখাপড়া কর মেলা।
আমরা যখন আকাশের তলে ওড়ায়েছি শুধু ঘুড়ি
তোমরা এখন কলের জাহাজ চালাও গগন জুড়ি।
উত্তর মেরু, দক্ষিণ মেরু সব তোমাদের জানা
আমরা শুনেছি সেখানে রয়েছে জিন ,পরী, দেও, দানা।
পাতালপুরীর অজানা কাহিনী তোমরা শোনাও সবে
মেরুতে মেরুতে জানা পরিচয় কেমন করিয়া হবে।
তোমাদের ঘরে আলোর অভাব কভূ নাহি হবে আর
আকাশ-আলোক বাঁধি আনি দূর করিবে অন্ধকার।
শস্য-শ্যামলা এই মাটি মা'র অঙ্গ পুষ্ট করে
আনিবে অটুট স্বাস্থ্য, সবল দেহ-মন ঘরে ঘরে।
তোমাদের গানে, কল-কলতানে উছসি উঠিবে নদী-
সরস করিয়া তৃণ ও তরুরে বহিবে সে নিরবধি
তোমরা আনিবে ফুল ও ফসল পাখি-ডাকা রাঙা ভোর
জগৎ করিবে মধুময়, প্রাণে প্রাণে বাঁধি প্রীতিডোর।
আদর্শ ছেলে
কুসুমকুমারী দাশ
আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে
কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে?
মুখে হাসি বুকে বল, তেজে ভরা মন
'মানুষ হইতে হবে'- এই তার পণ।
বিপদ আসিলে কাছে হও আগুয়ান
নাই কি শরীরে তব রক্ত, মাংস, প্রাণ?
হাত পা সবারই আছে, মিছে কেন ভয়?
চেতনা রয়েছে যার, সে কি পড়ে রয়?
সে ছেলে কে চাই বল, কথায় কথায়
আসে যার চোখে জল, মাথা ঘুরে যায়?
মনে প্রাণে খাট সবে, শক্তি কর দান,
তোমরা 'মানুষ' হলে দেশের কল্যাণ।
খোকার বিড়াল ছানা
কুসুমকুমারী দাশ
সোনার ছেলে খোকামণি, তিনটি বিড়াল তার,
একডণ্ড নাহি তাদের করবে চোখের আড় |
খেতে শুতে সকল সময় থাকবে তারা কাছে,
না হ'লে কি খোকামণির খাওয়া দাওয়া আছে?
এত আদর পেয়ে বিড়াছানাগুলি,
দাদা, দিদি, মাসি, পিসি সকল গেছে ভুলি |
সোনামুখী, সোহাগিনী, চাঁদের কণা ব'লে
ডাকে খোকা, ছানাগুলি যায় আদরে গলে |
"সোনামুখী" সবার বড় খোকার কোলে বসে,
"সোহাগিনী" ছোটো যেটি বসে মাথার পাশে |
মাঝখানেতে মানে মানে বসে' "চাঁদের কণা",
একে একে সবাই কোলে করবে আনাগোনা |
দাদার চিঠি
কুসুমকুমারী দাশ
[মুকুল, কার্তিক, ১৩০২]
আয়রে মনা, ভুতো, বুলী আয়রে তাড়াতাড়ি,
দাদার চিঠি এসেছে আজ, শুনাই তোদের পড়ি |
"কলকাতাতে এসেছি ভাই কালকে সকাল বেলা,
হেথায় কত গাড়ি, ঘোড়া, কত লোকের মেলা |
পথের পাশে সারি সারি দু'কাতারে বাড়ি
দিন রাত্তির হুস্ হুস্ করে ছুটেছে রেল গাড়ি |
আমি কি ভাই গেছি বুলে তোদের মলিন মুখ,
মনে পড়লে এখনও যে কেঁপে ওঠে বুক |
সেই যে মায়ের জলে ভরা স্নেহের নয়ন দু'টি
সেই যে আমার হাতটি ছেড়ে দিতে চায় নি পুঁটি---
ভূতি মনার আবদারে ভাব, দাদা, কোথায় যাবে?
যদি তুমি যেতে চাও তো সঙ্গে মোদের নেবে |"
সেই যে বুলী ঠোঁট কাপায়ে চুলের গোছা ছেড়ে
"যেতে নাহি দিব" ব'লে দাঁড়িয়েছিল দোরে---
সেই যে নলিন ষ্টেশন ঘরে চোখে কাপড় দিয়ে
কাঁদছিলি তুই হাতখানি মোর তোর হাতেতে নিয়ে |
সে সব কথা মনে প'ড়ে চোখে আসছে জল
দিনে দিনে কমে যাচ্ছে ভরা বুকের বল |
এসব কথা মায়ের কাছে বলো নাক' ভাই,
আজকে আমি এখান হ'তে বিদায় হ'তে চাই |
আর এক কথা, নিয়মমত লিখো আমায় চিঠি
কেমন আছে ভূতি, মনা, বুলী, ছোট পুঁটি?
মা বাবাকে প্রণাম দিয়ে বলবে আমার কথা,
সিটি কলেজ খুললে আমি ভর্তি হব তথা |
দু'চার দিন আর আছে বাকি, ভাল আছি আমি
আমার হ'য়ে ভাইবোনদের চুমু দিও তুমি |
বিদেশ এলে বুঝতে পারবে কেমন করে প্রাণ,
বুঝেছি ভাই কাকে ব'লে এক রক্তের টান |
এখন আমার চোখের কাছে যেন জগত্খানা
ভাসছে নিয়ে ভূতো, পুঁটি, বুলী, ননী, মনা |'
নদীর স্বপ্ন
বুদ্ধদেব বসু
কোথায় চলেছো? এদিকে এসো না!
দুটো কথা শোনা দিকি,
এই নাও- এই চকচকে ছোটো,
নতুন রূপোর সিকি।
ছোকানুর কাছে দুটো আনি আছে,
তোমারে দিচ্ছি তাও,
আমাদের যদি তোমার সঙ্গে
নৌকায় তুলে নাও।
নৌকা তোমার ঘাটে বাঁধা আছে-
যাবে কি অনেক দূরে?
পায়ে পড়ি, মাঝি, সাথে নিয়ে চলো
মোরে আর ছোকানুরে।
আমারে চেনো না? আমি যে কানাই।
ছোকানু আমার বোন।
তোমার সঙ্গে বেড়াবো আমরা
মেঘনা,পদ্মা,শোন।
শোনো, মা এখন ঘুমিয়ে আছেন
দিদি গেছে ইশকুলে,
এই ফাঁকে মোরে – আর ছোকানুরে –
নৌকোয় নাও তুলে।
কোন ভয় নেই – বাবার বকুনি
তোমাকে হবে না খেতে,
যত দোষ সব, আমার- না, আমি
একা নেবো মাথা পেতে।
অনেক রঙের পাল আছে, মাঝি?
বেগুনি, বাদামী, লাল?
হলদেও? – তবে সেটা দাও আজ,
বেগুনিটা দিয়ো কাল।
সবগুলো নদী দেখাবে কিন্তু।
আগে পদ্মায় চলো,
দুপুরের রোদে ঝলমলে জল
বয়ে যায় ছলোছলো।
শুয়ে-শুয়ে দেখি অবাক আকাশ,
আকাশ মস্ত বড়ো,
পৃথিবীর যত নীল রং বুঝি
সেখানে করেছে জড়ো।
ঝাঁকে ঝাঁকে বেঁকে ঐ দ্যাখো পাখি
উড়ে চলে যায় দূরে
উঁচু থেকে ওরা দেখতে কী পায়
মোরে আর ছোকানুরে?
