নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমার গল্পটা হোক পৃথিবীর সেরা গল্প ।কারন আমি হতে চাই একজন সত্যিকারের জীবন শিল্পী ।

নুরুন নাহার লিলিয়ান

নুরুন নাহার লিলিয়ান › বিস্তারিত পোস্টঃ

বিস্ময়কর এবং ভয়ংকর সৌন্দর্যময় জলরাশি নায়াগ্রা জলপ্রপাত - নুরুন নাহার লিলিয়ান

১০ ই নভেম্বর, ২০১৯ সন্ধ্যা ৭:৩৩



জাপানে তখন রাত তিনটা।আমি তখন ঘুমে আচ্ছন্ন । আমার স্বামী পাশে বসে ল্যাপটপে কাজ করে। হঠাৎ ওর খুশিতে আত্মহারা হয়ে যাওয়ার চিৎকার । আমি চোখ খুলে দেখি তাঁর চোখে মুখে খুশির ঝিলিক ।
ও পাগলামি করে বলে আরে উঠো উঠো চল কানাডা যাই হানিমুনে ।
আমি ঘুম চোখে বিস্মিত হয়ে যাই ।
কি এখন !
আমি চোখ ডলতে ডলতে উঠে বসি । স্বপ্ন নয়তো!
না। একদম বাস্তব । ওর ইমেইল দেখলাম । আমার স্বামী বৈজ্ঞানিক ডঃ মোঃ নজরুল ইসলাম ভুঁইয়া তাঁর গবেষণা পত্র উপস্থাপনের জন্য কানাডার মাইক্রোবায়োলজি সোস্যাইটি থেকে আমন্ত্রণ পেয়েছেন ।যেখানে এই আয়োজন খুব কাছেই আমার বড় বোন তাঁর পরিবার নিয়ে বসবাস করেন ।
আমার স্বামীর জাপানি প্রফেসর মাকতো উবুকতা আমাদের ব্যাপারে অনেক সহানুভূতিশীল ছিলেন । কারন উনি অনুভব করতেন আমার স্বামীর পিএইচডি করার কঠিন সময়ে আমার ত্যাগস্বীকার করার বিষয়টি।
কারন বিয়ের দিন ও নজরুল ল্যাবে কাজ করেছিল ।তাঁর গবেষণার ফলাফল না আসা পর্যন্ত সে বলা যায় চব্বিশ ঘণ্টাই ল্যাবে সময় ব্যয় করতো । তাই প্রফেসর নজরুলের কাছে আমার খোঁজ খবর নিত । নব বিবাহিতা একজন নারী বিদেশে অচেনা জায়গায় কেমন আছি ।তিনি জানতে চাইতো । আমাকে যেন কানাডা সফরসঙ্গী করে সেটা প্রফেসরই পরামর্শ দিয়েছিল।

খুব সহজেই কানাডার ভিসা হয়ে গেল অনলাইনে । কারন আমরা থাকতাম জাপানের হোক্কাইডো দ্বীপে। সেখানে কানাডার দূতাবাস ছিল না । তাই আমাদের অনলাইনে আবেদন করতে হয়েছিল ।
কিন্তু ট্রানজিটের জন্য আমেরিকার ভিসা নিতে হবে ।
ঘুম থেকে উঠে দেখি নজরুল ল্যাবে চলে গিয়েছে খুব ভোরে।
মোবাইলে জানাল রেডি হয়ে থাকতে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম কোথায় যাব?

ও বলল," তোমাকে পাহাড়ে নিয়ে যাব। হেটে হেটে কিভাবে পাহাড়ের উপরে উঠতে হয় দেখাব।
আমি জানি মারুয়ামা পাহাড়ে আমেরিকান এ্যাম্বাসি।তাই দুষ্টুমি করে হেসে দিয়ে বললাম পাহাড়ে উঠতে পাসপোর্ট ও কাগজপত্র লাগবে না।
ও সিরিয়াস হয়ে উত্তর দিল, " হুম। তা তো লাগবেই। সব কাগজপত্র সাথে নিও। "
পরের দিন সকালে আমরা দুজন মারুয়ামা পাহাড়ের পথে।চারপাশে কি অদ্ভুত সব পাহাড়ি সৌন্দর্য ।আর সেই অবারিত সৌন্দর্য দেখতে দেখতে স্বামীর হাত ধরে আমি পাহাড়ে উঠে গেলাম।
আমেরিকার ভিসা পাওয়া এতো সহজ! মাত্র কয়েকটা প্রশ্ন করল আর পাসপোর্ট পাঠিয়ে দিবে বলে দিল। প্রথম অভিজ্ঞতায় ভীষণ অভিভূত হয়েছিলাম ।

