![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমেরিকার সংবাদপত্রের অবস্থা মোটেই ভালো নয়। প্রায় সব বড় পত্রিকার প্রচারসংখ্যাই কমে আসছে। বিজ্ঞাপন থেকে আয় কমে আসছে, ফলে সাংবাদিকদের দেদার ছাঁটাই চলছে। অধিকাংশ পত্রিকাই বিদেশে তাদের স্থায়ী সাংবাদিক প্রতিনিধি এখন আর রাখতে পারছে না, নয়তো তাঁদের সংখ্যা কমিয়ে দিচ্ছে। এমনকি পত্রিকার পাতার সংখ্যাও কমে আসছে, ফলে পরিবেশিত খবরের পরিমাণ ও গুণাগুণ কমতে শুরু করেছে।
সোজা কথায়, অবস্থা মোটেই ভালো নয়। ওয়াশিংটনের পিউ রিসার্চ ইনস্টিটিউট তাদের ২০০৮ সালের ‘আমেরিকার সংবাদপত্রের অবস্থা’ শিরোনামে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে। প্রায় ২৫০টি পত্রিকার চলতি হাল নিয়ে গবেষণার পর এ প্রতিবেদনে মন খারাপের মতো অনেক খবরই আছে, কিন্তু পুরোটাই যে খারাপ তা নয়। পত্রিকার প্রচারসংখ্যা কমলেও পাঠক কিন্তু কমেনি। এর কারণ, এখন পাঠক ক্রমবর্ধমান হারে ইন্টারনেট থেকে তাদের প্রয়োজনীয় খবর সংগ্রহ করছে। যেসব সংবাদপত্র ইন্টারনেট মাধ্যমকে সফলভাবে ব্যবহার আয়ত্ত করেছে, প্রতিযোগিতায় তারাই সবচেয়ে এগিয়ে। প্রকৃতপক্ষে, ইন্টারনেটের আগমনের ফলে সংবাদপত্রের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পেয়েছে, হ্রাস পায়নি। একসময় সবাই সংবাদ ও সংবাদপত্রকে একটি ‘প্রডাক্ট’ বা পণ্য হিসেবে বিবেচনা করত। কিন্তু ইন্টারনেটের যুগে সংবাদমাধ্যমের আসল কাজ সার্ভিস বা সেবা দেওয়া; পাঠক বা ক্রেতা কী চায়, তা মাথায় রেখে তাকে সেই সেবার সঙ্গে যুক্ত করা। আগে যেমন খবর পরিবেশন করেই পত্রিকা ভাবতে পারত তার দায়িত্ব ফুরাল, কিন্তু এখন তা নয়। পাঠক তথ্যের গভীরে যেতে চায়, তথ্যকে বিভিন্ন আঙ্গিক থেকে আবিষ্ককার করতে চায়। ইন্টারনেটের ফলে এখন সেই সংযুক্তি মোটেই কঠিন কোনো ব্যাপার নয়। এই যে নতুন সম্ভাবনার দ্বার ইন্টারনেট খুলে দিয়েছে, সংবাদপত্রের জন্য আসল চ্যালেঞ্জ হলো এর সফল প্রয়োগ।
পিউ তাদের এই প্রতিবেদনে আমেরিকার সংবাদপত্রের চারটি প্রধান লক্ষণ চিহ্নিত করেছে।
১। অধিকাংশ পত্রিকাই তাদের কর্মীর সংখ্যা কমিয়েছে এবং প্রকাশিত খবরের পরিমাণ হ্রাস করেছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেসব পত্রিকা, যাদের প্রচারসংখ্যা এক লাখের ওপর।
২। প্রায় সব পত্রিকাই বিদেশি খবরের পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে, এমনকি জাতীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ এমন খবরের পরিমাণও কমে গেছে। কিন্তু স্থানীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ এমন খবরের পরিমাণ বেড়েছে।
৩। অধিকাংশ পত্রিকাই পুরোনো ও অভিজ্ঞ সাংবাদিকদের ছাঁটাই করে তরুণ, কম অভিজ্ঞ কিন্তু প্রযুক্তিগতভাবে চালাক-চতুর সংবাদকর্মীদের নিয়োগ দিচ্ছে।
৪। ইন্টারনেটের আবির্ভাবের ফলে সংবাদ পরিবেশনার সব ধ্যান-ধারণা বদলে গেছে। এই প্রযুক্তি এখন বিপুল সম্ভাবনা উন্নুক্ত করেছে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ভয়ের কথাও আছে। কোনো ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে ইন্টারনেটে তা প্রকাশের যে অব্যাহত চাপ, তা মানতে গিয়ে প্রকাশিত সংবাদের মান হ্রাস পাচ্ছে, কখনো কখনো ওই সংবাদের বস্তুনিষ্ঠতাও প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।
