নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

এই পৃথিবীকে নতুন শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি

সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে,শোন শোন পিতা,কহ কানে কানে,শোনাও প্রাণে প্রাণে মঙ্গল বারতা.........।

অপরাজিতা মুন্নি

কতোটা পথ পেরুলে তবে পথিক বলা যায় ......

অপরাজিতা মুন্নি › বিস্তারিত পোস্টঃ

হুমায়ুন আজাদের কয়েকটি জনপ্রিয় কবিতা

১৪ ই নভেম্বর, ২০১৩ ভোর ৫:৩১



ভালো থেকো



ভালো থেকো ফুল, মিষ্টি বকুল, ভালো থেকো।

ভালো থেকো ধান, ভাটিয়ালি গান, ভালো থেকো।

ভালো থেকো মেঘ, মিটিমিটি তারা।

ভালো থেকো পাখি, সবুজ পাতারা।

ভালো থেকো।



ভালো থেকো চর, ছোট কুড়ে ঘর, ভালো থেকো।

ভালো থেকো চিল, আকাশের নীল, ভালো থেকো।

ভালো থেকো পাতা, নিশির শিশির।

ভালো থেকো জল, নদীটির তীর।

ভালো থেকো গাছ, পুকুরের মাছ, ভালো থেকো।

ভালো থেকো কাক, কুহুকের ডাক, ভালো থেকো।

ভালো থেকো মাঠ, রাখালের বাশিঁ।

ভালো থেকো লাউ, কুমড়োর হাসি।

ভালো থেকো আম, ছায়া ঢাকা গ্রাম, ভালো থেকো।

ভালো থেকো ঘাস, ভোরের বাতাস, ভালো থেকো।

ভালো থেকো রোদ, মাঘের কোকিল,

ভালো থেকো বক, আড়িয়ল বিল,

ভালো থেকো নাও, মধুমতি গাও,ভালো থেকো।

ভালো থেকো মেলা, লাল ছেলেবেলা, ভালো থেকো।

ভালো থেকো, ভালো থেকো, ভালো থেকো ।





সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে



আমি জানি সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে।

নষ্টদের দানবমুঠোতে ধরা পড়বে মানবিক

সব সংঘ-পরিষদ; চলে যাবে, অত্যন্ত উল্লাসে

চ’লে যাবে এই সমাজ-সভ্যতা-সমস্ত দলিল

নষ্টদের অধিকারে ধুয়েমুছে, যে-রকম রাষ্ট্র

আর রাষ্ট্রযন্ত্র দিকে দিকে চলে গেছে নষ্টদের

অধিকারে। চ’লে যাবে শহর বন্দর ধানক্ষেত

কালো মেঘ লাল শাড়ি শাদা চাঁদ পাখির পালক

মন্দির মসজিদ গির্জা সিনেগগ পবিত্র প্যাগোডা।

অস্ত্র আর গণতন্ত্র চ’লে গেছে, জনতাও যাবে;

চাষার সমস্ত স্বপ্ন আস্তাকুড়ে ছুঁড়ে একদিন

সাধের সমাজতন্ত্রও নষ্টদের অধিকারে যাবে।



আমি জানি সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে।

কড়কড়ে রৌদ্র আর গোলগাল পূর্ণিমার চাঁদ

নদীরে পাগল করা ভাটিয়ালি খড়ের গম্বুজ

শ্রাবণের সব বৃষ্টি নষ্টদের অধিকারে যাবে।

রবীন্দ্রনাথের সব জ্যোৎস্না আর রবিশংকরের

সমস্ত আলাপ হৃদয়স্পন্দন গাথা ঠোঁটের আঙুর

ঘাইহরিণীর মাংসের চিৎকার মাঠের রাখাল

কাশবন একদিন নষ্টদের অধিকারে যাবে।

চলে যাবে সেই সব উপকথাঃ সৌন্দর্য-প্রতিভা-মেধা;

এমনকি উন্মাদ ও নির্বোধদের প্রিয় অমরতা

নির্বাধ আর উন্মাদদের ভয়ানক কষ্ট দিয়ে

অত্যন্ত উল্লাসভরে নষ্টদের অধিকারে যাবে।



আমি জানি সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে।

সবচে সুন্দর মেয়ে দুইহাতে টেনে সারারাত

চুষবে নষ্টের লিঙ্গ; লম্পটের অশ্লীল উরুতে

গাঁথা থাকবে অপার্থিব সৌন্দর্যের দেবী। চ’লে যাবে,

কিশোরীরা চ’লে যাবে, আমাদের তীব্র প্রেমিকারা

ওষ্ঠ আর আলিঙ্গন ঘৃণা ক’রে চ’লে যাবে, নষ্টদের

উপপত্নী হবে। এই সব গ্রন্থ শ্লোক মুদ্রাযন্ত্র

শিশির বেহালা ধান রাজনীতি দোয়েলের স্বর

গদ্য পদ্য আমার সমস্ত ছাত্রী মার্ক্স-লেনিন,

আর বাঙলার বনের মত আমার শ্যামল কন্যা-

রাহুগ্রস্থ সভ্যতার অবশিষ্ট সামান্য আলোক

আমি জানি তারা সব নষ্টদের অধিকারে যাবে।





বাঙলাদেশের কথা (আমরা কি এই বাঙলাদেশ চেয়েছিলাম)





যখন আমরা বসি মুখোমুখি, আমাদের দশটি আঙুল হৃৎপিন্ডের মতো কাঁপতে থাকে

দশটি আঙুলে, আমাদের ঠোঁটের গোলাপ ভিজে ওঠে আরক্ত শিশিরে,

যখন আমরা আশ্চর্য আঙুলে জ্বলি, যখন আমরাই পরষ্পরের স্বাধীন স্বদেশ,

তখন ভুলেও কখনো আমাকে তুমি বাঙলাদেশের কথা জিজ্ঞেস করো না;

আমি তা মূহূর্তেও সহ্য করতে পারি না, -তার অনেক কারণ রয়েছে।

তোমাকে মিনতি করি কখনো আমাকে তুমি বাঙলাদেশের কথা তুলে কষ্ট দিয়ো না।

জানতে চেয়ো না তুমি নষ্টভ্রষ্ট ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইলের কথা, তার রাজনীতি,

অর্থনীতি, ধর্ম, পাপ, মিথ্যাচার, পালে পালে মনুষ্যমন্ডলি, জীবনযাপন, হত্যা, ধর্ষণ,

মধ্যযুগের দিকে অন্ধের মতোন যাত্রা সম্পর্কে প্রশ্ন ক’রে আমাকে পীড়ন কোরো না;

