নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সময়ের সাথে দৌঁড়ে পারিনা, জীবনের দৌঁড়েও পিছিয়ে আমি!খুঁজে ফিরি আপন মানুষ, মাঝে মাঝে হই বেহুঁশ...হৃদয়ে অবিরাম স্বপ্ন গাঁথন, বলব আজ নিপুণ-কথন।
দেব দুলাল গুহ
ঘুম থেকে উঠে, আমরা প্রতিদিন রুটিনমাফিক এমন কিছু কাজ করি, যা করার জন্য আমাদের কোন চিন্তা-ভাবনার দরকার হয় না। যেমন ধরুন, বালিশ থেকে মাথাটাকে উঁচু করে তোলা, তারপর খাট থেকে নেমে কয়েক পা হাঁটা। দিনের পর দিন একই কাজ একইভাবে করতে করতে এতটাই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি আমরা। গোত্র-জাতি-দেশ-ধর্ম নির্বিশেষে পৃথিবীর প্রায় ৭ বিলিয়ন (৭০০ কোটি) মানুষের ক্ষেত্রেই ব্যাপারটা এমন। আলাদা কেবল পৃথিবী থেকে ৪০০কিমি দূরে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে(আইএসএস) থাকা ৬ জন নভোচারীর বেলায়। ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির নভোচারী টিম পিকও শীঘ্রই তাঁদের সাথে যোগ দেবেন।
পাঠক, চলুন জেনে নিই আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে একজন নভোচারীর জীবন কেমন হয়!
ঘুম থেকে ওঠা
মহাকাশ স্টেশনে আপনি সূর্যের আলো নয়, বরং মিশন কন্ট্রোলের কৃত্রিম আলো দেখে জাগবেন, ভোর ৬টায়। সেখানে ঘুমানোর মানে হলো হারমোনি মডিউলের স্লিপিং ব্যাগে ঢুকে চোখ বুজে পড়ে থাকা, আর সারারাত ভেসে ভেসে কাটিয়ে দেয়া! তাই, ‘ওঠা’, ‘নামা’ শব্দগুলো এখানে আপেক্ষিক। জেগে ওঠার পর, বাকি কাজগুলো পৃথিবীর মতোই। তবুও সেখানে যেহেতু সবকিছু ওজনহীন, তাই একইরকম হয়েও তা আলাদা। যেমন, ব্রাশ করতে গিয়ে পানি ব্রাশের ভেতর আটকে থাকতে পারে, পেস্ট বাতাসেই ভাসতে শুরু করতে পারে! তারপর, ব্রাশ করে থু ফেলবেন কীভাবে একবার ভাবুন!
কাজে লেগে পড়া
কিছু খেয়েই এরপর কন্ট্রোলের সাথে মিটিং করে যার যার কাজে নেমে পড়তে হয়। স্টেশনটার রুটিনমাফিক রক্ষণাবেক্ষণ এবং নিরাপত্তার দিকটি অধিকাংশ দিনই দেখতে হয়। সবকিছুই পুর্বপরিকল্পিত এবং নভোচারীদের নিজ নিজ কাজ ধাপে ধাপে সম্পন্ন করতে হয়।
শরীরচর্চা
আপনি ভাবছেন, শুণ্যে ভেসে বেড়ানো তো মজার কাজ? না পাঠক, শারীরিক সমস্যাও দেখা দিতে পারে। যেহেতু সেখানে চলাফেরায় তেমন পরিশ্রম লাগে না, তাই পেশী ধীরে ধীরে কার্যক্ষমতা হারাতে থাকে, হাড় ক্ষয়ে যায়। এজন্য দিনে কমপক্ষে ২ ঘন্টা নিয়মিত ব্যায়ামের মাধ্যমে শরীরকে ঠিক রাখতে হয়। মহাকাশ স্টেশনে আছে ব্যায়ামের তিন ধরণের যন্ত্রপাতি- একটি ট্রেডমিল, একটি ব্যায়ামের বাইক এবং সম্প্রতি যুক্ত হওয়া একটি ‘এআরইডি’। এমনকি, ওজনহীনতা মানুষের শরীরের ওপর কী প্রভাব ফেলে, সেটাও সেখানে গবেষণা করে দেখা হয়। কারণ, মঙ্গলে সত্যিই মানুষ গেলে, তখন এই অভিজ্ঞতা কাজে দেবে।
দুপুরের খাবার
পৃথিবীর মতো সেখানেও সপ্তাহ আছে, ছুটির দিন আছে। সাধারণ দিনে প্রত্যেকেই ছোট ছোট গ্রুপে বিভক্ত হয়ে আলাদা জায়গায় কাজে যায়। তাই, ছুটির দিন (রবিবার) বাদে বাকি দিনগুলোতে একত্রে খাবার খাওয়ার সুযোগ তেমন হয় না। বাড়ির মতো সেখানেও সরিষা, মরিচ, কেচআপের বিভিন্ন ধরণের সস আছে, আছে লবণ এবং মরিচ। কিন্তু এর সবই তরল, নাহলে ওজনহীনতার কারণে তা স্টেশনময় ছড়িয়ে যেত! আছে টাটকা ফলও, যা প্রতিটি কার্গোর সাথে পৃথিবী থেকে পাঠানো হয়। কিন্তু ফল পচনশীল বিধায় তা দ্রুতই খেয়ে ফেলতে হয়।
