নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমার চারপাশের মানুষ গুলো অনেক ভাল।

নিথর শ্রাবণ শিহাব

মাটির মানুষ ভিজলে কাদা হয় না কেন প্রশ্ন জাগে, মানুষ গড়া অন্যকিছুয় আমার শুধু এমন লাগে।

নিথর শ্রাবণ শিহাব › বিস্তারিত পোস্টঃ

বিধাতা "খ"

১৫ ই মে, ২০১৩ সকাল ৭:৩৮

বিধাতা "ক"

রাত সাড়ে দশটা।

এনায়েত সাহেব আর মনোয়ার খেতে বসেছেন টেবিলে। মরিয়ম খাবার বেড়ে দিচ্ছেন দুজনকে। মেঘলা আর তিনি পরে খান। আগে এক সাথে খেতো। কিন্তু ধীরে ধীরে নিয়ম বদলেছে।

কারেন্ট এসেছে একটু আগে। চার্জারের আলোয় খাওয়া দাওয়া করায় ভীষণ অসুবিধা হয় এনায়েত সাহেবের। বয়স হয়েছে। চশমা পরেও তিনি মাছের কাঁটা দেখতে পান না এখন। ইলেকট্রিক বাতির নিচে বসে খেতে হয়।

মনোয়ার চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছে। খাওয়ার সময় সাধারণত কথা বলে সে। কিন্তু মায়ের কথা থাকলে ভিন্ন ব্যাপার। আজকে মরিয়ম কথা বলার উদ্দেশ্যেই এখানে এসে ভাত বেড়ে দিচ্ছেন। না হলে ভাত বাড়ার জন্য রোজ আসেন না তিনি। মনোয়ারের বৌ থাকলে সেই বাড়ে। আর না থাকলে এঁরা নিজেরাই বেড়ে খায় কিংবা মেঘলা থাকে। আজকে মেয়েকে আসতে দেননি। ঘরে বসে থাকতে বলেছেন। স্বামী আর ছেলের সঙ্গে তাঁর জরুরী কথা আছে। এ সময় মেঘলার থাকা চলবে না।

“দিলিপকে ওষুধ দিয়া তুই পাঠাইছিলি?” ছেলের প্লেটে মাছের পিস তুলে দিতে দিতে তীক্ষ্ম গলায় বললেন মরিয়ম।

মাথা ঝাঁকালো মনোয়ার। হ্যাঁ সূচক উত্তর।

“তোরে না বলছি বাড়ীতে তোর বোনটা বড় হইছে- বাসায় যখন তখন কাউকে পাঠাইবি না?”

“বিয়ে শাদীর সম্বন্ধ নিয়ে তো আর আসেনি দিলিপ। ওষুধ দিয়া পাঠাইছি, নিয়াসছে।” গম্ভীর মুখে উত্তর দিল মনোয়ার।

মরিয়ম ছেলের উত্তরে হতচকিত হয়ে তাকিয়ে রইলেন কয়েক মুহূর্ত। দ্রুত সামলে নিলেন। গলা কয়েক ধাপ চড়িয়ে বললেন, “ঘরে মেয়ে থাকলে আসলে বড় ভাইগুলারে আলাদা করে দেওয়া উচিত। মেয়ে বাড়ীতে বাহির থেকে জোয়ান পোলা একটা পথেই ঢুকতে পারে- মেয়ের ভাইয়ের মাধ্যমে। একবার ঢুকলে দূর্ঘটনা ঘটাইতে সময় লাগে না। দুনিয়ার পুরুষ মানুষ হইল সবচেয়ে খারাপ জাত। জায়গা দিবি- ঘরে ঢুকে নষ্ট করে দিবে। বিশ্বাস নাই এদের। এরা ঘুমায় থাকলেও ঘরে দরজা দিয়ে রাখতে হয়। আর তুই পাঠাইতেছিস দিলিপের মত চোর বাটপার পোলারে বাসার ভিতর? এ্যাঁ? বুদ্ধি শুদ্ধি কি দিন দিন কমে যাইতেছে তোর? নিজের ছেলে মেয়েগুলারে তো আরেকজনের বাড়ীতে বসায় রাখছিস। আমার মেয়েরে আমারেই সামলাইতে দে।”

এনায়েত চৌধুরী বিরক্ত হলে খুব, “আহ্‌! কি শুরু করলা মরিয়ম? ছেলেটা খাইতেছে- শান্তি মত খাইতে দিবা না?”

স্বামীর দিকে বিষ দৃষ্টিতে তাকালেন মরিয়ম, “মেয়ের যে হাতের মধ্যে শ্বেতী হইছে, বিয়া দিতে পারবা? পারবা বিয়া দিতে? কত করে বলতেছি পরীক্ষার কোনোই দরকার নাই, সারা শরীলে ছড়ানোর আগেই একটা হাবাগোবা ছেলে দেইখা বিয়া দিয়ে দেও- কথা কানে যাইতেছে না বাপ বেটার। পরে যখন মেয়েরে ঘরে বসায় রাখতে হবে সারা জীবন- তখন টের পাবা আমি কিছু বলছিলাম তোমাদের। কানে তুলো নাই।”

মনোয়ার হঠাৎ চাপা গলায় বলে উঠল, “আম্মা! আস্তে কথা বলেন। মেঘলা শুনতে পাইলে কি ভাববে?”

