নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

নূর মোহাম্মদ নূরু (পেশাঃ সংবাদ কর্মী), জন্ম ২৯ সেপ্টেম্বর প্রাচ্যের ভেনিস খ্যাত বরিশালের উজিরপুর উপজেলাধীন সাপলা ফুলের স্বর্গ সাতলা গ্রামে

নূর মোহাম্মদ নূরু

দেখি শুনি স্মৃতিতে জমা রাখি আগামী প্রজন্মের জন্য, বিশ্বাস রাখি শুকনো ডালের ঘর্ষণে আগুন জ্বলবেই। ভবিষ্যৎকে জানার জন্য আমাদের অতীত জানা উচিতঃ জন ল্যাক হনঃ ইতিহাস আজীবন কথা বলে। ইতিহাস মানুষকে ভাবায়, তাড়িত করে। প্রতিদিনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা কালক্রমে রূপ নেয় ইতিহাসে। সেসব ঘটনাই ইতিহাসে স্থান পায়, যা কিছু ভাল, যা কিছু প্রথম, যা কিছু মানবসভ্যতার অভিশাপ-আশীর্বাদ। তাই ইতিহাসের দিনপঞ্জি মানুষের কাছে সবসময় গুরুত্ব বহন করে। এই গুরুত্বের কথা মাথায় রেখে সামুর পাঠকদের জন্য আমার নিয়মিত আয়োজন ‘ইতিহাসের এই দিনে’। জন্ম-মৃত্যু, বিশেষ দিন, সাথে বিশ্ব সেরা গুণীজন, এ্ই নিয়ে আমার ক্ষুদ্র আয়োজন

নূর মোহাম্মদ নূরু › বিস্তারিত পোস্টঃ

বাংলাদেশে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের জনক, শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের ৮৮তম জন্মবার্ষিকীতে ফুলেল শুভেচ্ছা

০১ লা মার্চ, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:০১


এ দেশের সংবাদপত্র জগতের অন্যতম পুরোধা, মুক্তিযুদ্ধের নির্ভিক সৈনিক শহীদ বুদ্ধিজীবী সিরাজুদ্দীন হোসেন।পাকিস্তান আমলে যে কয়জন সাংবাদিকের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে সাংবাদিকরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন এবং বাঙালী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন, সিরাজুদ্দীন হোসেন ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। ১৯৫২ সালে দৈনিক আজাদের বার্তা সম্পাদক থাকা অবস্থায় মহান ভাষা আন্দোলনের সপক্ষে তার সাংবাদিকতা বাংলাদেশের সাংবাদিকতা জগতে তার অসাধারণ কীর্তি বলে পরিগণিত। সিরাজুদ্দীন হেসেন ছিলেন দৈনিক ইত্তেফাকের কার্যনির্বাহী ও বার্তা সম্পাদক। ব্রিটিশ আমলের শেষভাগ থেকে শুরু করে তার সাংবাদিকতা জীবন স্বাধীনতা যুদ্ধ পর্যন্ত ব্যপ্ত। এই পুরো সময়কালে দেশের সকল আন্দোলনের সঙ্গে তার ছিল সরাসরি যোগাযোগ। তিনি তার ক্ষুরধার লেখনির মাধ্যমে এ দেশের বঞ্চিত মানুষের কথা অসাধারণ দক্ষতায় সংবাদপত্রের পাতায় ফুটিয়ে তুলেছেন। শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেনের অসাধারণ শিরোনাম বাঙালি জাতির রক্তে আগুন ধরিয়ে দিত। চিনিল কেমনে, সুকুইজ্জা কডে, জয় বাংলার জয়, অবশেষে বাংলার ভাগ্যাকাশ হইতে বাস্তিলের কারাগার ধসিয়া পড়িয়াছে, জনতার জয় হইয়াছে, বিক্ষুব্ধ নগরীর ভয়াল গর্জন এবং দুই পাকিস্তানের ভারসাম্যহীনতাকে সংখ্যা দিয়ে প্রকাশ করে যে শিরোনাম করেছেন, তা পাঠককে বিষয়ের গভীরে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের জনক সিরাজুদ্দীন হোসেনের আজ ৮৮তম জন্মবার্ষিকী। ১৯২৯ সালের আজকের দিনে তিনি তৎকালীন যশোর জেলার মাগুরায় জন্ম গ্রহণ করেন। শহীদ বুদ্ধিজীবী সিরাজুদ্দীনের জন্মদিনে ফুলেল শুভেচ্ছা।

