![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আব্বুর সাথে কথা বলে ফোনটা রেখে দেখি কাঁটায় কাঁটায় রাত আটটা! সাড়ে আটটায় রওনা দিতে হবে বাসায় যেতে! হাতে সময় নেই একেবারেই! দুদ্দাড় করে ব্যাকপ্যাকে দুইটা জামা, ফোন চার্জার, টুথব্রাশ, কিছু টাকা ঢুকিয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে তাকালাম রুমের দিকে। গোছানোই আছে। ঝকঝকে পরিষ্কার! ভাগ্যিস আজ সকালেই গুছিয়ে রেখেছিলাম! রুমমেট এসে নালিশ করতে পারবে না! সদ্য গোছানো ব্যাকপ্যাকটা পিঠে ঝুলিয়ে দরজা লক করলাম দেখেশুনে।
কি আশ্চর্য! ছ'তলা থেকে সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় একবারো পা কাঁপলো না! চোখের সামনে কালো পর্দা নেমে এলো না! আমি কি তাহলে পাথর ই হয়ে গেলাম?
আমাদের দেশে মেয়েদের হোস্টেলের নিয়ম অনেক কড়া! রাত বিরাতে বের হতে চাইলে তো আরো যন্ত্রণা! হাজারটা প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়! কোথায় যাচ্ছো,কেন যাচ্ছো,কার সাথে যাচ্ছো,কখন আসবে! আমার অবশ্য তার দরকার নেই। আব্বু আগেই হোস্টেল সুপারকে ফোনে জানিয়ে দিয়েছে সবকিছু। সিকিউরিটি কে শুধু বললেই হবে।
গেইটে যেয়ে দাঁড়াতেই গার্ড একজন এগিয়ে এলো। রাত ৮টায় ব্যাকপ্যাক কাঁধে, বাইরের পোশাকে আমাকে দেখে এগিয়ে না আসাটাই অবশ্য অস্বাভাবিক!
শান্ত গলায় ব্যাখ্যা করলাম কি হয়েছে। মামা গাড়ি নিয়ে আসবে। সেই গাড়িতেই যাবো। এটাও বললাম। গার্ড মাথা নেড়ে চলে গেলে গেইটের পাশের বেঞ্চিতে পা ঝুলিয়ে বসলাম। হোস্টেলের সামনের রাস্তা হলদে ফ্ল্যাশলাইটের আলোয় ভেসে যাচ্ছে।
কি আশ্চর্য! কি হয়েছে বলতে গিয়ে একবারো আমার চোখে পানি এসে গেলো না! এমনকি গলাটাও ধরে এলো না! আমি কি তাহলে সত্যিই পাথর হয়ে গেলাম?
ঠিক রাত সাড়ে আটটায় আমাকে নিতে আসার কথা। ফোনের ডিসপ্লেতে সময় আটটা বেজে পঞ্চান্ন। এখনো আসছে না কেন ওরা? আমি ধীরে ধীরে অধৈর্য হয়ে পড়ছি। ওদিকে তো গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল!
অবশেষে ওরা এলো। গেটের বাইরে গাড়ি থামতেই আমি দৌড়ে বের হলাম। গাড়ির দরজা খোলাই ছিল। মেজনানুর পাশে উঠে বসলাম। মামা বসেছে ড্রাইভারের পাশের সিটে। আমার দিকে ফিরে বললো,মামণি? সব ঠিকঠাক আছে তো? ভালো আছো তুমি?
হ্যাঁ মামা! ঠিক আছে সব! চলো রওনা দিই। বলতে বলতেই গাড়ি ছেড়ে দিল। একবার জানালার কাঁচে আরেকবার কোলে রাখা ব্যাকপ্যাকের ওপর মাথা রেখে ঘুমুনোর চেষ্টা করতে লাগলাম। আম্মু বা আব্বু থাকলে ভালো হত যদিও। ওদের কাঁধে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে যেতাম। যেহেতু নেই, কি আর করা এ ছাড়া! ঘুমুতে আমাকে হবেই! না হলে সব বমি করে ভাসিয়ে ফেলার প্রবল সম্ভাবনা আছে। আর সেটা মোটেই ভালো কিছু হবে না।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ছাড়িয়ে কুমিল্লার রাস্তায় আসতে গাড়ি একটু একটু লাফালাফি করতে লাগলো। এই লাফালাফির মধ্যেই আমি বেশ ভালোই একটা ঘুম দিয়ে ফেললাম। দুয়েকবার ঘুম ভেঙে গেল যদিও। দেখলাম, মেজনানু ডুকরে ডুকরে কাঁদছে।
কি আশ্চর্য! নানুর চাইতে তো আমার বেশি কাঁদার কথা! অথচ আমার চোখ একটুও ভিজে উঠছে না! কেন? আমি কি তাহলে পাথর হয়েই গেলাম?