“শুনলে কি আমার? যা ঘটার তা তো ঘটেই গেছে। ভাবছো শ্বেতী কি জিনিস আমি চিনি না? ধবল না বানাইয়া ছাড়বে ভাবছো? এই সব হইল পাপ। পাপ করছে হয়তো ছেমড়ি। স্কুল কলেজ তো সব বেহায়াপনার একশেষ! আমাদের দিনে ঠিক আছিল। সব আলাদা আলাদা। এখন তো রাস্তা ঘাটেও প্রেম পিরিতি হয়।”

এনায়েত সাহেব রাগ চেপে রাখতে পারলেন না, “মরিয়ম, মুখ সামলায় কথা বলবা। সে তোমার মেয়ে। তোমার মতই মানুষ। এসব কথা তার কানে গেলে মেয়েটা ভাঙে পড়বে।”

“ঠিক আছে! চিল্লাইলাম না আর। আমার সাফ কথা- এই মেয়ের বিয়া যেমনে পারো দুই এক দিনের মধ্যে দেওনের ব্যবস্থা করো। সারা গায়ে ছড়াইলে কইলাম বাকি জীবন ভাত তোমার বাড়ীতেই বসে খাবে।”

এনায়ের সাহেব ভাতের ওপরেই হাত ধুয়ে উঠে পরলেন। ক্ষুধা নষ্ট হয়ে গেছে তাঁর। পাঞ্জাবীর গায়ে হাত মুছে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। বারান্দায় চলে এলেন। স্ত্রীর ওপর রেগে গেছেন প্রচণ্ড। কিন্তু রাগটা দমানোর চেষ্টা করছেন। মরিয়ম যে কথাগুলো বলেছে- একটাও অযৌক্তিক কিছু বলেনি। মেঘলার হাতের শ্বেতী রোগটা শুরু হয়েছিল মাস ছয়েক আগে। প্রথম দিকে তেমন পাত্তা দেয়নি কেউ। ভেবেছিল তেমন কিছু না। ওষুধ খেলেই ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু ঠিক হওয়ার বদলে এখানে ওখানে ছড়িয়ে পড়া শুরু করে দ্রুত। শেষে শহরে গিয়ে ভাল স্কিন ডিজিস স্পেশালিস্টের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন মেঘলাকে। ডাক্তার সাহেব ভাল করে পরীক্ষা করে হতাশ মুখে বলেছেন, “আপনার মেয়ের কপালটা খারাপই বলতে হবে এনায়েত সাহেব। ভিটিলিগো হয়েছে ওর। সোজা বাংলায় শ্বেতী রোগ। মেডিক্যাল সায়েন্সে এর কোনো ট্রিটমেন্ট নেই। ধীরে ধীরে সারা শরীরেই ছড়িয়ে যায় জিনিসটা।”

এনায়েত সাহেবের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে তখন। কেবল অস্পষ্ট স্বরে বলেছেন, “আমাদের বংশে তো কারো....”

“কারো থাকতে হয় না। এমনিতেই হয়। তবে মাঝে মাঝে বংশের দোষেও হয়। রক্তে সমস্যা, জিনে ডিফেক্ট থাকলে কিংবা আল্ট্রাভায়োলেট রে’র কারণে হতে পারে। ঠিক নেই। তবে রোগটা ক্ষতিকর কিছু না। কেবল সাদা হয়ে যাবে স্কিন। শ্বেতাঙ্গদের মত।”

এনায়েত সাহেব চোখে মুখে অন্ধকার দেখছিলেন সেদিন। যে দেশে সামান্য গায়ের রঙ ময়লা হলে মেয়েদের বিয়ে দেয়া যায় না- সেখানে শ্বেতী রোগের মেয়েকে বিয়ে দেবে কিভাবে? রোগের কথা জানাজানি হলেই তো সম্বন্ধ আসা থেমে যাবে।

এনায়েত সাহেব সেদিন থেকে মেঘলাকে বলে দিয়েছিলেন যে খুব সাবধানে চলা ফেরা করে। কারো কাছে বিষয়টা নিয়ে কথা না বলে। বিশেষ করে বান্ধবীদের সঙ্গে।

কিন্তু লাভ কতটুকু হয়েছে কে জানে। এনায়েত সাহেব যে মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে চেষ্টা করেন নি তা না। গত ছয় মাস ধরে তিনি আর মনোয়ার মিলে মেঘলার বিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কিন্তু বিচিত্র কোনো উপায়ে ছেলে পক্ষ টের পেয়ে যাচ্ছে যে মেয়ের শ্বেতী রোগ হয়েছে। মেঘলার বান্ধবীরাই ছড়িয়ে থাকতে পারে। এছাড়া আর তো কোনো উত্তর নেই। এক মেয়ের রোগের খবর আরেক মেয়ে ফলাও করে ছড়াবে এটাই স্বাভাবিক। আর গ্রাম গঞ্জ এলাকায় বর পক্ষ মেয়ের বান্ধবীদের মাধ্যমেই খবর বের করার চেষ্টা করে। ওড়না দিয়ে হাত ঢাকা গেলেও খবর কি করে ঢাকা যাবে?

একটা নিঃশ্বাস ফেলে পিলারের গায়ে হেলান দিলেন এনায়েত সাহেব। বৃষ্টি নেই। বাহিরে নিকষ কালো আকাশটার মাঝে একটা দুটো করে তারা ফুটতে শুরু করেছে। চশমাটা খুলে ঝাপসা দৃষ্টিতে আকাশটার দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনি অসহায় চোখে। আচ্ছা বিধাতা ঠিক কোথায় থাকেন? তাঁর মেয়েটাকে এভাবে কষ্ট দিয়ে ওপরে বসে থাকতে এতো ভাল লাগে তাঁর? তাঁর মেয়েটা কার এমন কি ক্ষতি করেছিল? হাত পা পঙ্গু না হয়েও এভাবে পঙ্গু করে দেয়ার মাঝে কিসের এত পরীক্ষা তাঁর? এতো আনন্দ কেন তাঁর মেয়েটাকে নির্জীব একটা শ্বেত পাথরে পরিণত করায়?





