নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

নূর মোহাম্মদ নূরু (পেশাঃ সংবাদ কর্মী), জন্ম ২৯ সেপ্টেম্বর প্রাচ্যের ভেনিস খ্যাত বরিশালের উজিরপুর উপজেলাধীন সাপলা ফুলের স্বর্গ সাতলা গ্রামে

নূর মোহাম্মদ নূরু

দেখি শুনি স্মৃতিতে জমা রাখি আগামী প্রজন্মের জন্য, বিশ্বাস রাখি শুকনো ডালের ঘর্ষণে আগুন জ্বলবেই। ভবিষ্যৎকে জানার জন্য আমাদের অতীত জানা উচিতঃ জন ল্যাক হনঃ ইতিহাস আজীবন কথা বলে। ইতিহাস মানুষকে ভাবায়, তাড়িত করে। প্রতিদিনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা কালক্রমে রূপ নেয় ইতিহাসে। সেসব ঘটনাই ইতিহাসে স্থান পায়, যা কিছু ভাল, যা কিছু প্রথম, যা কিছু মানবসভ্যতার অভিশাপ-আশীর্বাদ। তাই ইতিহাসের দিনপঞ্জি মানুষের কাছে সবসময় গুরুত্ব বহন করে। এই গুরুত্বের কথা মাথায় রেখে সামুর পাঠকদের জন্য আমার নিয়মিত আয়োজন ‘ইতিহাসের এই দিনে’। জন্ম-মৃত্যু, বিশেষ দিন, সাথে বিশ্ব সেরা গুণীজন, এ্ই নিয়ে আমার ক্ষুদ্র আয়োজন

নূর মোহাম্মদ নূরু › বিস্তারিত পোস্টঃ

উনিশ শতকের ইংরেজি ভাষার জনপ্রিয় আধুনিকতাবাদী সাহিত্যিক ভার্জিনিয়া উল্ফ এর ১৩৮তম জন্মবার্ষিকীতে ফুলেল শুভেচ্ছা

২৫ শে জানুয়ারি, ২০২০ বিকাল ৪:৫০


বিংশ শতাব্দীর আধুনিকতাবাদী সাহিত্যিকদের মধ্যে অন্যতম এ্যাডেলাইন ভার্জিনিয়া উল্ফ। যিনি বিশ্বব্যাপী ভার্জিনিয়া উল্ফ নামে পরিচিত। ব্রিটিশ কথাসাহিত্যিক ভার্জিনিয়া উল্ফ ছিলেন নারী মুক্তিতে অবিচল একজন সমাজ বিশ্লেষক। সাহিত্যনুরাগী বাবার লেখালেখি ভার্জিনিয়াকে একজন সাহিত্যিক হতে উৎসাহ যুগিয়েছিল। তার উল্লেখযোগ্য রচনা হল, মিসেস ডাল্লাওয়ে (১৯২৫), টু দ্যা লাইটহাউজ (১৯২৭), ওরলান্ডো (১৯২৮)। তার রচিত ভাষন সংকলন এ রুম ওয়ান’স ওন (১৯২৯) বইটি তার উক্তি “নারী যখন ফিকশন লেখে তখন তার একটি কক্ষ আর কিছু অর্থ খুব প্রয়োজন।” এর জন্য বিখ্যাত। ভার্জিনিয়া উলফের অন্যতম বিখ্যাত লেখনী ‘এ রুম অব ওয়ান'স অওন’, ১৯২৯ সালে প্রকাশিত হয়। মূলত ১৯২৮ সালে কেমব্রিজ বিশ্বদ্যালয়ে দেয়া দুটি লেকচারের সংকলন এটি। এখানেই তিনি তার বিখ্যাত উক্তিটি করেছিলেন- “নারী যখন ফিকশন লেখে তখন তার একটি কক্ষ আর কিছু অর্থ খুব প্রয়োজন।” শিল্পে, সাহিত্যে, উপন্যাসে কেন নারীরা পুরুষের চেয়ে পিছিয়ে? এই উত্তর খুঁজতে গিয়ে লেখিকা দেখিয়েছেন নারীর অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকার কথা। সেই সাথে তাদের নিজের একটা ঘরও নেই। সৃজনশীলতার জন্য যা খুব প্রয়োজন বলে তিনি উপলব্ধি করেন। তিনি বলেন, “যদি নিজস্ব একটা ঘর আর ৫০০ পাউন্ডের নিশ্চয়তা দেয়া হয়, নারীরাও অনেক উন্নতমানের সাহিত্য উপহার দিতে পারবে। জেইন অস্টেন থেকে ব্রন্টি ভগ্নিদ্বয়, জর্জ এলিয়ট ও মেরি কারমাইকেল পর্যন্ত সব লেখিকাই অনেক প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও শেকসপীয়রের স্তরে উন্নীত হতে পারছে না আর্থিকভাবে সমর্থ না থাকায়। আর তাই নারীকে নির্ভর করতে হয় পুরুষের ওপর। আর নারীদের নিচে ফেলে না রাখলে পুরুষরা বড় হবে কি করে- এই মনোভাব বজায় রাখলে নারীদের মুক্তি মিলবে কিভাবে?”- এই প্রশ্ন তখন সমাজের কাছে ছুঁড়ে দেন ভার্জিনিয়া।প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়কালে লন্ডর লিটারেসি সোসাইটি এর একজন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। উল্ফ ডিপোলার ডিজঅর্ডার নামক এক‌টি মানসিক রো‌গে ভু‌গে‌ছি‌লেন। আধুনিকতাবাদী এই ইংরেজ সাহিত্যিকের আজ ১৩৮তম জন্মবার্ষিকী। ১৮৮২ সালের আজকের দিনে তিনি লন্ডনের দক্ষিন কেনসিংটনে জন্মগ্রহণ করেন। ইংরেজি ভাষার জনপ্রিয় সাহিত্যিক ভার্জিনিয়া উল্ফ এর জন্মবার্ষিকীতে ফুলেল শুভেচ্ছা।