সিরাজুদ্দীন হোসেন ১৯২৯ সালের ১লা মার্চ তৎকালীন মাগুরা মহকুমার (বর্তমানে মাগুরা জেলা) শালিখা থানার অন্তর্গত শরুশুনা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা পিতা মৌলভী মোজাহারুল হক। মাত্র সাড়ে ৩ বছর বয়সে তাঁর বাবা মারা যান। এ সময় তাঁর চাচা মৌলবী মোহাম্মদ ইসহাক পিতৃহারা ভাইপো-ভাইজিদের দেখাশুনার দায়িত্ব নেন। তাঁর পড়াশুনার হাতেখড়ি চাচার কাছে। সিরাজুদ্দীন হোসেন ঝিকরগাছা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন। এরপর যশোর মাইকেল মধুসূদন দত্ত কলেজ থেকে আই.এ. পাশ করেন। আই.এ. পাশ করার পর তিনি কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে বি.এ. পড়া শুরু করেন। এই কলেজে পড়ার সময়ই তাঁর শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুদ্দীন মোল্লা, আসফউদদৌলা রেজা, খন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস, কাজী গোলাম মাহবুব প্রমুখের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়। কলেজ জীবনে বই কেনার মতো আর্থিক স্বচ্ছলতা তাঁর ছিল না। অন্যের বই আর শিক্ষকদের লেকচারের উপর ভিত্তি করে নোট তৈরি করেই তিনি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতেন। পিতৃহীন সিরাজুদ্দীন হোসেন বেঁচে থাকার তাড়নায়ই এ সময় সংবাদপত্রে কাজ নিতে বাধ্য হন। ১৯৪৭ সালে ছাত্রাবস্থায় তিনি দৈনিক আজাদ-এ সাংবাদিকতা শুরু করেন। কালক্রমে তিনি আজাদ-এর বার্তা সম্পাদক হন। সমসাময়িককালে এত অল্প বয়সে বার্তা-সম্পাদকের পদে কাজ করার সৌভাগ্য আর কারো হয়নি। ১৯৫৪ সালে আজাদ-এর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার পর তিনি ঢাকার ইউএসআইএস অফিসে জুনিয়র এডিটর হিসবে কিছুদিন কাজ করেন। এক বছর পর ১৯৫৫ সালে তিনি ইত্তেফাক-এর বার্তা সম্পাদক পদে নিযুক্ত হন। মানিক মিয়ার অসাধারণ দূরদৃষ্টি আর সিরাজুদ্দীন হোসেনের টিমওয়ার্ক ‘ইত্তেফাক’কে অল্পদিনের মধ্যেই একটি প্রথম শ্রেণীর সংবাদপত্রে পরিণত করে।

ব্রিটিশ আমলের শেষভাগ থেকে শুরু করে তার সাংবাদিকতা জীবন স্বাধীনতা যুদ্ধ পর্যন্ত ব্যপ্ত। এই পুরো সময়কালে দেশের সকল আন্দোলনের সঙ্গে তার ছিল সরাসরি যোগাযোগ। তিনি তার ক্ষুরধার লেখনির মাধ্যমে এ দেশের বঞ্চিত মানুষের কথা অসাধারণ দক্ষতায় সংবাদপত্রের পাতায় ফুটিয়ে তুলেছেন। ষাট দশকের সব আন্দোলন, মি. জিন্নাহর নির্বাচন, পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ছয় দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত নির্যাতিত-নিপীড়িত বাঙালিদের অব্যক্ত কথা ইত্তেফাকের পাতায় মূর্ত করে তুলেছিলেন তিনি এমনই দরদ-মমত্ব আর পারঙ্গমতার সঙ্গে, যা এ দেশের সাংবাদিকতার ইতিহাসের এক অনন্য সাধারণ অধ্যায়রূপে চিহ্নিত হয়ে রয়েছে। ১৯৭১ সালে অবরুদ্ধ এই দেশে তিনি সাহসিকতার সঙ্গে সাংবাদিকতা করে গেছেন। সে সময় তার লেখা ঠগ বাছিতে গাঁ উজাড়, অধূনা রাজনীতির কয়েকটি অধ্যায় ধরনের উপ-সম্পাদকীয় এবং এতদিনে শিরোনামে সম্পাদকীয় মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে তার দৃঢ় অবস্থানের সাক্ষ্য দেয়। তিনি প্রবাসী সরকারের কাছে পূর্ব পাকিস্তানের আমেরিকান কনস্যুলেটের গোপন রিপোর্টটি পাঠিয়েছিলেন, যা পরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বার বার প্রচারিত হওয়ার পর বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্ব জনমত গড়ে উঠতে সাহায্য করে। মৃত্যুর পূর্বপর্যন্ত তিনি ইত্তেফাক-এই কর্মরত ছিলেন।