দিলিপ ওর টিন শেডের ঘরটার ভেতরে বিছানায় মশারী টানিয়ে ভেতরে বসে আছে। কোনো জানালা নেই ঘরটায়। কেবল দরজা। টিনের দেয়ালের ওপর আর নিচে সামান্য ফাঁক আছে। বাতাস ওখান দিয়েই আসে। ফ্যান নেই। গরমের দিনে চুলার মত গরম হয়ে থাকে ঘরটা। দিনরাত চব্বিশ ঘন্টা দরজা খোলা রেখে দেয়। সাপ, ব্যাঙ যা আছে সব ঢোকে। লাঠি দিয়ে মেরে টেরে যাতটা থাকা যায় আর কি।

ছোট একটা চৌকির ওপর তিন চারটা কাঁথা বিছিয়ে শোয়। তোশক নেই। তেল চিটচিটে বালিশ। সারাক্ষণ ভুর ভুর করে নারকেল তেলের গন্ধ আসতে থাকে।

অনেক রাত হয়ে গেছে। বাতি নেভানোর আগে কাঁথা উলটে অনেকগুলো ওষুধের ফাইল বের করল। ফার্মেসিতে বসে যখন যা পারে সরিয়েছে। রাতে ঘুমানোর সময় হিসাব করতে বসে কত টাকার ওষুধ সরিয়েছে। গত সপ্তাহেই শহরে গিয়ে দেড় হাজার টাকার ওষুধ বেঁচে এসেছে। এই সপ্তাহে তেমন হবে না। মনোয়ার ভাই সব সময় বসে থাকে দেখে ওষুধ সরানো মুশকিল। এবারে বেশি সরাতে পারেনি। টেনে টুনে সাতশো সাড়ে সাতশো হবে। চুরির জিনিস বলে অরিজিনাল রেটে বিক্রি করা যায় না। ছাড়তে হয় কিছু।

ওষুধের হিসাব করার পর কাঁথার নিচে আগের মত রেখে দিল। তারপর ভাঁজ করা একটা সাদা কাগজ বের করল। স্কুলের রুলটানা খাতায় লেখা ভাঙ্গা ভাঙ্গা হাতের একটা চিঠি। প্রচুর কাটা ছেঁড়া করা-



“দাদা,

কেমন আছিস তুই? কোথায় থাকা হয় এখন তোর? আমি জানি, আমি যে ঠিকানায় চিঠি দেই- তুই সেখানে নেই। তুই অন্য কোথাও থাকিস। কিন্তু আমাকে বলিস না। যদি জামাইয়ের মার খেয়ে তোর কাছে চলে আসি এই ভয়ে। তাই না?

তোর ভয়টা আসলেই সত্যিরে দাদা। তোর আসল ঠিকানাটা যদি জানতে পারতাম, কিংবা একটা মোবাইল নাম্বার থাকতো- তোকে খুঁজে বের করে চলে আসতাম। মরণের আগে আর বাড়ী ফিরতাম না। তোর টাকা পাঠিয়ে কি লাভ বলতে পারিস? আমার ভাঙা কপাল কি আর তোর ওষুধ বেচার টাকায় জোড়া লেগে যাবে?

কোথায় থাকিস একটা বার বল দাদা। না হলে এসে আমাকে নিয়ে যা। এখানে প্রতিদিন মরার চেয়ে তোর কাছ এসে না খেয়ে একেবারে মরে যেতাম। আগে তো কত রাত না খেয়ে কাটিয়েছি তোর সাথে। ভাতের জন্য আর কাঁদবো না আমি দাদা।

ইতি

দীপালী”

সূক্ষ্ম একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে চিঠিটা ভাঁজ করে আগের জায়গায় ঢুকিয়ে রাখলো কাঁথা উলটে। বাতিটা নিভিয়ে শুয়ে পড়ল। বিড় বিড় করে অন্ধকারেই বলল, “মাফ করে দিস্‌রে দীপালী। আমার থালা ভরে ভাত খাওয়ার অভ্যাস হয়ে গেছে। অর্ধেক থালা খাইতে পারবো না আর।”



গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেল হঠাৎ এনায়েত সাহেবের। ঘুমটা ভেঙে যাওয়ার কারণটা ধরতে পারছেন না। ঘরটা প্রায় অন্ধকার। ড্রইং রূমের বাতিটা জ্বলছে বলে দরজার কোণা ঘেষে আলো আসছে। সেই আলোতে ঘরটাআবছা ভাবে দেখা যায়। ঘুমের রেশটা ধীরে ধীরে কাটার পরেই টের পেলেন ঘরের মধ্যে কেউ খুব নিচু স্বরে কাঁদছে। চমকে উঠলেন। এত রাতে কাঁদে কে? মরিয়মকে ডাকার জন্য পাশ ফিরতে গিয়ে অবাক হয়ে দেখলেন মরিয়ম বিছানায় নেই।

আস্তে আস্তে উঠে বসলেন এনায়েত চৌধুরী। মশারীর ভেতর থেকে বাহিরটা দেখা যাচ্ছে। ফ্যানের বাতাসে মশারীর দেয়ালগুলো অনবরত নড়তে থাকলেও ঘরের মাঝামাঝি জায়নামায বিছিয়ে মোনাজাত ধরা মরিয়মকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। আকুল হয়ে কাঁদছেন তিনি তাহাজ্জুদের নামায পড়তে পড়তে।

এনায়েত চৌধুরী শক্ত হয়ে বসে আছেন বিছানার ওপর।



পরীক্ষা দিয়ে হল থেকে বেরিয়েছে মেঘলা। বাহিরে ভয়ংকর রোদ। ওড়নাটা খুব ভাল করে পেঁচিয়ে নিয়েছে। গরম লাগছে খুব। ক্লিপ বোর্ডটা মাথার সামনের দিকে এনে সূর্যটাকে আড়াল করে দ্রুত পায়ে হাঁটতে লাগলো। ওদের সেন্টার পড়েছে জামালপুর ডিগ্রী কলেজে। বাড়ী থেকে হাঁটা পথে বিশ মিনিটের দূরত্ব। আগে আগেই হল থেকে বেরিয়েছে ও। বান্ধবীদের সঙ্গে আসতে চাচ্ছিল না। তাছাড়া অসুখটা হওয়ার পর থেকে ওর বান্ধবীরাও কেমন যেন গুঁটিয়ে নিয়েছে নিজেদের ওর থেকে। মেঘলা আর ঘাঁটতে যায়নি। যার একা চলাই নিয়তি হয়ে গেছে- তার কারো জন্য অপেক্ষা করার কোনও অর্থ হয় না। কেউ সাথে আসবে না, এটাই স্বাভাবিক।

রাস্তার বালুগুলো আগুণ গরম হয়ে আছে। স্যান্ডেলের ভেতর ঢুকে পড়ছে বার বার। জ্বলতে শুরু করেছে পা। এভাবে হেঁটে যেতে থাকলে পায়ে ফোস্কা পড়ে যাবে কিছুক্ষণের মাঝেই। মেঘলা প্রায় দৌড়ে দৌড়ে হাঁটছে বালুর হাত থেকে বাঁচতে। আশে পাশে কাউ নেই যে দেখতে আসবে কে দৌড়াচ্ছে এমন ভাবে।

ভর দুপুর দেখে রাস্তাতে লোকজন নেই। দখিন বাড়ী পুলটা পেরুনোর সময় হঠাৎ পেছন থেকে ডাক শুনতে পেল, “মেঘলা?”