পিউয়ের এ প্রতিবেদনে একটা জিনিস খুবই স্পষ্ট। আমেরিকার সংবাদপত্রের জন্য অর্থনৈতিক চাপটিই মুখ্য। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন থেকে আয় কমে গেছে, কারণ অনেক বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ইন্টারনেটে বিজ্ঞাপন দিতে বেশি আগ্রহী। ইন্টারনেটের অধিকাংশ পাঠক বয়সে অপেক্ষাকৃত তরুণ। তারা অধিক শিক্ষিত এবং অর্থনৈতিকভাবে অধিক সচ্ছল। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের কাছে এই বয়সী ও এই আয়ের পাঠকই বেশি লোভনীয়। ফলে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন না দিয়ে তারা ইন্টারনেটে বিজ্ঞাপন দিতে বেশি আগ্রহী। এ অবস্থায় টিকে থাকার জন্য পত্রিকাগুলোকে একদিকে নিউজরুমে সম্পাদক ও সংবাদপত্রকর্মীর সংখ্যা কমাতে হচ্ছে, অন্যদিকে তাদের ইন্টারনেট সংস্করণের জন্য কারিগরি-কর্মীর সংখ্যা বাড়াতে হচ্ছে।
ইন্টারনেটের যুগে সংবাদপত্রকে টিকে থাকতে হলে তাদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো যত দ্রুত সম্ভব খবর ওয়েবে পৌঁছে দেওয়া। পত্রিকাগুলোকে এখন শুধু একে অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হয় না। তাদের সঙ্গে সমানে পাল্লা দিচ্ছে সিএনএন, সিএনবিসির মতো চব্বিশ ঘণ্টার নিউজ চ্যানেলগুলো। তার ওপর আছে ওয়েব ব্লগ। এখন যে কেউ একটা ল্যাপটপ বগলদাবা করে ইন্টারনেটে ব্লগ চালাতে পারে। অধিকাংশই একদম খবরের উৎসের কাছাকাছি অবস্থান করে, ফলে ‘প্রত্যক্ষদর্শী’র মতো তাৎক্ষণিকভাবে এরা খবর ও মতামত পৌঁছে দিতে পারে। এ কারণেই এসব ব্লগারের নাম দেওয়া হয়েছে ‘সিটিজেন জার্নালিস্ট’। খুব নির্ভরযোগ্য না হলেও অনেক ব্লগই এখন ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। (নিজের উদাহরণ দিয়ে বলতে পারি, আগে প্রতিদিন নিউইয়র্ক টাইমস পড়ে আমার দিন শুরু হতো। এখন ‘টকিংপয়েন্টস মেমো ডটকম’ নামের একটি ব্লগ না পড়া পর্যন্ত আমার স্বস্তি নেই।) এসব ব্লগের রাজনৈতিক গুরুত্বও এখন আর অস্বীকার করার জো নেই। যে ব্লগ যত বেশি পাঠক জোগাতে পারছে, বিজ্ঞাপনদাতারাও তাদের কাছে তত ভিড় জমাচ্ছে। বলা বাহুল্য, এই ‘একাই এক শ’ সংবাদপত্রের সঙ্গে পাঁচতলা বাড়ি নিয়ে দুই হাজার কর্মীর সংবাদপত্রের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা খুব সহজ নয়।
ফলে, ‘সিটিজেন জার্নালিস্ট’দের প্রতিযোগিতার চাপেই হোক আর নিজের ব্যবসায়িক চাপ ও পেশাদারি স্বার্থের কারণেই হোক, সংবাদপত্রকে তার পুরোনো ধ্যান-ধারণা বদলাতে হচ্ছে। তাকে অনেক বেশি ‘স্পেশালাইজড’ হতে হচ্ছে, অনেক বেশি ‘স্নার্ট’ হতে হচ্ছে। ইন্টারনেট থেকে এক বড় ফায়দা হলো, পাঠক কী চায় তা নির্ণয় করা এখন অনেক সহজ। পত্রিকার কোন খবর কতবার পড়া হচ্ছে, তার হিসাব রাখা এখন আর মোটেই কোনো কঠিন ব্যাপার নয়। ফলে একদিকে পত্রিকার ব্যবস্থাপকেরা যেমন পাঠক কী চায় তা বুঝে তেমন খবর পরিবেশন করতে পারেন, তেমনি বিজ্ঞাপনদাতারাও কোন পত্রিকায় তাদের ‘প্রডাক্ট’-এর প্রতি আগ্রহী এমন পাঠক/ক্রেতা বেশি, সে কথা আগেভাগেই ঠিক করে নিতে সক্ষম। প্রথাগত সংবাদপত্রের পাঠকেরা অবশ্য এতে কিঞ্চিৎ ভীত হতে পারে। খবরের গুণাগুণ নয়, ব্যবসায়িক সাফল্যই যখন কোন খবর কী পরিমাণ ছাপা হবে তা নির্ধারণ করে, তখন উদ্বিগ্ন হতে হয় বৈকি। তবে ইন্টারনেটে মজা হচ্ছে এর প্রায় সবটাই বিনা পয়সায় এবং পছন্দমতো খবর বাছাইয়ের সুযোগ প্রায় অফুরন্ত।
