নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সময়ের সাথে দৌঁড়ে পারিনা, জীবনের দৌঁড়েও পিছিয়ে আমি!খুঁজে ফিরি আপন মানুষ, মাঝে মাঝে হই বেহুঁশ...হৃদয়ে অবিরাম স্বপ্ন গাঁথন, বলব আজ নিপুণ-কথন।
ছেলে আজ বাড়ি ছেড়ে ঢাকা যাবে। ছেলে বললে কম বলা হয়, একমাত্র সন্তান। বিধবা মায়ের যক্ষের ধন। তাই, রাতে ঠিকমতো ঘুম হলো না মায়ের। একটু পরপর উঠে বসে ঘড়ি দেখেছে, আবার চোখ বুজে ঘুমানোর চেষ্টা, আবার উঠে বসা। এভাবে ভোর পাঁচটার কিছু আগে উঠে পড়লো মা। ঘরে খাট দুটো। একটা আবার ভাঙা। ভালো খাটটাতেই মা-ছেলে ঘুমোয়। এই খাটটায় মশারির ভেতর দিয়ে বাতাস ঢোকে কম। সারারাত গরমে ছটফট করেছে মা, পাতলা কাথা গায়ে ছিল, তাতে ঘেমে ঠান্ডা-গরম লেগে গেছে। এখন গলায় কাশি।
ছেলেটা যে এবারই প্রথম দূরে যাচ্ছে, তা নয়। গত ১০ বছর ধরেই ও একরকম বাইরে বাইরে। ছোট থেকেই পড়ালেখায় ভালো ছিল। বাবার মনটা ছিল বড়। সামর্থে না কুলাক, তবুও একমাত্র সন্তান- বংশের প্রদীপের জন্য চেষ্টার কোন ত্রুটি করা যাবে না। করেনও নি। না চাইতেই ছেলেকে দিয়েছেন সব। ছেলেটাও সাধ্যিমত ভালো ফল করেছে। ইন্টারে ভালো করে তো আর মফস্বলে বসে থাকাটা মানায় না। তাই, হঠাৎ বাবার পরলোকগমণ ওর ভেতরের বড় হবার আগুন নেভাতে পারলো না। সংসারের একমাত্র শক্ত মানুষ উপার্জনক্ষম মানুষটি চলে গেলেও মাকে একা রেখে ছেলে তাই আবার ঢাকামুখী হলো। সেখানে অনেক চড়াই-উতরাই পেড়িয়ে, এখন সে স্নাতক-স্নাতকোত্তর। বাবার মতো সেও ভালোবাসে লেখালেখি। ওর মনের দুটি অংশ। এক অংশ দাবি করে সে দুনিয়ার সম্রাট। কাউকে কোন বিষয়ে ছাড় না দিয়ে প্রাপ্য অধিকার বুঝে নিতে এবং নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দিতে সে বধ্যপরিকর। আরেক অংশ কাদামাটির মতোই নরম। এই অংশে বাস করে এক কবি-লেখক সত্বা। এই অংশ ঝামেলা চায় না, দু:স্থ মানুষ দেখলে কেঁদে ওঠে, মন খারাপ হলে নিজের ওপরেই অত্যাচার চালায়। এই দুই অংশের মাঝে মাঝে মাঝেই যুদ্ধ লেগে যায়। একসময় কেউ জেতে না।
ভোর পাঁচটায় উঠেই মা প্রথমে ঘর ঝারু দেয়, দুয়ার ঝারু দেয়। উঠোনের একমাত্র আম গাছটির সবক'টি গুটি আম যেন ঝরে পড়েছে। সেগুলো তুলে রাখে। এগুলো দিয়ে ছেলেকে আমের টক বানিয়ে দেবেন... ওহো, আজ তো ছেলে সকালেই ঢাকা যাবে! তাহলে আমগুলোর কি হবে? যাক, পাশের বাড়ির বল্টুকে দিয়ে দেয়া যাবে। ছেলে বাড়ি না থাকলে মা ঠিকমতো রান্না করে খায়না। ছেলে অল্প অল্প করে টাকা জমিয়ে মাকে একটা রাইস কুকার কিনে দিয়েছে। সমপরিমাণ পানির ভেতর চাল দিয়ে সুইচ অন করে দিলে অটো ভাত রান্না হয়ে যায়! ছেলে মাকে বলেছে, যেন অন্তত দুটো সেদ্ধ দিয়ে ভাত খায়, বাড়তি তরকারি রান্না করতে মন না চাইলেও। কিন্তু মায়ের মন তো! স্বামী নাই, সন্তান নাই -একা ঘরে নিজের জন্য রান্না করতে মন চায় কার? তাই মা মাঝে মাঝেই একরকম না খেয়ে থাকে। নিজের পেশাগত ব্যস্ততায় যেটুকু সময় বাইরে কাটে, সেটুকু বাদে বাকিটা সময় মা সন্তানের চিন্তা আর স্বামীর কথা মনে করেই একরকম বিছানায় এপাশ-ওপাশ করে কাটিয়ে দেয়। ঘরে টিভি আছে, কিন্তু টিভি দেখে আর কতক্ষণ সময় কাটানো যায়? ঘরে যে একটা মনের কথা বলার ও শোনার মতো লোক নেই!