অবাক হয়ে ফিরে তাকালো। তাদের ফার্মেসির দিলিপ ভাই। একটা সাইকেল নিয়ে আসছেন। পেছনের ক্যারিয়ারে বড় একটা ওষুধের বক্স রাখা। মেঘলা দাঁড়িয়ে পড়তেই ওর পাশের এসে দাঁড়ালো সাইকেল নিয়ে দিলিপ, “পরীক্ষা দিয়া আসতেছো?” হাসি হাসি গলায় বলল।

মেঘলা ভর দুপুরের মাঝেও বরফের মত জমে গেছে। টের পাচ্ছে নাক মুখ লাল হয়ে যাচ্ছে ওর। কথা বলতে গিয়ে কথা জড়িয়ে যাচ্ছে, “হ্‌-হ্যা। বোটানী পরীক্ষা ছিল।”

“কেমন দিলা?” মুখের সামনে হাত এনে চোখ আড়াল করলো দিলিপ। চোখে রোদ লাগছিল।

মাথা কাত করলো মেঘলা, “ভ-ভাল।”

“দৌড়াতেছিলা ক্যান? দূর থেকে দেখলাম লাফায় লাফায় যাইতেছো?” হা হা করে হাসতে লাগলো দিলিপ।

লজ্জায় মাটি খুঁড়ে ঢুকে পড়তে ইচ্ছে করছে মেঘলার। মুখ পুরো গোলাপী হয়ে গেছে। তোতলাতে তোতলাতে কেবল বলল, “ন্‌-না, ব-বালি বেশি গরম দেখে দ-দৌড়াইছি!”

হাসছে দিলিপ। হাসলে ছেলেটার চোখগুলো ছোট ছোট হয়ে যায়। হাসার সময় পানিও চলে আসে। চোখে। মেঘলা তাকাতে পারছে না মানুষটার দিকে। কিন্তু হাসির শব্দটা শুনতে পাচ্ছে। প্রচণ্ড লজ্জার মাঝেও কেন যেন খুব ইচ্ছে করছে হাসতে থাকা মানুষটার চোখগুলোর দিকে একটু তাকাতে। ইস্‌ লোকটা অন্যদিকে তাকায় না কেন? গত বছর যখন মনোয়ার ভাই দিলিপকে ফার্মেসিতে চাকরী দেয়, প্রায়ই বাসায় নিয়ে আসতো। দুপুর দিকে ভাতও খেতো। মেঘলা তাকিয়ে দেখতো ছেলেটা সব সময় খুব আগ্রহ নিয়ে ভাত নেড়ে চেড়ে খেতো। খুব অদ্ভুত ব্যাপার হল- মানুষটা ভাত খাওয়ার সময় কেমন যেন চোখ লুকিয়ে রাখতো। মেঘলা ধরতে পেরেছিল দিলিপ ভাত খাওয়ার সময় কাঁদে। কেন কাঁদে মেঘলা জানে না। বড় মায়া লাগতো তখন থেকে এই মানুষটার জন্য। আজও যখন হাসছে সে- চোখ তুলে তাকাতে চেয়েও পারছে না। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে ধমক দিল- কি ভাবছে সে এসব!

“তুমি আমার সাইকেলের পিছনে উঠে বসো। তোমাকে নামায় দিয়া আসি।”

মেঘলা হা হয়ে তাকায় দিলিপের দিকে। এত ভয়ংকর একটা কথা কত অবলীলায় বলে দিল ছেলেটা!

মেঘলার বড় বড় চোখ দুটোর দিকে হঠাৎ হাসি থামিয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে দিলিপ। খুব অবাক হয়ে দেখতে পায় মেয়েটার বড় বড় চোখ দুটোয় পানি চলে আসছে। মেয়েটা প্রাণ পণ চেষ্টা করছে সেই পানি আটকাতে। পারছে না। আবার চোখও ফিরিয়ে নিচ্ছে না। ওর দিকেই তাকিয়ে আছে।

দিলিপ কথা হারিয়ে ফেলল কিছুক্ষণের জন্য।

“ইয়ে, মেঘলা..... আরে কান্দো ক্যান! মানে তুমি সাইকেল.... ইয়ে থাক্‌ উঠা লাগবে না!”

দিলিপকে হতবাক করে দিয়ে মেঘলা ঘুরে ছুটতে থাকে তপ্ত বালুর সমুদ্রের মাঝ দিয়ে।

গণগণে আগুণ ঢালতে থাকা সূর্যটা ঠিক মাথার ওপরেই, পুলটার মাঝে হতভম্ব হয়ে সাইকেলের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে দিলিপ। মেঘলার ছুটন্ত পথে চিক চিকে বালু অদ্ভুত নদী তৈরি করেছে..... মেয়েটার চোখের পানিও কি মিশেছে সেই নদীতে?



পনেরো দিন পর। দুপুর বেলা হঠাৎ করেই মায়ের ঘরে চলে এলো ব্যস্ত ভঙ্গিতে মনোয়ার।

“কিরে? কিছু বলবি?” মরিয়ম একটা বোতাম লাগাচ্ছিলেন এনায়েত চৌধুরীর একটা পাঞ্জাবীতে। এনায়েত সাহেব ঘুমাচ্ছেন পাশ ফিরে। একটু আগেই দুপুরের খাবার খেয়েছে। খাওয়ার পর ঘুমানোর অভ্যাস তাঁর। শোয়া মাত্রই ঘুমিয়ে গেছেন।

মনোয়ার এক ঝলক বাবার ঘুমন্ত শরীরটার দিকে তাকিয়ে অস্বস্তি মেশানো গলায় বলল, “কেরানী বাড়ীর সম্বন্ধটা মানা করে দিছে।”

দীর্ঘ একটা মুহূর্ত নীরবতা। মরিয়ম শান্ত স্বরে বললেন, “আরো কোনো বাড়ীতে সম্বন্ধ পাঠাইছিলি?”