২০১৪ সালের ২২ জুলাই আমরা কানাডার পথে রওয়ানা হলাম।
কানাডা যাওয়ার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হল রহস্যময় জলরাশির নায়াগ্রা জলপ্রপাত। সেই সাথে প্রবাসী বোনের সাথে দেখা হওয়া।
আমেরিকার লসএঞ্জেলসের হলিউড আর কতো সুন্দর সব জায়গা পরিভ্রমণ করে আমরা মন্ট্রিল এয়ার লাইনে যাত্রা করলাম। ২৪ জুলাই, ২০১৪ সালের ভোর বেলা প্লেন ল্যান্ড করল। চারিদিকে শুধু ফ্রেঞ্চ শব্দ। বাইরে বের হতেই ফুলের তোড়া নিয়ে দাড়িয়ে আছে বোনের পরিবার।বড় বোন, দুলাভাই আর ভাগনিরা। নতুন জামাইকে বরণের পর বাসায় নানা আয়োজন উপভোগ করা।
আমার স্বামী সকালে কনফারেন্সে চলে যেতো। বিকালে আমরা পরিবার সহ মন্ট্রিয়ালের পরিচিত সবার প্রিয় জায়গা গুলো ঘুরতাম।অথবা পরিচিত বাংলাদেশিদের বাসায় দাওয়াত খেতাম ।



সেই কনফারেন্সে আমার স্বামীর দুই জাপানি প্রফেসর ও যোগ দিয়েছিলেন। উনারা আমার আপুর বাসায় বেড়াতে আসে। আমার বোন দুলা ভাই তাদের জন্য রান্না করেছিল ছত্রিশ রকমের খাবার। জাপানে কোন পারিবারিক আয়োজনে এমনটা দেখা যায় না। ভীষণ খুশি হয়েছিল জাপানিরা। কোন বাংলাদেশি পরিবারের আতিথিয়েতায় এতো আয়োজন ছিল বলে। আমার বড় দুলা ভাই গাজী ইন্ড হাসান ও আমার বড় বোন কামরুন নাহার ডলি অনেক পরিশ্রম করেছিল আমাদের সুখী করতে।আমাদের ট্যুরটা যেন আনন্দময় হয় সব দিক থেকে তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা ছিল ।
প্রফেসর মাকতো উবুকতার গলায় বিঁধে পাবদা মাছের কাটা। মুরগী, খাসি, গরু, নানা রকম মাছ আর তরকারির মধ্যে প্রফেসরের পাবদা মাছ পছন্দ হল। সে দুই টুকরো খেলো। আর সেটাতেই কাঁটা বিঁধলো।সেই পাবদা মাছের কাঁটা গলা থেকে সরাতে সাদা ভাত দলা ধরে তাকে খাওয়ানো হল ।সাদা দলা ধরা ভাতের সাথে তিনি জাপানি ওনিগিরির তুলনা করলেন । এই নিয়ে চলল নানা মজার সব অভিজ্ঞতা বিনিময় ।

দুই জাপানি প্রফেসরেরই এটা প্রথম অভিজ্ঞতা ছিল কোন বাংলাদেশির বাসায় দাওয়াত খাওয়া ।প্রফেসর মাকতো উবুকতার জুনিয়র ছিল মিচ্চা হাসি সান । তার আনন্দ ও অভিব্যক্তি ছিল ভীষণ অবাক করার মতো । নতুন পরিবেশে আর নতুন মানুষের ভিড়ে তিনি ভীষণ রকম আত্মহারা ছিল ।
এরপর আমাদের যাত্রা শুরু আবার অগাস্টের শুরুতে। এরমধ্যেই আমার স্বামীর গবেষণা পত্র উপস্থাপন শেষ হয়ে গেলো।পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ কানাডা । চারিদিকে শুধু নিস্তব্ধতা আর ব্যস্ততা।

১ আগস্ট ,২০১৪ আমরা মন্ট্রিল থেকে অন্টারিও রওয়ানা করলাম । আমাদের সবার মধ্যেই একটা ভাল লাগার উত্তেজনা কাজ করছে ।আমার দুই ভাগ্নি কুইন আর ইলমা ফ্রেঞ্চ ভাষায় কুটকুট কথা বলেই যাচ্ছে । ওরা বাংলা বুঝে না । ইলমা খুব ছোট । ওদের সাথে ভাষার কারনে ভালবাসা বিনিময় করতে ও কষ্ট হচ্ছিল । সেই থেকে আমি ফ্রেঞ্চ ভাষা শিখতে শুরু করি ।
মাল্টিকালচারের যুগে পৃথিবীর সাথে সম্পর্ক রাখতে আমাদের কতো কি শিখতে হয় ।

