নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সময়ের সাথে দৌঁড়ে পারিনা, জীবনের দৌঁড়েও পিছিয়ে আমি!খুঁজে ফিরি আপন মানুষ, মাঝে মাঝে হই বেহুঁশ...হৃদয়ে অবিরাম স্বপ্ন গাঁথন, বলব আজ নিপুণ-কথন।
"মরণ সাগর পারে তোমরা অমর,
তোমাদের স্মরি ।"
মানুষের জীবনে আর কিছু ঠিক থাক আর না থাক, দুটি জিনিস সবসময় ঠিক থাকে- যার একটি জন্ম এবং অপরটি মৃত্যু । জন্ম নিলে মরতে একদিন হবেই, এর থেকে কারো নিস্তার নেই । মানুষ বাঁচে তার কর্মে । মৃত্যু সবসময়ই বেদনার, কাছের মানুষগুলোকে কাঁদায়- যারা সারাজীবন আগলে রাখে তাকে । অপমৃত্যু আরও বেশী বেদনার এবং শোকের । এটা কারো কাম্য নয় । তবু এমন ঘটনা ঘটে । এই যেমন ১৯৮৫ সালের ১৫ অক্টোবর ৩৯ টি তাজা প্রাণের অপমৃত্যু জাতি দেখেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য জগন্নাথ হলে । এটি দেশের সেরা বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তথা সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থার জন্য শুধু শোকের উপলক্ষ্য নয়, লজ্জার কারণও বটে । লজ্জার বলছি এ কারণে যে, দেশের সেরা মেধাগুলোকে আমরা মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছি, হলে মাথার ওপরে একটা শক্ত ও নিরাপদ ছাদ আমরা দিতে পারিনি । দুর্ঘটনা পরবর্তী উদ্ধার তৎপরতায় যারা শ্রম দিয়েছেন, এমনকি জীবন পর্যন্ত দিয়েছেন- তাঁদের প্রতি এবং কর্তৃপক্ষের প্রতি আমরা সেই দুর্যোগ পরবর্তী সাহায্যের জন্য অবশ্যই কৃতজ্ঞ, কিন্তু তাঁদের কৃতকর্মও এই ব্যর্থতা আর লজ্জা ঢাকতে পারে না । কারণ, যা হবার ছিল তাতো হয়েই গেছে! প্রশ্ন আসতেই পারে- দেশের সেরা বিদ্যাপীঠের সেরা ছাত্ররা এই ঝুঁকিপূর্ণ টিভি রুমটি (তৎকালীন পরিষদ ভবন) কেন ব্যবহার করবে? অপ্রয়োজনীয় অনেক স্থাপনা নির্মাণের পয়সা বরাদ্দ থাকলেও পরিষদ ভবনের সংস্কারে কেন বরাদ্দ হয়নি বা সেদিকে যথেষ্ট নজর কেন দেয়া হয়নি? কেন আমরা সময় থাকতে সেই ভবনের ছাদ মেরামত করতে ব্যর্থ হলাম? কেন সংস্কারাধীন অবস্থায় ওখান থেকে টিভি সেট সরানো হল না? এটি নিঃসন্দেহে একধরনের অবহেলা, অযত্নও বটে । এখন সেখানে সুউচ্চ স্মৃতি ভবন সেই লজ্জা বিন্দুমাত্র কমাতে পারে না । সর্বোপরি ছাত্রদের প্রতি এই ধরনের উদাস মনোভাব আমাদেরকে লজ্জিত করে ।