আমি তা মুহূর্তেও সহ্য করতে পারি না, – তার অনেক কারণ রয়েছে ।



তোমাকে মিনতি করি কখনো আমাকে তুমি বাঙলাদেশের কথা তুলে কষ্ট দিয়ো না।

জানতে চেয়ো না তুমি নষ্ট ভ্রষ্ট ছাপ্পান্ন হাজার বর্গ

মাইলের কথা: তার রাজনীতি

অর্থনীতি, ধর্ম, পাপ, মিথ্যাচার, পালে পালে মনুষ্যম-লী

জীবনযাপন, হত্যা, ধর্ষণ

মধ্যযুগের দিকে অন্ধের মতোন যাত্রা সম্পর্কে প্রশ্ন

করে আমাকে পীড়ন কোরো না





তার ধানক্ষেত এখনো সবুজ, নারীরা এখনো রমনীয়, গাভীরা এখনো দুগ্ধবতী,

কিন্তু প্রিয়তমা, বাঙলাদেশের কথা তুমি কখনো আমার কাছে জানতে চেয়ো না;

আমি তা মুহূর্তেও সহ্য করতে পারি না, তার অনেক কারণ রয়েছে।







আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে



আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে।

আমার খাদ্যে ছিল অন্যদের আঙুলের দাগ,

আমার পানীয়তে ছিল অন্যদের জীবাণু,

আমার বিশ্বাসে ছিল অন্যদের ব্যাপক দূষণ।

আমি জন্মেছিলাম আমি বেড়ে উঠেছিলাম

আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে।

আমি দাঁড়াতে শিখেছিলাম অন্যদের মতো,

আমি হাঁটতে শিখেছিলাম অন্যদের মতো,

আমি পোশাক পরতে শিখেছিলাম অন্যদের মতো ক’রে,

আমি চুল আঁচড়াতে শিখেছিলাম অন্যদের মতো ক’রে,

আমি কথা বলতে শিখেছিলাম অন্যদের মতো।

তারা আমাকে তাদের মতো করে দাঁড়াতে শিখিয়েছিলো,

তারা আমাকে তাদের মতো করে হাঁটার আদেশ দিয়েছিলো,

তারা আমাকে তাদের মতো করে পোশাক পরার নির্দেশ দিয়েছিলো,

তারা আমাকে বাধ্য করেছিলো তাদের মতো করে চুল আঁচড়াতে,

তারা আমার মুখে গুজে দিয়েছিলো তাদের দূষিত কথামালা।

তারা আমাকে বাধ্য করেছিল তাদের মতো করে বাঁচতে।

আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে।

আমি আমার নিজস্ব ভঙ্গিতে দাঁড়াতে চেয়েছিলাম,

আমি পোশাক পরতে চেয়েছিলাম একান্ত আপন রীতিতে,

আমি চুল আঁচড়াতে চেয়েছিলাম নিজের রীতিতে,

আমি উচ্চারন করতে চেয়েছিলাম আন্তর মৌলিক মাতৃভাষা।

আমি নিতে চেয়েছিলাম নিজের নিশ্বাস।

আমি আহার করতে চেয়েছিলাম আমার একান্ত মৌলিক খাদ্য,

আমি পান করতে চেয়েছিলাম আমার মৌলিক পানীয়।

আমি ভুল সময়ে জন্মেছিলাম। আমার সময় তখনো আসে নি।

আমি ভুল বৃক্ষে ফুটেছিলাম। আমার বৃক্ষ তখনো অঙ্কুরিত হয় নি।

আমি ভুল নদীতে স্রোত হয়ে বয়েছিলাম। আমার মেঘ তখনো আকাশে জমে নি।

আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে।

আমি গান গাইতে চেয়েছিলাম আপন সুরে,

ওরা আমার কন্ঠে পুরে দিতে চেয়েছিলো ওদের শ্যাওলা-পড়া সুর।

আমি আমার মতো স্বপ্ন দেখতে চেয়েছিলাম,

ওরা আমাকে বাধ্য করেছিলো ওদের মতো ময়লা-ধরা স্বপ্ন দেখতে।

আমি আমার মতো দাঁড়াতে চেয়েছিলাম,

ওরা আমাকে নির্দেশ দিয়েছিলো ওদের মতো মাথা নিচু করে দাঁড়াতে।

আমি আমার মতো কথা বলতে চেয়েছিলাম,

ওরা আমার মুখে ঢুকিয়ে দিতে চেয়েছিলো ওদের শব্দ ও বাক্যের আবর্জনা।

আমি খুব ভেতরে ঢুকতে চেয়েছিলাম,

ওরা আমাকে ওদের মতো করেই দাঁড়িয়ে থাকতে বলেছিলো বাইরে।

ওরা মুখে এক টুকরো বাসি মাংস পাওয়াকে বলতো সাফল্য,

ওরা নতজানু হওয়াকে ভাবত গৌরব,

ওরা পিঠের কুঁজকে মনে করতো পদক,

ওরা গলার শেকলকে মনে করতো অমূল্য অলংকার।

আমি মাংসের টুকরা থেকে দূরে ছিলাম। এটা ওদের সহ্য হয় নি।

আমি নতজানু হওয়ার বদলে নিগ্রহকে বরণ করেছিলাম। এটা ওদের সহ্য হয় নি।

আমি পিঠ কুঁজের বদলে বুকে ছুরিকাকে সাদর করেছিলাম। এটা ওদের সহ্য হয় নি।

আমি গলার বদলে হাতেপায়ে শেকল পড়েছিলাম। এটা ওদের সহ্য হয় নি।

আমি অন্যদের সময়ে বেঁচে ছিলাম। আমার সময় তখনো আসেনি।

ওদের পুকুরে প্রথাগত মাছের কোনো অভাব ছিলো না,

ওদের জমিতে অভাব ছিলো না প্রথাগত শস্য ও শব্জির,

ওদের উদ্যানে ছিলো প্রথাগত পুষ্পের উল্লাস।

আমি ওদের সময়ে আমার মতো দিঘি খুঁড়েছিলাম ব’লে

আমার দিঘিতে পানি ওঠে নি।

আমি ওদের সময়ে আমার মতো চাষ করেছিলাম ব’লে

আমার জমিতে শস্য জন্মে নি।

আমি ওদের সময়ে আমার মতো বাগান করতে চেয়েছিলাম ব’লে

আমার ভবিষ্যতের বাগানে একটিও ফুল ফোটে নি।

তখনো আমার দিঘির জন্য পানি উৎসারণের সময় আসে নি।

তখনো আমার জমির জন্য নতুন ফসলের সময় আসে নি।

তখনো আমার বাগানের জন্যে অভিনব ফুলের মরশুম আসে নি।

আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে।

আমার সবকিছু পর্যবসিত হয়েছে ভবিষ্যতের মতো ব্যর্থতায়,

ওরা ভ’রে উঠেছে বর্তমানের মতো সাফল্যে।

ওরা যে-ফুল তুলতে চেয়েছে, তা তুলে এনেছে নখ দিয়ে ছিঁড়েফেড়ে।

আমি শুধু স্বপ্নে দেখেছি আশ্চর্য ফুল।

