নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ওবায়দুল হক মাহমুদ

মোহাম্মদ ওবায়দুল হক মাহমুদ (মিঠু)। বৈচিত্রহীন বাঙ্গাল।

ওবায়দুল হক মাহমুদ › বিস্তারিত পোস্টঃ

আমার প্রিয় কবিতা (কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

১৪ ই অক্টোবর, ২০১২ সকাল ১১:৪৮

অন্তর মম বিকশিত করো

- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর



অন্তর মম বিকশিত করো

অন্তরতর হে।

নির্মল করো, উজ্জ্বল করো,

সুন্দর কর হে।

জাগ্রত করো, উদ্যত করো,

নির্ভয় করো হে।

মঙ্গল করো, নরলস নিঃসংশয় করো হে।

অন্তর মম বিকশিত করো,

অন্তরতর হে।



যুক্ত করো হে সবার সঙ্গে,

মুক্ত করো হে বন্ধ,

সঞ্চার করো সকল মর্মে

শান্ত তোমার ছন্দ।

চরণপদ্মে মম চিত নিঃস্পন্দিত করো হে,

নন্দিত করো, নন্দিত করো,

নন্দিত করো হে।

অন্তর মম বিকশিত করো

অন্তরতর হে।





পূজার সাজ

- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর



আশ্বিনের মাঝামাঝি উঠিল বাজনা বাজি,

পূজার সময় এল কাছে ।

মধু বিধু দুই ভাই ছুটাছুটি করে তাই

আনন্দে দু হাত তুলি নাচে ।



পিতা বসি ছিল দ্বারে ; দুজনে শুধালো তারে,

'কী পোশাক আনিয়াছ কিনে ।'

পিতা কহে, 'আছে আছে তোদের মায়ের কাছে,

দেখিতে পাইবি ঠিক দিনে ।'



সবুর সহে না আর - জননীরে বার বার

কহে, 'মা গো, ধরি তোর পায়ে,

বাবা আমাদের তরে কী কিনে এনেছে ঘরে

একবার দে-না, মা, দেখায়ে ।'

ব্যস্ত দেখি হাসিয়া মা দুখানি ছিটের জামা

দেখাইল করিয়া আদর ।

মধু কহে, 'আর নেই ?' মা কহিল, 'আছে এই

একজোড়া ধুতি ও চাদর ।'



রাগিয়া আগুন ছেলে - কাপড় ধুলায় ফেলে

কাঁদিয়া কহিল, 'চাহি না মা !

রায়বাবুদের গুপি পেয়েছে জরির টুপি

ফুলকাটা সাটিনের জামা ।'

মা কহিল, 'মধু, ছি ছি, কেন কাঁদ মিছামিছি !

গরিব যে তোমাদের বাপ ।

এবার হয় নি ধান, কত গেছে লোকসান,

পেয়েছেন কত দুঃখ তাপ ।

তবু দেখো বহু ক্লেশে তোমাদের ভালোবেসে

সাধ্যমত এনেছেন কিনে -

সে জিনিস অনাদরে ফেলিলি ধূলির 'পরে,

এই শিক্ষা হল এত দিনে !'



বিধু বলে, 'এ কাপড় পছন্দ হয়েছে মোর,

এই জামা পরাস আমারে !'

মধু শুনে আরো রেগে ঘর ছেড়ে দ্রুত বেগে

গেল রায়-বাবুদের দ্বারে ।

সেথা মেলা লোক জড়ো ; রায়বাবু ব্যস্ত বড়ো,

দালান সাজাতে গেছে রাত ।

মধু যবে এক কোণে দাঁড়াইল ম্লানমনে

চোখে তাঁর পড়িল হঠাৎ ।

কাছে ডাকি স্নেহভরে কহেন করুণ স্বরে

তারে দুই বাহুতে বাঁধিয়া,

'কী রে মধু, হয়েছে কী, তোরে যে শুকনো দেখি !'

শুনি মধু উঠিল কাঁদিয়া-

কহিল, 'আমার তরে বাবা আনিয়াছে ঘরে

শুধু এক ছিটের কাপড় !'

শুনি রায়-মহাশয় হাসিয়া মধুরে কয়,

'সেজন্য ভাবনা কিবা তোর !'