এই মুহূর্তে আমার সামনে কিছু কালো মলাটের বই- হ্যাঁ, অক্টোবর স্মৃতির স্মরণিকা আর দু'চোখে অশ্রু । শত চেষ্টায়ও এই অশ্রুধারা থামানো যাচ্ছেনা, ডুকরে ডুকরে কান্না পাচ্ছে আমার । আমি জগন্নাথ হলের বর্তমান ছাত্র, অক্টোবর ট্রাজেডি দেখার অভিজ্ঞতা (বা দুর্ভাগ্য যাই বলেন) আমার হয়নি, শুধু বাবা কবি বাবু ফরিদী (অ্যাডভোকেট কমল কৃষ্ণ গুহ) ও মামা গৌতম মিত্রের মুখে ঘটনার মর্মস্পর্শী বিবরণ শুনেছি মাত্র । মায়ের মুখে শিনেছি, সেই সময় নাকি আমার দুই মামা ওই টিভি রুমে ছিলেন । কিভাবে যে তাঁরা অক্ষত বেঁচে গেলেন, আমি ভেবে অবাক হই । তাঁরা ভাগ্যবান, কিন্তু সবাই তাদের মতো ছিলেন না । খুব কাছের মানুষ হারানোর অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে (ওই দুর্ঘটনায় নয় অবশ্য), তাই আমি বুঝি আপনজন হারানোর বেদনা কতটা পীড়াদায়ক । হলের অগ্রজ শ্রদ্ধেয় মোহন নারায়ণ কুণ্ডু মহাশয়ের হৃদয়বিদারক বর্ণনা আর সেই দিনগুলোর স্মৃতিচারণ আমার চোখে জল এনে দিয়েছে । আমি আর কিছুই ভাবতে পারছি না, শুধু সেই কালো রাতের চেহারাটা কেমন হতে পারে তাই কল্পনার তুলিতে আঁকার চেষ্টা করছি । আমার চারিদিকে নিকষ আঁধার, আর সেই আঁধারের মাঝে শুধু আহতদের আর্তচিৎকার- এ কোথায় আছি আমি? কোন মৃত্যুপুরীতে? ছাত্ররা কেন মৃত্যুপুরীতে থাকবে? তারাই তো দেশের সেরা সন্তান, দেশের সম্পদ । তাদের জায়গা হওয়া উচিৎ দেশের সবচেয়ে নিরাপদ কোন জায়গায়, যেখানে তারা বাকী সব চিন্তা ঝেরে ফেলে শুধুই লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকবে, দেশ ও দশের জন্য কিছু করার ব্রত নেবে । ছাত্রাবস্থায় সরকার তাদের শিক্ষা ও নিরাপত্তার দায়িত্ব নেবে আর পড়ালেখা শেষে এই ছাত্ররাই দরকার হলে দেশের তরে নিজেদের জীবন পর্যন্ত দিয়ে দেবে । এটাই তো হওয়া উচিৎ তাইনা? এমনটাই তো হওয়া উচিৎ ছিল!
এই মুহূর্তে আমার চোখে ভেসে উঠছে এক বিধবা মায়ের মুখ, যিনি সদ্য স্বামীহারা হয়েও ছেলের জন্য কঠিন সংগ্রাম করে যাচ্ছেন দিনের পর দিন । একলা ঘরে সঙ্গী তাঁর স্বামীর স্মৃতি আর একমাত্র ছেলের জন্য চিন্তা, পথ চেয়ে বসে থাকা । ঢাবিতে পড়তে আসা বেশিরভাগ ছেলেমেয়েরই পরিবারের অবস্থা এমন, অথবা হয়তো এর চাইতেও খারাপ । বিনিময়ে এইসব বাবা-মা কি চান? চান তাদের সন্তান যেন মানুষের মতো মানুষ হয়, যেন তাদের নাম উজ্জ্বল করে, দেশের ও দশের জন্য কিছু করে, সাথে সাথে নিজেদের ভাগ্যেরও পরিবর্তন আনে । বাবা-মায়ের সেই যক্ষের ধন সন্তানটি যদি এইরকম কোন দুর্ঘটনায় প্রশাসনের অসতর্কতায় বা অবহেলায় লাশ হয়ে ঘরে ফেরে তখন আমরা তাদের কাছে কি জবাব দিতে পারি? আদৌ কি মুখ দেখানোর জো থাকে? ভাবতেই কষ্ট লাগে এমনই একটি ঘটনা ঘটেছিল আমার জন্মেরও আগে, এখানে, এই জগন্নাথ হলে!