এটা কী? জেলের নৌকা? তাই তো।
জাল টেনে তোলা দায়,
রূপোলি নদীতে রূপোলি ইলিশ-
ইশ, চোখে ঝলসায়।
ইলিশ কিনলে? – আঃ, বেশ, বেশ,
তুমি খুব ভালো, মাঝি।
উনুন ধরাও, ছোকানু দেখাক
রান্নার কারসাজি।
পইঠায় বসে ধোঁয়া-ওঠা ভাত,
টাটকা ইলিশ-ভাজা-
ছোকানু রে, তুই আকাশের রানী,
আমি পদ্মার রাজা।
খাওয়া হলো শেষ, আবার চলছি
দুলছে ছোট্ট নাও,
হালকা নরম হাওয়ায় তোমার
লাল পাল তুলে দাও।
দেখি বসে বসে আকাশের রং
কী আশ্চর্য নীল
ছোটো পাখি আরও ছোটো হয়ে যায়
আকাশের মুখে তিল।
সারাদিন গেলো, সূর্য লুকালো
জলের তলার ঘরে
সোনা হয়ে জ্বালে পদ্মার জল
কালো হলো তার পরে।
সন্ধ্যার বুকে তারা ফুটে ওঠে-
এবার নামাও পাল,
গান ধরো, মাঝি; জলের শব্দ
ঝুপঝুপ দেবে তাল।
ছোকানুর চোখ ঘুমে ঢুলে আসে
আমি ঠিক জেগে আছি
গান গাওয়া হলে আমায় অনেক
গল্প বলবে, মাঝি?
শুনতে শুনতে আমি ঘুমোই
বিছানা বালিশ বিনা –
মাঝি, তুমি দেখো ছোকানুরে, ভাই,
ও বড়োই ভীতু কিনা।
আমার জন্যে কিচ্ছু ভেবো না
আমিতো বড়োই প্রায়
ঝড় এলে ডেকো আমারে – ছোকানু
যেন সুখে ঘুম যায়।
সব নাও, মাঝি, চকচকে সিকি
এই আনি দুটো, তাও।
লক্ষ্মী তো, মোরে – আর ছোকানুরে
নৌকায় তুলে নাও।
আমি যদি বাবা হতুম, বাবা হত খোকা
কাজী নজরুল ইসলাম
আমি যদি বাবা হতুম, বাবা হত খোকা,
না হলে তার নামতা,
মারতাম মাথায় টোকা ||
রোজ যদি হত রবিবার !
কি মজাটাই হত যে আমার !
কেবল ছুটি ! থাকত নাক নামতা লেখা জোকা !
থাকত না কো যুক্ত অক্ষর, অংকে ধরত পোকা ||
খাঁদু-দাদু
কাজী নজরুল ইসলাম
অ-মা! তোমার বাবার নাকে কে মেরেছে ল্যাং?
খাঁদা নাকে নাচ্ছে ন্যাদা- নাক্ ডেঙাডেং ড্যাং!
ওঁর নাকটাকে কে ক’রল খ্যাঁদা র্যাঁ দা বুলিয়ে?
চামচিকে-ছা ব’সে যেন ন্যাজুড় ঝুলিয়ে!
বুড়ো গরুর পিঠে যেন শুয়ে কোলা ব্যাং!
অ-মা! আমি হেসে মরি, নাক ডেঙাডেং ড্যাং!
ওঁর খ্যাঁদা নাকের ছেঁদা দিয়ে টুকি কে দেয় ‘টু’!
ছোড়দি’ বলে সর্দি ওটা, এ রাম! ওয়াক্! থু:!
কাছিম যেন উপুড় হ’য়ে ছড়িয়ে আছেন ঠ্যাং,
অ-মা! আমি হেসে মরি, নাক ডেঙাডেং ড্যাং!
দাদু বুঝি চীনাম্যান্ মা, নাম বুঝি চাং চু?
তাই বুঝি ওঁর মুখটা অমন চ্যাপ্টা সুধাংশু!
জাপান দেশের নোটীশ উনি নাকে এঁটেছেন!
অ-মা! আমি হেসে মরি, নাক ডেঙাডেং ড্যাং!
দাদুর নাকি ছিল না মা অমন বাদুড়-নাক,
ঘুম দিলে ঐ চ্যাপ্টা নাকেই বাজতো সাতটা শাঁখ,
দিদিমা তাই থ্যাবড়া মেরে ধ্যাবড়া করেছেন!
অ-মা! আমি হেসে মরি, নাক ডেঙাডেং ড্যাং!
লম্ফানন্দে লাফ দিয়ে মা চলতে বেঁজির ছা
দাড়ির জালে প’ড়ে যাদুর আঁটকে গেছে গা,
বিল্লি-বাচ্চা দিল্লি যেতে নাসিক এসেছেন!
অ-মা! আমি হেসে মরি, নাক ডেঙাডেং ড্যাং!
দিদিমা কি দাদুর নাকে টাঙতে ‘আলমা নাক্’
গজাল ঠুঁকে দেছেন ভেঙে বাঁকা নাকের কাঁখ?
মুচি এসে দাদুর আমার নাক করেছে ‘ট্যান্’!
অ-মা! আমি হেসে মরি, নাক ডেঙাডেং ড্যাং!
বাঁশির মতন নাসিকা মা মেলে নাসিকে,
সেথায় নিয়ে চল দাদু দেখন-হাসিকে।
সেথায় গিয়ে করুন দাদু গরুড় দেবের ধ্যান,
খাঁদু-দাদু নাকু হবেন, নাক ডেঙাডেং ড্যাং!
লিচু চোর
কাজী নজরুল ইসলাম
বাবুদের তাল-পুকুরে
হাবুদের ডাল-কুকুরে
সে কি বাস করলে তাড়া,
বলি থাম একটু দাড়া।
পুকুরের ঐ কাছে না
লিচুর এক গাছ আছে না
হোথা না আস্তে গিয়ে
য়্যাব্বড় কাস্তে নিয়ে
গাছে গো যেই চড়েছি
ছোট এক ডাল ধরেছি,
ও বাবা মড়াত করে
পড়েছি সরাত জোরে।
পড়বি পড় মালীর ঘাড়েই,
সে ছিল গাছের আড়েই।
ব্যাটা ভাই বড় নচ্ছার,
ধুমাধুম গোটা দুচ্চার
দিলে খুব কিল ও ঘুষি
একদম জোরসে ঠুসি।
আমিও বাগিয়ে থাপড়
দে হাওয়া চাপিয়ে কাপড়
লাফিয়ে ডিঙনু দেয়াল,
দেখি এক ভিটরে শেয়াল!
সেকি ভাই যায় রে ভুলা-
মালীর ঐ পিটুনিগুলা!
কি বলিস ফের হপ্তা!
তৌবা-নাক খপ্তা!
মোসাহেব
কাজী নজরুল ইসলাম
সাহেব কহেন,
চমতকার,
সে চমতকার।
মোসাহেব বলে,
চমতকার সে হতেই
হবে যে, হুজুরের
মতে অমত কার?
সাহেব কহেন,
কি চমতকার, বলেতেই
দাও, আহা হা
মোসাহেব বলে, হুজুরের
কথা শুনেই বুঝেছি,
বাহা হা বাহা হা বাহা হা!
সাহেব কহেন,
কথাটি কি জান,
সেদিন…
মোসাহেব বলে,
জানি না আবার, ঐযে,
কি বলে যেদিন…
সাহেব কহেন, সেদিন
বিকেলে বৃষ্টিটা ছিল
স্বল্প,
মোসাহেব বলে, আহা-
হা, শুনেছ কিবা অপরুপ
গল্প!
সাহেব কহেন,
আরে ম’লো,
আগে বলতেই দাও
গোড়া টা
মোসাহেব বলে,
আহাহা গোড়াটা,
হুজুরের গোড়া, এই চুপ
চুপ ছোড়াটা।
সাহেব কহেন,
কি বলছিলাম,
গোলমালে গেল গুলায়ে
মোসাহেব বলে, হুজুরের
মাথা, গুলাতেই হবে,
দিব হস্ত বুলায়ে?
সাহেব কহেন, শোন
না সেদিন সূর্য
উঠেছে সকালে,
মোসাহেব বলে,
সকালে সূর্য?
আমরা কিন্তু
দেখিনা কাদিলে কোঁকালে।
সাহেব কহেন,
ভাবিলাম যাই,
আসি খানিকটা বেড়ায়ে
মোসাহেব বলে, অমন
সকাল,
যাবে কোথা বাবা,
হুজুরের চোখ এড়ায়ে?