ছেলেরে ডাকিয়া চুপি কহিলেন, 'ওরে গুপি,

তোর জামা দে তুই মধুকে ।'

গুপির সে জামা পেয়ে মধু ঘরে যায় ধেয়ে,

হাসি আর নাহি ধরে মুখে ।



বুক ফুলাইয়া চলে, সবারে ডাকিয়া বলে,

'দেখো কাকা, দেখো চেয়ে মামা-

ওই আমাদের বিধু ছিট পরিয়াছে শুধু,

মোর গায়ে সাটিনের জামা ।'



মা শুনি কহেন আসি লাজে অশ্রুজলে ভাসি

কপালে করিয়া করাঘাত-

'হই দুঃখী হই দীন কাহারো রাখি না ঋণ,

কারো কাছে পাতি নাই হাত ।

তুমি আমাদেরি ছেলে ভিক্ষা লয়ে অবহেলে

অহংকার কর ধেয়ে ধেয়ে !

ছেঁড়া ধুতি আপনার ঢের বেশি দাম তার

ভিক্ষা-করা সাটিনের চেয়ে ।

আয় বিধু, আয় বুকে, চুমো খাই চাঁদমুখে-

তোর সাজ সব চেয়ে ভালো ।

দরিদ্র ছেলের দেহে দরিদ্র বাপের স্নেহে

ছিটের জামাটি করে আলো ।'





আমার মিলন লাগি তুমি

- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর



আমার মিলন লাগি তুমি

আসছ কবে থেকে।

তোমার চন্দ্র সূর্য তোমায়

রাখবে কোথায় ঢেকে।

কত কালের সকাল-সাঁঝে

তোমার চরণধ্বনি বাজে,

গোপনে দূত গৃহ-মাঝে

গেছে আমায় ডেকে।



ওগো পথিক, আজকে আমার

সকল পরাণ ব্যেপে

থেকে থেকে হরষ যেন

উঠছে কেঁপে কেঁপে

যেন সময় এসেছে আজ,

ফুরালো মোর যা ছিল কাজ -

বাতাস আসে, হে মহারাজ,

তোমার গন্ধ মেখে।







চিরায়মানা

- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর



যেমন আছ তেমনি এসো, আর কোরো না সাজ।

বেণী নাহয় এলিয়ে রবে, সিঁথি নাহয় বাঁকা হবে,

নাই-বা হল পত্রলেখায় সকল কারুকাজ।

কাঁচল যদি শিথিল থাকে নাইকো তাহে লাজ।

যেমন আছ তেমনি এসো, আর করো না সাজ।।



এসো দ্রুত চরণদুটি তৃণের 'পরে ফেলে।

ভয় কোরো না - অলক্তরাগ মোছে যদি মুছিয়া যাক,

নূপুর যদি খুলে পড়ে নাহয় রেখে এলে।

খেদ কোরো না মালা হতে মুক্তা খসে গেলে।

এসো দ্রুত চরণদুটি তৃণের 'পরে ফেলে।



হেরো গো ওই আঁধার হল, আকাশ ঢাকে মেঘে।

ও পার হতে দলে দলে বকের শ্রেণী উড়ে চলে,

থেকে থেকে শূন্য মাঠে বাতাস ওঠে জেগে।

ওই রে গ্রামের গোষ্ঠমুখে ধেনুরা ধায় বেগে।

হেরো গো ওই আঁধার হল, আকাশ ঢাকে মেঘে।।



প্রদীপখানি নিবে যাবে, মিথ্যা কেন জ্বালো?

কে দেখতে পায় চোখের কাছে কাজল আছে কি না আছে,

তরল তব সজল দিঠি মেঘের চেয়ে কালো।

আঁখির পাতা যেমন আছে এমনি থাকা ভালো।

কাজল দিতে প্রদীপখানি মিথ্যা কেন জ্বালো?।



এসো হেসে সহজ বেশে, আর কোরো না সাজ।

গাঁথা যদি না হয় মালা ক্ষতি তাহে নাই গো বালা,

ভূষণ যদি না হয় সারা ভূষণে নাই কাজ।

মেঘ মগন পূর্বগগন, বেলা নাই রে আজ।

এসো হেসে সহজ বেশে, নাই-বা হল সাজ।।







দুই বিঘা জমি

- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর



শুধু বিঘে-দুই ছিল মোর ভুঁই, আর সবই গেছে ঋণে।

বাবু বলিলেন, 'বুঝেছ উপেন? এ জমি লইব কিনে।'