ভাবতে ভাবতে আবারো ঘুমিয়ে গেলাম।
ঘুম ভাঙলো মামার ডাকে। মা ওঠো! চলে এসেছি আমরা। চোখ রগড়াতে রগড়াতে চশমা পরলাম। ব্যাগটা হাতে নিতে নিতেই দৃষ্টিসীমায় চলে এলো নানুবাড়ি।
টিনের চালের একতলা বাড়ি। বাড়ির সামনে সুপুরিবাগান। আমার ফোনের ডিসপ্লেতে এখন রাত তিনটা বেজে পাঁচ। অথচ সামনের উঠোন আধ ডজন বাল্ব এর আলোতে ফকফকা। উঠোন জুড়ে শামিয়ানা টাঙানো। তার নিচে ডেকোরেটরের ভাড়া করা চেয়ারে বসে আছে একদল পাঞ্জাবী টুপি পরা ছেলে। বয়স ১০ থেকে ২৫ সবার। হাতে কুরআন শরীফ। গোল হয়ে বসে একমনে কুরআন পড়ছে সবাই। বৃত্তের মাঝে একটা খাটিয়া। খাটিয়ার চারপাশ ঘিরে আগরবাতি জ্বলছে। গোলাপজলের ঘ্রাণ। উঠোন দিয়ে হেঁটে সদর দরজায় পৌঁছুনোর আগে ফিরে তাকালাম খাটিয়াটার দিকে।
সাদা কাফনে জড়ানো একটা লাশ। দেখেই বোঝা যাচ্ছে মৃত্যুর আগে মানুষটা খুব শুকিয়ে গিয়েছিল।
লাশ? ভাবতে গিয়ে চমকে উঠলাম আমি..
১০ দিন আগে ক্যাম্পাসে ফেরার আগে এই লাশটার কপালেই চুমু খাচ্ছিলাম যখন, তখন এটা আমার নানাভাই ছিল.. আমার আম্মুর বাবা ছিল.. নানুবাড়ির পশ্চিমের ঘরটায় নাকে ক্যানুলা নিয়ে শুয়ে থাকতো। নড়তো না যদিও তেমন। কিন্তু শ্বাস নিতো। পার্থক্য, আর সে শ্বাস নিচ্ছে না। সবার যত্নে, ভালোবাসায় যে এতদিন নিজের ঘরে নিজের বিছানায় শুয়ে ছিল, আজ তাকে তার ই ঘরের বাইরের উঠোনে রেখেই ঘরে চলে যাচ্ছে সবাই..
বড়মামণি এসেছে.. বড়মামণি এসেছে.. আমি ঘরে ঢুকতেই বিড়বিড়ানি শুনলাম। কোন রুমে যেতে হবে আমি জানি। পশ্চিমের ঘরটার দিকে এগিয়ে গেলাম। বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে থাকা মহিলার পাশে যেয়ে বসলাম। আস্তে করে পিঠে হাত বুলাতে আমার দিকে তাকালো সে। দৃষ্টি উদভ্রান্ত। ধীরে ধীরে হাত বাড়ালো আমার দিকে। আমি মাথা গুঁজলাম আম্মুর বুকে।
সন্ধ্যা সাতটায় ফোনে ছোটবোন টেক্সট দিয়েছিল, কই তুই? ফোন ধর আপি! নানাভাই মরে গেছে। ওটা দেখার পর আমার কেন যেন কোন অনুভূতি হয়নি! এক ফোঁটা পানি আসেনি চোখে! আমাকে বুকে জড়িয়ে আম্মু যখন চিৎকার করে কেঁদে উঠলো, মা, তোর নানাভাই আর নাই রে! আমার আব্বা আর নাই রে মা!
আমার চোখ ফেটে পানি বের হল অবশেষে.. চিৎকার করে কাঁদলে মৃতের আত্মা কষ্ট পায় জেনেও আমি আম্মুকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলাম। জানি না ঠিক কতক্ষণ পর আম্মুকে ছেড়ে সোজা হয়ে বসলাম। খালামণিরা কাঁদছে। নানু পাথরের মত বসে আছে। সেই চোখে কোন দৃষ্টি নেই। বাড়িভর্তি মানুষ কাঁদছে আমাদের কান্না দেখে।
তারপর, একসময় কান্না থেমে এলো।
কি আশ্চর্য! আম্মুকে ধরে যখন কাঁদতে শুরু করেছিলাম,ভাবিনি এই কান্না শেষ হতে পারে কোনদিন! ভেবেছিলাম, এই ব্যথায় মৃত্যু পর্যন্ত আমার অশ্রু গড়াবে। কিন্তু কই! থেমে গেল যে! আমি কি শেষ পর্যন্ত পাথর হয়েই গেলাম?