ছেলে ঘুমের ভেতরই মায়ের কাশির শব্দ শুনতে পায়। শুনে ঘুম ভেঙে যায়। অথচ বাইরে রাগ দেখায়, বলে- "কাশি হলো কি করে মা? তোমাকে না কতবার বলেছি, এত ভোরে পুকুরে ডুব দিতে যাবে না?" মা কোন কথা না বলে কাজ করে যায়। অনেকবছর ধরে বাসায় পানির উৎস নেই। টিউবওয়েলটা নষ্ট, পৌরসভার পানির লাইন এ বাসায় আসেনি। ওর বাবা থাকতে অনেকবার আবেদন জানিয়েছে মোটা পাইপের জন্য। চিকন পাইপে এতো ভেতরে পানি আসেনা। কিন্তু মিলেছে শুধুই আশ্বাস। এখন মা-ছেলেকেও আশ্বাস দেয়া হয়। নির্বাচন আসে, নির্বাচন যায়। বাসায় আর পানির লাইন আসেনা। তাই, পাশের বাসা থেকে অথবা পাশের মন্দির থেকে পানি বয়ে আনতে হয়। খুব কষ্ট হয় মায়ের, তবু ছেলেকে সে পানি আনতে দেবে না। তাঁর কথা- "আমি থাকতে তুই কেন?" ছেলে ঢাকায় পড়ে, লেখালেখি ও টিউশন করে নিজের খরচ চালায়। কত কষ্ট করে! ক্যান্টিনের খাবার খেতে খেতে স্বাস্থ্যের অবস্থা খারাপ। ক'টা দিনের জন্য বাড়িতে এসেও সে কষ্ট করবে? তাই কি হয়?
ছেলে রাতে বলেই রেখেছে। সকালে বেশি কিছু করা যাবেনা খাবার জন্য। শুধু চা আর বিস্কুট খেয়ে রওনা হবে সে। আর ব্যাগে পুরে নিয়ে যাবে মায়ের হাতের রুটি আর আলু-বেগুণভাজি! এগুলো ঢাকায় হলে ফিরে খাবে সে। যাত্রার আগে ও বাসে ভরপেট খেলে পথে সমস্যা হয় ওর। আসলে এসব মনের খুঁতখুতি, তারপরেও। মা সেগুলোই তৈরি করে দিয়েছে। তারপর ছেলেকে ডেকে তুলেছে।
ওদিকে ছেলের তো অনেকক্ষণ ধরেই ঘুম ভেঙেছে। মায়ের কাশি শুনে ঘুম ভেঙেই মনটা খারাপ। আজ সে মাকে অসুস্থ রেখে কিভাবে যাবে? এই প্রথম সে অনুভব করে, মাকে ঢাকায় নিয়ে গিয়ে একসাথে থাকা জরুরি। আর এজন্য চাই ভালো একটা চাকুরি, আর অনেক অনেক টাকা। মা আবার ছেলেকে বিয়ে দিয়ে সব ভার বৌমাকে বুঝিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চান। ছেলে কিন্তু এসব নিয়ে ভাবে না। পছন্দের কেউও নেই। সে শুধু নিজের জীবনটা গোছাতেই ব্যস্ত এখন। উঠে বসে ফ্রেস হয়ে হাত-মুখ ধুয়ে চা খেতে বসলো। চায়ে চিনি বেশি কেন?-এ নিয়ে মায়ের সাথে কিছুক্ষণ রাগ-রাগ খেলা খেললো। প্রতিবার যাবার আগে ও মায়ের সাথে এমন করে, ইচ্ছে করেই। এতে যাবার সময় একটু কম খারাপ লাগে, নিজেরও, হয়তো মায়েরও! মা বিস্কুটের কৌটা এগিয়ে দেয়, বলে- "তোর বাবা বলতো, ঘুম থেকে উঠে খালি পেটে চা খেতে নেই। রুটি অথবা বিস্কুট দিয়ে খা। তার আগে জল খা।" ছেলে শুধু পানি খায়। ওর মনটা মায়ের কাশির শব্দের সঙ্গে সঙ্গে আরও খারাপ হচ্ছে। কাশির কারণ কি জেনে নিয়ে মাকেই বকা দিয়ে বসে ছেলে- "গরম লাগলে কাথা ফেলে দাওনি কেন গা থেকে?" এরপর ওর এক বন্ধু ফোন দেয় ওকে। ওদের আজ একসাথে ঢাকা যাওয়ার কথা। কিন্তু ওর যে আজ যেতে ইচ্ছে করছে না! অথচ এইতো কাল কত বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বন্ধুকে একদিন আগে যেতে রাজি করালো! এখন?