ওরা যে-তরুণীকে জরিয়ে ধরতে চেয়েছে তাকে ধরেছে দস্যুর মতো।

আমার তরুণীকে আমি জরিয়ে ধরেছি শুধু স্বপ্নে।

ওরা যে-নারীকে কামনা করেছে, তাকে ওরা বধ করেছে বাহুতে চেপে।

আমার নারীকে আমি পেয়েছি শুধু স্বপ্নে।

চুম্বনে ওরা ব্যবহার করেছে নেকড়ের মতো দাঁত।

আমি শুধু স্বপ্নে বাড়িয়েছি ওষ্ঠ।

আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে।

আমার চোখ যা দেখতে চেয়েছিলো, তা দেখতে পায় নি।

তখনো আমার সময় আসে নি।

আমার পা যে-পথে চলতে চেয়েছিলো, সে পথে চলতে পারে নি।

তখনো আমার সময় আসে নি।

আমার হৃদয় যা নিবেদন করতে চেয়েছিলো, তা নিবেদন করতে পারে নি।

তখনো আমার সময় আসে নি।

আমার কর্ণকুহর যে-সুর শুনতে চেয়েছিলো, তা শুনতে পায় নি।

তখনো আমার সময় আসে নি।

আমার ত্বক যার ছোঁয়া পেতে চেয়েছিলো, তার ছোঁয়া পায় নি।

তখনো আমার সময় আসে নি।

আমি যে পৃথিবীকে চেয়েছিলাম, তাকে আমি পাই নি।

তখনো আমার সময় আসে নি। তখনো আমার সময় আসে নি।

আমি বেঁচে ছিলাম

অন্যদের সময়ে।







আমি সম্ভবত খুব ছোট কিছুর জন্য





আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্য মারা যাবো

ছোট ঘাসফুলের জন্যে

একটি টলোমলো শিশিরবিন্দুর জন্যে

আমি হয়তো মারা যাবো চৈত্রের বাতাসে

উড়ে যাওয়া একটি পাঁপড়ির জন্যে

একফোঁটা বৃষ্টির জন্যে



আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্যে মারা যাবো

দোয়েলের শিসের জন্যে

শিশুর গালের একটি টোলের জন্যে

আমি হয়তো মারা যাবো কারো চোখের মণিতে

গেঁথে থাকা একবিন্দু অশ্রুর জন্যে

একফোঁটা রৌদ্রের জন্যে



আমি সম্ভবতখুব ছোট্ট কিছুর জন্যে মারা যাবো

এক কণা জ্যোৎস্নার জন্যে

এক টুকরো মেঘের জন্যে

আমি হয়তো মারা যাবো টাওয়ারের একুশ তলায়

হারিয়ে যাওয়া একটি প্রজাপতির জন্যে

এক ফোঁটা সবুজের জন্যে



আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্যে মারা যাবো

খুব ছোট একটি স্বপ্নের জন্যে

খুব ছোট দুঃখের জন্যে

আমি হয়তো মারা যাবো কারো ঘুমের ভেতরে

একটি ছোটো দীর্ঘশ্বাসের জন্যে

একফোঁটা সৌন্দর্যের জন্যে





আমাদের মা





আমাদের মাকে আমরা বলতাম তুমি, বাবাকে আপনি।

আমাদের মা গরিব প্রজার মত দাঁড়াতো বাবার সামনে,

কথা বলতে গিয়ে কখনোই কথা শেষ ক’রে উঠতে পারতোনা।

আমাদের মাকে বাবার সামনে এমন তুচ্ছ দেখাতো যে

মাকে আপনি বলার কথা আমাদের কোনোদিন মনেই হয়নি।

আমাদের মা আমাদের থেকে বড় ছিলো, কিন্তু ছিলো আমাদের সমান।

আমাদের মা ছিলো আমাদের শ্রেনীর, আমাদের বর্ণের, আমাদের গোত্রের।

বাবা ছিলেন অনেকটা আল্লার মতো, তার জ্যোতি দেখলে আমরা সেজদা দিতাম

বাবা ছিলেন অনেকটা সিংহের মতো, তার গর্জনে আমরা কাঁপতে থাকতাম

বাবা ছিলেন অনেকটা আড়িয়াল বিলের প্রচন্ড চিলের মতো, তার ছায়া দেখলেই

মুরগির বাচ্চার মতো আমরা মায়ের ডানার নিচে লুকিয়ে পড়তাম।

ছায়া সরে গেলে আবার বের হয়ে আকাশ দেখতাম।

আমাদের মা ছিলো অশ্রুবিন্দু-দিনরাত টলমল করতো

আমাদের মা ছিলো বনফুলের পাপড়ি;-সারাদিন ঝরে ঝরে পড়তো,

আমাদের মা ছিলো ধানখেত-সোনা হয়ে দিকে দিকে বিছিয়ে থাকতো।

আমাদের মা ছিলো দুধভাত-তিন বেলা আমাদের পাতে ঘন হয়ে থাকতো।

আমাদের মা ছিলো ছোট্ট পুকুর-আমরা তাতে দিনরাত সাঁতার কাটতাম।

আমাদের মার কোনো ব্যক্তিগত জীবন ছিলো কিনা আমরা জানি না।

আমাদের মাকে আমি কখনো বাবার বাহুতে দেখি নি।

আমি জানি না মাকে জড়িয়ে ধরে বাবা কখনো চুমু খেয়েছেন কি না

চুমু খেলে মার ঠোঁট ওরকম শুকনো থাকতো না।

আমরা ছোট ছিলাম, কিন্তু বছর বছর আমরা বড় হতে থাকি,

আমাদের মা বড় ছিলো, কিন্তু বছর বছর মা ছোটো হতে থাকে।

ষষ্ঠ শ্রেনীতে পড়ার সময়ও আমি ভয় পেয়ে মাকে জড়িয়ে ধরতাম।

সপ্তম শ্রেনীতে ওঠার পর ভয় পেয়ে মা একদিন আমাকে জড়িয়ে ধরে।

আমাদের মা দিন দিন ছোটো হতে থাকে

আমাদের মা দিন দিন ভয় পেতে থাকে।

আমাদের মা আর বনফুলের পাপড়ি নয়, সারাদিন ঝরে ঝরে পড়েনা

আমাদের মা আর ধানখেত নয়, সোনা হয়ে বিছিয়ে থাকে না

আমাদের মা আর দুধভাত নয়, আমরা আর দুধভাত পছন্দ করিনা

আমাদের মা আর ছোট্ট পুকুর নয়, পুকুরে সাঁতার কাটতে আমরা কবে ভুলে গেছি।

কিন্তু আমাদের মা আজো অশ্রুবিন্দু, গ্রাম থেকে নগর পর্যন্ত

আমাদের মা আজো টলমল করে।









গোলামের গর্ভধারিণী





আপনাকে দেখিনি আমি; তবে আপনি

আমার অচেনা

নন পুরোপুরি, কারণ বাঙলার

মায়েদের আমি

মোটামুটি চিনি, জানি। হয়তো

গরিব পিতার ঘরে

বেড়ে উঠেছেন দুঃক্ষিণী

বালিকারূপে ধীরেধীরে;