সাহেব কহেন,
হলোনা বেড়ানো, ঘরেই
রহিনু বসিয়া
মোসাহেব বলে, আগেই
বলেছি, হুজুর কি চাষা,
বেড়াবেন হাল চষিয়া?
সাহেব কহেন,
বসিয়া বসিয়া পড়েছি কখন
ঝিমায়ে
মোসাহেব বলে, এই চুপ
কর, হুজুর ঝিমায়,
পাখা কর, ডাক নিমাই-য়ে।
সাহেব কহেন,
ঝিমাইনি, কই
এইতো জেগেই রয়েছি
মোসাহেব বলে, হুজুর
জেগেই রয়েছেন,
তা আগেই
সবারে কয়েছি।
সাহেব কহেন,
জাগিয়া দেখিনু
জুটিয়াছে যত হনুমান
আর অপদেব
হুজুরের চোখ,
যাবে কোথা বাবা,
প্রণমিয়া কয়
মোসাহেব।
সুকুমার রায়
আবোল তাবোল
আয়রে ভোলা খেয়াল-খোলা
স্বপনদোলা নাচিয়ে আয়,
আয়রে পাগল আবোল তাবোল
মত্ত মাদল বাজিয়ে আয়।
আয় যেখানে ক্ষ্যাপার গানে
নাইকো মানে নাইকো সুর।
আয়রে যেথায় উধাও হাওয়ায়
মন ভেসে যায় কোন সুদূর।
আয় ক্ষ্যাপা-মন ঘুচিয়ে বাঁধন
জাগিয়ে নাচন তাধিন্ ধিন্,
আয় বেয়াড়া সৃষ্টিছাড়া
নিয়মহারা হিসাবহীন।
আজগুবি চাল বেঠিক বেতাল
মাতবি মাতাল রঙ্গেতে--
আয়রে তবে ভুলের ভবে
অসম্ভবের ছন্দেতে।।
বড়াই
গাছের গোড়ায় গর্ত করে ব্যাং বেঁধেছেন বাসা,
মনের সুখে গাল ফুলিয়ে গান ধরেছেন খাসা।
রাজার হাতি হাওদা -পিঠে হেলে দুলে আসে-
বাপরে ব'লে ব্যাং বাবাজি গর্তে ঢোকেন ত্রাসে!
রাজার হাতি মেজাজ ভারি হাজার রকম চাল ;
হঠাৎ রেগে মটাং করে ভাঙল গাছের ডাল।
গাছের মাথায় চড়াই পাখি অবাক হ'য়ে কয়-
বাসরে বাস! হাতির গায়ে এমন জোরও হয়!
মুখ বাড়িয়ে ব্যাং বলে, ভাই তাইত তোরে বলি-
"আমরা, অর্থাৎ চার-পেয়েরা, এন্মি ভাবেই চলি"।।
অবাক কাণ্ড
শুন্ছ দাদা! ঐ যে হোথায় বদ্যি বুড়ো থাকে,
সে নাকি রোজ খাবার সময় হাত দিয়ে ভাত মাখে?
শুন্ছি নাকি খিদেও পায় সারাদিন না খেলে?
চক্ষু নাকি আপনি বোজে ঘুমটি তেমন পেলে?
চল্তে গেলে ঠ্যাং নাকি তার ভূয়েঁর পরে ঠেকে?
কান দিয়ে সব শোনে নাকি? চোখ দিয়ে সব দেখে?
শোয় নাকি সে মুণ্ডটাকে শিয়র পানে দিয়ে?
হয় না কি হয় সত্যি মিথ্যা চল্ না দেখি গিয়ে!
ভয় পেয়ো না
ভয় পেয়ো না, ভয় পেয়ো না, তোমায় আমি মারব না-
সত্যি বলছি কুস্তি ক'রে তোমার সঙ্গে পারব না।
মন্টা আমার বড্ড নরম, হাড়ে আমার রাগ্টি নেই,
তোমায় আমি চিবিয়ে খাব এমন আমার সাধ্যি নেই!
মাথায় আমার শিং দেখে ভাই ভয় পেয়েছ কতই না-
জানো না মোর মাথার ব্যারাম, কাউকে আমি গুঁতোই না?
এস এস গর্তে এস, বাস করে যাও চারটি দিন,
আদর ক'রে শিকেয় তুলে রাখব তোমায় রাত্রি দিন।
হাতে আমার মুগুর আছে তাই কি হেথায় থাক্বে না?
মুগুর আমার হাল্কা এমন মারলে তোমায় লাগবে না।
অভয় দিচ্ছি শুন্ছ না যে? ধরব নাকি ঠ্যাং দুটা?
বসলে তোমার মুন্ডু চেপে বুঝবে তখন কান্ডটা!
আমি আছি গিন্নি আছেন, আছে আমার নয় ছেলে-
সবাই মিলে কাম্ড়ে দেব মিথ্যে অমন ভয় পেলে।
গল্প বলা
"এক যে রাজা-", "থাম্ না দাদা,
রাজা নয় সে, রাজ পেয়াদা।"
"তার যে মাতুল-", "মাতুল কি সে?
সবাই জানে সে তার পিসে।"
"তার ছিল এক ছাগল ছানা-"
"ছাগলের কি গজায় ডানা?"
"একদিন তার ছাতের প'রে-"
"ছাত কোথা হে টিনের ঘরে?"
"বাগানের এক উড়ে মালী"-
"মালি নয় ত? মেহের আলী-"
"মনের সাধে গাইছে বেহাগ-"
"বেহাগ তো নয়? বসন্ত রাগ।"
"থোও না বাপু ঘ্যাঁচা ঘেঁচি-"
"আচ্ছা বল চুপ করেছি।"
"এমন সময় বিছানা ছেড়ে
হঠাৎ মামা আসল তেড়ে,
ধরল সে তার ঝুঁটির গোড়া-"
"কোথায় ঝুঁটি ? টাক যে ভরা।"
"হোক না টেকো, তোর তাতে কি?
লক্ষ্মীছাড়া মুখ্যু ঢেঁকি।
ধরব ঠেসে টুঁটির প'রে,
পিট্ব তোমার মুন্ডু ধ'রে-
কথার উপর কেবল কথা,
এখন বাপু পালাও কোথা?"
ট্যাঁশ্ গরু
ট্যাঁশ্ গরু গরু নয়, আসলেতে পাখি সে;
যার খুশি দেখে এস হারুদের আফিসে।
চোখ দুটি ঢুলু ঢুলু, মুখখান মস্ত,
ফিট্ফাট্ কালোচুলে টেরিকাটা চোস্ত।
তিন-বাঁকা শিং তার ল্যাজখানি প্যাঁচান-
একটুকু ছোঁও যদি, বাপরে কি চ্যাঁচান!
লট্খটে হাড়গোড় খট্খট্ ন'ড়ে যায়,
ধম্কালে ল্যাগ্ব্যাগ চমকিয়ে প'ড়ে যায়।
বর্ণিতে রূপ গুণ সাধ্য কি কবিতার,
চেহারার কি বাহার- ঐ দেখ ছবি তার।
ট্যাঁশ্ গরু খাবি খায় ঠ্যাস্ দিয়ে দেয়ালে,
মাঝে মাঝে কেঁদে ফেলে না জানি কি খেয়ালে ;
মাঝে মাঝে তেড়ে ওঠে, মাঝে মাঝে রেগে যায়,
মাঝে মাঝে কুপোকাৎ দাঁতে দাঁত লেগে যায়।
খায় না সে দানাপানি- ঘাস পাতা বিচালি
খায় না সে ছোলা ছাতু ময়দা কি পিঠালি;
রুচি নাই আমিষেতে, রুচি নাই পায়েসে
সাবানের সুপ আর মোমবাতি খায় সে।
আর কিছু খেলে তার কাশি ওঠে খক্খক্,
সারা গায়ে ঘিন্ ঘিন্ ঠ্যাং কাঁপে ঠক্ঠক্।
একদিন খেয়েছিল ন্যাকড়ার ফালি সে-
তিন মাস আধমরা শুয়েছিল বালিশে।
কারো যদি শখ্ থাকে ট্যাঁশ গরু কিনতে ,
সস্তায় দিতে পারি,দেখ ভেবে চিন্তে।
খিচুড়ি
হাঁস ছিল, সজারু, (ব্যাকরণ মানি না),
হয়ে গেলে "হাঁসজারু" কেমনে তা জানি না।
বক কহে কচ্ছপে "বাহবা কি ফুর্তি!
