নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সময়ের সাথে দৌঁড়ে পারিনা, জীবনের দৌঁড়েও পিছিয়ে আমি!খুঁজে ফিরি আপন মানুষ, মাঝে মাঝে হই বেহুঁশ...হৃদয়ে অবিরাম স্বপ্ন গাঁথন, বলব আজ নিপুণ-কথন।
(৬)
সতু ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ে। দ্রুত এগিয়ে গিয়ে হেরিকেনটা উস্কে দেয়। গৌরীর দিকে তাকায়। লক্ষ্য করে ওর মুখের দিকে, যেখানে শ্মশানের ভয় জমেছিল সেখানে এখন সাহসের ক্ষীণ একটা আলো প্রজ্জলিত হচ্ছে।
ওঝা সাগরেদকে চলে যাবার ঈশারা করে। সাগরেদ সরে যায় লোকের ভিড়ে। দরজা বন্ধ হবার শব্দ তার পিঠের ওপর আছড়ে পড়ে।
ঘরের ভেতর পিন পতন নিস্তব্ধতা। মাঝে মধ্যে দু’একটা ইঁদুর ঘরের এপাশ-ওপাশ করছে। আবার খটাখট শব্দ হচ্ছে কখনও। যদিও বাইরে মানুষের ভিড়, শলাপরামর্শ কথোপকথনের শব্দ শুনতে শুনতে সতু ঘরে ঢুকেছে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এ ঘরের ক’টি নিঃশব্দ মানুষ ছাড়া ধারে-কাছে কোথাও কোন জনমানবের সাড়া নেই। বাইরের কোন শব্দই এখন আর সতুর কানকে স্পর্শ করছে না। হয়তো ওঝার কর্মকান্ডের প্রতি একাগ্রতাই সতুকে এ মুহূর্তে বধির করে ফেলেছে।
শুরু হলো গৌরীর চিকিৎসা। ওঝা লাল গামছা দুটোর একটা গৌরীর নিম্নাঙ্গে আর অন্যটা উর্ধাঙ্গে জড়িয়ে ওর পরনের কাপড়টা বদলাতে বলে সতুকে। প্রথমটায় ও একটু সংকোচ বোধ করলেও প্রচণ্ড খরার পর রিমঝিম বৃষ্টির সুখে শেষ পর্যন্ত আর সংশয় বোধটা থাকে না।
ওঝা ততক্ষণে বিড়বিড় করে কী সব বলতে শুরু করেছে। ঠোঁট দুটো নড়ছে। সতু গৌরীর কাছে এগোয়। ওর পরনের কাপড়ের জায়গায় সাবধানে গামছা দুটো জড়ায়। গৌরী নিঃশব্দে তা মেনে নেয়।
ওঝা হিন্দু ব্রাহ্মণের পূজার আয়োজনের মতো চাল, তেল, হাড়ি কুড়িতে টুংটাং আওয়াজ তুলে অস্ফুট তন্ত্র মন্ত্র পাঠ করে দীর্ঘক্ষণ। সতু পেছন থেকে দাঁড়ানো অবস্থার গৌরীকে ধরে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে ওঝার ফু-ফার ওজন পরিমাপ করে।
স্বপ্ন-দুঃস্বপ্নের মধ্য দিয়ে বেশ কিছুটা সময় অতিবাহিত হয়। বিভিন্নভাবে গৌরীর চিকিৎসা চললো। কিছুক্ষণের মধ্যেই গৌরীর শরীর অসার হয়ে এলো। সতু ওর কোমড় জড়িয়ে দাঁড়ায়। গৌরী সতুর ঘাড়ে গলায় কয়েকবার মুখ ঘসলো। ওর শরীরে গৌরীর ন্যুয়ে পড়া শরীর এ মুহূর্তে মোহময় মনে হয়। সুক্ষ্ম একটা নেশার অনুভূতিতে সতু আক্রান্ত হয়ে পড়ে। অকস্মাৎ সম্বিত ফিরে পায়। এ চিকিৎসার সাথে গোপনীয়তার একটা যোগসাজশ আছে মনে করে এসব অনুভূতি সে গায়ে মাখে না। তবু ধড়ফড় বুক ক্রমশ দ্রুততর হয়। মনে মনে ভাবে, সর্বনাশটা হয়তো এখনই পুরো হতে যাচ্ছে। এরই মধ্যে অবস্থার হাতে নিষ্ক্রিয় সতু এ যাত্রা রক্ষার একটা পথ খুঁজতে থাকে মনে মনে। এক সময় পেয়েও যায়।
‘ওকে আর ধরে রাখতে পারছি না’ –মুখ খোলে সতু।
-এইতো আর অল্প সময়।
-না, আজ থাক। আমার ভাল লাগছে না।
-ক্যান, ভাল্লাগতেছে না ক্যান?