দুঃক্ষের সংসারে কুমড়ো ফুলের

মতো ফুটেছেন

ঢলঢল, এবং সন্ত্রস্ত ক’রে

তুলেছেন মাতা

ও পিতাকে। গরিবের ঘরে ফুল

ভয়েরই কারণ।

তারপর একদিন ভাঙা পালকিতে চেপে

দিয়েছেন

পাড়ি, আর এসে উঠেছেন আরেক গরিব

ঘরে;

স্বামীর আদর হয়তো ভাগ্যে

জুটেছে কখনো, তবে

অনাদর জুটেছে অনেক। দারিদ্র্য,

পীড়ন, খণ্ড

প্রেম, ঘৃণা, মধ্যযুগীয়

স্বামীর জন্যে প্রথাসিদ্ধ

ভক্তিতে আপনার কেটেছে জীবন।

বঙ্গীয় নারীর

আবেগে আপনিও চেয়েছেন বুক জুড়ে

পুত্রকন্যা,

আপনার মরদ বছরে একটা নতুন

ঢাকাই

শাড়ি দিতে না পারলেও বছরে বছরে

উপহার

দিয়েছেন আপনাকে একের পর এক

কৃশকায়

রুগ্ন সন্তান, এবং তাতেই আপনার

শুষ্ক বুক

ভাসিয়ে জেগেছে তিতাসের তীব্র

জলের উচ্ছ্বাস।

চাঁদের সৌন্দর্য নয়, আমি জানি

আপনাকে মুগ্ধ

আলোড়িত বিহ্বল করেছে সন্তানের

স্নিগ্ধ মুখ,

আর দেহের জ্যোৎস্না। আপনিও

চেয়েছেন জানি

আপনার পুত্র হবে সৎ, প্রকৃত

মানুষ। তাকে

দারিদ্র্যের কঠোর কামড় টলাবে

না সততার

পথ থেকে, তার মেরুদণ্ড হবে দৃঢ়,

পীড়নে বা

প্রলোভনে সে কখনো বুটদের সেজদা

করবে না।

আপনার উচ্চাভিলাষ থাকার তো কথা

নয়, আপনি

আনন্দিত হতেন খুবই আপনার পুত্র

যদি হতো

সৎ কৃষিজীবী, মেরুদণ্ডসম্পন্ন

শ্রমিক, কিংবা

তিতাসের অপরাজেয় ধীবর। আপনি

উপযুক্ত

শিক্ষা দিতে পারেন নি

সন্তানকে;- এই পুঁজিবাদী

ব্যবস্থায় এটাই তো স্বাভাবিক,

এখানে মোহর

ছাড়া কিছুই মেলে না, শিক্ষাও

জোটে না। তবে এতে

আপনার কোনো ক্ষতি নেই জানি;

কারণ আপনি

পুত্রের জন্যে কোনো রাজপদ, বা ও

রকম কিছুই

চান নি, কেবল চেয়েছেন আপনার

পুত্র হোক

সৎ, মেরুদণ্ডী, প্রকৃত মানুষ।

আপনার সমস্ত

পবিত্র প্রার্থনা ব্যর্থ ক’রে

বিশশতকের এই

এলোমেলো অন্ধকারে আপনার পুত্র

কী হয়েছে

আপনি কি তা জানেন তা, হে অদেখা

দরিদ্র জননী?

কেনো আপনি পুত্রকে

পাঠিয়েছিলেন মুঘলদের

এই ক্ষয়িষ্ণু শহরে, যেখানে

কৃষক এসে লিপ্ত

হয় পতিতার দালালিতে, মাঠের

রাখাল তার

নদী আর মাঠ হ’য়ে ওঠে হাবশি

গোলাম?

আপনি কি জানেন, মাতা, আপনার

পুত্র শহরের

অন্যতম প্রসিদ্ধ গোলাম আজ?

আপনি এখন

তাকে চিনতেও ব্যর্থ হবেন,

আপনার পুত্রের দিকে

তাকালে এখন কোনো মস্তক পড়ে না

চোখে, শুধু

একটা বিশাল কুঁজ চোখে পড়ে।

দশকে দশকে

যতো স্বঘোষিত প্রভু দেখা

দিয়েছেন মুঘলদের

এ-নষ্ট শহরে, আপনার পুত্র তাদের

প্রত্যেকের

পদতলে মাথা ঠেকিয়ে ঠেকিয়ে

পৃষ্ঠদেশ জুড়ে

জন্মিয়েছে কুঁজ আর কুঁজ; আজ তার

পৃষ্ঠদেশ

একগুচ্ছ কুঁজের সমষ্টি;-

মরুভূমিতে কিম্ভুত

বহুকুঁজ উটের মতোই এখন দেখায়

তাকে।

সে এখন শহরের বিখ্যাত গোলাম

মজলিশের

বিখ্যাত সদস্য, গোলামিতে সে ও

তার ইয়ারেরা

এতোই দক্ষ যে প্রাচীন,

ঐতিহাসিক গোলামদের

গৌরব হরণ ক’রে তারা আজ মশহুর

গোলাম

পৃথিবীর। এখন সে মাথা তার

তুলতে পারে না,

এমনকি ভুলেও গেছে যে একদা তারও

একটি

মাথা ছিলো, এখন সে বহুশীর্ষ

কুঁজটিকেই মাথা

ব’লে ভাবে। খাদ্যগ্রহণের পর

স্বাভাবিক পদ্ধতিও

বিস্মৃত হয়েছে সে, প্রভুদের

পাদুকার তলে

প’ড়ে থাকা অন্ন চেটে খাওয়া ছাড়া

আর কিছুতেই

পরিতৃপ্তি পায় না আপনার পুত্র,

একদা আপনার

স্তন থেকে মধুদুগ্ধ শুষে নিয়ে

জীবন ধারণ

করতো যে বালক বয়সে। এখন সে

শত্রু পাখি

ও নদীর, শত্রু মানুষের, এমন কি

সে আপনার

স্তন্যেরও শত্রু। তার জন্য

দুঃক্ষ করি না, কতোই

তো গোলাম দেখলাম এ-বদ্বীপে

শতকে শতকে।

কিন্তু আপনার জন্যে, হে গরিব

কৃষক-কন্যা, দুঃক্ষী

মাতা, গরিব-গৃহিণী, আপনার জন্যে

বড় বেশি

দুঃখ পাই;- আপনার পুত্রের

গোলামির বার্তা আজ

রাষ্ট্র দিকে দিকে, নিশ্চয়ই তা

পৌঁছে গেছে তিতাসের

জলের গভীরে আর কুমড়োর খেতে,

লাউয়ের

মাঁচায়, পাখির বাসা আর চাষীদের

উঠানের কোণে।

তিতাসের জল আপনাকে দেখলে ছলছল

ক’রে

ওঠে, ‘ওই দ্যাখো গোলামের

গর্ভধারিণীকে’; মাঠে

পাখি ডেকে ওঠে, ‘দ্যাখো গোলামের

গর্ভধারিণীকে’;