“আরো তিন জায়গায় দিছিলাম।” মাথা নাড়লো হতাশ ভাবে, “মেঘলার অসুখটার কথা আসলে সারা গ্রামে ছড়ায় গেছে। ছেলের বাড়ী থেকে খোঁজ নিতে আসলেই দরজা থেকে ফেরত চলে যায়।”

থম থমে মুখে খোলা জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে রইলেন মরিয়ম। তারপর গম্ভীর হয়ে বললেন, “মিজান ভাইয়ের ছেলেটা মেঘলারে বিয়ে করতে চাইছিল না? জাফর? তারে বলবি মেঘলার সাথে বিয়ে দিতে রাজী আছি আমরা।”

মনোয়ার ইতঃস্তত গলায় বলল, “কিন্তু ওর তো আগের দুইটা বৌ আছে।”

“তোর বোনও বেশি ভাল জিনিস না। যে রোগ বাঁধাইছে তাতে বিয়ে বসানোই ঝামেলা।” কট মট করে তাকালেন ছেলের দিকে।

মনোয়ার মাথা নাড়ালো পুতুলের মত।

“আর শোন্‌ তোর ঐ এ্যাসিস্টেন্ট- দিলিপ; ঐটারে চলে যাইতে বলবি গ্রাম ছাইড়া। প্রয়োজনে বেশি টাকা দিবি। তাও যেন আর কোন দিন ফেরত না আসে। নানান দিক থেকে খবর পাইতেছি তোর বোনের কলেজের সামনে গিয়া নাকি দাঁড়ায় থাকে ছ্যামড়া। মেঘলার পিছন পিছন সারা রাস্তা হাঁইটা আসে। এই স হিন্দু ছেলেরে নিয়া কিছু কথা রটার আগেই পথটা বন্ধ করতে হবে। পরিষ্কার?”

মনোয়ার মাথা ঝাঁকালো আবার।



বৃষ্টি হচ্ছে। টিনের চালে ঝাপিয়ে নেমেছে এই মাঝরাতে। খানিক পর পর আকাশ চৌচির করে বিদ্যুতের নীল শিখা ছড়িয়ে পড়ছে। পুরো জগৎ খান খান করে ভেঙে দিচ্ছে প্রতি মুহূর্তে।

মেঘলা ওর বিছানার পাশের জানালাটায় মূর্তির মত বসে আছে। জানালা খোলা। বাহির থেকে বৃষ্টির ছটা বাতাসে নিয়ে এসে ভেতরে ফেলছে। ভিজে যাচ্ছে সে। তবু নির্বিকার ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে বাহিরের জমাট অন্ধকারের দিকে। মুহূর্তে মুহূর্তে দিনের মত জেগে ওঠে চারপাশ। পরক্ষণেই ডুবে যায় নিকষ কালো অন্ধকারে। হীরার মত জ্বল জ্বলে চোখে মেঘলা তাকিয়ে থাকে।

কাল সকালে ওর বিয়ে। দূর সম্পর্কের এক ভাইয়ের সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে তার। জাফর সিদ্দিক। আগের দুটো বৌ আছে। তৃতীয় পক্ষ বসবে মেঘলা। কোন আয়োজন ছাড়াই বিয়েটা হচ্ছে। এনায়েত সাহেব তাঁর তিন বিঘা ধানী জমি লিখে দিচ্ছেন মেয়ে জামাইকে। সাথে ছয় ভরি সোনার গহনা সিয়ে সাজিয়েও দেবেন। আসবাব পত্র, ফ্রিজ, টিভিও বাদ রাখছেন না। বাদ থাকার মাঝে কেবল রয়েছে আত্মীয় সজনকে ডেকে ঘটা করে খাওয়ানো। মরিয়ম কোন রকম আত্মীয় ডাকা অনুষ্ঠান করতে চাননি। মেয়ের সম্পর্কে আজে বাজে কথা ছটানোর সময় মুখিয়ে থাকা আত্মীয়দের না খাওয়ালে তাঁর কিছু আসবে যাবে না। যে আত্মীয় বিয়ের আগেই সম্বন্ধ ভাঙার গীত গাইতে জানে- বিয়ের খাওয়া খেয়ে যে মাংসে লবণ বেশি পড়েছিল বলবে না- তার কোনো ঠিক নেই। জিভ সর্বস্ব প্রাণী মরিয়ম দুই চোখে দেখতে পারেন না।

বৃষ্টি-বাতাসের ঝাপ্টায় জানালার পর্দাটা বার বার উড়ে যাচ্ছে, ডানা ঝাপ্টাচ্ছে পাখির মত। মেঘলা জানালার গ্রিলে মাথা রেখে শূণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ওড়নাটা এখনো একই ভাবে পেঁচিয়ে রেখেছে।

বজ্রপাতের চমকাতে থাকা আলোতে পশ্চিম দিকের রাস্তাটা ধরে কেউ এগিয়ে আসছে, ছাতা কিংবা টর্চ কোনটাই সাথে নেই। পানি জমে ওঠা রাস্তাটায় ছপ্‌ ছপ্‌ শব্দে পা ফেলে হেঁটে আসছে মানুষটা। মেঘলা ধীরে ধীরে সোজা হয়ে বসল, মুখটা সরিয়ে নিলো গ্রিল থেকে। পর্দাটার এপাশে চলে এলো। বৃষ্টির মাঝে ভিজতে ভিজতে বাড়ীর দিকে এগিয়ে আসতে থাকা মানুষটাকে চিনতে পেরেছে সে বিদ্যুতের খনিক আলোতেও। দিলিপ ভাই। জানালা থেকে সরে গেছে সে জন্য। পাথরের মত জমে গেছে মেঘলা।