অতি খাসা আমাদের বকচ্ছপ মূর্তি।"
টিয়ামুখো গিরগিটি মনে ভারি শঙ্কা
পোকা ছেড়ে শেষে কিগো খাবে কাঁচা লঙ্কা?
ছাগলের পেটে ছিল না জানি কি ফন্দি,
চাপিল বিছার ঘাড়ে, ধড়ে মুড়ো সন্ধি!
জিরাফের সাধ নাই মাঠে ঘাটে ঘুরিতে,
ফড়িঙের ঢং ধরি, সেও চায় উড়িতে।
গরু বলে, "আমারেও ধরিলো কি ও রোগে?
মোর পিছে লাগে কেন হতভাগা মোরগে?"
হাতিমির দশা দেখ , তিমি ভাবে জলে যাই,
হাতি বলে, "এই বেলা জঙ্গলে চল ভাই"।
সিংহের শিং নেই, এই তার কষ্ট
হরিণের সাথে মিলে শিং হল পষ্ট।
গোঁফ চুরি
হেড আফিসের বড় বাবু লোকটি বড় শান্ত,
তার যে এমন মাথায় ব্যামো কেউ কখনো জানত?
দিব্যি ছিলেন খোসমেজাজে চেয়ারখানি চেপে,
একলা ব'সে ঝিমঝিমিয়ে হঠাৎ গেলেন ক্ষেপে!
আৎকে উঠে হাতে পা ছুঁড়ে চোখটি ক'রে গোল
হঠাৎ বলেন, "গেলুম গেলুম, আমায় ধ'রে তোল"!
তাই শুনে কেউ বদ্যি ডাকে , কেউ বা হাঁকে পুলিশ,
কেউবা বলে, "কামড়ে দেবে সাবধানেতে তুলিস।
ব্যস্ত সবাই এদিক ওদিক করছে ঘোরাঘুরি
বাবু হাঁকেন, "ওরে আমার গোঁফ গিয়েছে চুরি"!
গোঁফ হারান! আজব কথা ! তাও কি হয় সত্যি?
গোফ জোড়া ত তেমনি আছে, কমেনি এক রত্তি!
সবাই তাঁরে বুঝিয়ে বলে, সামনে ধ'রে আয়না,
মোটেও গোঁফ হয়নি চুরি, কক্ষনো তা হয় না।
রেগে আগুন তেলে বেগুন, তেড়ে বলেন তিনি,
"কারো কথার ধার ধারিনে, সব ব্যাটাকেই চিনি।
নোংরা ছাঁটা খ্যাংরা ঝাঁটা বিচ্ছিরি আর ময়লা,
এমন গোফ ত রাখ্ত জানি শ্যামবাবুদের গয়লা।
এ গোঁফ যদি আমার বলিস করব তোদের জবাই"
এই না ব'লে জরিমানা কল্লেন তিনি সবায়।
ভীষণ রেগে বিষম খেয়ে দিলেন লিখে খাতায়
"কাউকে বেশি লাই দিতে নেই, সবাই চড়ে মাথায়।
আফিসের এই বাঁদরগুলো, মাথায় খালি গোবর
গোঁফ জোড়া যে কোথায় গেলে কেউ রাখে না খবর।
ইচ্ছে করে এই ব্যাটাদের গোঁফ ধরে খুব নাচি,
মুখ্যুগুলোর মুন্ড ধ'রে কোদাল দিয়ে চাঁচি।
গোঁফকে বলে তোমার আমার গোঁফ কি কারো কেনা?
গোঁফের আমি গোফের তুমি, তাই দিয়ে যায় চেনা।"
সৎপাত্র
শুনতে পেলুম পোস্তা গিয়ে-
তোমার নাকি মেয়ের বিয়ে?
গঙ্গারামকে পাত্র পেলে?
জানতে চাও সে কেমন ছেলে?
মন্দ নয়, সে পাত্র ভাল-
রঙ যদিও বেজায় কালো;
তার উপরে মুখের গঠন
অনেকটা ঠিক প্যাঁচার মতন।
বিদ্যে বুদ্ধি? বলছি মশাই-
ধন্যি ছেলের অধ্যবসায়!
উনিশটি বার ম্যাট্টিকে সে
ঘায়েল হ'য়ে থামল শেষে।
বিষয় আশয় ? গরীব বেজায়-
কষ্টে- সৃষ্টে দিন চলে যায়।
মানুষ ত নয় ভাইগুলো তার
একটা পাগল একটা গোঁয়ার ;
আরেকটি সে তৈরি ছেলে,
জাল করে নোট গেছেন জেলে।
কনিষ্ঠটি তবলা বাজায়
যাত্রাদলে পাঁচ টাকা পায়।
গঙ্গারাম ত কেবল ভোগে
পিলের জ্বর আর পান্ডু রোগে।
কিন্তু তারা উচ্চ ঘর,
কংসরাজের বংশধর!
শ্যাম লাহিড়ী বনগ্রামের
কি যেন হয়ে গঙ্গারামের।-
যাহোক্, এবার পাত্র পেলে,
এমন কি আর মন্দ ছেলে?
বুড়ীর বাড়ি
গালভরা হাসিমুখে চালভাজা মুড়ি,
ঝুরঝুরে পড়ো ঘরে থুর থুরে বুড়ী।
কাঁথাভরা ঝুলকালি, মাথাভরা ধলো,
মিট্মিটে ঘোলা চোখ, পিঠখানা কুলো।
কাঁটা দিয়ে আঁটা ঘর- আঠা দিয়ে সেঁটে,
সুতো দিয়ে বেঁধে রাখে থুতু দিয়ে চেটে।
ভর দিতে ভয় হয় ঘর বুঝি পড়ে,
খক্খক্ কাশি দিলে ঠক্ঠক্ নড়ে।
ডাকে যদি ফিরিওলা হাঁকে যদি গাড়ি,
খসে পড়ে কড়িকাঠ ধসে পড়ে বাড়ী।
বাঁকাচোরা ঘরদোর ফাঁকা ফাঁকা কত,
ঝাঁট দিলে ঝ'রে পড়ে কাঠকুটো যত।
ছাদ গুলো ঝুলে পড়ে বাদ্লায় ভিজে,
একা বুড়ি কাঠী গুজে ঠেকা দেয় নিজে।
মেরামত দিন রাত কেরামত ভারি,
থুরথুরে বুড়ী তার ঝুরঝুরে বাড়ী।
বোম্বাগড়ের রাজা
কেউ কি জান সদাই কেন বোম্বাগড়ের রাজা-
ছবির ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখে আমসত্ত্ব ভাজা?
রানীর মাথায় অষ্টপ্রহর কেন বালিশ বাঁধা?
পাঁউরুটিতে পেরেক ঠোকে কেন রানীর দাদা?
কেন সেথায় সর্দি হলে ডিগবাজি খায় লোকে?
জোছ্নাথ রাতে সবাই কেন আলতা মাথায় চোখে?
ওস্তাদেরা লেপ মুড়ি দেয় কেন মাথায় ঘাড়ে?
টাকের পরে পন্ডিতেরা ডাকের টিকিট মারে।
রাত্রে কেন ট্যাঁক্ঘড়িটা ডুবিয়ে রাখে ঘিয়ে।
কেন রাজার বিছ্না পাতে শিরীষ কাগজ দিয়ে?
সভায় কেন চেঁচায় রাজা "হুক্কা হুয়া" বলে?
মন্ত্রী কেন কলসী বাজায় বসে রাজার কোলে?
সিংহাসনে ঝোলায় কেন ভাঙা বোতল শিশি?
কুমড়ো নিয়ে ক্রিকেট খেলে কেন রাজার পিসী?
রাজার খুড়ো নাচেন কেন হুঁকোর মালা পরে?
এমন কেন ঘটছে তা কেউ বলতে পার মোরে?
ঠিকানা
আরে আরে জগমোহন- এস ,এস,এস-
বলতে পার কোথায় থাকে আদ্যনাথের মেশো?