আপনার পালিত বেড়াল দুধের বাটি

থেকে

দু-চোখ ফিরিয়ে বলে, ‘গোলামের

গর্ভধারিণীর

হাতের দুগ্ধ রোচে না আমার জিভে’,

প্রতিবেশী

পুরুষ-নারীরা অঙ্গুলি সংকেত

ক’রে কলকণ্ঠে

বলে, ‘দ্যাখো গোলামের

গর্ভধারিণীকে।’ এমন কি

প্রার্থনার সময়ও আপনি হয়তো বা

শুনতে পান

‘গোলামের গর্ভধারিণী, ধারিণী’

স্বর ঘিরে ফেলছে

চারদিক থেকে। আপনি যখন অন্তিম

বিশ্রাম

নেবেন মাটির তলে তখনো হয়তো

মাটি ফুঁড়ে

মাথা তুলবে ঘাসফুল, বাতাসের

কানে কানে ব’লে

যাবে, ‘এখানে ঘুমিয়ে আছেন এক

গর্ভধারিণী

গোলামের।’ ভিজে উঠবে মাটি

ঠাণ্ডা কোমল অশ্রুতে।

কী দোষ আপনার? মা কি কখনোও জানে

দশমাস

ধ’রে যাকে সে ধারণ করছে সে মানুষ

না গোলাম?





