![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সবার মনেই তখন অন্যরকম এক ভয়। কি যে হয়? কারো মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছেনা। আজমল স্যার বলেছেন এবার নাকি ৫৪ জনের ২৬ জনই ফেল করেছে। সবাই সৃষ্টিকর্তাকে মনে মনে ডাকছে যাতে এই ২৬ জনের মধ্যে তারা না থাকে। শুধু শিউলিকে অন্যরকম মনে হল। তার মধ্যে বিষণ্ণতার চেয়ে উচ্ছ্বাসই বেশি। চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে তার, কিছু প্রাপ্তির প্রত্যাশায়। যথারীতি হেডস্যার ফলাফল প্রকাশের জন্য সামনে এসে দাঁড়ালেন । শিউলি যেমনটা ভেবেছিল ঠিক তেমনটাই হয়েছে। অষ্টম শ্রেণির মেধাতালিকায় সে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে। আজ আর ক্লাস হবেনা, ঘোষণা দিয়ে হেডস্যার সবাইকে লাইন ধরে ক্লাসে যেতে বললেন। ক্লাস থেকে বই গুলো নিয়েই শিউলি বাড়ির দিকে দ্রুত হাঁটতে লাগলো। মাকে রেজাল্ট না শুনানো পর্যন্ত শিউলির যেন স্বস্তি নেই। মা নিশ্চয় খুশি হবে আমার রেজাল্ট শুনে, ভাবতেই শিহরিত হচ্ছে শিউলির মন। বাড়ির কাছাকাছি আসতেই শিউলি ওর মায়ের আর্তচিৎকার শুনতে পেল। সহসা সে বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করে দেখতে পেল, তার মা তার আড়াই বছরের ছোট ভাইটিকে বুকে জড়িয়ে অঝোরে কাঁদছে। উঠোনের একদিকে ময়লা-আবর্জনা ফেলবার স্থান। পাশেই রান্নাঘর। রান্নাঘরের দরজা ঘেঁষে যে মাটির দেয়ালটি আছে সেখানেই হেলান দিয়ে শিউলির মা চোখের জলে বুক ভাসিয়ে দিচ্ছে। হাঁপাতে হাঁপাতে শিউলি বলল-
-কি অইছে মা?
-কি আর হবো। এইড়া নতুন কিছু না। হাতমুখ ধুইয়া ভাত খা। নিমিষেই গলাটা স্বাভাবিক করে ফেলে শিউলির মা।
-বাজান তোমারে কি কইছে আগে কও আমারে।
-ঐ আজেবাজে কতা তোর হুনা লাগবেনা।
-তুমি কবা কিনা কও, নইলে আমি ভাত খামুনা। শিউলির সাফ উত্তর।
-তোর বাজান নাকি মোল্লাসাবরে কতা দিছে।
-কি কতা দিছে মা?
-মোল্লাসাবের বড় পোলা ঢাকা থাহেনা? ওগো বাসায় নাকি একটা কামের মাইয়া লাগবো। তোর বাজান নাকি কতা দিছে তোরে ঢাকায় পাঠাইবো ওগো বাসায় কাম করাইতে। আমি না করছি বইলা আমার উপর তেড়ে আইসলো, আমারে ইচ্ছামত মারলো। কথাগুলো একনাগাড়ে বলে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললো শিউলির মা। তারপর বললো
-তুই ঐ সব নিয়া চিন্তা করিস না। তোরে আমি ঢাকায় কিছুতেই যাইতে দিমুনা। তুই পড়াশুনা করবি, মানুষের মত মানুষ হবি। আমাগো দুঃখ-কষ্ট সব দূর করবি। তোরে নিয়া আমার মেলা স্বপ্ন। তোর বাজান একটা মাতাল, পাগলা মানুষ। তার কতায় তুই কিছু মনে করিস না মা।
শিউলি ওর মায়ের কথাগুলো একজন বিজ্ঞ লোকের মত শুনলো। শিউলির চোখ ছলছল করছে। যেকোনো সময় কেঁদে ফেলতে পারে সে। মায়ের জন্য তার খুব কষ্ট হয়। মাকে সে করুন কণ্ঠে প্রশ্ন করে-
-আমি না হয় কিচ্ছু মনে করলাম না। কিন্তু তুমি কয়দিন এইভাবে বাজানের অত্যাচার সহ্য করবা?