আদ্যনাথের নাম শোননি? খগেনকে তো চেনো?
শ্যাম বাগচি খগেনেরই মামাশ্বশুর জেনো।
শ্যামের জামাই কেষ্টমোহন, তার যে বাড়ীওলা-
(কি যেন নাম ভুলে গেছি), তারই মামার শালা;
তারই পিশের খড়তুতো ভাই আদ্যনাথের মেশো-
লক্ষী দাদা ,ঠিকানা তার একটু জেনে এসো।
ঠিকানা চাও? বলছি শোন; আমড়াতলার মোড়ে
তিন-মুখো তিন রাস্তা গেছে তারি একটা ধ'রে,
চলবে সিধে নাক বরাবর, ডান দিকে চোখ রেখে;
চলতে চলতে দেখবে শেষে রাস্তা গেছে বেঁকে।
দেখবে সেথায় ডাইনে বায়ে পথ গিয়াছে কত,
তারি ভিতর ঘুরবে খানিক গোলকধাঁধাঁর মত।
তারপরেতে হঠাৎ বেঁকে ডাইনে মোচর মেরে ,
ফিরবে আবার বাঁয়ের দিকে তিনটে গলি ছেড়ে।
তবেই আবার পড়বে এসে আমড়া তলার মোড়ে-
তারপরে যাও যেথায় খুশি- জ্বালিয়ে নাকো মোরে ।
একুশে আইন
শিবঠাকুরের আপন দেশে ,
আইন কানুন সর্বনেশে!
কেউ যদি যায় পিছলে প'ড়ে,
প্যায়দা এসে পাক্ড়ে ধরে ,
কাজির কাছে হয় বিচার-
একুশ টাকা দন্ড তার।।
সেথায় সন্ধে ছটার আগে
হাঁচতে হলে টিকিট লাগে
হাঁচলে পরে বিন্ টিকিটে
দম্দলমাদম্ লাগায় পিঠে ,
কোটাল এসে নস্যি ঝাড়ে-
একুশ দফা হাচিয়ে মারে।।
কারুর যদি দাতটি নড়ে,
চার্টি টাকা মাশুল ধরে ,
কারুর যদি গোঁফ গজায় ,
একশো আনা ট্যাক্সো চায়-
খুঁচিয়ে পিঠে গুঁজিয়ে ঘাড়,
সেলাম ঠোকায় একুশ বার।।
চলতে গিয়ে কেউ যদি চায়
এদিক্ ওদিক্ ডাইনে বাঁয়,
রাজার কাছে খবর ছোটে,
পল্টনেরা লাফিয়ে ওঠে ,
দুপুরে রোদে ঘামিয়ে তায়-
একুশ হাতা জল গেলায়।।
যে সব লোকে পদ্য লেখে,
তাদের ধরে খাঁচায় রেখে,
কানের কাছে নানান্ সুরে
নামতা শোনায় একশো উড়ে,
সামনে রেখে মুদীর খাতা-
হিসেব কষায় একুশ পাতা।।
হঠাৎ সেথায় রাত দুপুরে
নাক ডাকালে ঘুমের ঘোরে,
অম্নি তেড়ে মাথায় ঘষে,
গোবর গুলে বেলের কষে,
একুশটি পাক ঘুরিয়ে তাকে-
একুশ ঘন্টা ঝুলিয়ে রাখে।।
রামগরুড়ের ছানা
রামগরুড়ের ছানা হাসতে তাদের মানা,
হাসির কথা শুনলে বলে,
"হাসব্ না-না, না-না"।
সদাই মরে ত্রাসে- ঐ বুঝি কেউ হাসে!
এক চোখে তাই মিট্মিটিয়ে
তাকায় আশে পাশে।
ঘুম নাহি তার চোখে আপনি বকে বকে
আপনারে কয়, "হাসিস্ যদি
মারব কিন্তু তোকে!"
যায় না বনের কাছে, কিম্বা গাছে গাছে,
দখিন হাওয়ার সুড়সুড়িতে
হাসিয়ে ফেলে পাছে!
সোয়াস্তি নেই মনে- মেঘের কোণে কোণে
হাসির বাষ্প উঠ্ছে ফেঁপে
কান পেতে তাই শোনে।
ঝোপের ধারে ধারে রাতের অন্ধকারে
জোনাক্ জ্বলে আলোর তালে
হাসির ঠারে ঠারে ।
হাসতে হাসতে যারা হচ্ছে কেবল সারা
রামগরুড়ের লাগছে ব্যথা
বুঝছে না কি তারা?
রামগরুড়ের বাসা ধমক দিয়ে ঠাসা,
হাসির হাওয়া বন্ধ সেথায়
নিষেধ সেথায় হাসা।
নারদ নারদ
"হ্যাঁরে হ্যাঁরে তুই নাকি কাল, সাদাকে বলছিলি লাল?
(আর) সেদিন নাকি রাত্রি জুড়ে, নাক ডেকেছিস্ বিশ্রী সুরে?
(আর) তোদের পোষা বেড়ালগুলো, শুন্ছি নাকি বেজায় হুলো?
(আর) এই যে শুনি তোদের বাড়ি, কেউ নাকি রাখে না দাড়ি?
ক্যান্ রে ব্যাটা ইসটুপিড? ঠেঙিয়ে তোরে করব ঢিট্!"
"চোপরাও তুম্ স্পিকটি নট্, মার্ব রেগে পটাপট্-
ফের যদি ট্যারাবি চোখ, কিম্বা আবার কর্বি রোখ,
কিম্বা যদি অম্নি ক'রে, মিথ্যেমিথ্যি চ্যাঁচাস জোরে-
আই ডোন্ট কেয়ার কানাকড়ি- জানিস্ আমি স্যান্ডো করি?"
"ফের লাফাচ্ছিস্! অল্রাইট, কামেন্ ফাইট ! কামেন্ ফাইট!"
"ঘুঘু দেখেছ, ফাঁদ দেখনি, টেরটা পাবে আজ এখনি!
আজকে যদি থাক্ত মামা, পিটিয়ে তোমায় করত ধামা।"
"আরে! আরে! মার্বি নাকি? দাঁড়া একটা পুলিশ ডাকি!"
"হাঁহাঁহাঁহাঁ! রাগ করো না, করতে চাও কি তাই বল না!"
"হাঁ হাঁ তাতো সত্যি বটেই, আমি তো চটিনি মোটেই!
মিথ্যে কেন লড়তে যাবি? ভেরি- ভেরি সরি মশলা খাবি?"
"শেক্হ্যান্ড আর দাদা বল, সব শোধ বোধ ঘরে চল।"
"ডোন্ট পরোয়া অল্ রাইট্, হাউ ডু য়ু ডু গুড্ নাইট।"
কাজের লোক
প্রথম।
বাঃ - আমার নাম 'বাঃ',
বসে থাকি তোফা তুলে পায়ের উপর পা!
লেখাপড়ার ধার ধারিনে , বছর ভরে ছুটি,
হেসে খেলে আরাম ক'রে দুশো মজা লুটি।
কারে কবে কেয়ার করি , কিসের করি ডর?
কাজের নামে কম্প দিয়ে গায়ে আসে জ্বর।
গাধার মতন খাটিস্ তোরা মুখটা করে চুন-
আহাম্মুকি কান্ড দেখে হেসেই আমি খুন।
সকলে।
আস্ত একটি গাধা তুমি স্পষ্ট গেল দেখা,
হাস্ছ যত, কান্না তত কপালেতে লেখা।
দ্বিতীয়।
'যদি' বলে ডাকে আমায় নামটি আমার যদি -
আশায় আশায় বসে থাকি হেলনা দিয়ে গদি।
সব কাজেতে থাকতে যদি খেলার মত মজা,
লেখাপড়া হত যদি জলের মত সোজা -
স্যান্ডো সমান ষন্ডা হতাম যদি গায়ের জোরে,
প্রশংসাতে আকাশ পাতাল যদি যেত ভরে -
উঠে পড়ে গেলে যেতাম বাজে তর্ক ফেলে।
করতে পারি সবি - যদি সহজ উপায় মেলে।
সকলে।
হাতের কাছে সুযোগ, তবু যদির আশায় বসে
নিজের মাথা খাচ্ছ বাপু নিজের বুদ্ধি দোষে
তৃতীয়।
আমার নাম 'বটে' আমি সদাই আছি চটে-
কট্মটিয়ে তাকাই যখন, সবাই পালায় ছুটে।
চশমা পরে বিচার ক'রে চিরে দেখাই চুল-
উঠ্তে বস্তে কচ্ছে সবাই হাজার গন্ডা ভুল।
আমার চোখে ধুলো দেবে সাধ্যি আছে কার?