আব্বু ঘরে ঢুকতেই দৌঁড়ে আব্বুকে জড়িয়ে ধরলাম। আরেক দফা নোনা পানির ফোয়ারায় আব্বুর শার্টটা একটু একটু করে ভিজে যেতে লাগলো।
আব্বুও হয়তো বুঝতে পেরেছে আমার মনের অবস্থা। আম্মুকে তার আব্বুর জন্য কাঁদতে দেখেই হয়তো আমি এত জোরে আব্বুকে আঁকড়ে ধরেছি। সাইকোলজি সব সাইকোলজি! কাঁদতে কাঁদতে ভাবতেই অবাক হয়ে গেলাম।
কি আশ্চর্য! আমার নানাভাই আর নেই। বাড়িভর্তি সবাই কাঁদছে। আর আমি কাঁদতে কাঁদতে সাইকোলজির কথা ভাবছি? পাষাণ হয়ে গেছি আমি!
আব্বুর চাপাচাপিতে ছোটমামার ঘরে একটু ঘুমিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছি। অন্ধকার ঘরে বাইরে থেকে আসা হালকা হলুদাভ আলোয় সবকিছুই আবছা আবছা দেখতে দেখতে ফ্ল্যাশব্যাকের মত সবকিছু মনে পড়তে লাগলো।
নানাভাই তার সবগুলো নাতনীকে আলাদা আলাদা নাম দিয়েছিল। আমাকে ডাকতো ইরানী। পরিবারের প্রথম থার্ড জেনারেশন তথা বড় নাতনীর প্রতি স্বাভাবিকভাবেই আদরটা ছিল সীমাহীন। আম্মু বলেছে ছোটবেলায় আমি যখন কোলের বাচ্চা ছিলাম, আমাকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে নানাভাই নাকি ঘন্টার পর ঘন্টা আমার পাশে বসে থাকতো। পাহারা দিতো।
নানাভাই গল্প শোনাতো আমাদেরকে। এক গরীব রাজার গল্প। সেই গরীব রাজার মাত্র একটা লুঙ্গি ছিল। লুঙ্গিটা ধুতে হলে রাজা সেটা ধুয়ে ঝোপের ওপর শুকাতে দিত। নিজে ঝোপের আড়ালে বসে থাকতো। তারপর লুঙ্গি শুকালে সেটা পরতো।
আর ভাবতে পারছি না! স্মৃতিগুলো কি ঝাপসা হয়ে গেল আমার?
সেই ছোট্টবেলা থেকে প্রতিটা পরীক্ষার আগে নানুবাসায় যেতাম। দোয়া নিতে। নানাভাই দোয়া পড়ে ফুঁ দিয়ে দিতো। তবে শেষবার দিতে পারেনি। কিভাবে দেবে নানাভাই তো আমাকে চিনতেই পারেনি।
মাইল্ড স্ট্রোকের পর নানাভাই একটু একটু করে সব ভুলে যাওয়া শুরু করেছিল। আমি যে তার ইরানী ভুলেই যেত মাঝে মাঝে। এমনকি আম্মুকে বা নানুকেও চিনতে পারত না।
শেষবার কথা বলার সময় আমাকে ছোটখালামণি মনে করায় কেঁদে সবকিছু ভাসিয়ে ফেলেছিলাম। আমাকে কাঁদতে দেখে নানাভাই ও কাঁদতে শুরু করেছিল। কেন আমাদেরকে চিনতে পারে না তাই।
নানাভাই আর কোনদিন আমাকে চেনেনি। তারপর তো কথা বলাই বন্ধ হয়ে গেল। বিছানায় সটান হয়ে শুয়ে শুধু তাকিয়ে থাকতো। কী জানি তাঁর ইরানীকে চিনতো নাকি.. জানা হয়নি। আর হবেও না কখনো। নানাভাই যে আর কোনদিন আমাকে ইরানী বলে ডাকে নি! চুপ করেই চলে গেছে।
আমার ভেতরটা পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে ভাবতে গিয়ে! আমি মরে যাচ্ছি না কেন আল্লাহ? আমি এত কষ্ট নিয়ে কীভাবে বেঁচে আছি?