-মারে, মাইয়া মানুষ হইয়া জন্মাইছি, আমাগো মেলা কিছু সহ্য করা লাগবো। তাছাড়া যে উপায় নাই। ঐ সব রাখতো , হাতমুখ ধুইয়া আয় ,ভাত খাবি।
-আমার খাইতে ইচ্ছা করতাছেনা –বলেই শিউলি বাড়ির বাইরের দিকে ছুটে গেল। মা পেছন থেকে অনেক ডাকলো, কিন্তু শিউলি মায়ের কথায় সাড়া দিলোনা।
শিউলির বাবা একজন ট্রাক হেল্পার। কোনদিন বাড়ি ফেরে, আবার কোনদিন ট্রাকেই রাত কাটিয়ে দেয়। প্রায়ই মাতাল হয়ে বাড়ি ফিরে অকথ্য ভাষায় বকাবকি করে শিউলির মাকে, শিউলিকে। কাউকেই তার ভাল লাগেনা। এমনকি আড়াই বছরের ছেলেটাকেও সে কোনদিন আদর করে ‘বাবা’ ডাকেনি। তার কাছে স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে সবাই বোঝা। সবাই বসে বসে খাচ্ছে আর সে দিনরাত একাই খেটে মরছে, এমন অভিযোগ তার উঠতে-বসতে।
শিউলির মায়ের অনেক ধৈর্য্য। শত অত্যাচার সহ্য করেও সে দিনাতিপাত করতে চায় স্বাভাবিক একজন পল্লীবধূর মত। শিউলি এবং তার ছোট ভাই সজীবের জন্য সে পৃথিবীর সব সুখ বিসর্জন দিতে পারে।
শিউলি ওর রেজাল্টের কথা ভুলেই গিয়েছিল। রাতে খাবার সময় শিউলির মা হঠাৎ শিউলিকে প্রশ্ন করলো
-কিরে, তোর না আইজকা পরীক্ষার রেজাল্ট দেওনের কতা? দিছে?
-হ, দিছে।
-তোর খবর কি? শিউলির মায়ের চোখ জ্বলজ্বল করে উঠে ভাল কিছু শুনার প্রত্যাশায়।
-আমি সেকেন্ড হইছি।
শিউলির মা নিমিষেই জীবনের সব দুঃখ ভুলে যায়। শিউলিকে বুকে জড়িয়ে আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বলে-
তুই আমার স্বপ্ন পূরণ করবি মা?
শিউলি ঘুমিয়ে পড়েছিল, কিন্তু তার বাবার চিৎকার-চেচামেচিতে তার ঘুম ভেঙ্গে গেল। রাত তখন গভীর। শিউলির বাবা মাতাল হয়ে ফিরেছে। শিউলির মাকে এবং শিউলিকে অকথ্য ভাষায় গালি-গালাজ করছে সে। শিউলির ছোট ভাই সজীব হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে উঠে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবেশ দেখে কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে। শিউলির কাছে মনে হল এ যেন এক জাহান্নামপুরী। শিউলির বাবার কণ্ঠ দিয়ে যেন আগুন ঝরছে।
-তোরা আর কত জ্বালাবি আমারে? মাইনষের মাইয়ারা ঢাকায় গিয়া গারমেন্সে কাম কইরা বাপ-মাইরে কত টাহা কামাই কইরা দিতাছে। আর আমার মাইয়া? টাহা কামাই তো দূরের কতা, আমারে কি কইরা ফকির বানাইবো, এই চিন্তাই রাইত দিন করে। আমি মোল্লাসাবরে কতা দিছি এক হপ্তার মইধ্যে শিউলিরে ঢাকায় পাঠাইমো ওনার পোলার বাসায় কাম করাইতে। এর যেন হেরফের না অয়। অইলে তো’গ কপালে বহুত খারাবি আছে। শিউলি পাশের রুম থেকে সবই শুনতে পায়। নিজেকে তার খুব অপরাধী মনে হয়। সেই রাতে শিউলির আর ঘুম হয়না।
শিউলির বাবা দুইদিন ধরে বাড়িতে আসেনা। যদিও বাড়িতে এই দুইদিন কোন ঝগড়া-ঝাটি হয়নি, তবুও শিউলির মায়ের মনটা অনেক খারাপ। মানুষটা কোথায় গেল, কি খেলো,না খেলো, কে জানে। শিউলির মায়ের চিন্তা ক্রমশ ভয়ে পরিণত হতে লাগলো, যখন শিউলির বাবা চারদিন পরেও বাড়িতে ফিরলোনা। এমনতো কখনও হয়নি। একদিন বাড়িতে না ফিরলে পরের দিন ঠিকই শিউলির বাবা বাড়িতে ফিরতো। কি হয়েছে তার? চিন্তায় এবং ভয়ে শিউলির মা নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দিল।
পরের দিন সকাল বেলায় শিউলির মায়ের ঘুম ভাঙল মোল্লাসাহেবের ডাকা-ডাকি শুনে। শিউলির মা একহাতে চোখ কচলাতে কচলাতে অন্য হাতে ঘোমটা করে মোল্লাসাহেবের সামনে এসে দাঁড়ালো। মোল্লাসাহেব বললেন-
-তোমা’গ রহিমের(শিউলির বাবা) খবর কি কিছু জানো?