কখনো আমি





কখনো আমি স্বপ্ন দেখি যদি

স্বপ্ন দেখবো একটি বিশাল নদী।

নদীর ওপর আকাশ ঘন নীল

নীলের ভেতর উড়ছে গাঙচিল।

আকাশ ছুঁয়ে উঠছে কেবল ঢেউ

আমি ছাড়া চারদিকে নেই কেউ।



কখনো আমি কাউকে যদি ডাকি

ডাকবো একটি কোমল সুদূর পাখি।

পাখির ডানায় আঁকা বনের ছবি

চোখের তারায় জ্বলে ভোরের রবি।

আকাশ কাঁপে পাখির গলার সুরে

বৃষ্টি নামে সব পৃথিবী জুড়ে ।





আমার কুঁড়েঘরে





আমার কুঁড়েঘরে নেমেছে শীতকাল

তুষার জ’মে আছে ঘরের মেঝে জুড়ে বরফ প’ড়ে আছে

গভীর ঘন হয়ে পাশের নদী ভ’রে

বরফ ঠেলে আর তুষার ভেঙে আর দু-ঠোঁটে রোদ নিয়ে

আমার কুঁড়েঘরে এ-ঘন শীতে কেউ আসুক



আমার গ্রহ জুড়ে বিশাল মরুভূমি

সবুজ পাতা নেই সোনালি লতা নেই শিশির কণা নেই

ঘাসের শিখা নেই জলের রেখা নেই

আমার মরুভূর গোপন কোনো কোণে একটু নীল হয়ে

বাতাসে কেঁপে কেঁপে একটি শীষ আজ উঠুক



আমার গাছে গাছে আজ একটি কুঁড়ি নেই

একটি পাতা নেই শুকনো ডালে ডালে বায়ুর ঘষা লেগে

আগুন জ্ব’লে ওঠে তীব্র লেলিহান

বাকল ছিঁড়েফেড়ে দুপুর ভেঙেচুরে আকাশ লাল ক’রে

আমার গাছে আজ একটা ছোট ফুল ফুটুক



আমার এ-আকাশ ছড়িয়ে আছে ওই

পাতটিনের মতো ধাতুর চোখ জ্বলে প্রখর জ্বালাময়

সে-তাপে গ’লে পড়ে আমার দশদিক

জল ও বায়ুহীন আমার আকাশের অদেখা দূর কোণে

বৃষ্টিসকাতর একটু মেঘ আজ জমুক



আমার কুঁড়েঘরে নেমেছে শীতকাল

তুষার জ’মে আছে ঘরের মেঝে জুড়ে বরফ প’ড়ে আছে

গভীর ঘন হয়ে পাশের নদী ভ’রে

বরফ ঠেলে আর তুষার ভেঙে আজ দু-ঠোঁটে রোদ নিয়ে

আমার কুঁড়েঘরে এ-ঘন শীতে কেউ আসুক।





গরীবের সৌন্দর্য





গরিবেরা সাধারণত সুন্দর হয় না।

গরিবদের কথা মনে হ’লে সৌন্দর্যের কথা মনে পড়ে না কখনো।

গরিবদের ঘরবাড়ি খুবই নোংরা, অনেকের আবার ঘরবাড়িই নেই।

গরিবদের কাপড়চোপড় খুবই নোংরা, অনেকের আবার কাপড়চোপড়ই নেই।

গরিবেরা যখন হাঁটে তখন তাদের খুব কিম্ভুত দেখায়।

যখন গরিবেরা মাটি কাটে ইট ভাঙে খড় ঘাঁটে গাড়ি ঠেলে পিচ ঢালে তখন তাদের

সারা দেহে ঘাম জবজব করে, তখন তাদের খুব নোংরা আর কুৎসিত দেখায়।

গরিবদের খাওয়ার ভঙ্গি শিম্পাঞ্জির ভঙ্গির চেয়েও খারাপ।

অশ্লীল হাঁ ক’রে পাঁচ আঙ্গুলে মুঠো ভ’রে সব কিছু গিলে ফেলে তারা।

থুতু ফেলার সময় গরিবেরা এমনভাবে মুখ বিকৃত করে

যেনো মুখে সাতদিন ধ’রে পচছিলো একটা নোংরা ইঁদুর।

গরিবদের ঘুমোনোর ভঙ্গি খুবই বিশ্রী।

গরিবেরা হাসতে গিয়ে হাসিটাকেই মাটি ক’রে ফেলে।

গান গাওয়ার সময়ও গরিবদের একটুও সুন্দর দেখায় না।

গরিবেরা চুমো খেতেই জানে না, এমনকি শিশুদের চুমো খাওয়ার সময়ও

থকথকে থুতুতে তারা নোংরা করে দেয় ঠোঁট নাক গাল।

গরিবদের আলিঙ্গন খুবই বেঢপ।

গরিবদের সঙ্গমও অত্যন্ত নোংরা, মনে হয় নোংরা মেঝের ওপর

সাংঘাতিকভাবে ধ্বস্তাধ্বস্তি করছে দু’টি উলঙ্গ অশ্লীল জন্তু।

গরিবদের চুলে উকুন আর জট ছাড়া কোনো সৌন্দর্য নেই।

গরিবদের বগলের তলে থকথকে ময়লা আর বিচ্ছিরি লোম সব জড়াজড়ি করে।

গরিবদের চোখের চাউনিতে কোনো সৌন্দর্য নেই,

চোখ ঢ্যাবঢ্যাব ক’রে তারা চারদিকে তাকায়।

মেয়েদের স্তন খুব বিখ্যাত, কিন্তু গরিব মেয়েদের স্তন শুকিয়ে শুকিয়ে

বুকের দু-পাশে দুটি ফোড়ার মতো দেখায়।

অর্থাৎ জীবনযাপনের কোনো মুহূর্তেই গরিবদের সুন্দর দেখায় না।



শুধু যখন তারা রুখে ওঠে কেবল তখনি তাদের সুন্দর দেখায় ।





বাঙলা ভাষা





শেকলে বাঁধা শ্যামল রূপসী, তুমি-আমি, দুর্বিনীত দাসদাসী-

একই শেকলে বাঁধা প’ড়ে আছি শতাব্দীর পর শতাব্দী।

আমাদের ঘিরে শাঁইশাঁই চাবুকের শব্দ, স্তরে স্তরে শেকলের ঝংকার।

তুমি আর আমি সে-গোত্রের যারা চিরদিন উৎপীড়নের মধ্যে গান গায়-

হাহাকার রূপান্তরিত হয় সঙ্গীতে-শোভায়।



লকলকে চাবুকের আক্রোশ আর অজগরের মতো অন্ধ শেকলের

মুখোমুখি আমরা তুলে ধরি আমাদের উদ্ধত দর্পিত সৌন্দর্য:

আদিম ঝরনার মতো অজস্র ধারায় ফিনকি দেয়া টকটকে লাল রক্ত,

চাবুকের থাবায় সুর্যের টুকরোর মতো ছেঁড়া মাংস

আর আকাশের দিকে হাতুড়ির মতো উদ্যত মুষ্টি।



শাঁইশাঁই চাবুকে আমার মিশ্র মাংসপেশি পাথরের চেয়ে শক্ত হয়ে ওঠে

তুমি হয়ে ওঠো তপ্ত কাঞ্চনের চেয়েও সুন্দর।

সভ্যতার সমস্ত শিল্পকলার চেয়ে রহস্যময় তোমার দু-চোখ

যেখানে তাকাও সেখানেই ফুটে ওঠে কুমুদকহ্লার

হরিণের দ্রুত ধাবমান গতির চেয়ে সুন্দর ওই ভ্রূযুগল

তোমার পিঠে চাবুকের দাগ চুনির জড়োয়ার চেয়েও দামি আর রঙিন

তোমার দুই স্তন ঘিরে ঘাতকের কামড়ের দাগ মুক্তোমালার চেয়েও ঝলোমলো

তোমার ‘অ, আ’ –চিৎকার সমস্ত আর্যশ্লোকের চেয়েও পবিত্র অজর



তোমার দীর্ঘশ্বাসের নাম চন্ডীদাস

শতাব্দী কাঁপানো উল্লাসের নাম মধুসূদন

তোমার থরোথরো প্রেমের নাম রবীন্দ্রনাথ

বিজন অশ্রুবিন্দুর নাম জীবনানন্দ

তোমার বিদ্রোহের নাম নজরুল ইসলাম



শাঁইশাঁই চাবুকের আক্রোশে যখন তুমি আর আমি

আকাশের দিকে ছুঁড়ি আমাদের উদ্ধত সুন্দর বাহু, রক্তাক্ত আঙুল,

তখনি সৃষ্টি হয় নাচের নতুন মুদ্রা;

ফিনকি দেয়া লাল রক্ত সমস্ত শরীরে মেখে যখন আমরা গড়িয়ে পড়ি

ধূসর মাটিতে এবং আবার দাঁড়াই পৃথিবীর সমস্ত চাবুকের মুখোমুখি,

তখনি জন্ম নেয় অভাবিত সৌন্দর্যমন্ডিত বিশুদ্ধ নাচ;

এবং যখন শেকলের পর শেকল চুরমার ক’রে ঝনঝন ক’রে বেজে উঠি

আমরা দুজন, তখনি প্রথম জন্মে গভীর-ব্যাপক-শিল্পসম্মত ঐকতান-

আমাদের আদিগন্ত আর্তনাদ বিশশতকের দ্বিতীয়ার্ধের

একমাত্র গান।





এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়





এ লাশ আমরা রাখবো কোথায় ?

তেমন যোগ্য সমাধি কই ?

মৃত্তিকা বলো, পর্বত বলো

অথবা সুনীল-সাগর-জল-

সব কিছু ছেঁদো, তুচ্ছ শুধুই !

তাইতো রাখি না এ লাশ আজ

মাটিতে পাহাড়ে কিম্বা সাগরে,

হৃদয়ে হৃদয়ে দিয়েছি ঠাঁই।





ব্যাধিকে রূপান্তরিত করছি মুক্তোয়





একপাশে শূন্যতার খোলা, অন্যপাশে মৃত্যুর ঢাকনা,

প’ড়ে আছে কালো জলে নিরর্থক ঝিনুক।

অন্ধ ঝিনুকের মধ্যে অনিচ্ছায় ঢুকে গেছি রক্তমাংসময়

আপাদমস্তক বন্দী ব্যাধিবীজ। তাৎপর্য নেই কোন দিকে-

না জলে না দেয়ালে-তাৎপর্যহীন অভ্যন্তরে ক্রমশ উঠছি বেড়ে

শোণিতপ্লাবিত ব্যাধি। কখনো হল্লা ক’রে হাঙ্গরকুমীরসহ

ঠেলে আসে হলদে পুঁজ, ছুটে আসে মরা রক্তের তুফান।

আকষ্মিক অগ্নি ঢেলে ধেয়ে আসে কালো বজ্রপাত।

যেহেতু কিছুই নেই করণীয় ব্যাধিরূপে বেড়ে ওঠা ছাড়া,

নিজেকে-ব্যাধিকে-যাদুরসায়নে রূপান্তরিত করছি শিল্পে-

একরত্তি নিটোল মুক্তোয়!