কানাডা আসলেই মহান আল্লাহ্‌র তৈরি ভিন্ন এক ভূখণ্ড । চারিদিকে অসাধারণ সব সৌন্দর্য বিরাজমান ।
প্রকৃতিতে কতো রকম বিস্ময় আছে । কানাডার নায়াগ্রা জলপ্রপাত তেমন এক বিস্ময় যা যেকোন মানুষ কে কেবল সৌন্দর্য আর রহস্যে ডুবাবে ।

প্রকৃতির এক অপার বিস্ময়কর রহস্য আর ভয়ংকর সৌন্দর্য ।ধারনা করা হয় নায়াগ্রা নদী থেকে নায়াগ্রা জলপ্রপাতের নামকরণ হয়েছে ।ONGUIAAHRA এই শব্দের অর্থ জলরাশির বজ্রধ্বনি। স্থানীয়দের মতে এই শব্দ থেকে ও নায়াগ্রা ফলসের নামকরণ হয়েছে ।
নায়াগ্রা জলপ্রপাতের ইংরেজি হল Niagra Falls . নায়াগ্রা নদীর উপরে হওয়ায় স্থানীয়রা একে নায়াগ্রা ফলস বলে থাকে ।

প্রচলিত আছে ১৮০০ বছর পূর্বে অন্টারিও শহরের দক্ষিনে প্রায় দুই থেকে তিন কিলোমিটার জায়গা বরফে আচ্ছাদিত ছিল । কিন্তু ঋতু পরিবর্তনের ফলে সেই বরফ গলে গিয়ে লেক ঈরি , লেক অন্টারিও,ও নায়াগ্রা নদীকে কেন্দ্র করে পানি জমে বিশাল নায়াগ্রা ফলস তৈরি হয় ।পাশাপাশি তিনটি ভিন্ন ফলস মিলেই নায়াগ্রা ফলস বা নায়াগ্রা জলপ্রপাত ।

এই ফলস গুলো কানাডা ফলস বা হর্সশু ফলস , আমেরিকান ফলস ও ব্রাইডাল ভিল ফলস । প্রতিদিন প্রায় ৬০ লক্ষ ঘন ফুট জল প্রবাহিত হয় । যার গড় পরিমান ৪০ লক্ষ ঘনফুট । গ্রীষ্মকাল ও বসন্তকাল হল নায়াগ্রা ভ্রমনের সেরা সময় । ঋতু বুঝে ভ্রমণ করলে সেরা সৌন্দর্যটা উপভোগ করা যায় ।
সারাটা সময় গাইডের মতো আমার স্বামী খুব পরিস্কার ভাবে আমাকে বর্ণনা করছিল ।

আমরা সিএন টাওয়ার, স্কাইলন , আই অফ দ্য গভঃ খ্যাত সিটি হল , ওল্ড পোর্ট , ক্যাসিনো অফ দ্য মন্ট্রিয়াল, মন্ট্রিয়াল সায়েন্স সেন্টার , মেরিন ল্যান্ডের ডলফিন শো সহ কতো কিছুই দেখেছি । সবচেয়ে মন ছুঁয়েছে নায়াগ্রার জলরাশির জলধবনি ।

কিন্তু কেন জানি যখন মেইড অফ দ্য মিস্ট নামক জাহাজটা আমেরিকান ফলস ঘুরে হর্সশু ফলস কিংবা কানাডিয়ান ফলসের খুব কাছে ঢেউ খেতে খেতে এগিয়ে যাচ্ছিল । পুরো শরীর হীম হয়ে গিয়েছিল । ভয়াবহ সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে জাহাজে থাকা সকল যাত্রীরা আত্মহারা । এতো সুন্দর! এতো সুন্দর ! সবাই যেন হাসতে হাসতে সেই সৌন্দর্যে তলিয়ে যেতে চাচ্ছে । সবাই মহাসুখে প্রায় উন্মাদ ।পুরো জাহাজে সহযাত্রীদের বিচিত্ররকম উন্মাদনা ও চোখে পড়ে ।

ফলসের খুব কাছে গিয়ে একটা ধাক্কা লাগে । চারিদিক থেকে পানি ছিটে আসে শরীরে । আর সহযাত্রীদের আত্মহারা খুশির চিৎকার ।এ যেন অন্য এক বিস্ময় ।

