নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সময়ের সাথে দৌঁড়ে পারিনা, জীবনের দৌঁড়েও পিছিয়ে আমি!খুঁজে ফিরি আপন মানুষ, মাঝে মাঝে হই বেহুঁশ...হৃদয়ে অবিরাম স্বপ্ন গাঁথন, বলব আজ নিপুণ-কথন।
(প্রথম অংশের পর)
(২)
শ্রাবণ আবারও বাইরের দিকে চোখ রাখে । আকাশের দিকে উদাস দৃষ্টি মেলে নয়নের উদ্দেশ্যে বলে- লেরোন রেনেট এর লেখা ‘WHAT MANNER OF MAN’ এ আছে, ‘It is great art, possibly the greatest art; to know when to move, when to break roots…’
হেরে যাবার শব্দ বুকে নিয়ে ওরা দুজনেই মূক হয়ে যায় ।
ঢাকায় শ্রাবণের বড় খালা নাজমা থাকেন । খালু চাকরি করেন একটি বিদেশী ফার্মে । ভালো বেতন পান । সংসারে খানেয়ালা স্বামী-স্ত্রী ছাড়া আর কেউ নেই । একটি কাজের মেয়ে আছে খালাকে সাহায্যের জন্য । খালা ভালবেসে বিয়ে করেছিলেন খালুকে । খালার পরিবার প্রথমে মেনে নেয়নি ও-বিয়ে । কারণ খালুর পরিবার নাকি খালাদের চাইতে নিম্নপর্যায়ের । এ নিয়ে অনেক গ্যাঞ্জাম । তারপর স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে খালাদের চাইতে খালুদের পারিবারিক মর্যাদা বৃদ্ধি পেতে থাকলো । খালাদের পরিবার আস্তে আস্তে নাম-গোত্রহীন অবস্থায় পরিণত হল । ভালো চাকরি হল খালুর । আজ এ-চাকরি কাল ও-চাকরি করে এখন বিদেশী ফার্মের ভালো পদে আছেন । আস্তে আস্তে আম-দুধ মিশে গেল, আঁঠি গেল আধারে!
খালা মাসখানেক আগে শ্রাবণদের বাড়িতে এসেছিলেন। তিনি নিজেই মাকে বলেছেন- তাদের তো কোনো সন্তানাদি নেই, শ্রাবণকে নিজের সন্তানের মতো নিজের কাছে রেখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে চান তিনি । মা বাবাকে বলে রাজি করালেন । তারপর রেজাল্ট বেরুলে ঢাকায় যাবার আয়োজন হল । খালাকে দেখলে এখন বোঝাই যাবেনা যে, মা-খালা দুজন আপন মায়ের পেটের বোন । ঢাকা আর মফস্বলের যে পার্থক্য হয় আর কি! তার ওপর মোটা অংকের বেতন খালুর । টাকার গন্ধে শরীর-মন সব কিছুরই পরিবর্তন হয় ।
প্যান্টের পকেট হাতড়ে নোটবুকটা বের করে শ্রাবণ । ঢাকা এখন আজব শহর । ঠিক ঠিকানায় না পৌঁছতে পারলে বিপদ । সাধুবেশী ফটকাবাজদের খপ্পরে পড়লে সর্বস্ব খোয়াতে হয় । ঠিকানায় পৌঁছে দেবার ছলেও অনেক সময় অলিগলিতে হাত পকেট সিজ অথবা লাশ হবার সম্ভাবনা ।
শ্রাবণ ঠিকানাটা একবার দেখে নেয়-
কনফিডেন্স টাওয়ার,
৫ খ সাত মসজিদ রোড,
মোহাম্মদপুর, ঢাকা- ১২০৭ ।
মোহাম্মদপুরের নাম শ্রাবণের কাছে আতঙ্কের মতো । অনেক গল্প শুনেছে ও সেই স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়কার । দেখা হয়নি স্বচক্ষে । আসবে আসবে করেও আসা হয়নি অনেকবার । সময় এবং সুযোগ দুটোরই অভাব ছিল । মোহাম্মদপুর এখন আর ভয়ের জায়গা নয় । ওটা এখন স্বাধীনতার স্বাদে সুস্বাদু স্থান ।
