নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সময়ের সাথে দৌঁড়ে পারিনা, জীবনের দৌঁড়েও পিছিয়ে আমি!খুঁজে ফিরি আপন মানুষ, মাঝে মাঝে হই বেহুঁশ...হৃদয়ে অবিরাম স্বপ্ন গাঁথন, বলব আজ নিপুণ-কথন।
(৪)
কলি সবসময়ই শ্রাবণের মঙ্গলের জন্য ব্যতিব্যস্ত সময় কাটায়। শ্রাবণেরও ভালো লাগে কলির সান্নিধ্য।
রেজাল্ট বেরুবার দিন—ও নিজের ঘরে অঘোরে ঘুমাচ্ছিলো। হঠাৎ কারো ডাকে ধড়ফড় করে বিছনায় উঠে বসলো। চোখে তখনো ঘুমের খিল। বসেই ঝিমাতে লাগলো শ্রাবণ। পুরোপুরি সকাল হয়নি তখনও। পূর্ব আকাশে তামাটে রঙের ভাবটা কেটে গেছে। সূর্য উঠি-উঠি করছে। পাখির কলরব শুরু হয়ে গেছে বনবাদাড়ে, গাছগাছালিতে। আধবোঝা চোখে টেবিলঘড়িটাতে নজর করে শ্রাবণ। মাত্র ছটা। তারপর একটু চিৎ হয়ে শুয়ে ঘুম তাড়ানোর ব্যায়ামটা করে নিলো।
এত সকালে ও ঘুম থেকে ওঠে না কোনোদিন, বিশেষ ঠ্যাকা ছাড়া। আজও একটা প্রয়োজনেই ঘুম ভেঙেছে ওর। ওকে ডেকে তুলেছে কলি। মা সাত-সকালে ছেলের ঝাড়ি খাবার ভয়ে কলিকে দিয়ে এ কাজটি করিয়েছে। মা জানে শ্রাবণের কাছে কলির সাতখুন মাফ।
-শ্রাবণ, কলেজে যাবি না? নয়ন তোর অপেক্ষায় বসে আছে –বললো কলি।
-হ্যাঁ, তাই তো! আজ সকাল সকালেই বেরুতে হবে। কই? নয়ন কোথায়?
-পাশের ঘরে বসতে দিয়েছি।
-নাস্তা দিয়েছিস ওকে?
-না, দেওয়া হয়নি। তুই ওঠ, একসাথে খাবি। যা তৈরি হয়ে নে।
কলি বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। অনেকদিন কলেজের সীমানায় যায়নি শ্রাবণ। সেই যে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে এসেছে। বন্ধু-বান্ধবদের কারো সাথে দেখা-সাক্ষাৎ নেই। প্রয়োজন কী জিনিস- শ্রাবণ ভাবে, ছুটিছাটা ছাড়া একদিন কলেজে না গেলে বা বন্ধুদের সাথে আড্ডা না মেরে যার সময় কাটতো না, তার কিনা আজ তিনমাস হতে চললো কলেজের কথা মনে হয়নি। যা কিছু মনে হয়েছে তা ভার্সিটির কথা। সময় যে কোথা দিয়ে কীভাবে চলে যায়!
রাত ৮টা ৩০ মিনিটের টিভি নিউজে ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে। এই খবরের জন্যই এতটা দিন প্রতীক্ষার প্রহর গুনতে হয়েছে। সহপাঠীসহ শুভাকাঙ্ক্ষীদের উত্তেজনার ঝড়ও বেড়ে গেছে। এটাই স্বাভাবিক। কথায় বলে, ‘নো কলেজ, নো নলেজ’। দুটি বছরের বাঁধনমুক্ত জীবনে সফলতা, ব্যার্থতার হিসেব-নিকেশ হবে এ ফলাফলে—যার উপর নির্ভর করছে ভবিষ্যতের কর্ম-পরিকল্পনা।
অনেকের মধ্যে, গাঁয়ের ছেলে নয়নই শ্রাবণের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কলেজজীবনের শুরু থেকেই কলির স্থান দখল করেছে নয়ন। এরকম হয়। জীবন কখনও থেমে থাকে না। একজন পেছনে পড়ে গেলে কেউ না কেউ সে স্থান দখল করে নেয়। এভাবে হাজারো ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে কাটছাঁট করতে করতে দু-একজন টিকে থাকে। আবার না-ও টিকতে পারে। এভাবে গ্রাম থেকে শহর, শহর থেকে রাষ্ট্র, আবার রাষ্ট্র থেকে আন্তর্জাতিক বন্ধু-সুহৃদ পায় মানুষ। সবকিছুর মূলে লেখাপড়া- জ্ঞান অর্জন। তারপর জীবনে প্রতিষ্ঠা। একজন মানুষ কর্ম-গুণে, দক্ষতা-গুণে এক এক পদে আসীন হয়। তারপর সে প্রবেশ করে সামাজিক জীবনে। যেখানে গিয়ে মানুষকে সংসারী হতে হয়। স্ত্রীর ভরণপোষণ, বাচ্চাকাচ্চা লাললপালনের মধ্য দিয়ে মানুষ ভিন্ন জগতের বাসিন্দা হয়ে মৃত্যুর দিকে এগোয়।