অতীতে এতো পবিত্র সৌন্দর্যের স্পর্শে গিয়ে অনেকেই ঝাঁপিয়ে পড়েছে । কেউ কেউ ঝাঁপ দিয়ে ও বেঁচে গিয়ে দুঃসাহসী অভিযাত্রীর উপাধি পেয়েছে ।
নিক ওয়ালান্ডা নামের এক দুঃসাহসী মার্কিন যুবক ২০১২ সালের ১৫ জুন দুই ইঞ্চি তারের উপর দিয়ে নায়াগ্রা পার হয়ে নতুন ইতিহাস গড়েছে । এমন অনেকেই নানা রকম দুঃসাহসী কাজ করে নায়াগ্রা জলপ্রপাতের রহস্যময় সৌন্দর্যকে জয় করেছেন ।

ভ্রমন শুধু অবলোকন নয় , মনের ভেতরের সৌন্দর্যকে আবিস্কার করা । আর তাকে জয় করা ।

আমরা সেই সৌন্দর্য জয় করতে করতে বাড়ি ফিরে আসি । আমাদের ভ্রমনের সময় ও শেষ হয়ে আসে । তারপর বোনের পরিবারের সবার ভালবাসা বুকে নিয়ে, আটলান্টিক মহাসাগর পার হয়ে আমেরিকার স্টাচু অফ লিবার্টিকে ছুঁয়ে দিয়ে ভালবাসার দেশ জাপানে ফিরে যাই ।

জীবনে বেঁচে থাকলে পৃথিবীর আর ও বিচিত্র সব সৌন্দর্য দেখার সুযোগ হয়তো পাব । কিন্তু কানাডার নায়াগ্রা জলপ্রপাত যে সৃষ্টির বিস্ময়কর আর ভয়ংকর সৌন্দর্যময় জলারাশি তাকে হৃদয়ের চোখ থেকে সরানো কঠিন । সত্যি পৃথিবীর সেরা বিস্ময়ের অনন্য বিস্ময় কানাডার নায়াগ্রা জল্প্রপাত ।

সেই জলরাশির জলধ্বনি এখনও বুকের কোথাও পবিত্র স্পর্শ দিয়ে যায় ।আর অভিজ্ঞতার নানা স্বপ্নিল রঙ আমাকে স্বপ্ন ঘোরে নিয়ে যায় ।

মন্তব্য ৮ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৮) মন্তব্য লিখুন

১| ১০ ই নভেম্বর, ২০১৯ সন্ধ্যা ৭:৪৬

শেহজাদী১৯ বলেছেন: আপনার ভালো লাগা এবং মুগ্ধতা ছুঁয়ে গেলো।

১১ ই নভেম্বর, ২০১৯ রাত ১:০৪

নুরুন নাহার লিলিয়ান বলেছেন: ধন্যবাদ।

২| ১০ ই নভেম্বর, ২০১৯ রাত ১০:৫৮

মলাসইলমুইনা বলেছেন: ভয়ঙ্কর সুন্দর কেন ? নায়েগ্রাতো অপার্থিব সুন্দর !

১১ ই নভেম্বর, ২০১৯ রাত ১:০৫

নুরুন নাহার লিলিয়ান বলেছেন: যে সৌন্দর্য অনেক প্রাণ কেড়ে নিয়েছে তাকে তো ভয়ংকর বলতেই হয় । ধন্যবাদ।

৩| ১১ ই নভেম্বর, ২০১৯ দুপুর ১:৩৭

মোহামমদ কামরুজজামান বলেছেন: আমিও ভ্রমণ এবং দেখা সম্পূর্ণ করলাম নায়াগ্রা জলপ্রপাত আপনার চোখের দেখা ,লেখার মাধ্যমে ।

বাঙালি হিসাবে,আপনার অতিথির (জাপানি বস) যত্ন নেওয়ার জন্য আমরা গর্ববোধ করি আপনার বোন এবং তার স্বামীর জন্য ।

চমৎকার ভ্রমণ কাহিনীর জন্য আপনাকে ধন্যবাদ ।

১১ ই নভেম্বর, ২০১৯ সন্ধ্যা ৬:২৩

নুরুন নাহার লিলিয়ান বলেছেন: সুন্দর মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।

৪| ১৫ ই নভেম্বর, ২০১৯ দুপুর ২:৫৮

রাজীব নুর বলেছেন: পোষ্ট টি উপভোগ করলাম।

৩০ শে ডিসেম্বর, ২০১৯ দুপুর ২:৩৪

নুরুন নাহার লিলিয়ান বলেছেন: ধন্যবাদ ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.