রাজধানীর কথা ভাবতেই একটা আনন্দঘন পরিবেশের কথা মনে হয় শ্রাবণের । কিন্তু মফস্বলে থেকে রাজধানীর যে চিত্র পত্রপত্রিকায় দ্যাখে, তাতে মনে হয় বিশ্বের সবচাইতে বিপদসংকুল এলাকা এটা, আফ্রিকার গভীর অরণ্যের মতো । আবার মনে মনে অভয় দেয় নিজেকেই নিজে । কোটি মানুষের মধ্যে দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা কোন ঘটনাই নয় । এরকম এখন গ্রামগঞ্জেও অহরহ হচ্ছে ।
নানারকম ভাবনার মাঝে নিজ গ্রামের ছবি ভেসে ওঠে শ্রাবণের মনে । কুমার নদের কোল ঘেঁষে ওদের গ্রাম । শহর থেকে সাত কিলোমিটার দূরে বড় ব্রিজের বোগল দিয়ে ডানদিকে হাতের মতো পিচঢালা পথ চলে গেছে, আরও ডানে তারই শাখায় মাটির রাস্তার দুপাশে ওদের বসত-ভিটা, জমি-জিরাত । সামনে এগোলে প্রাইমারি স্কুল, স্কুল-সংলগ্ন প্রকাণ্ড বটগাছ, বটগাছের পড়েই একটি ছোট্ট বাজার । বাজারটার দক্ষিণের বড় বাড়িটা কলিদের। তার উল্টোদিকে মাদ্রাসা-সংলগ্ন পুরোনো একটা মসজিদ। ওর বাবা মারা যাবার পর থেকেই কলি মায়ের সাথে নানাবাড়িতে থাকে।
গ্রামের অধিকাংশই নতুন বসতি। মাঠাম জমি কিনে বসতি গড়েছে বরিশাল, নোয়াখালি আর ত্রিপুরার লোকজন। সে কারণে পুরোনো ঐতিহ্যে লালিত শ্রাবণের পরিবারের সাথে সম্ভান্ত কলিদের পরিবারের ওঠাবসা বেশি। ফলে কলি আর শ্রাবণ ছোটবেলা থেকেই একসাথে লালিত-পালিত হয়েছে। পড়াশুনাও চালিয়েছে পাশাপাশি। ছোটবেলার খেলার সাথী হিসেবে অদ্যাবধি কলি আর শ্রাবণই টিকে আছে। কলির মায়ের অনুরোধে ক্লাসের না-বোঝা বিষয়গুলি শ্রাবণই বুঝিয়ে দেয়। শ্রাবণ ছাত্র হিসেবে খুব ভালো। কলিও মন্দ নয়, তবে মেয়ে হিসেবে যতটা কাঁচা থাকার কথা, ততটা আর কি! পাঠ পারা না-পারা এখন আর ওদের বিষয় নয়—বলা যায় ছোটবেলার অভ্যাস। কোনো সমস্যা হলেই কলি ছুটে আসে শ্রাবণের কাছে। শ্রাবণও খুব আন্তরিক কলির কাছে। কলির সান্নিধ্য ওকে পুলকিত করে। গভীর মমতা ও মনোনিবেশে শ্রাবণ অবলোকন করে কলির বেড়ে ওঠা।
পড়াশোনায় কলি বরাবরই অমনোযোগী। স্কুলে যাবার সময় বই-খাতা গোছাবার আগে পাঁচগুটি খেলার গুঁটি, চারটি কড়ি অথবা খেজুর বিচির চার অর্ধেক গোছাত আগে। আমের দিনে কাঁচা আম গুঁজত কোমরে ইজার প্যান্টের ভেতর, জামের দিনে জাম, কামরুল, করমচা, ডৌয়া, বড়ই, খেজুর, পেয়ারা, লিচু, তেঁতুল-- সব ফলই মৌসুমভেদে স্কুলে নেয়া ছিল ওর অভ্যাস।
শ্রাবণ এসব দেখে প্রথম প্রথম কিছু বলতে গিয়ে চর-থাপ্পড়-ঘুষিও খেয়েছে। তারপরেও অবশ্য হালকা রসিকতা হয়েছে দুজনার মধ্যে। হাসাহাসি, দুষ্টুমি, ল্যাং মারামারি, টিপ্পনী কাটা, চিমটি কাটা। এভাবে কলি টক খেতে গিয়ে চোখ টিপেছে শ্রাবণকে। আবার শ্রাবণ ল্যাং মেরে ফেলে দিয়ে ডানা ধরে তুলে দুষ্টুমি একধাপ এগিয়ে নিয়েছে।
(চলবে)
উপন্যাসঃ নির্জনতার সমুদ্রে অবগাহন
লেখকঃ কবি বাবু ফরিদী
©somewhere in net ltd.