-তা বলতে পারবো না, তবে খারাপ লাগছে এইটেই সত্যি।
সতু কথার মাঝেই গৌরীর অচেতন শরীরটা মাটিতে শুইয়ে ছাড়া কাপড় দিয়ে ওকে ভালো করে ঢেকে দেয়। ওঝা আশ্চর্যান্বিত হয়ে প্রশ্ন করে, ‘সে কি! শুইয়ে দিলেন?’
-দেবো না তো কি করব? দেখছেন না ওর অবস্থা? তাছাড়া হেরিকেনে আলো কম আর আমারও এখন ধৈর্য নেই। আজ থাক।
-এ জন্যেই তো কইছিলাম- আমার সাগরেদরে দরকার, আপনার দ্বারা এডা অবে না, আপনে তা শুনলেন না।
-থাক ভাই, সামনের দিন আপনার সাগরেদকে কাজে লাগাবেন। আমি বকশিস দেবো। আজ থাক।
এবার আর আপত্তি করে না ওঝা। সে তার ঝোলার জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে ঘর থেকে বেড়োয়। সতু তার দিকে দুটো পঞ্চাশ টাকার নোট মেলে ধরে।
‘খুব পরিশ্রম অইছে বাবু’ –বিনীত কণ্ঠস্বর ওঝার।
‘নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই অনেক পরিশ্রম করেছেন’ সতু আরও একটা পঞ্চাশ টাকার নোট ওঝার দিকে বাড়ায়।
-আজ আপনি আসুন, দুদিন বাদে আবার আপনাকে ডেকে পাঠাবো।
-জ্বি আচ্ছা।
ওঝা সালাম জানিয়ে চলে যেতে উদ্যত হয়, আবার কি ভেবে ছোট একটা ঔষধের বোতল সতুকে দিয়ে বললো, ‘এক পোয়া তিলা তৈলের সাথে এই তৈল মিশাইয়া দিনে চাইর পাইচবার রোগিণীর মাথায় মাখবেন, আর রোজ তিনবার কইরা ঠাণ্ডা পানি দিয়া গোসল করবেন। ভাল অইয়া যাবে।’ মৌরী ও অমিত ওঝার পাশে এসে দাঁড়ায়।
ওঝা চলে যাবার সময় ওর চোখে একশত পঞ্চাশ টাকার খুশী খুশী ভাবটা লক্ষ্য করে সতু আশ্বস্ত হয়। হাত ঘড়ির দিকে তাকায়। রাত দশটা বেজে সাঁইত্রিশ। সমাগত দর্শকদের অনেকেই কেটে পড়েছে ইতিমধ্যে। যারা ছিল, তারাও ওঝার পিছু পিছু ছোটে। সাথে সাগরেদ।
/...চলবে।
[ আগের অংশ পড়তে টাইমলাইন অথবা বাবু ফরিদীর পেইজে দেখুন। ]
উপন্যাসঃ ভেঙে ভেঙে গড়া ভালোবাসা
লেখকঃ কবি বাবু ফরিদী
প্রথম প্রকাশঃ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৮ ।
প্রকাশকঃ বোস ব্রাদার্স ।
©somewhere in net ltd.