নটরডেম কলেজে পড়াকালীন সময়ে একদিন বাবার হাত ধরে বইমেলায় এসেছিলাম । সম্ভবত সেটাই আমার প্রথম ঢাবির মাটিতে পা রাখা । বাবা কবি ও সাহিত্যিক ছিলেন, তাই প্রতিবছর বইমেলায় ঢাকা আসতেন । উদ্দেশ্য ছিল কবিতা উৎসব ও বইমেলায় অংশগ্রহণ । সেদিন আমিও বাবার সঙ্গী হলাম, বইমেলা হয়ে ঢাবির ক্যাম্পাস ঘুরতে বের হলাম । সবকিছু অনেকটা স্বপ্নের মতো লাগলো আর মনে মনে এখানে পড়ার ইচ্ছা পোষণ করতে লাগলাম । এভাবেই একসময় জগন্নাথ হলে আসা । মেইন গেইট দিয়ে ঢুকে ডানে মোড় নিয়ে দেখতে পেলাম একটি নতুন ভবন (অক্টোবর স্মৃতি ভবন) এবং একটি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন (সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্য ভবন,পূর্ব বাড়ি ) পাশাপাশি দাঁড়িয়ে । আরেকটু সামনে এগুনোর পর ডানে একটি সাদা স্মৃতিস্তম্ভ ও একটি নামফলক চোখে পড়লো । বাবার মুখেই জানতে পারলাম এর পিছের ইতিহাস, যা বোধ করি কারো অবিদিত নয় । মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল, কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না ব্যাপারটা । সংগ্রহশালায় সংগৃহীত সেই টিভি,আহত ছাত্রদের ছবি, জামাকাপড়, জুতা, বিভিন্ন সংবাদপত্রের সেদিনের হেডলাইন দেখে আমি শিউরে উঠলাম । মনে মনে ভাবলাম, এটা কি ছাত্রদের থাকার হল নাকি মৃত্যুপুরী? জানলাম, সেদিন রাতে নাকি বাবার বন্ধু পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় ও ফেরদৌসি অভিনীত 'শুকতারা' নাটক দেখছিল সবাই । সেটাই নাকি কাল হয়েছিল! ফেরার পথে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনটি (পূর্ব বাড়ি) দেখে বাবার কাছে জানতে চেয়েছিলাম- "এই ভবনটিও তো ঝুঁকিপূর্ণ, এটি কেন সংস্কার করা হয় না বাবা? আবার যদি অমন কিছু হয়?" বাবা কি বুঝিয়েছিলেন মনে নেই ।
আজও সেই ভবনটি সেভাবেই দাঁড়িয়ে আছে, যেন ১৫ অক্টোবর আমাদেরকে কিছুই শিক্ষা দেয় নি! সামান্য ভূমিকম্প হলেই সে ভবন ভেঙে পড়ার ঝুঁকিতে আছে । তার আগেই কেন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছেনা? আশার কথা এটাই যে একটু দেরিতে হলেও হলের নতুন ভবনের কাজ এখন শেষ পর্যায়ে । মাননীয় উপাচার্য মহোদয় , হলের মাননীয় প্রাধ্যক্ষ মহোদয় ও সংশ্লিষ্ট সকলের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় এটা সম্ভব হয়েছে এবং আশ্বস্ত হবার কথা হল, ঝুঁকিপূর্ণ পূর্ব বাড়ি ভবনটির ছাত্রদেরকেই সবার আগে নতুন ভবনে স্থানান্তরের কথা রয়েছে । এমনটিই তো চাই, চাই বিপদ ঘটে যাওয়ার আগেই সতর্কতা । ১৫ অক্টোবর আমাদেরকে এই শিক্ষাই দিয়েছে, আমাদেরকে শিখিয়েছে কি করে বন্ধু হারানোর ব্যথা সইতে হয়, কি করে বিপদের দিনে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে একে অন্যের পাশে দাঁড়াতে হয় । এই ১৫ অক্টোবরই আমাদেরকে ভবিষ্যতে বড় ধরনের বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পেতে সময় থাকতেই কিছু করার সতর্কবাণী দিয়েছে ।
