নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সময়ের সাথে দৌঁড়ে পারিনা, জীবনের দৌঁড়েও পিছিয়ে আমি!খুঁজে ফিরি আপন মানুষ, মাঝে মাঝে হই বেহুঁশ...হৃদয়ে অবিরাম স্বপ্ন গাঁথন, বলব আজ নিপুণ-কথন।
(৭)
ভালোয় ভালোয় দু’দিন কেটে গেলো। যে গৌরীর চার-চারটি মাস নিদ্রাহীন কাটলো, সে এ দুটো দিনে অঘোরে ঘুমুলো। ঘুম ভাঙ্গলে প্রচুর খেলোও। যা বিগত চারমাস কল্পনাতীত ছিল। ওঝার দেয়া তেল এবং তার নির্দেশিত পন্থায় গোসলে এ ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যাচ্ছে বলে কেউ কেউ মন্তব্যও করে বসলো। সতু, অমিত ওরাও বিষয়টি নিয়ে ভাবলো...।
হঠাৎ দু’দিন পরেই গৌরীর পাগলামির মাত্রাটা এত বেশী বাড়লো যে, ওকে আর মুক্ত অবস্থায় রাখা কারো সমীচীন মনে হলো না। সে হাতের কাছে কোন বাচ্চাকে পেলেই প্রহার করে। কুকুর দেখলে তেড়ে আসে। মানুষ দেখলে লাঠি নিয়ে পেটাতে আসে।
এভাবে কেটে যায় এক সপ্তাহ। গৌরীর অবস্থার অবনতি দেখে অমিতের ভেতর কোন পরিবর্তন লক্ষ্য করা না গেলেও হরিদাসী ও মৌরী যে বেশ বিচলিত তা বোঝা গেলো।
সবার মনেই অস্থিরতা। কি করি- কি করি ভাব। এমন ভাবের পরিমন্ডলে সতু পড়লো বিপাকে। কেমন যেন কাণ্ডজ্ঞানহীন, কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা। ওর মাথায় কোন বুদ্ধি খেলছে না। সেদিন ওভাবে ওঝাকে ফেরত পাঠানোর কারণে বাড়ির লোকেরা তাকে কি চোখে দেখছে, এ রকম অপরাধবোধের সাথে অধিকারবোধের ক্যাচাল ওকে বিব্রত করে তুলল। কিছুক্ষণ নিজের চুলে আঙুল চালাল। তারপর গৌরীর প্রতি ভালোবাসা আর দায়বোধের ঘোড়ায় চেপে ঊর্ধ্বশ্বাসে শহরের দিকে ছুটল। তখন বেলা দশটা।
স্টেশন বাজারে পরিচিত দু’একজনকে কথায় কথায় গৌরীর কথা পাড়লো। ওর পরিবর্তনশীল অবস্থার সাথে ওঝার কর্মকাণ্ডের একটা ডাটা গভীরভাবে উপস্থাপন করলো সতু।
বিষয়টি সবার মনেই দাগ কাটলো। সতুকেও ভাবিয়ে তুললো। একজন প্রৌঢ় সতুর বর্ণনা শুনে কিছুক্ষণ চুপ থাকলেন। তারপর বললেন, ‘বাবু, আজকাল মানুষ পাওয়া খুব ভাগ্যের দরকার। বেশীরভাগ মানুষই কুকুর স্বভাবের। যে যেভাবে পারে খাবলে দেয়।’ তিনি উদ্বেগের স্বরে আরও বললেন, ‘আমার কি মনে হয় জানো? আমার মনে হয় ওঝা ঐ পাগলীটারে নষ্ট করছে। যাতে তোমরা আবার ওরে ডাকো। আর সেই সুযোগে ও ওর কুমৎলব হাসিল করতে পারে।’
বৃদ্ধের কথাগুলো সতুর মাথায় ঘুরলো।
বৃদ্ধ চলে গেলে একজন যাত্রী তাদের গ্রামের একজন ফকিরের নাম উল্লেখ করে বললো, ‘বিষ দিয়া বিষ তুলতি অয়, বুঝলেন? এই পাগলীর একমাত্র চিকিৎসা এহন আমাগ্যার গেরামে। দ্যাশ-বিদ্যাশের কতো রোগী আসে- কাউরে তো শুনলাম না ফকিরের বদনাম করতি।
লোকটার কথা সতুকে নতুন পথের সন্ধান দেয়। কি জানি কার মধ্যে কী আছে? কোথায় কার মুক্তি নিহিত? ও লোকটার কাছ থেকে ফকিরের বাড়িটার ঠিকানা জেনে নেয়। মনে মনে জেদ আঁটে, ‘প্রয়োজনে অন্য ফকির দেখাবো, তবু ঐ ওঝাকে আর ডাকবো না। যাকে দেখলে গা ঘিন ঘিন করে, হাড্ডি তেতো হয়ে যায়, তাকে দিয়ে আবারও গৌরীর চিকিৎসা? গৌরী মরে গেলেও না’।
শহর থেকে ফেরে সতু। বাড়ি এসে প্রথমেই বিষয়টি অমিত ও মৌরীর সাথে আলোচনা করলো, তারপর হরিদাসী, প্রতিবেশী নগেন, এমনইভাবে অনেকেরই মত চাওয়া হলো। সকলেই একবাক্যে ফকিরবাড়ি গৌরীকে নেবার জন্য সায় দিলো। তৎক্ষণাৎ ঠিকানাসহ একশত টাকার নোট দেয়া হলো নগেনকে। কাল সকালেই নগেন ফকির বাড়ি যাবে এবং ফকিরের সব ধরণের খোঁজ জেনে আসবে।