-না, হেয় তো পাঁচদিন ধইরা বাড়িত আহেনা।
-বাঁইচা থাকলে তো আইবো।
-মাইনে, শিউলির মায়ের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। নির্বাক হয়ে মাটিতে বসে পড়ে সে।
-হুনলাম, গত পরশু রাইতে আনারসের ট্রিপ ভইরা রহিম আর মজু ড্রাইভার ঢাকায় যাইবার লাগছিল। পথিমধ্যে মজু ক্লান্ত হইয়া রহিমকে ড্রাইভারির দায়িত্ব দেয়। রহিম নাকি ঐ দিন আবার বেশি খাইছিলো। তারপরে তো কেল্লা- ফতে। ট্রাক যাইয়া পড়লো পাশের একটা নদীতে। নদীতে অনেক স্রোত আছিলো। মজু ড্রাইভারের লাশ পাওয়া গেছে, আর রহিমেরটা খুঁইজাই পাওয়া যায় নাই। নদীর স্রোতে কোথায় যে চইলা গেছে আল্লাহ্ই জানে।
নিমিষেই কান্নার রোল পড়ে যায় , প্রতিবেশীরা ক্রমশ ভীড় করতে থাকে শিউলিদের বাড়িতে।
তিন দিন পরের কথা ...........
শিউলি স্কুলে যাবে এমন সময় শিউলিদের বাড়ির সামনে একটা জীপ গাড়ী এসে থামে। জীপ গাড়ী থেকে নেমে আসে মোল্লাসাহেবের বড় ছেলে জুয়েল। একটু পরে সেখানে মোল্লাসাহেবও আসে, সংগে আরও কয়েকজন এলাকাবাসী। শিউলির মা সজীবকে কোলে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। অসহায়ভাবে সে জুয়েলকে জিজ্ঞেস করে-
-কি অইছে বাবা?
-আমি শিউলিকে নিতে এসেছি। চাচা প্রায়ই ঢাকায় আমার বাসায় যেত। আমি একটা কাজের মেয়ে খুঁজছিলাম। চাচা শুনে বলল শিউলিকে আমাদের বাসায় কাজ করাতে পাঠাবে এবং এর জন্য চাচা আমার কাছ থেকে শিউলির বেতনের এডভান্স দাবি করে। আমিও দিয়ে দেই। আমি চাচাকে এভাবে অনেক টাকা দিয়েছি। কিন্তু চাচা শিউলিকে বিগত দুই-তিন মাস ধরে আমার বাসায় রেখে আসার কথা বললেও রেখে আসেনি। তাই আমি নিজেই শিউলিকে নিতে এসেছি। ভদ্রভাবে কথাগুলো বলে জুয়েল।
-না, আমি শিউলিকে কিছুতেই ঢাকা নিয়া যাইতে দিমুনা, চিৎকার করে উঠে শিউলির মা।
-তাইলে ওর এতদিনের সব টাহা ফেরত দাও, মোল্লাসাহেব এলাকাবাসীদের সমর্থনের জন্য দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এলাকাবাসীরাও সাঁয় দেয়।
-কিন্তু আমি এত টাহা কই পামু, আমারে একটু দয়া করেন, ওরে আমি পড়াশুনা করামু, মানুষের মত মানুষ বানামু, আমার উপর আপনারা এত নির্দয় হইয়েন না। কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে শিউলির মা।
শিউলি এতক্ষন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখছিলো। মায়ের অপমান তার আর সহ্য হলনা। তার জন্য তার মা অনেক অত্যাচার সহ্য করেছে, আর না। জুয়েলের দিকে তাকিয়ে সে বলল- ভাইজান আপনে একটু দেরি করেন, আমি কিছুক্ষনের মধ্যে রেডি হইয়া আসতেছি। কিছুক্ষন পরে শিউলি তার স্কুল ব্যাগটায় কিছু জামা-কাপড় ভরে বাড়ির বাইরে এসে দাঁড়ালো। শিউলির মা শিউলিকে অনেক ফেরানোর চেষ্টা করলো। শিউলি শুধু একটা কথাই বললো- আমারে যাইতে দাও মা, আমার নিয়তি আমারে নিতে আইছে। শিউলি নিজেও জানেনা তার এ অভিমান কার উপর। শিউলি গিয়ে জীপে উঠলো। জুয়েল জীপ স্টার্ট করে নিমিষেই উধাও হয়ে গেলো চোখের সামনে থেকে। শিউলির মা নিষ্পলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে শিউলি চলে যাওয়া পথের দিকে...
২| ০২ রা জুলাই, ২০১৩ রাত ২:৪২
রিদম হাসান বলেছেন: আপনার ভাল লাগা আমার সৌভাগ্য
৩| ০২ রা জুলাই, ২০১৩ রাত ৩:১০
মাক্স বলেছেন: শিউলীর শোকগাথা চমত্কারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন!
৪| ০৩ রা জুলাই, ২০১৩ রাত ১২:৫০
রিদম হাসান বলেছেন: ধন্যবাদ আপনার উৎসাহের জন্য। @মাক্স
©somewhere in net ltd.
১|
১২ ই মার্চ, ২০১৩ রাত ১:১৮
মৌমিতা আহমেদ মৌ বলেছেন: ভালোলাগা +++++