এ্যাডেলাইন ভার্জিনিয়া উল্ফ ( Adeline Virginia Woolf) ১৮৮২ সালের ২৫ জানুয়ারি লন্ডনের দক্ষিন কেনসিংটনে ২২ হাইড পার্কের একটি বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পুরো নাম ছিল এ্যাডেলাইন ভার্জিনিয়া স্টিফেন। বিয়ের পর তিনি উল্ফ পদবীটি গ্রহণ করেন। তার বাবার নাম স্যার লেসলী স্টিফেন এবং মার নাম জুলিয়া প্রিন্সেপ ডাকওয়ার্থ স্টিফেন। কাকা বিখ্যাত আইনবিদ ও ভারতীয় সাক্ষ্য আইনের জনক জেমস ফিটজেমস স্টিফেন। বাবা স্যার লেসলী ছিলেন একজন স্বনামধন্য ইতিহাসবিদ, লেখক, সমালোচক এবং পর্ব্বত আরোহী। বাবার লেখালেখি ভার্জিনিয়াকে একজন সাহিত্যিক হতে উৎসাহ যুগিয়েছিল। ভার্জিনিয়ার মা জুলিয়া স্টিফেনের জন্ম তৎকালিন ব্রিটিশ ভারতে। পরে তিনি ইংল্যান্ডে চলে আসেন। ভার্জিনিয়ার বাবা মা দুইজনই পূর্বে একাধিকবার বিয়ে করেন। ছোটবেলায় ভার্জিনিয়া উল্ফ তার বেশ কয়েকজন সৎ ভাইবোনের সাথে একই পরিবারে বসবাস করতেন। শৈশবে সৎ ভাইদের দ্বারা যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন সাহিত্যিক উলফ। তার বিভিন্ন লেখনীতে সেই বিষয়টি তুলে ধরেছেন তিনি। উনবিংশ শতাব্দীর শেষের লন্ডনের শিক্ষাব্যবস্থা ছিল ভিন্ন। ছেলেরা স্কুল, ভার্সিটিতে যেতে পারলেও মেয়েদের শিক্ষাগ্রহণ বাড়িতেই হতো। ভার্জিনিয়ার পরিবার তখন কর্ণওয়েলের একটি বাড়িতে স্থানান্তর হন। সেখানে বসার ঘরের পিছনেই বই নিয়ে বসতেন ভার্জিনিয়া ও তার বোন ভেসেনিয়া। ভার্জিনিয়ার লেখা থেকে জানা যায়, কক্ষটি ছিল সুন্দর আর অনেক জানালা ঘেরা। শান্ত নিরিবিলি ঐ পরিবেশ পড়াশুনা আর ছবি আঁকার জন্য ছিল একদম জুতসই। ভার্জিনিয়ার মা জুলিয়া তাদের ইতিহাস, ফ্রেঞ্চ এবং ল্যাটিন পড়াতেন। বাবা লেসলি শেখাতেন গণিত। লেসলির ছিল বইয়ের বিশাল সম্ভারে ভরপুর লাইব্রেরি। সেই লাইব্রেরির বইয়ের মাধ্যমে বাবার সাথে এক সমধুর হৃদ্যতা গড়ে উঠে ভার্জিনিয়ার। যদিও সেসময় মেয়েদের স্কুলে গিয়ে বিদ্যাশিক্ষার তেমন প্রচলন ছিল না, কিন্তু লেখালেখির বিষয়টিকে পারিবারিকভাবেই বেশ উৎসাহ দেয়া হতো। তাই ১০ম জন্মদিনে ভার্জিনিয়াকে একটি কালির দোয়াত, কলমের স্ট্যান্ড এবং বেশ কিছু লেখালেখির সামগ্রী উপহার হিসেবে দেয়া হয়েছিল। ভার্জিনিয়ার বয়স যখন মাত্র ১৩ বছর, ১৮৯৫ সালে ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হয়ে তার মা মারা যান। ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়স পর্যন্ত বিদ্যালয়ে গিয়ে পড়াশুনার সুযোগ পান ভার্জিনিয়া। ১৮৯৯ থেকে ১৯০১ সাল পর্যন্ত লন্ডনের কিং কলেজের নারী বিভাগে তিনি প্রাচীন গ্রীক, ল্যাটিন, জার্মান ও ইংরেজি বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করেন। এসময় তার বোন ভেনেসাও ঐ বিভাগে যোগ দেন। ১৮৯৭ সালে ভার্জিনিয়ার সারোগেট মা স্টেলা ডাকোয়ার্থ মারা যান। ১৯০২ সালে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন তার পিতা লেসলি স্টিফান এবং একটি অপারেশনও করা হয়। কিন্তু তিনি আর সুস্থ হননি। ১৯০৪ সালে মৃত্যুবরণ করেন স্টিফান। বাবার মৃত্যুর পর আবারো মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন ভার্জিনিয়া। মা, স্টেলা এরপর বাবার মৃত্যু- ১৮৯৭ থেকে ১৯০৪ সালকে ভার্জিনিয়া দুঃখের সাত বছর হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