কহিলাম আমি, 'তুমি ভূস্বামী, ভূমির অন্ত নাই -

চেয়ে দেখো মোর আছে বড়জোর মরিবার মতো ঠাঁই।

শুনি রাজা কহে, 'বাপু, জানো তো হে, করেছি বাগানখানা,

পেলে দুই বিঘে প্রস্থে ও দিঘে সমান হইবে টানা -

ওটা দিতে হবে।' কহিলাম তবে বক্ষে জুড়িয়া পাণি

সজল চক্ষে, 'করুন রক্ষে গরিবের ভিটেখানি।

সপ্তপুরুষ যেথায় মানুষ সে মাটি সোনার বাড়া,

দৈন্যের দায়ে বেচিব সে মায়ে এমনি লক্ষ্মীছাড়া!'

আঁখি করি লাল রাজা ক্ষণকাল রহিল মৌনভাবে,

কহিলেন শেষে ক্রুর হাসি হেসে, 'আচ্ছা, সে দেখা যাবে।'



পরে মাস-দেড়ে ভিটে মাটি ছেড়ে বাহির হইনু পথে -

করিল ডিক্রি, সকলই বিক্রি মিথ্যা দেনার খতে।

এ জগতে হায় সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি,

রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি।

মনে ভাবিলাম, মোরে ভগবান রাখিবে না মোহগর্তে,

তাই লিখি দিল বিশ্বনিখিল দু বিঘার পরিবর্তে।

সন্ন্যাসীবেশে ফিরি দেশে দেশে হইয়া সাধুর শিষ্য -

কত হেরিলাম মনোহর ধাম, কত মনোরম দৃশ্য।

ভূধরে সাগরে বিজনে নগরে যখন যেখানে ভ্রমি

তবু নিশিদিনে ভুলিতে পারি নে সেই দুই বিঘা জমি।

হাটে মাঠে বাটে এইমত কাটে বছর পনেরো-ষোলো,

একদিন শেষে ফিরিবারে দেশে বড়োই বাসনা হল।।



নমোনমো নম, সুন্দরী মম জননী বঙ্গভূমি!

গঙ্গার তীর, স্নিগ্ধ সমীর জীবন জুড়ালে তুমি।

অবারিত মাঠ, গগনললাট চুমে তব পদধুলি -

ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড় ছোটো ছোটো গ্রামগুলি।

পল্লবঘন আম্রকানন, রাখালের খেলাগেহ -

স্তব্ধ অতল দিঘি কালোজল নিশীথশীতলস্নেহ।

বুক-ভরা-মধু বঙ্গের বধু জল লয়ে যায় ঘরে

মা বলিতে প্রাণ করে আনচান, চোখে আসে জল ভরে।

দুই দিন পরে দ্বিতীয় প্রহরে প্রবেশিনু নিজগ্রামে -

কুমোরের বাড়ি দক্ষিণে ছাড়ি, রথতলা করি বামে,

রাখি হাটখোলা নন্দীর গোলা, মন্দির করি পাছে

তৃষাতুর শেষে পঁহুছিনু এসে আমার বাড়ির কাছে।।



ধিক্ ধিক্ ওরে, শত ধিক্ তোরে নিলাজ কুলটা ভূমি,

যখনি যাহার তখনি তাহার - এই কি জননী তুমি!

সে কি মনে হবে একদিন যবে ছিলে দরিদ্রমাতা

আঁচল ভরিয়া রাখিতে ধরিয়া ফলফুল শাক-পাতা!

আজ কোন্ রীতে কারে ভুলাইতে ধরেছ বিলাসবেশ -

পাঁচরঙা পাতা অঞ্চলে গাঁথা, পুষ্পে খচিত কেশ!

আমি তোর লাগি ফিরেছি বিবাগি গৃহহারা সুখহীন,

তুই হেথা বসি ওরে রাক্ষসী, হাসিয়া কাটাস দিন!

ধনীর আদরে গরব না ধরে! এতই হয়েছ ভিন্ন -

কোনোখানে লেশ নাহি অবশেষ সে দিনের কোনো চিহ্ন!