ভাবতে ভাবতে কখন যেন আমি ঘুমিয়ে গেছি। চোখ মেলল বাবার ডাকে। মা ওঠ! তোর নানাভাইকে দেখাবে এখন। দেখে আয় শেষবার।
আমি দৌড়ে বের হলাম একটাও কথা না বলে। উঠোনে খাটিয়ার চারপাশে নানু, খালামণি, আম্মু, বোনেরা আরো আত্মীয়রা দাঁড়িয়ে আছে। আমি আস্তে আস্তে নানাভাইয়ের মাথার কাছে দাঁড়ালাম। বড়মামা কাফন সরিয়ে দিল। নানাভাইয়ের চোখ দুটো বন্ধ। মুখটা একটু ফাঁক হয়ে আছে। শুকিয়ে গেছে। খুব শুকিয়ে গেছে। কপালে হাত রাখলাম। ঠাণ্ডা..
চোখ বেয়ে পানি পড়ছে নীরবে। নানাভাইয়ের গায়ে সেগুলো পড়ার আগেই সরে আসলাম। রুহের কষ্ট হবে! আম্মু আবার কাঁদছে। ধরে রাখলাম আমি। তারপর বড়মামার তাগাদায় শেষবারের মতো নানাভাইয়ের দিকে তাকিয়ে চলে আসলাম পেছনে ফিরে। আমার চিৎকার করে কেঁদে দুনিয়া ফাটিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে! কিন্তু না! আমি কাঁদলে নানাভাইয়ের কষ্ট হবে! আমি কাঁদবো না! কিছুতেই কাঁদবো না!
দেখতে দেখতে দিনটাও কীভাবে যেন পার হয়ে গেল। আমি ভেবেছিলাম দিনটা খুব লম্বা হবে। ফুরোতেই চাইবে না! কিন্তু, ফুরিয়ে গেল তো!
আগে কোনদিন কাছের কারো মৃত্যু দেখিনি। তার বাড়িতে কি হয় জানিও না তাই! আমি ভেবেছিলাম, কেউ খায় না, ঘুমোয় না.. শুধু বসে থাকে চুপচাপ.. আর একটু পর পর কেঁদে ওঠে..
কিন্তু না! আমি ভুল ছিলাম। মানুষের জৈবিক চাহিদা সবকিছুর ঊর্ধ্বে! না হলে নিজের আব্বাকে কবরে শুইয়ে দিয়ে আম্মু খাচ্ছে কীভাবে? স্বামীকে কবরের শক্ত মাটিতে শুইয়ে নানু বিছানায় ঘুমাচ্ছে কী করে? আমার নানাভাই মারা গেছে মাত্র ২৮ ঘন্টা আগে। আমি হাসছি কীভাবে?
নানুর পাশে গিয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়লাম। আমার ধারণা আবারো ভুল প্রমাণিত হল। নানু জেগে আছে। আমি শুতেই একহাতে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। নানুকে জড়িয়ে ধরে আমি আবারো নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলাম।
নানু, কাঁদে না! তোমার নানাভাই দেখছে তো তোমাদের! কাঁদলে কষ্ট হবে তো নানাভাইয়ের!
নানুর কথায় কান্নার কোন ছাপ নেই। বাচ্চা মেয়ের মত কাঁদতে কাঁদতে বললাম, নানাভাই আমাকে দেখছে নানু?
হ্যাঁ দেখছেই তো! সেজন্যেই তো কাঁদতে নিষেধ করলাম। কষ্ট পাবে তো দেখলে!
হেঁচকি তুলতে তুলতে কান্না থামালাম। নানু আমার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। কখন যেন ঘুমিয়েও গেলাম..
রাত কটা বাজে জানি না। দুটা কি তিনটা হবে। ঘুম ভেঙে গেল হঠাৎ। চোখ বুজেই ঠাহর করতে চেষ্টা করলাম, আমি কোথায়। মনে পড়লো সাথে সাথেই। আমি নানুবাসায়। আমার নানাভাই গতকাল মারা গেছে। দলাবাঁধা কান্না এসে শ্বাস আটকে দিচ্ছে আমার। ডুকরে উঠতে গিয়ে সামলে নিলাম। কান্নার শব্দে অন্যদের ঘুম ভেঙে যেতে পারে।
বিছানায় শুয়ে থেকেই পাশের ঘরের খালি বিছানাটা দেখতে পাচ্ছি। হুম, নানাভাইয়ের বিছানা। মৃত মানুষের বিছানায় নাকি অনেকদিন শুতে হয়না। তাই খালিই আছে। কেউ শোয়নি। আচ্ছা, নানাভাইয়ের একা একা ভয় লাগছে না কবরে? কাছে কেউ নেই তো! মাথার পাশে আর নানু বসে নেই। একদম নির্জন। এই গভীর রাতে একা একা থাকবে? ভাবতে ভাবতেই আমাকে যেন নিশিতে পেলো। নানাভাইয়ের কাছে যাবো আমি! এখন ই যাবো!