"দোস্ত, আজকে না গেলে হয়না? মায়ের শরীরটা মনে হয় খারাপ করেছে..."
মা পাশ থেকে বাধা দেন- "কই? আমার আবার কি হল? আমিতো সুস্থ! আমার জন্য চিন্তা করতে হবে না, তুই ভালোয় ভালোয় যা।"
ছেলে ওর মাকে চেনে। মায়েরা কখনোই নিজের খারাপ লাগার কথা বলেনা। বুঝে নিয়েই বন্ধুকে বলে, "...আচ্ছা কি করবি সিদ্ধান্ত নিয়ে জানা।"
কিছুক্ষণ পর বন্ধু ফোন দিয়ে জানায়, "চল কালকেই যাই।" শুনে উচাটন মন শান্ত হয় অসীমের। যাক, আরেকটা দিন থাকা যাবে। বেশ কয়েক মাস ধরেই প্রতিবেশীদের দ্বারা ওদের বাড়ির বেদখলকৃত কিছু অংশ নিয়ে ঝামেলা লেগে আছে ওদের সাথে। ওর বাবা মারা যাবার পর ওর অনুপস্থিতিতে, ও যখন ঢাকায় জীবনসংগ্রামে ব্যস্ত, ঠিক তখন এতদিনের "আপনজন" এই অপকর্ম করেছে। এখন সব ফেরত চায় অসীম। অল্প জায়গা হলেও, লিজ নেয়া জায়গা হলেও এটা ওর বাবার একমাত্র স্মৃতি। ছেড়ে দেবে কেন? সবাই অনুৎসাহিত করলেও অসীম তাই যুদ্ধ চালিয়ে যায়। হার মানতে নারাজ ও। এখন মাকে এই অবস্থায় একা রেখে যেতে অজানা আশংকা মনে দানা বাধে। আবার নিজেই নিজেকে বুঝ দেয়-"এত সোজা নাকি? ছেড়ে দিলেই পেয়ে বসে"। অন্তত আজকের দিনটা তো মায়ের পাশে থাকা যাবে! ওসব আশংকা মুহূর্তে উবে যায় মাথা থেকে। মা শুনে উপরে উপরে রাগ দেখালেও মন থেকে খুশি হয়। তারপর ছেলে ঘুম পূর্ণ করতে গেলে, মা ছেলের মানা সত্বেও ওর ময়লা জামা-প্যান্ট ধুয়ে নিয়ে আসে। পুকুরে গিয়ে ধুতে কষ্ট হয় মায়ের। উপরন্তু আজ মায়ের উপোষ! অথচ ছেলের রুমের পাশেই বাথরুম, অফুরন্ত পানি। সেখানে বালতিতে জামা-কাপড় ভিজিয়ে সহজেই ধুয়ে ফেলা যায়। তবু মায়ের মন তো! এই মন বলে- "আমি থাকতে তুই কেন নোংরা কাপড়ে ঢাকা যাবি? রোদ আছে, শুকিয়ে যাবে। চিন্তা করিস না।"
জীবনটা বড়ই নিষ্ঠুর। জীবিকার প্রয়োজনে মা-বাবা ভাই-বোন কাছের মানুষকে দূরে রেখে রাত-দিন নিজের ভাগ্য বদলাতে কাজ করে যেতে হয়। যাবার সময় মনটাতো কম-বেশী কাঁদবেই। জীবনের অর্ধেকএরও বেশী সময় কেটে যায় এভাবে। আসলে, জীবনটা এক যুদ্ধক্ষেত্র। এখানে আবেগের কোন জায়গা নেই।
©somewhere in net ltd.