ব্যক্তিগত জীবনে আট পুত্র সন্তানের জনক ছিলেন শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেন ছিলেন বিনয়ী, সদালাপী, পরোপকারী এবং সজ্জন ব্যক্তিত্ব। তাঁর স্ত্রীর নাম নূরজাহান সিরাজী। সাংবাদিকতার পাশাপাশি তিনি বেশ কিছু গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য মৌলিক গ্রন্থ হলঃ A Look into the mirror, ইতিহাস কথা কও, ছোট থেকে বড়, মহিয়সী নারী ইত্যাদি। তিনি বেশ কিছু বিদেশী গ্রন্থ অনুবাদ করেছেন। তার অনুদিত পুস্তকের সংখ্যা চল্লিশেরও অধিক। তাঁর অনুদিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্যগুলো হলঃ Man Against Nature, Sun, Democracy, Gone is gone, জার্মান রূপকথা, পারমানবিক শক্তির রহস্য, আমার জীবন দর্শন, মানব জীবন, অগ্নি পরীক্ষা ইত্যাদি। স্বাধীনতা যুদ্ধের এক বৎসর আগে তিনি Days Decisive নামে একটি মূল্যবান বই লিখেছিলেন। এই গ্রন্থের ভূমিকায় আবুল মনসুর আহমেদ লিখেছিলেনঃHis presentation of facts and documents and their analysis have been quite correct and objective but not without subjective outpouring of patriotic heart and tormented soul representative of suffering millions. একজন সাংবাদিক হিসেবে তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে ছিল দেশের গণমানুষ অপশাসন ও শোষণের হাত থেকে মুক্তির মাধ্যমে একটি সমৃদ্ধশালী জাতির উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গঠন।

১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে বুদ্ধিজীবী হত্যার নীল নকশার প্রথম শিকার হন সিরাজুদ্দীন হোসেন। স্বাধীনযুদ্ধে বিজয়ের প্রাক্কালে ১০ ডিসেম্বর ঘৃণ্য পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর আল বদর ও রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা তাঁকে তার চামেলীবাগের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায়, এরপর তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। সাংবাদিতায় অসামান্য অবদানের জন্য ১৯৭৬ সালে শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেন একুশে পদক (মরণোত্তর) এবং ২০১০ সালে মানিক মিয়া স্বর্ণপদক (মরণোত্তর) দেয়া হয়। এছাড়াও সিরাজুদ্দীন হোসেন ইন্টারন্যাশনাল প্রেস ইনস্টিটিউট অ্যাওয়ার্ডের জন্য মনোনয়ন লাভ করেছিলেন। বাংলাদেশের ইনভেস্টিগেটিং সাংবাদিকতার জনক শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেন আজ আমাদের মাঝে নেই, তবে মরেও তিনি অমর হয়ে আছেন।

২০১৩ সালের ৩রা নভেম্বর, চৌধুরী মুঈনুদ্দীন এবং আশরাফুজ্জামান খান কে ১৯৭১ সালের ১০ থেকে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে সিরাজুদ্দিন হোসেন সহ ১৮ জন বুদ্ধিজীবীকে অপহরণের পর হত্যার দায়ে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। আজ সাংবাদিক জগতের উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক অকুতভয় শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হেসেনের ৮৮তম জন্মবার্ষিকী। আদর্শবাদী ও নীতিনিষ্ঠ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের জন্মবাষিীকীতে ফুলেল শুভেচ্ছা।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.