কাঁধের ছোট ব্যাগটা নিয়ে দ্রুত পায়ে হাঁটছে দিলিপ। মেঘলা জানালাটার এপাশে একটা বাগানের মত রয়েছে। ঘাসের ওপর ইঞ্চি খানেক পানি জমে আছে। হাঁটতে গেলেই ছিটকে ওঠে। তার ওপর প্রচণ্ড বাতাসের জন্য বড় বড় ফোঁটার বৃষ্টিগুলো সূঁচের মত বিঁধছে। চোখ ছোট ছোট করে রাখতে হচ্ছে। না হলে দেখা যায় না কিছু। পানি এসে ভিজিয়ে দেয় চোখ।

টিনের চালে ঝম ঝম শব্দে সুর করে বৃষ্টি পড়ছে। মেঘলার জানালাটার কাছে এসে দাঁড়ালো দিলিপ। জানালার পর্দাটা উড়ছে ডানা ঝাপ্টে। বিদ্যুতের আলোয়া আবছা ভাবে মেঘলার অস্পষ্ট অবয়বটা বোঝা যাচ্ছে।

চাল থেকে যে অংশে বৃষ্টির পানি পড়ে, সেই সমান্তরাল রেখায় পানির দেয়ালটা ভেদ করে এগিয়ে এলো দিলিপ। অনুচ্চ স্বরে ডাকল, “মেঘলা?”

বিছানার ওপর স্থাণুর মত বসে রয়েছে মেঘলা। পতাকার মত পত্‌ পত্‌ করে এক কোনা উড়তে থাকা পর্দার ওপাশে নিচ থেকে দাঁড়িয়ে থাকা দিলিপকে দেখা যায়। জানালাটা বেশ উঁচুতে বলে দিলিপের মুখটা কেবল দেখা যাচ্ছে। ভিজে গেছে মানুষটা। প্রচণ্ড শীতে কাঁপছে।

“মেঘলা?” আবারও ডাকল দিলিপ।

মেঘলা চাপা স্বরে বলল, “এত রাতে কেন আসছেন আপনি?”

“আমি তো চলে যাইতেছি। মনোয়ার ভাই সন্ধ্যার সময় হঠাৎ করে অনেকগুলা টাকা হাতে দিয়া বলল এই গ্রাম ছাইড়া দূরে অন্য কোথাও চলে যাইতে।” অসহায় গলায় বলল।

মেঘলা ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকাতে চাইলো, “টাকা দিছে চলে যান। এইখানে আসছেন কেন?”

দিলিপ মুখ নিচু করে ফেলল। ভিজে যাচ্ছে এক টানা বর্ষণে। মেঘলা আপ্রাণ চেষ্টা করছে কান্না ঠেকাতে। পারছে না। চোখ ফেটে পানি আসছে। এই মানুষটা এভাবে দাঁড়িয়ে ভিজছে কেন বৃষ্টিতে? ভয়ংকর একটা কষ্ট মোচড় দিতে লাগল ভেতরে।

দিলিপ মুখ নিচু করে দাঁড়িয়েই আছে। কথা বলছে না। কাঁপছে শুধু ঠাণ্ডায়। মেঘলা উড়তে থাকা পর্দার আড়াল থেকে দেখতে পাচ্ছে মানুষটা ঠাণ্ডায় কাঁপা শুরু করেছে।

“আপনি দাঁড়ায় আছেন কেন? এইভাবে ভিজতেছেন কেন? চলে যাইতে বললাম না?” থাকতে না পেরে বলে ফেলল মেঘলা। কান্নার স্বরটা বৃষ্টির মাঝেও স্পষ্ট বোঝা গেল। মেঘলা টের পাচ্ছে তার পাগলের মত কান্না আসছে। কিন্তু শব্দ করে কাঁদতে পারছে না। মনে হচ্ছে সব কিছু ভেঙে চুরে গুড়িয়ে দিতে পারলে ভেতরের কিছু একটা শান্ত হতো। এত কষ্ট লাগছে কেন ওর?

দিলিপ ধীরে ধীরে মুখ তুলে প্রায় শোনা যায় না এমন স্বরে বলল, “মেঘলা? আমার সাথে যাবা? তোমার তো এখানে কেউ নাই।”

মেঘলা স্থির হয়ে গেল। উত্তর দিল না। বাতাসে মায়াবী পর্দা দুলছে।

“যাবা আমার সাথে?” জানালার গ্রিলে মুখ এনে ঠেকালো দিলিপ। কাতর চোখে তাকায় মেঘলার দিকে।

মেঘলা ফিস ফিস করে দীর্ঘ একটা মুহূর্ত পর বলে, “আমি তো সুন্দর না দিলিপ ভাই। দিন দিন কুৎসিত একটা মানুষে বদলায় যাবো আপনার চোখের সামনেই। আমাকে কেন নিতে চান সাথে?”

অসহায় ভঙ্গিতে হাসল, “সুন্দর অসুন্দরে কি দুনিয়ার হিসাব চলে? মানুষের মনের উপর সংসার গড়ছে। সুন্দরে না। সুন্দরে ঘরের শুরু করা যায় কেবল, সংসার না। মনের সুন্দর না থাকলে সংসার হয়?”

মেঘলা উত্তর দেয় না। কেবল টের পাচ্ছে জানালার ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার জন্য তার প্রচণ্ড মায়া হচ্ছে। কেন হচ্ছে জানে না।

“যাবা আমার সাথে?” আবার বলল দিলিপ।

মনের আনাচে কানাচে হাতড়ে সমস্ত শক্তি জড়ো করে নিলো মেঘলা। চোখ উপচে অনর্গল জল গড়াচ্ছে, তার মাঝেও অদ্ভুত দৃঢ় গলায় বলল, “না।”

দিলিপ চুপ হয়ে গেল ওপাশে। মুখ নিচু করে রেখেছে বৃষ্টির মাঝে।

মেঘলার দম আটকে আসা শুরু হয়েছে। ছেলেটা চলে যাচ্ছে না কেন? কেন এভাবে মুখ নিচু করে ভিজছে? কেন তার জানালার গ্রিল চেপে ধরে আছে? নিঃশব্দে কাঁদতে থাকে মেঘলা। দু হাতে মুখ চেপে শব্দ আটকাতে থাকে পাগলের মত। জানালার অন্যপাশের গ্রিলে কাত হয়ে হেলান দিয়ে কেঁপে কেঁপে কাঁদতে থাকে মেয়েটা। ভয়ংকর একটা কষ্ট মিশে গেছে রাতের আঁধারের এই দৃশ্যটায়।