(Leonard and Virginia Woolf in Hyde Park)
১৯১২ সালের ১০ আগস্ট লিওনার্ড উল্ফকে বিয়ে করেন ভার্জিনিয়া। সাহিত্যনুরাগী লিওনার্ড উলফ ছিলেন ভার্জিনিয়ার ভাই থোবির বন্ধু এবং দুজনে একসঙ্গে কেমব্রিজে পড়াশুনা করতেন। এসময় তারা অন্যান্য বন্ধুদের সঙ্গে একটি রিডিং গ্রুপ তৈরি করেছিলেন যার নাম ছিল মিডনাইট সোসাইটি। ভার্জিনিয়া ও লিওনার্ড দুজন দুজনার সম্পর্কে অবগত থাকলেও ১৯০৪ সালের আগ পর্যন্ত কেউ কখনো কারো সাথে কথা বলেননি। ১৯১২ সালের ১১ জানুয়ারি লিওনার্ড উলফ ভার্জিনিয়াকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। সেবছরই ১০ আগস্ট তারা বিয়ে করেন। এসময় ভার্জিনিয়ার মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে অবগত ছিলেন লিওনার্ড। আর্থিকভাবে খুব স্বচ্ছল না হলেও ভার্জিনিয়া-লিওনার্ডের ভালোবাসার বন্ধন ছিল অটুট। ১৯১৪ সালে এই দম্পতি লন্ডন থেকে দূরে রিচমন্ডে থাকা শুরু করেন। ১৯১৫ সালে মার্চ মাসে এ দম্পতি হগরাথ হাউজে স্থানান্তরিত হন। ঐ বাড়িটি থেকেই প্রথমবারের মত মুদ্রণের কাজ শুরু করেন এই দম্পতি, যাত্রা শুরু হয় হগরাথ প্রেস এর। ১৯১৫ সালে তার ভাই গেরাল্ড ডাকওয়ার্থের প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয় ভার্জিনিয়ার প্রথম উপন্যাস দ্য ভয়েজ আউট। বইটি প্রকাশের পর একাধিকবার সংশোধন করেছিলেন ভার্জিনিয়া। আমাদের ভাবনার জগত এবং কাজের মধ্যে যে পার্থক্য তা তুলে ধরা হয়েছে এ বইটিতে। এই দুইয়ের পার্থক্যের মধ্য দিয়ে ভালোবাসার রূপটি প্রকাশ করতে চেয়েছেন লেখিকা। বইটি প্রকাশের পরই আত্মহত্যার চেষ্টা করেন ভার্জিনিয়া। ১৯২০ সালে লেখকদের সংগঠন ব্লুমসবারি নতুন রূপে আত্মপ্রকাশ করে এবং এই দম্পতি সেখানে যোগদান করেন। তার তিনটি আত্মজীবনীমূলক প্রবন্ধ -১৯২১ সালে প্রকাশিত হয় ২২ ‘হাইড পার্ক গেট’, ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয় ‘ওল্ড ব্লুমসবারি’, ১৯৩৬ সালে প্রকাশিত হয় ‘এম আই এ স্নব’, ১৯৭৬ সালে তার মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয় সম্পাদিত গ্রন্থ ‘মোমেন্টস অব বিইং’। ১৯২৫ সালে প্রকাশিত হয় সামাজিক রাজনৈতিক উপন্যাস ‘মিসেস ডালওয়ে’। যুদ্ধ এবং তার ফলাফল নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী রচনা এ উপন্যাসটি। এটি প্রকাশিত হওয়ার পর পরই মানসিকভাবে কলাপসড হন ভার্জিনিয়া। যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে একটি পরিবারের মানুষগুলির বিপর্যস্ত জীবনের নানা বাঁক নিয়ে রচিত তার উপন্যাস ‘টু দ্য লাইটহাউজ’। সেই সাথে একজন নারীর উপর সামাজিক চাপ প্রয়োগের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়েছে। ১৯২৭ সালে বইটি প্রকাশিত হয়।