নয়ন আলালের ঘরের দুলাল। বন্ধু হিসেবে খুবই ভালো মনের মানুষ ও। ছাত্র হিসেবেও ভালো। বড়লোকি অহংকার নেই ওর মধ্যে। আছে পড়ালেখার প্রতি অধীর আগ্রহ। মঙ্গলবারে জন্ম হয়েছে বলেই হয়তো ও গ্রন্থপ্রিয়, সৎ-গুণী, লাবণ্যে ভরা চেহারা ও অর্থভাগ্য।
শ্রাবণের জন্ম বুধবার। বুধবার যাদের জন্ম, তাদের জন্মফলে দেখা যায়- তারা মেধাবি, দয়ালু, শ্রদ্ধাশীল, প্রতিভাবান হয়। এদের আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। শ্রাবণের বেলায়ও তা মিলে যায়। শনিবার যাদের জন্ম, লোকচক্ষে ‘শনির দশা’ বা যা-ই বলা হোক, বর্তমান যুগ-জামানায় তাদের ভাগ্য ভালো। তারা ধর্মপ্রাণ, বুদ্ধিমান, চাকরিতে উচ্চপদ লাভ এবং ব্যবসায় সাফল্য অর্জন করে।
-কি রে শ্রাবণ, এখনও বিছানায়! ওঠ, ওঠ, তাড়াতাড়ি কর –-বলতে বলতে শ্রাবণের ঘাটের পাশে এসে দাঁড়ায় নয়ন। শ্রাবণ বিছানা ছাড়ে।
দুজন একই সাথে সকালের নাস্তা খেয়ে রেজাল্টের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ে। কলি কুলবধূর মতো ঘরের কাঞ্ছিকোনায় দাঁড়িয়ে ওদের গমনপথের দিকে তাকিয়ে থাকে আর ওদের জন্য আল্লাহ্র দরবারে দোয়া করে।
উত্তেজনায় প্রহর গুনে চলে শ্রাবণ। রাতে ঘুমাতে গিয়ে ছটফটিয়ে কেটেছে অনেকটা। পরীক্ষার ফল নিয়ে ভেবেছে। ভাবতে ভাবতে যখনই দু-চোখের পাতা এক হয়েছে, তখনই দেখেছে স্বপ্ন- পরীক্ষার স্বপ্ন, রেজাল্টের স্বপ্ন, কলির আনন্দ-নিরানন্দের স্বপ্ন। পরীক্ষা খারাপ হয়নি। তবু কী হয় বলা তো যায় না! ঢাক-ঢোল পিটিয়েও আজকাল কম্পিউটারের ভুলের কথা প্রচারিত হয়। সেখানে নাকি ভালো ছাত্রের রেজাল্টও খারাপ হতে পারে। শ্রাবণের ফল খারাপ হলে বাবা-মা ভীষণ কষ্ট পাবেন। বাবা-মাকে না হয় সান্ত্বনা দেয়া যাবে, কিন্তু কলি? কলির মেঘবরন মুখ যে সহ্য করতে পারবে না। নিজেও লজ্জায় কুঁকড়ে যাবে ওর কাছে।
এসএসসি পরীক্ষায় পাঁচটি লেটারসহ ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছিলো শ্রাবণ। তখনও সে ভালো রেজাল্ট সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করতো। কিন্তু ভালো ফলে গর্বও হয়েছিলো। বাবা-মা খুশি হয়েছিলেন সবচে বেশি। কলি নিজের খারাপ রেজাল্টের দুঃখের চেয়ে শ্রাবণের ভালো রেজাল্টে আনন্দিত হয়েছিলো। গাঁয়ের এবাড়ি-ওবাড়ি করে শ্রাবণের ফল কলি পৌঁছে দিয়েছে সমস্ত গ্রামে। পড়শীরা কেউ কেউ টিপ্পনী কেটেছে, আবার কেউ কেউ আড়াল-আবডালে অকথা-কুকথা বলেছে কলি-শ্রাবণকে নিয়ে। কলি ওসব শুনেও না শোনার ভান করেছে। এবার ফলাফল খারাপ হলে পড়শীরা কলিকে দেখে দাঁত বের করে হাসবে।
(চলবে)
উপন্যাসঃ নির্জনতার সমুদ্রে অবগাহন
লেখকঃ কবি বাবু ফরিদী
©somewhere in net ltd.