ফুলেরা জানতো যদি



মুলঃ হেনরিক হাইনে



ফুলেরা জানতো যদি আমার হৃদয়

ক্ষতবিক্ষত কতোখানি,

অঝোরে ঝরতো তাদের চোখের জল

আমার কষ্ট আপন কষ্ট মানি ।



নাইটিংগেল আর শ্যামারা জানতো যদি

আমার কষ্ট কতোখানি-কতোদুর,

তাহলে তাদের গলায় উঠতো বেজে

আরো ব হু বেশী আনন্দদায়ক সুর ।



সোনালী তারারা দেখতো কখনো যদি

আমার কষ্টের অশ্রুজলের দাগ,

তাহলে তাদের স্থান থেকে নেমে এসে

জানাতো আমাকে সান্ত্বনা ও অনুরাগ ।



তবে তারা কেউ বুঝতে পারেনা তা-

একজন,শুধু একজন,জানে আমার কষ্ট কতো;

আমার হৃদয় ছিনিয়ে নিয়েছে যে

ভাংগার জন্য-বারবার অবিরত ।





আত্মহত্যার অস্ত্রাবলি



রয়েছে ধারালো ছোরা স্লিপিং টেবলেট

কালো রিভলবার

মধ্যরাতে ছাদ

ভোরবেলাকার রেলগাড়ি

সারিসারি বৈদ্যুতিক তার।

স্লিপিং টেবলেট খেয়ে অনায়াসে ম’রে যেতে পারি

বক্ষে ঢোকানো যায় ঝকঝকে উজ্জ্বল তরবারি

কপাল লক্ষ্য ক’রে টানা যায় অব্যর্থ ট্রিগার

ছুঁয়ে ফেলা যায় প্রাণবাণ বৈদ্যুতিক তার

ছাদ থেকে লাফ দেয়া যায়

ধরা যায় ভোরবেলাকার রেলগাড়ি

অজস্র অস্ত্র আছে

যে-কোনো একটি দিয়ে আত্মহত্যা ক’রে যেতে পারি

এবং রয়েছো তুমি

সবচেয়ে বিষাক্ত অস্ত্র প্রিয়তমা মৃত্যুর ভগিনী

তোমাকে ছুঁলে

দেখলে এমনকি তোমার নাম শুনলে

আমার ভেতরে লক্ষ লক্ষ আমি আত্মহত্যা করি।







বিজ্ঞাপন: বাঙলাদেশ ১৯৮৬







হ্যাঁ, আপনিই সেই প্রতিভাবান পুরুষ, যাঁকে আমরা খুঁজছি।

যদি আপনার কোন মগজ না থাকে, শুধু পেশি থাকে

যদি আপনার কোন হৃৎপিন্ড না থাকে, শুধু লিঙ্গ থাকে

যদি আপনার কোন ওষ্ঠ না থাকে, শুধু দাঁত থাকে

তাহলে আপনিই সেই প্রতিভাবান পুরুষ, যাঁকে আমরা খুঁজছি

যদি আপনি অবলীলায়, একটুও না কেঁপে, শিশুপার্কে

একঝাঁক কবুতরের মতো ক্রীড়ারত শিশুদের মধ্যে একের পর এক

ছুঁড়ে দিতে পারেন হাতবোমা।

যদি আপনি কল্লোলমুখর একটা কিন্ডারগার্টেনে পেট্রল ছড়িয়ে

হাসতে হাসতে আগুন লাগিয়ে দিতে পারেন প্রাতরাশের আগেই

এবং পকেটে হাত রেখে সেই দাউদাউ অগ্নিশিখার দিকে

তাকিয়ে খুব স্থিরভাবে টানতে পারেন ফাইভ ফিফটি ফাইভ

হ্যাঁ, তাহলে আপনিই সেই প্রতিভাবান পুরুষ, যাঁকে আমরা খুঁজছি।



যদি আপনি প্রেমিকাকে বেড়াতে নিয়ে উপর্যুপরি ধর্ষণের পর

খুন করে ঝোপে ছুঁড়ে ফেলে একশো মাইল বেগে সাইলেন্সারহীন হোন্ডা

চালিয়ে ফিরে আসতে পারেন ন্যাশনাল পার্ক থেকে

কলাভবনের বারান্দায় যদি আপনি অকস্মাৎ বেল্ট থেকে ছোরা টেনে নিয়ে

আমূল ঢুকিয়ে দিতে পারেন সহপাঠীর বক্ষদেশে,

যদি আপনি জেব্রাক্রসিংয়ে পারাপাররত পথচারীদের ওপর দিয়ে

উল্লাসে চালিয়ে দিতে পারেন হাইজ্যাক করা ল্যান্ডরোভার

তাহলে আপনিই সেই প্রতিভাবান পুরুষ, যাঁকে আমরা খুঁজছি



যদি আপনার ভেতরে কোন কবিতা না থাকে, শুধু হাতুড়ি থাকে

যদি আপনার ভেতরে কোন গান না থাকে, শুধু কুঠার থাকে

যদি আপনার ভেতরে কোন নাচ না থাকে, শুধু রিভলবার থাকে

যদি আপনার ভেতরে কোন স্বপ্ন না থাকে, শুধু নরক থাকে

তাহলে আপনিই সেই প্রতিভাবান পুরুষ, যাঁকে আমরা খুঁজছি

যদি আপনি পিতার শয্যার নিচে একটা টাইমবোম্ব ফিট করে

যাত্রা করতে পারেন পানশালার দিকে,

যদি আপনি জননীকে ঠেলে ফেলে দিতে পারেন টাওয়ারের

আঠারো তলার ব্যালকনি থেকে

যদি আপনি আপনার এলাকার ফুলের চেয়েও রূপসী মেয়েটির মুখে

এসিড ছুঁড়ে তাকে রূপান্তরিত করতে পারেন

পৃথিবীর সবচেয়ে কুৎসিত দুঃস্বপ্নে

তাহলে আপনিই সেই প্রতিভাবান পুরুষ, যাঁকে আমরা খুঁজছি



হ্যাঁ, আপনাকেই নিয়োগ করা হবে আমাদের মহাব্যবস্থাপক

আপনার ওপর ভার দেয়া হবে সমাজের

আপনার ওপর ভার দেয়া হবে রাষ্ট্রের

আপনার ওপর ভার দেয়া হবে সভ্যতার

আপনার খাদ্য হিসেবে বরাদ্দ করা হবে গুদামের পর গুদাম ভর্তি বারুদ

আপনার চিত্তবিনোদনের জন্যে সরবরাহ করা হবে লাখ লাখ স্টেনগান

আপনিই যদি হন আমাদের আকাঙ্খিত প্রতিবাবান পুরুষ

তাহলে, পোস্টবক্স: বাঙলাদেশ ১৯৮৬ তো

আজই আবেদন করুন।