ইন্টারনেট আরও একভাবে খবরের কাগজকে প্রভাবিত করা শুরু করেছে। সেখানে খবর লেখা ও পরিবেশন করা হয় ভিন্নভাবে। ইন্টারনেটের পাঠকের ধৈর্য কম, সে চায় কম কথায় মোদ্দা খবরটা জেনে নিতে। এর ফলে কম কথায় কার্যকর সংবাদ পরিবেশনা সংবাদপত্রকর্মীদের জন্য একটি নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে।
প্রযুক্তিকে যারা ভয় পায়, ইন্টারনেটের এই আগ্রাসন তাদের জন্য অবশ্যই উদ্বেগের কারণ, কিন্তু যারা ইন্টারনেট প্রযুক্তিকে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে ব্যবহার করতে শিখেছে, তারা একই সঙ্গে কাগজের পত্রিকা ও কাগজবিহীন পত্রিকাকে একে অন্যের পরিপূরক হিসেবে ব্যবহার করে এর ফায়দা তুলে নিচ্ছে। সবচেয়ে এগিয়েছে সেসব পত্রিকা, যারা মুদ্রিত কাগজের পাশাপাশি ইন্টারনেটে ‘মাল্টিমিডিয়া’ সংযোজন করতে শিখেছে। আজকের পাঠক কেবল খবর পড়েই সন্তুষ্ট নয়, তারা যাদের নিয়ে খবর, তাদের ছবি দেখতে চায়, তাদের কথাও শুনতে চায়। এ জন্য অনেকেই এখন খবরের পাশাপাশি অডিও-ভিডিও জুড়ে দিচ্ছে। অনেক পত্রিকা, যেমন মায়ামি হেরাল্ড ট্রিবিউন, এখন তাদের সংবাদপত্রকর্মীদের শুধু টেপরেকর্ড নয়, ভিডিও ক্যামেরাও সরবরাহ করছে। নিউজ বিটে যাঁরা আছেন, তাঁরা প্রায় সবাই ভিডিওতে তাঁদের খবর ধারণ করছেন এবং চোখের পলক পড়তে না-পড়তেই তা ‘এডিট’ করে পত্রিকার পাতায় ‘পোস্ট’ করে দিচ্ছেন। আবার ইন্টারনেটের ফলে এখন অধিকাংশ পত্রিকাই ‘ইন্টার্যাক্টিভ’ হয়ে উঠেছে। আগে পাঠক চিঠি লিখে তার মতামত জানাত। এখন খবর ছাপা হতে না-হতেই ইমেইল করে পাঠক তার প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে। অনেক পত্রিকা প্রকাশিত সংবাদের পাশাপাশি সংবাদদাতার নিজস্ব ‘ব্লগ’-এর জন্যও জায়গা ছেড়ে দেয়। এসব ব্লগে একজন সাংবাদিক ‘সংবাদের পেছনে যে খবর’ তা তুলে ধরেন এবং কখনো কখনো নিজেদের ব্যক্তিগত অভিমতও জানিয়ে থাকেন। যারা খবরের গভীরে যেতে চায়, তাদের এসব ব্লগ খুব পছন্দ। মন্তব্য করার সুযোগ থাকায় এই ব্লকের মাধ্যমে পাঠক সংবাদদাতার সঙ্গে সরাসরি সংলাপে অবতীর্ণ হওয়ার সুযোগও পেয়ে যায়।
আজকের সংবাদপত্রের জন্য এই চ্যালেঞ্জ শুধু আমেরিকা বা পশ্চিমের ব্যাপার নয়। বাংলাদেশেও সংবাদপত্রকে কমবেশি এ চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। আমাদের দেশেও নতুন তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে। এই প্রযুক্তি যে সম্ভাবনার দ্বার উন্নুক্ত করেছে, তার সুযোগ গ্রহণ করতে যারা ব্যর্থ হবে, এখন থেকে ১০ বা ১৫ বছর পর তারা বহালতবিয়তে টিকে থাকবে, তা ভাবা খুব বুদ্ধিমানের কাজ হবে বলে মনে হয় না। (লিখেছেন : হাসান ফেরদৌস, নিউইয়র্ক)
©somewhere in net ltd.