![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সকল অন্যায়ের অবিচারের বিরুদ্ধাচরণে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ
ছেলেটির নাম ছিল জাভেদ; আমার প্রাইমারী লেভেলের বন্ধু। স্কুলের যে সব বন্ধুদের সাথে রেডি খেলার জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকতাম তার মধ্যে সে ছিল অন্যতম। দুজনের বাসা একই পাড়ায় হওয়ায় আমাদের মাঝে অন্য রকম সখ্যতা ছিল। স্কুলের ছুটির ঘন্টা বাজলেই দুজন বস্তা আইসক্রিম হাতে নিয়ে বাসার পথে ভৌ দৌড় দিতাম।
জাভেদদের অর্থনৈতিক অবস্থা খুব একটা ভাল ছিল না। একটা সময় অর্থনৈতিক দুর্দশায় তার স্কুলে আসা বন্ধ হয়ে যায়। অনেকদিন স্কুলে না আসায় একদিন কিছু বন্ধুরা মিলে ওর বাড়িতে যাই। গিয়ে জানতে পারি ও একটা গ্যারেজে কাজ করা শুরু করেছে। স্কুলে নাকি আর পড়বে না। একথা শুনে মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। মনে মনে জাভেদের মাকে অনেক গাল দিয়েছিলাম। ছোট্ট মানুষ ছিলাম বলেই হয়তো ইমোশনটা বেশী ছিল। তাই ওদের নির্মম বাস্তবতা বুঝতে চেস্টা করি নি।
এর কিছুদিন পর আমি স্কুল পাল্টাই; জাভেদ যে গ্যারেজে কাজ করতো সেটা আমার স্কুলে যাওয়ার পথেই পড়তো। মাঝে মাঝে দেখা হতো ওর সাথে। গ্যারেজে কাজ করায় ওর শার্টে সবসময় কালি লেগে থাকতো। দেখা হলেই আমাকে বন্ধুদের কথা জিজ্ঞেস করতো; স্কুলের স্যারদের কথা জিজ্ঞেস করতো। স্যারদের মারের কথা উঠলেই বলতো -স্কুল ছেড়ে দিয়ে ভালোই নাকি করেছে সে; স্যারদের মার খেয়ে স্কুলে পড়ার কোন মানে হয় না; এইখানে মাস শেষে কিছু টাকা পায়। কাজ শেখে ঐটাই ভাল।
একদিন গ্যারেজে গিয়ে ওকে আর খুজে পায় না। গ্যারেজের লোকদের জিজ্ঞেস করলে তারা জানায় জাভেদ আর ঐখানে কাজ করে না। সে নাকি নতুন এক ফ্যাক্টরিতে ঢুকছে। এ কথা শুনার পর আমি বের হয়ে আসি। তারপর জাভেদের সাথে দেখা হওয়া বন্ধ হয়ে যায়।
২০০০ সালের দিকে এক প্লাস্টিক কারখানায় আগুন লাগে। খুব সম্ভবত তৎক্ষণাৎ ১১ জন পুড়ে মারা যায়। দুঃখজনক ব্যাপার ছিল ১১ জনের ৬ জনই ছিল আমাদের এলাকার। তাই সেবার এলাকা জুড়ে শোকের মাতম হয়েছিল । টানা কয়েকদিন গভীররাতে বারনিং ইউনিট থেকে এক একটা পোড়া লাশ আনতো। এনে আমাদের বাসার সামনের গ্যারেজে রাখতো। বাসার সামনে বড় মাঠ ছিল; সেটাতে জানাজা পড়ানো হতো।
লাশের মিছিল যখন থামবে থামবে করছে ; তখনই এলাকায় খবর আসে আরেকটি ছেলে মৃত্যুশয্যায় কাতরাচ্ছে; আজ রাতেই নাকি মারা যেতে পারে। আম্মা মারফত জানতে পারি ছেলেটি জাভেদ। আমার সেই ছোটবেলার বন্ধু। বিকেলেই জাভেদ মারা যায়; সন্ধ্যায় যথারীতি লাশ আমার বাসার সামনে এনে রাখে। বহুত চেস্টা করেছিলাম ওর লাশ দেখার। কিন্তু ছোট ছিলাম বিধায় তখন ওর লাশ দেখতে দেয়া হয় নি। পড়ে চাচার মুখে শুনেছিলাম ওর মুখটা নাকি পচে গিয়েছিল; চেহারা নাকি এতো বীভৎস হয়েছিল যে চেনা যাচ্ছিল না।
ওর মৃত্যুর পর অনেকদিন চরম ভয়ে দিন কেটেছে। রাতে ঘুমাতে পারতাম না। এ রুম থেকে ও রুমে যেতে পারতাম না। একা বাথরুমে যেতে পারতাম না। টেবিলে পড়তে বসলে মনে হতো আমাকে পেছন থেকে ডাকছে। মোটকথায় মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম। সত্যি বলতে ঐ ঘটনার রেশ এখনো আমাকে তাড়া করে। এখনো ঘুমালে মাঝে মধ্যে অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন বাজানোর দৃশ্য; গ্যারেজে লাশ রাখার দৃশ্য দেখতে পাই। তারপর ভয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠি :
(অফটপিকঃ আমরা আবেগে শিশুশ্রম বন্ধ করার কথা বলি; আবেগ দিয়ে বাস্তব চলে নারে ভাই; বাস্তব বড়ই নির্মম; কোন বাবা মা অন্তর থেকে চায় না যে তার ছেলে স্কুলে যাওয়া বাদ দিয়ে গ্যারেজে; কারখানায় কাজ করুক। একমাত্র অর্থনৈতিক মুক্তি ছাড়া শিশুশ্রম বন্ধ অসম্ভব।)
©somewhere in net ltd.