১৯৩৩ সালে তার বায়োগ্রাফি ‘ফ্লাস’ প্রকাশিত হয়। মূলত রোডলফ বেসিয়ারের একটি নাটক থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ফিকশনধর্মী এ উপন্যাসটি রচনা করেন তিনি যেখানে একটি কুকুরের চোখ দিয়ে পুরো থিমটি তুলে ধরা হয়। ভার্জিনিয়া উলফ তার আন্টি ফটোগ্রাফার জুলিয়া মার্গারেট ক্যামেরুনের জীবনের নানা দিক নিয়ে একটিমাত্র নাটক রচনা করেছিলেন, নাম ‘ফ্রেশওয়াটার’। ১৯৩৫ সালের ১৮ জানুয়ারি নাটকটি প্রথমবারের মত মঞ্চস্থ করা হয় যার নির্দেশনায় তিনি নিজেই ছিলেন। ১৯৩৬ সালে প্রকাশিত হয় ‘এম আই এ স্নব’। বইটিতে মূলত সমাজের ধনাঢ্য শ্রেণী এবং সেই সাথে সুশীল সমাজের একজন প্রতিনিধি হওয়ার যে সংকট তা তুলে ধরা হয়েছে। ভার্জিনিয়া উলফ এর শেষ উপন্যাস ‘বিটউইন দ্যা এ্যাক্টস’ ১৯৪১ সালে প্রকাশিত হয় যেখানের জীবনের নানা স্তরের উত্থান পতনের বর্ণনা করেছেন তিনি। এছাড়াও তিনি জেকবস্ রুম, ওরলানডো, দ্য ওয়েভস্ নামক প্রখ্যাত উপন্যাস রচনা করেছেন। যদিও ভার্জিনিয়া বাবাকে বেশি ভালোবাসতেন বলে বারবার উল্লেখ করেছেন। তবুও তার শেষজীবনে মায়ের দ্বারাই বেশি আবিষ্ট ছিলেন। তার বেশ কয়েকটি আত্মজীবনীমূলক প্রবন্ধ যেমন রেমিনিসেন্স (১৯০৮), ২২ হাইড পার্ক (১৯২১), আ স্কেচ অব দ্য পাস্ট (১৯৪০)-এ উঠে এসেছে মায়ের অপরূপ সৌন্দর্য আর তার সাথে মায়ের সুমধুর সম্পর্কের কথা। মায়ের মৃত্যুর পর প্রথমবারের মত মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন ভার্জিনিয়া। আর সেই অসুস্থতা থেকে বের হতে পারেননি। ভার্জিনিয়া উল্ফ তাঁর শেষ উপন্যাস ‘বিটউইন দ্য অ্যাক্টস’ লেখার পর পরই বিষণ্নতায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। এই বিষণ্নতার পেছনের আরেকটা কারণ ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তাঁর সুনাম কিছুটা কমে আসে। এ ছাড়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তাঁর লন্ডনের বাড়ি ধ্বংস হওয়াও আরেকটি কারণ। মুড সুইং থেকে শুরু করে মানসিকতা উৎকন্ঠা আর বিষাদ চরম পর্যায়ে পৌঁছায় ১৯০৪ সালে তার পিতার মৃত্যুর পর। মানসিক অবসাদের কারণে তার সামাজিক জীবন বিপর্যস্ত হলেও লেখালেখির তেমন কোন সমস্যা ঘটায়নি। বরং অসুস্থতার জন্য নিয়মিত বিরতি দিয়ে লেখালেখি চালিয়ে গেছেন তিনি। ১৯১০, ১৯১২, ১৯১৩ সাল পর্যন্ত তাকে ৩ বার স্বল্প সময়ের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ভর্তি করা হয়েছিল। আধুনিক মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তিনি বাইপোলার ডিসঅর্ডারে ভুগছিলেন। মানসিক আঘাতের পাশাপাশি তার অবস্থাটা কিছুটা জেনেটিকও ছিল। তার বাবা লেসলি স্টিফেনও অবসাদে ভুগতেন। তার সৎ বোন লোরাও একই সমস্যায় ভুগতেন এবং অনেকদিন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসাধীন ছিলেন। এছাড়া অনেকেই তার সৃজনশীলতাকে তার মানসিক অসুস্থতার কারণ বলে মন্তব্য করে বলেন, অনেকসময় সৃজনশীলতা মানসিক অসুস্থতার জন্ম দেয়।