কল্যাণময়ী ছিলে তুমি অয়ী, ক্ষুধাহরা সুধারাশি।

যত হাসো আজ, যত করো সাজ, ছিলে দেবী - হলে দাসী।।



বিদীর্ণহিয়া ফিরিয়া ফিরিয়া চারি দিকে চেয়ে দেখি -

প্রাচীরের কাছে এখনো যে আছে সেই আমগাছ একি!

বসি তার তলে নয়নের জলে শান্ত হইল ব্যথা,

একে একে মনে উদিল স্মরণে বালককালের কথা।

সেই মনে পড়ে, জ্যৈষ্ঠের ঝড়ে রাত্রে নাহিকো ঘুম,

অতি ভোরে উঠি তাড়াতাড়ি ছুটি আম কুড়াবার ধুম।

সেই সুমধুর স্তব্ধ দুপুর, পাঠশালা-পলায়ন -

ভাবিলাম হায়, আর কি কোথায় ফিরে পাব সে জীবন।

সহসা বাতাস ফেলি গেল শ্বাস শাখা দুলাইয়া গাছে,

দুটি পাকা ফল লভিল ভূতল আমার কোলের কাছে।

ভাবিলাম মনে, বুঝি এতখনে আমারে চিনিল মাতা।

স্নেহের সে দানে বহু সম্মানে বারেক ঠেকানু মাথা।।



হেনকালে হায় যমদূতপ্রায় কোথা হতে এল মালী।

ঝুঁটিবাঁধা উড়ে সপ্তম সুরে পাড়িতে লাগিল গালি।

কহিলাম তবে, 'আমি তো নীরবে দিয়েছি আমার সব -

দুটি ফল তার করি অধিকার, এত তারি কলরব।'

চিনিল না মোরে, নিয়ে গেল ধরে কাঁধে তুলি লাঠিগাছ;

বাবু ছিপ হাতে পারিষদ-সাথে ধরিতেছিলেন মাছ -

শুনে বিবরণ ক্রোধে তিনি কন, 'মারিয়া করিব খুন।'

বাবু যত বলে পারিষদ-দলে বলে তার শতগুণ।

আমি কহিলাম, 'শুধু দুটি আম ভিখ মাগি মহাশয়!'

বাবু কহে হেসে, 'বেটা সাধুবেশে পাকা চোর অতিশয়!'

আমি শুনে হাসি, আঁখিজলে ভাসি, এই ছিল মোরে ঘটে -

তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে।।







সোনার তরী

- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর



গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা।

কূলে একা বসে আছি, নাহি ভরসা।

রাশি রাশি ভারা ভারা

ধান-কাটা হল সারা,

ভরা নদী ক্ষুরধারা

খরপরশা--

কাটিতে কাটিতে ধান এল বরষা॥



একখানি ছোটো খেত, আমি একেলা---

চারি দিকে বাঁকা জল করিছে খেলা।

পরপারে দেখি আঁকা

তরুছায়ামসী-মাখা

গ্রামখানি মেঘে ঢাকা

প্রভাতবেলা---

এপারেতে ছোটো খেত, আমি একেলা॥



গান গেয়ে তরী বেয়ে কে আসে পারে!

দেখে যেন মনে হয়, চিনি উহারে।

ভরা পালে চলে যায়,

কোনো দিকে নাহি চায়,

ঢেউগুলি নিরুপায়

ভাঙে দু ধারে---

দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে॥



ওগো, তুমি কোথা যাও কোন্‌ বিদেশে?

বারেক ভিড়াও তরী কূলেতে এসে।

যেয়ো যেথা যেতে চাও,

যারে খুশি তারে দাও---

শুধু তুমি নিয়ে যাও

ক্ষণিক হেসে

আমার সোনার ধান কূলেতে এসে॥



যত চাও তত লও তরণী-পরে।

আর আছে?--- আর নাই, দিয়েছি ভরে॥

এতকাল নদীকূলে

যাহা লয়ে ছিনু ভুলে

সকলি দিলাম তুলে

থরে বিথরে---

এখন আমারে লহো করুণা ক'রে॥



ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই, ছোটো সে তরী

আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।

শ্রাবণগগন ঘিরে

ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে,

শূন্য নদীর তীরে

রহি নু পড়ি---

যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী॥

মন্তব্য ০ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.