নগেন ফকির বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো। আবার সন্ধ্যার আগেই সে ফিরে এসে ফকির বাড়ি সম্বন্ধে বেশ ভাল ধারণা উপস্থাপন করলো। সকলেই আশ্বস্ত হোল নগনের খবরে। নগেন আরও জানালো যে আগামীকাল গৌরীর চিকিৎসার জন্য উপযুক্ত দিন এবং ফকির এসব চিকিৎসা রাতেই করেন।
রাতের চিকিৎসা প্রসঙ্গে সতু বরাবরই সন্দিহান থেকেছে। এবারেও যেন নগেনের কথায় ও একটু হোঁচট খেলো। তবুও এ মুহূর্তে কারও বিরুপভাজন হতে চাইলো না। শুধু সবার চোখের ওপর দিয়ে একবার চোখদুটো ঘোরালো। দেখল সবার চোখেই চকচকে তারা জ্বলছে। খুশির শ্বাস ফেলছে মৌরী। আনন্দে কাঁধ ঝাকালো পরশী স্বজনেরা। কোন প্রতিক্রিয়া নেই শুধু অমিতের। ও শুধু ভাবলেশহীন চোখে সবার চোখের তারা দেখছে। একসময় সিদ্ধান্ত হলো পরদিন দুপুরেই ফকিরবাড়ি যাওয়া হবে। গৌরীর সাথে যাত্রী হবে অমিত, হরিদাসী, সতু ও নগেন। দু’শো টাকায় একটা মহিষের গাড়ি ভাড়া করা হলো। বিশ মাইল জল কাদার রাস্তা, উঁচু-নীচু, তার উপর পাগল নিয়ে যাওয়া। সতু বুঝতে পারলো ভাড়াটা একটু বেশিই হয়ে যাচ্ছে, তবু উপায় নেই। দুপুর তিনটেয় ওরা রওয়ানা হলো।
বাড়ি থেকে বেরুনোর পথেই নারী-পুরুষ-বাচ্চাদের হৈ-হুল্লোড় পড়ে গেলো। কেউ গাড়ির পিছু পিছু অনেকটা পথ এগিয়ে এলো। যেতে যেতে গাড়ির পেছনে দু’চারজন করে লোক বাড়লো-কমলো। মৌরীও খানিকটা পথ এগিয়ে দিয়ে গেলো।
বিশ মিনিটের মধ্যে গাড়ি শহরে এসে পড়লো। শহরের মাঝ বরাবর পথ। গাড়ি এগিয়ে চলছে সামনে। ভেতরে গৌরী পিঠ মোড়া করে শক্ত রশি দিয়ে বাঁধা। সাওতালদের মতো আঁটসাঁট করে কাপড় পড়ানো। ওর চারদিকে অমিত, সতু, নগেন ও হরিদাসী।
রেল স্টেশনের কাছে আসতেই এক মজমা মানুষ এসে গাড়িটা ঘিরে ফেলে। চিড়িয়াখানার জন্তু দেখার মতো তারা গৌরীকে দেখছে। গাড়ি শ্লথ গতিতে এগোয়।
গাড়ির চারদিকে মানুষের উৎসুক দৃষ্টি। ত্যক্ত-বিরক্ত বানরের মতো গৌরীর পাগলামিও এ সময় খানিকটা বেড়ে যায়। সতু ও অমিত ওকে নিবৃত করার চেষ্টা করে। গৌরীর লড়াকু ভাবটা চরমে ওঠে। সতুরাও শক্তি খাটায়। শক্তি পরীক্ষার এক পর্যায়ে গৌরীর বুকের স্ফীত অংশ বেরিয়ে পড়ে। হরিদাসী তখনই কাপড় টেনে সামাল দেয়। গৌরীর সাথে ধ্বস্তাধ্বস্তি চলে। এক সময় আকাশের দিকে পা ছোঁড়ে সে। কাপড় বেসামাল হয়ে যায়। হরিদাসীও সামাল দিতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। ভিড় ঠেলে কেউ কেউ উঁকি দেয়, বিটলেমী করে। কেউ শিষ বাজায়, কারও নজর খোঁজে অন্য কোন কিছু। দু’জন কুলি কুরমুর করে মুড়ি চিবোয় আর গৌরীর যৌবন উপভোগের ফাঁকে স্টেশনের ঘুসকীদের দিকে তাকায়, যারা গৌরীকে এক পলক দেখে ফিরে এসেছে। একজন ঘুসকির দৃষ্টি সেদিকে পড়তেই মুখে ভেংচি কেটে ঘাড় বাঁকায়। অন্য একজন উচ্চস্বরে বলে, ‘দ্যাখ, খানকির বাচ্চারা, ভালো কইরা দ্যাখ।’ একজন বলে, ‘হায় আল্লাহ, অই সুন্দর মাইডার একি আজাব? তুই অরে ভালো কইরা দে, আল্লাহ!’
/...চলবে। উপন্যাসের আগের অংশ পড়তে আমার টাইমলাইনে অথবা কবি বাবু ফরিদীর পেইজে যান। ধন্যবাদ।
উপন্যাসঃ ভেঙে ভেঙে গড়া ভালোবাসা,
লেখকঃ কবি বাবু ফরিদী,
প্রকাশকালঃ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৮ ।
©somewhere in net ltd.