দীর্ঘদিন বিষন্নতায় ভোগার ফলে বেঁচে থাকবার তীব্রতা কমে যায় তার। নিজের হাতে তুলে নেন নিজেকে ধ্বংসের দায়িত্ব। নিজের ওভারকোটটির পকেটে নুড়িপাথর ভরে ১৯৪১ সালের ২৮ মার্চ ৫৯ বছর বয়সে বাড়ির পাশে লন্ডনের ওউজ নদীতে ডুব দেন এই মহান সাহিত্যিক। জীবনে আর ফিরে আসেননি, জলের সঙ্গে একাকার হয়ে যান। ১৮ এপ্রিল তার দেহের কিছু অংশ পাওয়া যায়। লিওনেল সেই দেহাবশেষ সাসেক্সের মংক হাউজের একটি এলম গাছের নিচে সমাহিত করেন। শেষ বিদায়ের আগে প্রিয়তম স্বামীর উদ্দেশে এক মর্মস্পর্শী চিঠি লিখে যান ভার্জিনিয়া। চিঠিটি সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি পড়া সুইসাইড নোটগুলোর একটি। অত্যন্ত মর্মস্পর্শী এই চিঠিটি এখনও সাহিত্যপ্রেমী তথা ভার্জিনিয়া উলফের প্রেমীদের কাছে ভীষণ জনপ্রিয়। চিঠিতে ভার্জিনিয়া লিখেনঃ
‘প্রিয়তম, আমি নিশ্চিত, আবার পাগল হয়ে যাচ্ছি। মনে হচ্ছে, দ্বিতীয়বারের মতো আর ভয়াবহ সময় পার করতে পারব না। এবার আর সেরে উঠব না বোধ হয়। সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত কাজটিই আমি করতে যাচ্ছি। তুমি আমায় সম্ভাব্য সর্বোচ্চ সুখ দিয়েছ। যেকোনো মানুষের পক্ষে যতটা করা সম্ভব তুমি সব দিক থেকে ততটাই করেছ। আমার এই ভয়াবহ অসুখের পূর্ব পর্যন্ত আমরা যেমন সুখী ছিলাম, তেমন সুখী হয়তো আর দুজন মানুষের পক্ষে হওয়া সম্ভব নয়। আমি এই অসুখের সঙ্গে যুদ্ধ করতে আর পারছি না। আমি জানি, তোমার জীবনটাও আমি শেষ করে দিচ্ছি। জীবনে তোমাকে কখনো অধৈর্য হতে দেখিনি। তোমাকে পেয়েছি অবিশ্বাস্য রকমের সুবোধ স্বামী হিসেবে। আমি জোর দিয়ে বলতে চাই, আমি যা বলছি প্রত্যেকেই জানে। আমার এই ভয়াবহ অসুখের আক্রমণ থেকে কেউ বাঁচাতে পারলে সে শুধু তুমিই পারতে। আমার অধিকার থেকে সব কিছুই চলে গেছে- রয়ে গেছে তোমার ভালোবাসা। আবারো বলছি, দুজন মানুষ একসঙ্গে সুখী হতে পারে, তোমাকে না পেলে জানতাম না’।