জানালার ওপাশ থেকে দিলিপ আস্তে আস্তে একটা খয়েরি প্যাকেট বিছানার ওপর ছুঁড়ে ফেলে দেয়। অনেকগুলো একশো টাকার নোট উঁকি দিচ্ছে সেখান থেকে।

মেঘলা পর্দার অন্তরাল থেকে শুনতে পেল দিলিপ অনুচ্চ স্বরে বলছে, “মেঘলা, আমার টাকার দরকার আছিল না কুনো দিন। আমি এক পেট নিয়ে জন্মাইলে আমি না খায়ে জীবন পার করে দিতে পারতাম। কিন্তু সাথে একটা বোনও দিয়া দিছিল বিধাতা। এক পেটের খিদা সহ্য করা যায়, অন্য পেটের খিদা কেমনে সহ্য করি বলতে পারো? আমার বোনটারে যে আমি কেমনে মানুষ করছি- আমি আর ওপরের তিনি ছাড়া কেউ জানতো না। এক থালায় ভাগ করে ভাত খাইতে হইছে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত। বোনটারে যখন বিয়া দিলাম- তখন থালা ভরে ভাত খাওয়ার সাহেবী অভ্যাসটা হইছিল আমার। আমার বোনটা স্বামীর বাড়ীতে কুকুরের মত বাঁইচা আছে- আমি তাও আনি নাই তারে। চুরি করে করে টাকা পাঠাইতাম। আমার এক প্লেট ভাতে কাউরে ভাগ দিতে ইচ্ছা করতো না। আমি অনেক স্বার্থপর মানুষ।” হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখের পানি মুছলো দিলিপ, “কিন্তু সেই এক প্লেট ভাতের মায়া আমি ছাইড়া দিতে পারবো মেঘলা। যাবা না আমার সাথে? আমি যেমনে পারি, যে ভাবে পারি- তোমারে কোনদিন না খাওয়ায় রাখবো না। আমি জানি খিদার কষ্ট, ভাতের কষ্ট কি জিনিস....... মেঘলা আমি জানি, আমি হিন্দু বলে আমার সাথে আসবা না তুমি। মেঘলা- তোমার যে বিধাতা আছে, সেই একই বিধাতা আমারও। বিধাতা কখনো দুইটা হয় না। না হলে দুই বিধাতায় দুই রকম মানুষ বানাইতো। তাকায় দেখো- তোমার মতই হাত পা মুখ নাক চোখ ঠিক আমারও আছে। খিদার কষ্ট আমিও টের পাই। ব্যথা পাইলে চোখ গড়ায় পানি আমারও আসে- আমি তোমার থেকে ভিন্ন কিসে? বিধাতা কুনো দিন ভিন্ন হয় না মেঘলা। তোমার বিধাতা যেমন তোমার কষ্ট টের পায়, আমার কষ্টও সে একই ভাবে টের পায়। মেঘলা যাবা না আমার সাথে? আমি আমার বাকি জীবনটা আধ প্লেট ভাত খায়ে কাটায় দিতে পারবো। আসবা না তুমি?”

মেঘলা পাগলের মত কাঁদতে থাকে। জানালার ওপাশের মানুষটা এত ভয়ংকর ভাবে কষ্ট দিচ্ছে কেন তাকে? কি দোষ করেছে সে?

“যাবা না মেঘলা?” কাতর গলায় অনুনয় করল দিলিপ।

কান্না চেপে সমস্ত অবশিষ্ট শক্তি সঞ্চিত করে বলল মেঘলা, “না!”

দিলিপ বৃষ্টির মাঝে মাথা ঝুঁকিয়ে ফেলে আবার। তারপর ডান হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে ভাঙা গলায় বলে, “ঠিক আছে তাইলে। আমি চলে যাইতেছি। কিন্তু যাওয়ার আগে আমাকে একটা বার ছুঁইয়ে দিবা মেঘলা? আমার বাকি জনমটা তোমার হাতে ধরার কথা মনে রাখে পার করে দিতাম?”

মেঘলা ফোঁপাতে ফোঁপাতে দেখে দিলিপ জানালার গ্রিল দিয়ে ডান হাতটা বাড়িয়ে দিয়েছে ভেতরে। ভেজা হাতটা বজ্রপাতের আলোয় চিক চিক করছে।

মেঘলার মনে হতে লাগল সে মারা যাচ্ছে। এত তোলপাড় হচ্ছে কেন ভেতরটায়? দলা পাকানো একটা তীব্র কান্না গলায় উঠে এলো ওর। হাতটা ছুঁয়ে দেয়ার জন্য ভয়ংকর ইচ্ছে করছে। কিন্তু আটকে রেখেছে নিজেকে। প্রচণ্ড কষ্টে বিছানার চাদর খামচে ধরেছে মেয়েটা। জানালার গ্রিলের সঙ্গে পিঠ ঠেকিয়ে কেঁদে যাচ্ছে আকুল হয়ে। পা দুটো অস্থির ভঙ্গিতে বিছানায় ঘষছে। এত কষ্ট হচ্ছে কেন ওর? কেন মরে যাচ্ছে না? একটু মুক্তি পেতো তাহলে?

কেন ছেলেটা হাতটা এভাবে বাড়িয়ে রেখেছে? চলে যাচ্ছে না কেন? মেঘলা পাগলের মত কাঁদতে থাকে।

“দিলিপ ভাই আপনি চলে যান। আপনি চলে যান। না হলে আমি মরে যাবো এখন....”

প্রচণ্ড বজ্রপাতের মাঝে জগৎ খান খান হয়ে যাচ্ছে। সারা পৃথিবীতে এতটা হাহাকার কবে মিশেছিল আর সহস্র বৎসরে?