ধমক শুনে ভূতের বাবা হচ্ছে পগার পার।
হাসছ? বটে ভাবছ বুঝি মস্ত তুমি লোক,
একটি আমার ভেংচি খেলে উল্টে যাবে চোখ।
সকলে।
দিচ্ছ গালি, লোকের তাতে কিবা এল গেল?
আকাশেতে থুতু ছুঁড়ে - নিজেই গায়েই ফেল।
চতুর্থ।
আমার নাম 'কিন্তু' আমায় 'কিন্তু' বলে ডাকে,
সকল কাজে একটা কিছু গলদ লেগে থাকে।
দমটা কাজে লাগি কিন্তু আটটা করি মাটি,
ষোল আনা কথায় কিন্তু সিকি মাত্র খাঁটি।
লম্ফ ঝম্ফবহুৎ কিন্তু কাজের নাইকো ছিরি-
ফোস করে যাই তেড়ে - আবার ল্যাজ গুটিয়ে ফিরি।
পাঁচটা জিনিস গড়তে গেলে দশটা ভেঙে চুর -
বল্ দেখি ভাই কেমন আমি সাবাস বাহাদুর!
সকলে।
উচিত তোমায় বেধে রাখা নাকে দিয়ে দড়ি,
বেগারখাটা পশুকাজের মূল্য কানাকড়ি।
পঞ্চম।
আমার নাম 'তবু' তোমার কেউ কি আময়ি চেনো?
দেখতে ছোট তবু আমার সাহস আছে জেনো।
এতটুকু মানুষ তবু দ্বিধা নাইকো মনে,
যে কাজেতেই লাগি আমি খাটি প্রাণপণে।
এম্নি আমার জেদ, যখন অঙ্ক নিয়ে বসি,
একুশ বারে না হয় যদি বাইশ বারে কষি।
হাজার আসুক বাধা তবু উৎসাহ না কমে,
হাজার লোকে চোখ রাঙালে তবু না যাই দ'মে।
সকলে।
নিস্কম্মারা গেল কোথা,পালাল কোন দেশে?
কাজের মানুষ কারে বলে দেখুন এখন এসে।
হেসে খেলে, শুয়ে বসে কত সময় যায়,
সময়টা যে কাজে লাগায়,চালাক বলে তায়।
নিঃস্বার্থ
গোপালটা কি হিংসুটে মা! খাবার দিলেম ভাগ করে,
বল্লে নাকো মুখেও কিছু, ফেল্লে ছুঁড়ে রাগ করে।
জ্যেঠাইমা যে মেঠাই দিলেন, ‘দুই ভায়েতে খাও বলে’−
দশটি ছিল, একটি তাহার চাখতে দিলেম ফাও বলে,
আর যে নটি, ভাগ করে তায় তিনটে দিলেম গোপালকে−
তবুও কেবল হ্যাংলা ছেলে আমার ভাগেই চোখ রাখে।
বুঝিয়ে বলি, কাঁদিস কেন? তুই যে নেহাৎ কনিষ্ঠ,
বয়স বুঝে, সামলে খাবি, তা নইলে হয় অনিষ্ট।
তিনটি বছর তফাৎ মোদের, জ্যায়দা হিসাব গুণতি তাই,
মোদ্দা আমার ছয়খানি হয়, তিন বছরে তিনটি পাই,
তাও মানে না কেবল কাঁদে, স্বার্থপরের শয়তানি,
শেষটা আমার মেঠাইগুলো খেতেই হলো সবখানি।
হিংসুটিদের গান
আমরা ভালো লক্ষী সবাই, তোমরা ভারি বিশ্রী,
তোমরা খাবে নিমের পাচন, আমরা খাব মিশ্রী।
আমরা পাব খেলনা পুতুল ,আমরা পাব চম্চম্,
তোমরা ত তা পাচ্ছ না কেউ, পেলে ও পাবে কম কম
আমরা শোব খাট পালঙে মায়ের কাছে ঘেঁষ্টে,
তোমরা শোবে অন্ধকারে একলা ভয়ে ভেস্তে।
আমরা যাব জাম্তাড়াতে চড়ব কেমন ট্রেইনে,
চেঁচাও যদি "সঙ্গে নে যাও" বল্ব "কলা এইনে"!
আমরা ফিরি বুক ফুলিয়ে রঙিন্ জুতোয় মচ্মচ্,
তোমরা হাঁদা নোংরা ছিছি হ্যাংলা নাকে ফচ্ফচ্।
আমরা পরি রেশ্মি জরি, আমরা পরি গয়না,
তোমরা সেসব পাও না ব'লে তাও তোমাদের সয় না।
আমরা হব লাট মেজাজী, তোমরা হবে কিপ্টে,
চাইবে যদি কিচ্ছু তখন ধরব গলা চিপ্টে।
সঙ্গীহারা
সবাই নাচে ফূর্তি করে সবাই করে গান,
একলা বসে হাঁড়িচাঁচার মুখটি কেন ম্লান ?
দেখ্ছ নাকি আমার সাথে সবাই করে আড়ি-
তাইত আমার মেজাজ খ্যাপা মুখটি এমন হাঁড়ি ।
তাও কি হয় ! ঐ যে মাঠে শালিখ পাখি ডাকে
তার কাছে কৈ যাওনিকো ভাই শুধাওনিতো তাকে !
শালিখ পাখি বেজায় ঠ্যাঁটা চেঁচায় মিছিমিছি,
হল্লা শুনে হাড় জ্বলে যায় কেবল কিচিমিচি ।
মিষ্টি সুরে দোয়েল পাখি জুড়িয়ে দিল প্রাণ
তার কাছে কৈ বস্লে নাতো শুনলে না তার গান ।
দোয়েল পাখির ঘ্যান্ঘ্যানানি আর কি লাগে ভালো ?
যেমন রূপে তেমন গুণে তেমনি আবার কালো ।
রূপ যদি চাও যাও না কেন মাছরাঙার কাছে,
অমন খাসা রঙের বাহার আর কি কারো আছে ?
মাছরাঙা ? তারেও কি আর পাখির মধ্যে ধরি
রকম সকম সঙের মতন, দেমাক দেখে মরি ।
পায়রা ঘুঘু কোকিল চড়াই চন্দনা টুনটুনি
কারে তোমার পছন্দ হয়, সেই কথাটি শুনি !
এই গুলো সব ছ্যাবলা পাখি নেহাৎ ছোট জাত-
দেখলে আমি তফাৎ হাটি অমনি পঁচিশ হাত ।
এতক্ষণে বুঝতে পারি ব্যাপারখানা কি যে-
সবার তুমি খুঁৎ পেয়েছ নিখুঁৎ কেবল নিজে !
মনের মতন সঙ্গী তোমার কপালে নাই লেখা
তাইতে তোমায় কেউ পোঁছে না তাইতে থাক একা ।
জীবনের হিসাব
বিদ্যেবোঝাই বাবুমশাই চড়ি সখের বোটে
মাঝিরে কন , "বলতে পারিস্ সূর্যি কেন ওঠে?
চাঁদটা কেন বাড়ে কমে? জোয়ার কেন আসে?"
বৃদ্ধ মাঝি অবাক হয়ে ফ্যাল্ফেলিয়ে হাসে।
বাবু বলেন, "সারা জনম মরলিরে তুই খাটি,
জ্ঞান বিনা তোর জীবনটা যে চারি আনাই মাটি!"
খানিক বাদে কহেন বাবু,"বলত দেখি ভেবে
নদীর ধারা কেম্নে আসে পাহাড় হতে নেবে?