সৃষ্টিশীল মানুষ মানেই এক প্রকার মানসিক রোগী। নানা গবেষণায় এমনটাই উঠে এসেছে। মানসিক বিকার ব্যতিত কেউ লিখতে পারে না, সৃষ্টিশীল সত্তা মানেই বিকারগ্রস্ততা। সেটা কখনো প্রকট আকারে আসে আবার কখনো মৃদুভাবে আসে। এই বিকারগ্রস্ততার মানে কিন্তু আবার উচ্ছন্নে যাওয়া নয়, সৃষ্টিশীল সত্তা তাঁর সৃষ্টির মাঝে যখন বিলীন হয়ে যান তখন তার স্বাভাবিক ক্রিয়া কলাপ ব্যহত হয়।সমাজের আর দশটা স্বাভাবিক মানুষের মতো তিনি চলতে পারেন না। কখনো অধিকতর মহৎ সৃষ্টির তাড়নায় লেখক হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। বিষণ্নতায় আক্রান্ত হন। লেখকের এই বিষণ্নতা একদিকে যেমন লেখার জন্য ভাল, তেমনি লেখক নামক মানুষটির জন্য তা ক্ষতিকর। কারণ এই বিষণ্নতা একজন সৃষ্টিশীল মানুষকে নিয়ে যায় মৃত্যুর দিকে। লেখক আত্মহত্যার মাধ্যমে অথবা অন্যকোন উপায়ে নিজেকে নিঃশেষ করে দেন। কথিত আছে একজন কবির জীবন খেয়ে, জীবনটাকে নিঃশেষ করে দিয়েই একটি কবিতার জন্ম হয়। তেমনি উপন্যাসিক বা লেখকের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। কেন ঘটে এমনটা। তার কোন সুনির্দিষ্ট কারণ পাওয়া না গেলেও এতটুকু নিঃসন্দেহে বলা যায় কবি বা লেখক শেষ পর্যন্ত সবকিছু ছাপিয়ে প্রেমে পড়েন তার সৃষ্টির। সৃষ্টির প্রেমে মত্ত লেখকের জাগতিক আর কোন মোহ থাকে না। একজন লেখকের যখন সৃষ্টি প্রক্রিয়া থেমে যায় তখন তাঁর কাছে জাগতিক সমস্ত কিছু ম্লাণ হয়ে পড়ে। এসব কারণেই লেখকের জগতে লেখক একাই বসবাস করেন। তখন বেঁচে থাকাটাও নিরর্থক হয়ে উঠে। এ কারণেই একজন ভার্জিনিয়া উল্ফ বেছে নেন আত্মহননের মতো জীবন বিনাশী পথ। ফলে পরিণতি যা হওয়ার তাই হয়। ২৮শে মার্চ ১৯৪১ সালে ভার্জিনিয়া তাঁর ওভারকোটের পকেট ভারী পাথর দিয়ে ভরে ওউজ নদীতে ঝাপ দিলেন। নদীর জলে ভাসিয়ে দিলেন নিজের সমস্ত বিষণ্নতা। আর বিশ্ব সাহিত্যে রেখে গেলেন আরেকটি আত্মহননের গল্প। আত্মহত্যা করার ২০ দিন পর ১৮ই এপ্রিল নদীতে তাঁর দেহাবশেষ ভেসে ওঠে। বাংলা সাহিত্যসহ বিশ্ব সাহিত্যে অসংখ্য লেখককে খুঁজে পাওয়া যাবে যাঁরা নিজেদের নিঃশেষ করে দিয়ে গেছেন। ভার্জিনিয়া উল্ফ তাদেরই একজন। রডমেল, সাসসেক্স এর মংক হাউজে একটি এলম গাছের নিচে তাকে সমাহিত করা হয়। আজ আধুনিকতাবাদী এই ইংরেজ সাহিত্যিকের ১৩৮তম জন্মবার্ষিকী। ইংরেজি ভাষার জনপ্রিয় সাহিত্যিক ভার্জিনিয়া উল্ফ এর জন্মবার্ষিকীতে ফুলেল শুভেচ্ছা।