সময় ও স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না । কালের বিবর্তনে যত দিন যাবে আশেপাশের অনেক কিছুই তত পাল্টে যাবে । শুধু বদলাবে না কিছু স্মৃতি, বদলাবে না ১৫ অক্টোবর । যুগ যুগ ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শোক দিবস হিসেবে দিনটি পালিত হবে আর শোকের সাথে উচ্চারিত হবে কিছু মেধাবীর নাম, যারা আমাদেরকে ছেড়ে চলে গেছেন চিরতরে । আমরা চাইলেও ভুলে যেতে পারবোনা সেইসব নাম, সেইসব স্মৃতি, সেই অক্টোবরের ১৫ তারিখ । বিংশ শতাব্দীর অন্যতম কালো এই রাতটি যেন জাতির জীবনে আর না আসে । আর যেন কোন মায়ের বুক খালি না হয়,খালি না হয় কোন বন্ধুর কাঁধ । আর যেন এমন ভুল না হয় আমাদের । আমরা যেন সময় থাকতেই সময়ের মূল্যায়ন করি, ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে দেশের সেরা সন্তানদের না রাখি । আর যেন সময় হারিয়ে হাহাকার না করি ।
আজ খুব আফসোস হয় । আহারে! যদি এমনটি না হোত! কোন এক উদাস দুপুরে অথবা কোন গভীর রাতে এই ভবনের নিচে এলে আর যদি কোন মৃত ছাত্রের অশান্ত আত্মার কান্না শুনতে না হোত! সেই দুঃসহ স্মৃতি কল্পনায় এনে মনের অজান্তে চোখের কোণে যদি আর দু'ফোঁটা অশ্রু না জমতো! তাই, এখনি সময় শপথ নেয়ার । এখনি সময় কথা দেয়ার যে এমন ভুল আমরা আর করবো না । আমরা দেশের সূর্যসন্তানদের যথার্থ মূল্যায়ন করবো, তাঁদের ভাগ্য যেন ওই ৩৯ জনের মতো থেমে যাওয়া না হয় সেই দিকে খেয়াল রাখবো এবং শিক্ষাখাতে সবসময় পর্যাপ্ত বরাদ্দ রাখবো ।
সবশেষে, ১৫ অক্টোবরের দুর্ঘটনায় নিহত সকল তরুণের আত্মার শান্তি কামনা করি, তাদের পরিবারের প্রতি সমব্যথা জানাই এবং আহতদের জীবনটা যেন আর দশটা সাধারণ মানুষের মতোই সহজ হয় এই কামনা করি । আর কবিতার সুরে বলি-
"ক্ষমা করো হে অগ্রজ,
ক্ষমা করো!
ব্যর্থ-লজ্জিত আমরা,
একই সাথে শোকাহত!
যেখানেই থাকো
মনে রেখো-
আমরা তোমাদের ভুলি নাই,
এই হল, এই বিদ্যাপীঠ
তোমাদের ভোলে নি,
ভুলবে না কোনদিন ।
শুধু একটি দিন নয়
নয় একটি রাত,
তোমাদের স্মরি অনন্তকাল
তোমরা অমর ।"
লেখক: দেব দুলাল গুহ
রচনাকাল: ১৫ অক্টোবর, ২০১২।
©somewhere in net ltd.
১| ১৬ ই অক্টোবর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:০১
ছাসা ডোনার বলেছেন: ঐ দিন আমার অত্যন্ত ঘনিস্ট সহপাঠী স্কুল বন্ধু রন্জিত শহীদ হয়, আমরা একসাথে কি করি নাই! সব মনে পড়লে চোখের জলে ভেসে যাই। আপনার ওর জন্য ঈশ্বরের কাছে দোয়া করবেন। দোস্ত তুমি মর নাই আমাদের অন্তরের মাঝেই বেঁচে আছ এবং সবসময়ই বেঁচে থাকবে। ভগবান যেন তোমাকে স্বর্গ দান করেন এই প্রার্থনাই করি।