বলত কেন লবণপোরা সাগরভরা পানি?"
মাঝি সে কয়, "আরে মশাই , অত কি আর জানি?"
বাবু বলেন, "এই বয়সে জানিসনেও তা কি?
জীবনটা তোর নেহাৎ খেলো, অষ্ট আনাই ফাকি।"
আবার ভেবে কহেন বাবু, "বলতো ওরে বুড়ো,
কেন এমন নীল দেখা যায় আকাশের ঐ চুড়ো?
বল্তো দেখি সূর্য চাঁদে গ্রহণ লাগে কেন?"
বৃদ্ধ বলে, "আমায় কেন লজ্জা দেছেন হেন?"
বাবু বলেন, "বলব কি আর, বলব তোরে কি তা,-
দেখছি এখন জীবনটা তোর বারো আনাই বৃথা।"
খানিক বাদে ঝড় উঠেছে, ঢেউ উঠেছে ফুলে,
বাবু দেখেন নৌকাখানি ডুব্ল বুঝি দুলে।
মাঝিরে কন, "একি আপদ! ওরে ও ভাই মাঝি,
ডুবল নাকি নৌকো এবার ? মরব নাকি আজি?"
মাঝি শুধায়, "সাঁতার জানো? মাথা নাড়েন বাবু"
মুর্খ মাঝি বলে, "মশাই , এখন কেন কাবু?
বাঁচলে শেষে আমার কথা হিসেব কারো পিছে,
তোমার দেখি জীবনখানা ষোল আনাই মিছে!"
নিরুপায়
বসি বছরের পয়লা তারিখে
মনের খাতায় রাখিলাম লিখে-
"সহজ উদরে ধরিবে যেটুক্,
সেইটুকু খাব হব না পেটুক।"
মাস দুই যেতে খাতা খুলে দেখি,
এরি মাঝে মন লিখিয়াছে একি!
লিখিয়াছে, "যদি নেমন্তন্নে
কেঁদে ওঠে প্রাণ লুচির জন্যে,
উচিত হবে কি কাঁদান তাহারে?
কিম্বা যখন বিপুল আহারে ,
তেড়ে দেয় পাতে পোলাও কালিয়া
পায়েস অথবা রাবড়ি ঢালিয়া-
তখন কি করি, আমি নিরূপায়!
তাড়াতে না পারি, বলি আয় আয়,
ঢুকে আয় মুখে দুয়ার ঠেলিয়া
উদার রয়েছি উদর মেলিয়া!"
নন্দ গুপী
হঠাৎ কেন দুপুর রোদে চাদর দিয়ে মুড়ি,
চোরের মত নন্দগোপাল চলছে গুড়ি গুড়ি?
লুকিয়ে বুঝি মুখোশখানা রাখছে চুপি চুপি?
আজকে রাতে অন্ধকারে টেরটা পাবেন গুপি!
আয়না হাতে দাঁড়িয়ে গুপি হাসছে কেন খালি?
বিকট রকম পোশাক করে মাখছে মুখে কালি!
এম্মি করে লম্ফ দিয়ে ভেংচি যখন দেবে
নন্দ কেমন আঁৎকে যাবে -হাস্ছে সে তাই ভেবে।
আঁধার রাতে পাতার ফাঁকে ভূতের মতন কে রে?
ফন্দি এঁটে নন্দগোপাল মুখোশ মুখে ফেরে!
কোথায় গুপি, আসুক না সে ইদিক্ পানে ঘুরে-
নন্দদাদার হুঙ্কারে তার প্রাণটি যাবে উড়ে।
হেথায় কে রে মূর্তি ভীষণ মুখটি ভরা গোঁফে?
চিমটে হাতে জংলা গুপি বেড়ায় ঝাড়ে ঝোপে!
নন্দ যখন বাড়ির পথে আসবে গাছের আড়ে,
"মার্ মার্ মার কাট্রে"লে পড়বে তাহার ঘাড়ে।
নন্দ চলেন এক পা দু পা আস্তে ধীরে গতি,
টিপ্টিপিয়ে চলেন গুপি সাবধানেতে অতি-
মোড়ের মুখে ঝোপের কাছে মার্তে গিয়ে উকি
দুই সেয়ানে এক্কেবারে হঠাৎ মুখোমুখি!
নন্দ তখন ফন্দি ফাঁদন কোথায় গেল ভুলি
কোথায় গেল গুপির মুখে মার্ মার্ মার্ বুলি।
নন্দ পড়েন দাঁতকপাটি মুখোশ টুখোশ ছেড়ে
গুপির গায়ে জ্বরটি এল কম্প দিয়ে তেড়ে
গ্রামের লোকে দৌড়ে তখন বদ্যি আনে ডেকে,
কেউ বা নাচে কেউ বা কাঁদে রকম সকম দেখে।
নন্দগুপির মন্দ কপাল এম্নি হল শেষে,
দেখ্লে তাদের লুটোপুটি সবাই মেরে হেসে।
কৃতজ্ঞতা : অন্তর্জাল
০৫ ই নভেম্বর, ২০১৫ সকাল ৯:৩৯
আলোরিকা বলেছেন: ধন্যবাদ দাদাভাইয়া । শুভ কামনা
২| ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১০:৪২
কিরমানী লিটন বলেছেন: ঐ খানে তোর বাপ যে ঘুমিয়ে,ঐ খানে তোর মা-
ঐ খানে তোর দাদীর কবর-ডালিম গাছের তলে,
তিরিশ বছর ভিজিয়ে রেখেছি-দুই নয়নের জলে... কিংবা
তবু বলিয়াছি,মা'র গলা ধরে,মাগো-সেই কথা বলো...
মুগ্ধ সব স্মৃতির জানালা,নিত্য খুলে রাখি অতলের গভীরে,বিবেক আর বোধে!!!আর সেইসব নান্দনিক ভালোলাগার দরজা-জানালায় আরও একবার উঁকি দেয়ার সুযোগ করে দেয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ আপনাকে সুপ্রিয় আলোরিকা আপুমনিকে।
সতত শুভকামনা রইলো ...!!!
০৫ ই নভেম্বর, ২০১৫ সকাল ৯:৪২
আলোরিকা বলেছেন: 'মুগ্ধ সব স্মৃতির জানালা,নিত্য খুলে রাখি অতলের গভীরে,বিবেক আর বোধে!!!' - অসাধারণ ভাইয়া । ভাল থাকবেন । শুভ কামনা ।
৩| ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১০:৫৩
আহমেদ জী এস বলেছেন: আলোরিকা ,
শৈশবের স্মৃতি জাগানিয়া কিছু শেয়ার করেছেন ।
কিরমানী লিটনের কথাগুলোরই সুর ধরে বলি ----- শৈশবের নান্দনিক ভালোলাগার দরজা-জানালায় আরও একবার উঁকি দেয়ার সুযোগ করে দেয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ আপনাকে ।
০৫ ই নভেম্বর, ২০১৫ সকাল ৯:৪৮
আলোরিকা বলেছেন: মিষ্টি ছেলেবেলায় মাঝে মাঝে ডুব দেয়ার জন্য এ পোস্টটি তৈরি করা আরকি
আপনাদের ভাল লাগায় ধন্য । ভাল থাকবেন ।
৪| ০৫ ই নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১২:৫৯
আমিনুর রহমান বলেছেন:
শৈশবের স্মৃতি মনে করিয়ে দিলেন।
পোষ্ট প্রিয়তে +
০৫ ই নভেম্বর, ২০১৫ সকাল ১০:০৯
আলোরিকা বলেছেন: যায় কি ভোলা শৈশবের সেই দিনগুলো !