নূর মোহাম্মদ নূরু
গণমাধ্যমকর্মী
নিউজ চ্যানেল
ফেসবুক লিংক
[email protected]

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ২৫ শে জানুয়ারি, ২০২০ রাত ৯:৫৪

রাজীব নুর বলেছেন: ৃষ্টিশীল মানুষ মানসিক রোগী হতে যাবে কেন??
এক হিসেবে তো সব মানুষই মানসিক রোগী।

২৫ শে জানুয়ারি, ২০২০ রাত ১০:০৬

নূর মোহাম্মদ নূরু বলেছেন: ধন্যবাদ রাজীব ভাই আপনাকে চমৎকার বিষয়ে আলোকপাত করার জন্য।
আপনার জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি যে, সৃষ্টিশীল মানুষ মানসিক রোগী কারনঃ
সৃষ্টিশীলতা আসে দেবতার কাছ থেকে। এমনটাই বিশ্বাস করত প্রাচীন গ্রিসের লোকেরা।
গ্রিক মিথ অনুসারে শিল্প, সাহিত্য এবং বিজ্ঞানের উৎস ছিল নয়জন ‘মিউজ’। গ্রিক দেবতাদের রাজা
—দেবতা জিউসের ৯ মেয়েকে বলা হতো ‘মিউজেস’। এমনকি আঠারো শতকেও মনে করা হতো নিজে
থেকে কেউ সৃষ্টিশীল হতে পারে না। সৃষ্টিশীলতা এমন এক গুণ যা কারো কারোই থাকে, সবার থাকে না।
এমনকি এটাও মনে করা হতো যে বিষণ্ণতা, সিজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার ডিজঅর্ডার এসব মানসিক
অসুস্থতার সাথে সৃষ্টিশীলতার কোনো না কোনো সম্পর্ক আছে। চিত্রশিল্পী, লেখক, কবি, গায়ক,
নাট্যকার, নৃত্যশিল্পী, অভিনয়শিল্পী, ইত্যাদি সৃষ্টিশীল মানুষের মানসিক রোগে ভোগার
প্রবণতা তুলনামূলক বেশি।

সাইকোলজিস্ট জে ফিলিপ রাশটন পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা যায়,
সৃষ্টিশীলতার সাথে বুদ্ধি ও বিভিন্ন মুড ডিজঅর্ডারের সম্পর্ক আছে।
বিভিন্ন জিন যেগুলো সিজোফ্রেনিয়া ও বাইপোলার ডিজঅর্ডার-এর জন্যে দায়ী,
সেই জিনগুলোই মানুষের ক্রিয়েটিভিটির উৎস। এমনটাই ইঙ্গিত দেয় এই গবেষণার
ফলাফল। ক্রিয়েটিভ কাজের প্রতি ঝোঁক বাড়তে থাকলে, সিজোফ্রেনিয়া ও বাইপোলার
ডিজঅর্ডার-এর শিকার হওয়ার সম্ভাবনাও বাড়তে পারে।

২| ২৫ শে জানুয়ারি, ২০২০ রাত ১১:১০

মোহাম্মাদ আব্দুলহাক বলেছেন: সৃষ্টিশীল মানুষ মানেই এক প্রকার মানসিক রোগী। নানা গবেষণায় এমনটাই উঠে এসেছে। মানসিক বিকার ব্যতিত কেউ লিখতে পারে না, সৃষ্টিশীল সত্তা মানেই বিকারগ্রস্ততা।


জি নূরভাই, আমি ভুক্তভোগী, মাথায় ষোলআনা কাজ করেনা। লেখালেখির সময় এক্কেবারে ঝাক্কাস!

২৬ শে জানুয়ারি, ২০২০ সকাল ১০:৫৫

নূর মোহাম্মদ নূরু বলেছেন:
আপনার মন্তব্যে প্রতিয়মান হচ্ছে আপনি
একজন সৃষ্টিশীল মানুষ।
নতুন কিছু সৃষ্টি করার জন্য
একটু কষ্ট না হয় করলেনই!!
তবে বেশী যেন না হয়।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.