দিলিপ আস্তে আস্তে হাতটা নামিয়ে নেয়। বৃষ্টির মাঝেই হাতেই উলটো পিঠ দিয়ে চোখের পানি মুছতে মুছতে রাতের অন্ধকারে হারিয়ে যেতে থাকে চিরদিনের মত.......

মেঘলা জানালার গ্রিল চেপে ধরে শব্দ করে কাঁদতে থাকে। এবারে বাঁধ ভেঙে গেছে কান্নার জলে। অসহ্য একটা যন্ত্রণায় ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে আসছে।

বিধাতা কি দেখতে পেয়েছিল মেয়েটা আর একটু হলেই ছেলেটার হাতটা ছুঁয়ে দিতে পারতো? যে কিনা আধ প্লেট ভাত খেয়ে জীবন পার করে দিতে চেয়েছিল মেয়েটার জন্য।

মেঘলার ওড়নাটা সরে গেছে আজ। ঘন কালো চুলগুলো মুখের ওপর এসে পড়েছে। বজ্রপাতের সাদাটে আলোয় ওর হাতের শ্বেত শুভ্র দাগগুলো বড় জ্বল জ্বল করে জ্বলছে। ঠিক একেকটা নক্ষত্রের মত জ্বলছে...... বিধাতার নক্ষত্রের মত। দিলিপের বিধাতা কিংবা মেঘলার বিধাতা। যার গড়া আকাশে এত মেঘ বৃষ্টি আর আলোর খেলা চলে। যে আকাশের নিচে ঘাসের জলে ছপ্‌ ছপ্‌ পা ফেলে অন্ধকারের মাঝে কেউ হারিয়ে যায়...... আটকানোর জন্য পেছনে কেউ থেকেও বিধাতার অদৃশ্য দেয়ালে আটকা পড়ে থাকে; কোনো রোরুদ্যমনা নারী...... যার ডাক কেউ শোনেনি......

(সমাপ্ত)

মন্তব্য ১৫ টি রেটিং +৬/-০

মন্তব্য (১৫) মন্তব্য লিখুন

১| ১৫ ই মে, ২০১৩ সকাল ১০:১৬

কান্ডারি অথর্ব বলেছেন:
জীবন বোধের এক অনন্য উপস্থাপনা। প্রথম পর্বে যাচ্ছি।

১৫ ই মে, ২০১৩ দুপুর ২:০৯

নিথর শ্রাবণ শিহাব বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ আপনাকে ভাই :)

২| ১৫ ই মে, ২০১৩ দুপুর ১২:০২

s r jony বলেছেন: তোমার যে বিধাতা আছে, সেই একই বিধাতা আমারও। বিধাতা কখনো দুইটা হয় না। না হলে দুই বিধাতায় দুই রকম মানুষ বানাইতো। তাকায় দেখো- তোমার মতই হাত পা মুখ নাক চোখ ঠিক আমারও আছে। খিদার কষ্ট আমিও টের পাই। ব্যথা পাইলে চোখ গড়ায় পানি আমারও আসে- আমি তোমার থেকে ভিন্ন কিসে? বিধাতা কুনো দিন ভিন্ন হয় না মেঘলা। তোমার বিধাতা যেমন তোমার কষ্ট টের পায়, আমার কষ্টও সে একই ভাবে টের পায়।

৩| ১৫ ই মে, ২০১৩ দুপুর ১২:০২

s r jony বলেছেন: +++++++++++++ আপনাকে অনুশারিত করলাম

১৫ ই মে, ২০১৩ দুপুর ২:০৯

নিথর শ্রাবণ শিহাব বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ আপনাকে ভাই :)

৪| ১৫ ই মে, ২০১৩ বিকাল ৫:০২

প্রোফেসর শঙ্কু বলেছেন: প্রথম পর্ব পড়ে পুরো মন্তব্য করব। অনুসারিত এবং প্লাস।

৫| ১৫ ই মে, ২০১৩ রাত ৮:৫৩

মুনসী১৬১২ বলেছেন: অনন্য

শিহাব ভাই পিচ্চি জেনারেলের গল্প কি শেষ ? :)

১৬ ই মে, ২০১৩ ভোর ৬:৫৮

নিথর শ্রাবণ শিহাব বলেছেন: নাহ। শেষ না। এখানে পোস্ট করা হয়নি আর। ফেসবুকেই বেশি লিখি। ব্লগে ঢুকতে গেলে আসলে মেগাবাইট বেশি যায় ফেসবুকের থেকে। আমার দশ পনেরো এমবির নেট ব্লগে শেষ করে ফেললে কেমনে হয় :(

৬| ১৭ ই মে, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:৩৯

ইলুসন বলেছেন: বাস্তব কাহিনী উঠে এসেছে এই গল্পে। চমৎকার লাগল পড়ে। আমাদের দেশে মেয়েদের কত কিছুর মাঝ দিয়ে যেতে হয়, মনে হয় বিয়েটাই তাদের জীবনের সবচেয়ে বড় গন্তব্য, যেভাবে হোক বিয়ে দিতে হবে, ভাল খারাপ ব্যাপার না। অদ্ভুত লাগে।


ভাই ক্যাপ্টেন বাবাকোয়ার আরো কিছু গল্প পোস্ট করেন ব্লগে, অনেক মিস করি তাকে। এক মাস একটু বেশি মেগাবাইট খরচ করেন মিয়া!

২১ শে মে, ২০১৩ রাত ৯:৪১

নিথর শ্রাবণ শিহাব বলেছেন: :)

২১ শে মে, ২০১৩ রাত ৯:৪২

নিথর শ্রাবণ শিহাব বলেছেন: :)

৭| ১৮ ই মে, ২০১৩ রাত ৮:৪৩

সোহাগ সকাল বলেছেন: চমৎকার!

২১ শে মে, ২০১৩ রাত ৯:৪২

নিথর শ্রাবণ শিহাব বলেছেন: ধন্যবাদ :)

৮| ১৯ শে মে, ২০১৩ রাত ৯:০৪

সানজিদা হোসেন বলেছেন: মন খারাপের সাথে ভাললাগা

২১ শে মে, ২০১৩ রাত ৯:৪২

নিথর শ্রাবণ শিহাব বলেছেন: :)

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.