গবেষণা
আইএসএস নিজেই একটি বিশাল ল্যাবরেটরি। এর মূল কাজই গবেষণা করা। সেখানে আছে পাঁচটি ল্যাব মডিউল- রাশিয়ার দুটি, যুক্তরাষ্ট্রের ‘ডেস্টিনি’, ইউরোপের ‘কলম্বাস’ এবং অতি সম্প্রতি যুক্ত হওয়া জাপানের ‘কিবো’। স্টেশনের বাইরে উন্মুক্ত মহাশূণ্যে পরীক্ষণের জন্যও আছে ব্যবস্থা। সেখানে অবস্থানকারী নভোচারীকে তাই নিজেও গবেষণা করতে হয় এবং পৃথিবীর বিজ্ঞানীদের গবেষণার জন্য তথ্য যোগাতে হয়।
কঠোর শৃংখলার ভেতর দিয়ে গবেষণা হয় বিভিন্ন পদার্থ ও জীবের, এমনকি ছোটখাট বিস্ফোরণের ওজনহীনতার নিয়ে। ইঁদুর, পিঁপড়া, মাছ, কৃমি ছাড়িয়ে সবচেয়ে বড় গবেষণার বিষয়বস্ত সেখানে নভোচারী নিজেরাই। পৃথিবী থেকে সুবিধাজনক স্থানে হওয়ায়, পৃথিবীর ওপর গবেষণা এবং ছবি তোলার কাজটাও সেখানে হয়।
ভ্রমণে বের হওয়া
মাঝে মাঝে স্টেশনের রক্ষণাবেক্ষণের কাজটা বেশ চ্যালেঞ্জিং হয়ে ওঠে। যেমন ধরুন স্টেশনের বাইরের কোন অংশ মেরামতের কাজ। তখনই মহাশূণ্যচারীকে ভ্রমণে বের হতে হয়, যাকে বলে এক্সট্রা-ভেহিকুলার অ্যাক্টিভিটি(ইভা)। নিঃসন্দেহে এটা মনে রাখার মতো অভিজ্ঞতা তাঁদের জন্য।
তবে এতে ঝুঁকি প্রচুর। একটু এদিক সেদিক হলেই আছে মহাশূণ্যের বিশালতায় হারিয়ে যাওয়ার ভয়। তাই, কেউ একা যান না, যান জোড়ায় জোড়ায়। এজন্য যে পোষাকটি পড়তে হয়, তার নির্দেশিকাটিই ১০০ পৃষ্ঠার। শুধুমাত্র পোষাক পড়তেই লেগে যায় ৪ ঘণ্টা! এরপর কাজ করতে লাগতে পারে টানা ৮ ঘন্টার মতো।
অবসর সময়ে
দিনের কাজ শেষে অবসর বিকেলে নভোচারীরা যা খুশি করার স্বাধীনতা পান। চাইলে স্লিপিং স্টেশনে গিয়ে প্রিয়জনের সাথে কথা বলতে পারেন ফোনে, পাঠাতে পারেন বার্তা। ইচ্ছে হলে দেখতে পারেন ছবিও। তাঁদের জীবনধারার সাথে সম্পর্কিত ছবি ‘গ্রাভিটি’ এবং ‘দ্যা মারটিয়ান’ সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে সেখানকার ছবির তালিকায়।
গিটার বাজিয়ে এবং গানের ভিডিও বানিয়ে টুইটারে তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন নভোচারী ক্রিস হ্যাডফিল্ড। সে থেকে অন্যরাও অবসর সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সময় কাটান, পৃথিবীর মানুষদের সাথে যোগাযোগ রাখা এবং তাঁদের না-বলা গল্প শোনানোর জন্য।
তবে, খুব সম্ভবত, ট্রাঙ্কুইলিটি মডিউলের গম্বুজ থেকে এমন সুন্দর পৃথিবীটাকে নিজের চোখের সামনে ঘুরতে দেখাটাই নভোচারীদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয়। শুধু দেখাই নয়, বরং সুন্দর সুন্দর ছবি তুলে তা ইন্টারনেটের মাধ্যমে আমাদের কাছে পৌঁছে দেয়ার কাজটাও তাঁরা আনন্দ নিয়েই করেন।
পরিশেষে
তবে, একথা ঠিক যে আপনজন ছেড়ে সুদূর মহাশূণ্যে দিনের পর দিন একই রুটিনবদ্ধ জীবন যাপন করাটাও অনেকের কাছে ক্লান্তিকর। তবুও মানুষ স্বপ্ন দেখে, পৃথিবীর বাইরের জগতটা কেমন তা দেখার, তারা-নক্ষত্রের আরও কাছাকাছি পৌঁছে মহাশূণ্যের লুকানো রহস্য খোঁজার!
বিবিসি ও নাসা অবলম্বনে দেব দুলাল গুহ ।
[প্রজন্ম ডটকম,
দৈনিক প্রথম আলো।
০১-০২-২০১৬।]
©somewhere in net ltd.