ধন্যবাদ । ভাল থাকবেন ।
৫| ০৫ ই নভেম্বর, ২০১৫ সকাল ১১:৫৭
প্রামানিক বলেছেন: ছড়াগুলো পড়ে মূহুর্তেই সেই ছোটকালে চলে গেলাম। ধন্যবাদ আপনাকে এরকম একটা পোষ্ট দেয়ার জন্য।
০৫ ই নভেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১২:১১
আলোরিকা বলেছেন: ধন্যবাদ ভাইয়া
৬| ০৫ ই নভেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১২:৪৯
কান্ডারি অথর্ব বলেছেন:
সুন্দর পোষ্ট। তিন নং লাইক।
শৈশবের স্মৃতি সব সময় মধুর হয়।
০৫ ই নভেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১:১৫
আলোরিকা বলেছেন: ধন্যবাদ কাণ্ডারি । ভাল থাকবেন ।
৭| ০৫ ই নভেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১২:৫৯
রিকি বলেছেন: আমার প্রিয় শিশুর এই কবিতাটি---
লুকোচুরি
আমি যদি দুষ্টুমি করে
চাঁপার গাছে চাঁপা হয়ে ফুটি,
ভোরের বেলা মা গো, ডালের ‘পরে
কচি পাতায় করি লুটোপুটি,
তবে তুমি আমার কাছে হারো,
তখন কি মা চিনতে আমায় পারো।
তুমি ডাক, ‘খোকা কোথায় ওরে। '
আমি শুধু হাসি চুপটি করে।
যখন তুমি থাকবে যে কাজ নিয়ে
সবই আমি দেখব নয়ন মেলে।
স্নানটি করে চাঁপার তলা দিয়ে
আসবে তুমি পিঠেতে চুল ফেলে;
এখান দিয়ে পুজোর ঘরে যাবে,
দূরের থেকে ফুলের গন্ধ পাবে—
তখন তুমি বুঝতে পারবে না সে
তোমার খোকার গায়ের গন্ধ আসে।
দুপুর বেলা মহাভারত-হাতে
বসবে তুমি সবার খাওয়া হলে,
গাছের ছায়া ঘরের জানালাতে
পড়বে এসে তোমার পিঠে কোলে,
আমি আমার ছোট্ট ছায়াখানি
দোলাব তোর বইয়ের ‘পরে আনি—
তখন তুমি বুঝতে পারবে না সে
তোমার চোখে খোকার ছায়া ভাসে।
সন্ধেবেলায় প্রদীপখানি জ্বেলে
যখন তুমি যাবে গোয়ালঘরে
তখন আমি ফুলের খেলা খেলে
টুপ্ করে মা , পড়ব ভুঁয়ে ঝরে।
আবার আমি তোমার খোকা হব,
‘গল্প বলো' তোমায় গিয়ে কব।
তুমি বলবে, ‘দুষ্টু, ছিলি কোথা। '
আমি বলব, ‘ বলব না সে কথা। '
০৫ ই নভেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১:২১
আলোরিকা বলেছেন:
৮| ০৫ ই নভেম্বর, ২০১৫ দুপুর ২:০৭
হাসান মাহবুব বলেছেন: +++++
০৫ ই নভেম্বর, ২০১৫ দুপুর ২:১৫
আলোরিকা বলেছেন:
৯| ০৫ ই নভেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:০৯
কামরুন নাহার বীথি বলেছেন: ছেলেবেলার অনেক অনেক প্রিয় ছড়া/ কবিতা চোখের সামনে---------
অনেক অনেক ধন্যবাদ!!!!
০৭ ই নভেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১২:৩৩
আলোরিকা বলেছেন: অনেক অনেক ধন্যবাদ!!!!
১০| ০৫ ই নভেম্বর, ২০১৫ রাত ৯:৩৫
কি করি আজ ভেবে না পাই বলেছেন: অসময়ে মেহমান
ঘরে ঢুকে বসে যান
বোঝালাম ঝামেলার
যতগুলো দিক আছে
তিনি হেসে বললেন
ঠিক আছে ঠিক আছে।
আহা,,,মধু মধু
মিষ্টিবেলার দিনগুলো সেই
দিলে মনে করিয়ে;
শৈশবেরি ছড়ার স্মৃতি
আবার দিলে রাঙ্গিয়ে।
এসব নিয়েই সেকাল মোদের
আলোয় ভুবন ভরা;
ডিজিটাল কলিযুগে সব
ভার্চুয়াল ঘাটের ন্যাড়া।
স্মৃতির জাবর কাটলুম
তোমায় ধন্যবাদ;
ঐ দেখা যায় তালগাছ
পড়লো নাকি বাদ??
০৭ ই নভেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১২:৪০
আলোরিকা বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ কবিয়াল ! তালগাছ মাথায় আছে , পোস্টে বাদ পড়েছে একটু উদ্ভট , খাপছাড়া আর স্মৃতি বিজড়িত কবিতা গুলোকেই এই ফ্রেমে বন্দি করতে চেয়েছি কিনা । শুভ কামনা ।
১১| ০৭ ই নভেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১২:৪১
সেলিম আনোয়ার বলেছেন: বিশাল আয়োজন । পরিশ্রমে ভাল লাগা । পোস্টে প্লাস আর প্রিয়তে নিয়ে গেলাম । মাঝে মাঝে পড়তে হবে কবিতাগুলে ।
০৭ ই নভেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১:৩৭
আলোরিকা বলেছেন: অনেক অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া । আসলে ভাইয়া এ পোস্ট গুলো আমার ভাল লাগা থেকে তৈরি করা । যাতে পড়তে ইচ্ছে হলেই হাতের কাছে পাওয়া যায় । আপনার কবিতা পড়তে ভাল লাগলে ( জানি ভাল লাগে ) আমার কবিতা বিষয়ক - 'ভাল লাগা প্রিয় কবিতারা - প্রেম ও দ্রোহে' র পাঁচটি পর্বে ঢুঁ মারতে পারেন শুভেচ্ছা ।
১২| ০৭ ই নভেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৫:২২
গোর্কি বলেছেন:
শৈশবের আনন্দময় স্মৃতি বিজড়িত হারিয়ে যাওয়া নদীতে ডুবসাঁতারের চমৎকার আয়োজনে যারপরনাই মুগ্ধ। অনবদ্য পোস্টে সুপার লাইক। খুব ভাল থাকবেন।
০৭ ই নভেম্বর, ২০১৫ রাত ৯:৪১
আলোরিকা বলেছেন: পোস্টটি বানিয়েছিলাম নিজের জন্য , আপনাদের ভাল লাগায় কৃতার্থ । উচ্ছ্বসিত মন্তব্যে অনেক ভাল লাগা । ভাল থাকুন সবসময়
১৩| ০৮ ই নভেম্বর, ২০১৫ সকাল ১১:০৩
গিয়াস উদ্দিন লিটন বলেছেন:
বড়দের পড়ার সময় গোলাম মোস্তফার বনভোজন পুরোটাই মুখস্ত করে ফেলেছিলাম ।
আপনার ছড়া সংকলন বেশ লাগলো !
০৮ ই নভেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৩:০৬
আলোরিকা বলেছেন: গোলাম মোস্তফার বনভোজন - ছোট বেলায় পছন্দতো ছিলই , এখনও হাতছানি দেয় । কি মজার সেসব দিন ছিল !
অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া । শুভ কামনা
১৪| ১২ ই নভেম্বর, ২০১৫ দুপুর ২:২৩
জেন রসি বলেছেন: চমৎকার সংকলন।
ধন্যবাদ আপু, শেয়ার করার জন্য।
১২ ই নভেম্বর, ২০১৫ দুপুর ২:৫৩
আলোরিকা বলেছেন: ধন্যবাদ ভাইয়া পোস্টে ঢুঁ মারার জন্য
১৫| ১৩ ই নভেম্বর, ২০১৫ রাত ৯:৪৪
রুদ্র জাহেদ বলেছেন: অসাধারন সংকলন।পোস্ট প্রিয়তে রাখলাম, ভালোমতো পড়তে হবে++++++++++
১৩ ই নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১০:৫৮
আলোরিকা বলেছেন: রুদ্র ভাইয়ার অনেক ভাল লেগেছে জেনে আমারও খুব ভাল লাগছে ।
©somewhere in net ltd.
১|
০৪ ঠা নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১০:৪১
দীপংকর চন্দ বলেছেন: অবশ্যই প্রিয়তে থাকছে।
অনেক অনেক ভালো লাগলো।
অসম্ভব সমৃদ্ধ আপনার শৈশব!
আমার শুভকামনা জানবেন। অশেষ।
ভালো থাকবেন। অনেক। অনেক ভালো। সবসময়।