![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
চার মাস কেটে গেছে, কিন্তু সময় যেন থমকে আছে। বাঙ্কারের স্যাঁতসেঁতে বাতাস, কনক্রিটের দেয়ালে জমে থাকা ছাঁচ, আর বাইরে টহলদার সেনাদের ভারী বুটের শব্দ যেন প্রতিটি মুহূর্তে মনে করিয়ে দেয়—সবকিছু বদলে গেছে।
আবির তার মায়ের গায়ে ঘেঁষে বসে আছে। ছোট্ট শরীরটা কাঁপছে, হয়তো ঠান্ডায়, হয়তো ভয়ে। সে ফিসফিস করে বলল, “মা, সেদিন আসলে কী হয়েছিল?”
নুসরাত চুপ করে থাকে। কিছু সময় লাগে কথা খুঁজে পেতে। স্মৃতিগুলো যেন জমাট বাঁধা ধোঁয়া, ছুঁতে গেলেই ফসকে যায়। কিন্তু সে জানে, এই গল্প বলা দরকার। আবিরকে জানতে হবে কেন তারা এখানে, কেন তার বাবা ফিরে আসেনি।
“সেদিন সকালটা খুব সাধারণ ছিল, আবির,” নুসরাত ধীরে ধীরে বলে। “তোর জন্মদিন ছিল… মনে আছে? বাবার সাথে মিলে তোদের জন্য কেক বানিয়েছিলাম। তুই খালি ফ্রস্টিং চাটছিলি।”
আবিরের চোখে অল্প হাসির ছায়া খেলে গেলেও মুহূর্তেই তা মিলিয়ে যায়। নুসরাত বলে যেতে থাকে, যেন এই গল্পটা তার নিজের কাছেও খুব জরুরি।
সেদিন সকালটা সত্যিই স্বাভাবিক ছিল। দোকানে গিয়ে কেকের জন্য চিনি আর ডিম কিনছিল সে, পাশের চায়ের দোকান থেকে ভেসে আসছিল চায়ের সাথে মিশে থাকা আড্ডার শব্দ। রিকশাওয়ালা গলা ছেড়ে গান গাইছিল, কেউ একজন রাস্তার মোড়ে বাদাম বিক্রি করছিল।
তারপর হঠাৎ করেই শহর থমকে গেল। বিশাল বিলবোর্ডের স্ক্রিন ফেটে গিয়ে লাল আলো ছড়িয়ে পড়ল, মোবাইল ফোনে ভেসে উঠল একটা জরুরি বার্তা—‘সামরিক বাহিনী দেশের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে।’
চারপাশে গুঞ্জন শুরু হলো। কেউ বলল, রাষ্ট্রপতি খুন হয়েছেন, কেউ বলল তাকে বন্দি করা হয়েছে। মুহূর্তের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। রাস্তায় মানুষ দৌড়াতে শুরু করল, দোকানপাট একে একে বন্ধ হয়ে গেল।
তাদের বাসায় ফেরার পথেই আকাশে দেখা গেল অগণিত ড্রোন, একসাথে ওড়া কাকের ঝাঁকের মতো। এসব ড্রোন সাধারণ নজরদারির জন্য ছিল না, এগুলো ছিল যুদ্ধের জন্য। প্রতিটির গায়ে কামানবন্দ বন্দুক, স্বয়ংক্রিয় শত্রু শনাক্তকরণ ব্যবস্থা।
এরপর আসল রোবট সৈন্য। মসৃণ ধাতব শরীর, লাল চোখের গহ্বর, নিঃশব্দ অথচ ভয়ঙ্করভাবে কার্যকর। তারা রাস্তার মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে ছিল, মানুষের প্রতিটি গতিবিধি স্ক্যান করছিল।
“মা, ওরা কি মানুষ?” আবির একদিন জিজ্ঞেস করেছিল। নুসরাত তখন কিছু বলতে পারেনি। এখনো পারে না।
বিকেলের দিকে গুঞ্জন শোনা গেল—সেনাবাহিনীর ভেতরেই ভাঙন ধরেছে। একটি অংশ অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে। নাম শোনা গেল, ‘রিয়াদ আরিফ’। বলা হলো, তিনি সেনাবাহিনীর একাংশ নিয়ে লড়াইয়ে নেমেছেন।
তারপর শুরু হলো যুদ্ধ।
গাবতলীর দিকে বিকেলে প্রথম বিস্ফোরণটা হলো। জানালার কাঁচ কেঁপে উঠল, মানুষ চিৎকার করতে করতে ছুটতে লাগল। মুহূর্তেই আকাশ ধোঁয়ায় ঢেকে গেল। হেলিকপ্টার চক্কর দিচ্ছিল, মাটিতে নামছিল কামানের গোলা। কিন্তু সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ছিল স্বয়ংক্রিয় যুদ্ধযন্ত্রগুলোর আগ্রাসন।
ধোঁয়ার মধ্যে দিয়ে নুসরাত দেখল, এক রোবট সৈন্য ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। তার হাতে ধরা অস্ত্র থেকে এক ঝলক আলো বেরিয়ে এলো, সামনে থাকা এক ছেলেকে এক মুহূর্তে মাটিতে ফেলে দিল। রাস্তার মাঝখানে পড়ে থাকা লাশগুলোর দিকে তাকানোর মতো সাহস তার ছিল না।
তার স্বামী দ্রুত ব্যাগ গুছিয়ে নিল। বলল, ‘আর দেরি করা যাবে না, এখনই বের হতে হবে।’
নুসরাত আবিরকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। তখনো তার গায়ে ছিল জন্মদিনের নতুন জামার স্পর্শ, মুখে লেগে থাকা কেকের গন্ধ।
আজ, এই বাঙ্কারে, চার মাস পরেও সেই গন্ধ নুসরাতের মনে পড়ে। আবির এখন ঘুমিয়ে পড়েছে, কিন্তু তার চুলে এখনো ধোঁয়ার গন্ধ লেগে আছে, মাটির গন্ধ, ভয়ের গন্ধ।
১৪ ই এপ্রিল, ২০২৫ সকাল ১১:৪৩
নকল কাক বলেছেন: ধন্যবাদ
©somewhere in net ltd.
১|
১৪ ই এপ্রিল, ২০২৫ সকাল ১১:০৫
মনিরুল ইসলাম বাবু বলেছেন: সুন্দর।