আমি সদর দরজা খুলে বাইরে বের হলাম। রাত ৩টার ঘুরঘুট্টি অন্ধকারে ১টা এনার্জি সেভিং বাল্বের আলো পৌঁছাচ্ছে না নতুন কবরটা পর্যন্ত।
আমি ধীর পায়ে এগিয়ে গেলাম কবরের কাছে। বাঁশের বেড়া দিয়ে দেয়া হয়েছে কবরের চারপাশে। এখন আর কেউ নেই আশেপাশে শোনার মত। কারো ঘুম ভাঙবে না আমার কথার শব্দে। ফিসফিস করে বলতে শুরু করলাম নানাভাইকে।
“নানাভাই, নানু বলেছে,আমরা কেউ দেখবো না। কিন্তু তুমি আমাদেরকে দেখবা।
নানাভাই, তুমি কি আমাকে দেখতে পাচ্ছো? বলতো আমি কে? এখন তোমার সব মনে আছে তাই না বলো?
নানাভাই, আল্লাহ্ তো তোমাকে নিয়েই গেছে! আর তো দেবে না!জানো, যদি দিতো, আমি আর কোনদিন নানুবাসায় এসে টিভি দেখতাম না, গল্পের বই পড়তাম না, কম্পিউটার নিয়ে বসে থাকতাম না! শুধু তোমার কাছে বসে থাকতাম। শুধু কথা বলতাম তোমার সাথে!
গত ১ বছর ধরে প্রতিবার নানুবাসা থেকে যাওয়ার আগে তোমার কপালে চুমু দিয়ে কি ভাবতাম জানো? আমি আবার তোমাকে দেখবো তো? শুধু এবার চলে আসার আগে ভাবিনি। আর এবার ই তুমি চলে গেলে?
আমি সবসময় ভাবতাম, তুমি চলে যাওয়ার আগে একবার হলেও কথা বলবে, সবাইকে চিনবে! কিন্তু কই! কথা না বলেই তো চলে গেলে! আমাকে একবার ও ইরানী না ডেকে!”
কান্নায় শ্বাস আটকে আসছে আমার। হাঁটু গেড়ে বসে পড়লাম কবরের পাশে। ঝাপসা চোখে বাঁশের রেলিং আঁকড়ে ধরে হু হু করে কাঁদতে লাগলাম শুধু।
আজ প্রায় তিনমাস হয়ে গেল নানাভাই নেই। সেদিন রাতের কথা আম্মুকে আর নানুকে বলেছিলাম পরে। বলে ধমক ও খেয়েছিলাম। নানু বলেছে, এত রাতে নানাভাইয়ের কবরে গিয়েছি এটা দেখে নানাভাই খুব রাগ করেছে আমার উপর! মনে মনে নাকি বলছে, পচা ইরানী!
আমি বললাম, তাহলে স্বপ্নে এসে আমাকে ধমকে যাচ্ছে না কেন নিজেই?
মৃত্যুর পরের জীবনে ভালো থাকলে মানুষ নাকি স্বপ্নে আসে না। শুধু কষ্ট হলে আসে। কত কষ্ট হচ্ছে সেটা বলতে। নানু আমাকে এটাই বলেছে।
হোস্টেলের বিছানায় ঘুমিয়ে পড়ার আগে এখনো আমি স্বার্থপরের মত ভাবি, নানাভাই আজকে আসবে তো? আমি যে চেহারাই ভুলে যাচ্ছি ধীরে ধীরে! কখনো কাঁদতে কাঁদতেই ঘুমিয়ে পড়ি। নানাভাই আসে না। ভালোই আছে বোধহয় একা একা। ভালো থাকুক.. আমার স্বপ্নে আসতেও হবে না!
আমি ভুলে যাবো না কোনদিন নানাভাইকে, জানি আমি। চোখ বন্ধ করে যতবার ভাববো নানাভাইকে, সফেদ চুলের পানখাওয়া লাল দাঁতের মানুষটি আমার দিকে তাকিয়ে হাসবে। বলবে, ইরানী, গরীব রাজার গল্প শুনবা নানাভাই?
©somewhere in net ltd.