আমাকে ভালবাসার পর





আমাকে ভালবাসার পর আর কিছুই আগের মত থাকবে না তোমার,

যেমন হিরোশিমার পর আর কিছুই আগের মতো নেই উত্তর থেকে দক্ষিণমেরু পর্যন্ত।

যে কলিংবেল বাজেনি, তাকেই মুর্হুমুহু শুনবে বজ্রের মতো বেজে উঠতে

এবং থরথর ক’রে উঠবে দরোজা-জানালা আর তোমার হৃৎপিণ্ড।

পরমুহূর্তেই তোমার ঝনঝন-ক’রে ওঠা এলোমেলো রক্ত ঠাণ্ডা হ’য়ে যাবে,

যেমন একাত্তরে দরোজায় বুটের অদ্ভুত শব্দে নিথর স্তব্ধ হ’য়ে যেত ঢাকা শহরের জনগণ।



আমাকে ভালবাসার পর আর কিছুই আগের মতো থাকবে না তোমার।

রাস্তায় নেমেই দেখবে বিপরীত দিক থেকে আসা প্রতিটি রিকশায়

ছুটে আসছি আমি,

আর তোমাকে পেরিয়ে চ’লে যাচ্ছি এদিকে-সেদিকে।

তখন তোমার রক্তে আর কালো চশমায় এত অন্ধকার

যেন তুমি ওই চোখে কোনোদিন কিছুই দ্যাখোনি।



আমাকে ভালবাসার পর তুমি ভুলে যাবে বাস্তব আর অবাস্তব,

বস্তু আর স্বপ্নের পার্থক্য।

সিঁড়ি ভেবে পা রাখবে স্বপ্নের চূড়োতে,

ঘাস ভেবে দু-পা ছড়িয়ে বসবে অবাস্তবে,

লাল টুকটুকে ফুল ভেবে খোঁপায় গুঁজবে গুচ্ছ গুচ্ছ স্বপ্ন।

না-খোলা শাওয়ারের নিচে বারোই ডিসেম্বর থেকে তুমি অনন্তকাল দাঁড়িয়ে থাকবে এই ভেবে যে

তোমার চুলে-ত্বকে-ওষ্ঠে-গ্রীবায় অজস্র ধারায় ঝরছে বোদলেয়ারের আশ্চর্য মেঘদল।



তোমার যে ঠোঁটে চুমো খেয়েছিল উদ্যমপরায়ণ এক প্রাক্তন প্রেমিক,

আমাকে ভালবাসার পর সেই নষ্ট ঠোঁট খঁসে প’ড়ে

সেখানে ফুটবে এক অনিন্দ্য গোলাপ।





মুক্তিবাহিনীর জন্যে





তোমার রাইফেল থেকে বেরিয়ে আসছে গোলাপ

তোমার মেশিনগানের ম্যাগাজিনে ৪৫টি গোলাপের কুঁড়ি

তুমি ক্যামোফ্লেজ করলেই মরা ঝোপে ফোটে লাল ফুল

দস্যুরা অস্ত্রকে নয় গোলাপকেই ভয় পায় বেশি

তুমি পা রাখলেই অকস্মাৎ ধ্বংস হয় শত্রুর কংক্রিট ব্যাংকার

তুমি ট্রিগারে আঙ্গুল রাখতেই মায়াবীর মতো যাদুবলে

পতন ঘটে শত্রুর দুর্ভেদ্য ঘাঁটি ঢাকা নগরীর



তোমার রাইফেল থেকে বেরিয়ে আসছে ভালোবাসা

সর্বাঙ্গে তোমার প্রেম দাউদাউ জ্বলে

তুমি পা রাখতেই প্রেমিকার ব্যাকুল দেহের মতো যশোর কুমিল্লা ঢাকা

অত্যন্ত সহজে আসে তোমার বলিষ্ঠ বাহুপাশে

তোমাকে দেখলেই উঁচু দালানের শিব থেকে

ছিঁড়ে পড়ে চানতারামার্কা বেইমান পতাকা



তোমার রাইফেল থেকে বেরিয়ে আসছে জীবন

তুমি দাও থরোথরো দীপ্ত প্রাণ বেয়নেটে নিহত লাশকে

তোমার আগমনে প্রাণ পায় মরা গাছ পোড়া প্রজাপতি

তোমার পায়ের শব্দে বাঙলাদেশে ঘনায় ফাগুন

৫৬,০০০ বর্গমাইলের এই বিধ্বস্ত বাগানে

এক সুরে গান গেয়ে ওঠে সাত কোটি বিপন্ন কোকিল ।





বাঙলাদেশের কথা



ভুলেও কখনো আমাকে তুমি বাঙলাদেশের কথা জিজ্ঞেস করো না; আমি তা মূহূর্তেও সহ্য করতে পারি না, -তার অনেক কারণ রয়েছে।

তোমাকে মিনতি করি কখনো আমাকে তুমি বাঙলাদেশের কথা তুলে কষ্ট দিয়ো না।

জানতে চেয়ো না তুমি নষ্টভ্রষ্ট ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইলের কথা, তার রাজনীতি,

অর্থনীতি, ধর্ম, পাপ, মিথ্যাচার, পালে পালে মনুষ্যমন্ডলি, জীবনযাপন, হত্যা, ধর্ষণ,

মধ্যযুগের দিকে অন্ধের মতোন যাত্রা সম্পর্কে প্রশ্ন

ক’রে আমাকে পীড়ন কোরো না; আমি

তা মুহূর্তেও সহ্য করতে পারি না, – তার অনেক কারণ রয়েছে ।

তোমাকে মিনতি করি কখনো আমাকে তুমি বাঙলাদেশের কথা তুলে কষ্ট দিয়ো না।









কখনো আমি



কখনো আমি স্বপ্ন দেখি যদি



স্বপ্ন দেখবো একটি বিশাল নদী।



নদীর ওপর আকাশ ঘন নীল



নীলের ভেতর উড়ছে গাঙচিল।



আকাশ ছুঁয়ে উঠছে কেবল ঢেউ



আমি ছাড়া চারদিকে নেই কেউ।



কখনো আমি কাউকে যদি ডাকি



ডাকবো একটি কোমল সুদূর পাখি।



পাখির ডানায় আঁকাঁ বনের ছবি



চোখের তারায় জ্বলে ভোরের রবি।



আকাশ কাঁপে পাখির গলার সুরে



বৃষ্টি নামে সব পৃথিবী জুড়ে।





রাজনীতিবিদগন



যখন তাদের দেখি অন্ধ হয়ে আসে দুই চোখ ।

ভয় পাই কোনো দিন দেখতে পাবো না হায়

মেঘ পাতা সবুজ শিশির ।আমার সামনে থেকে মুছে যায়

গাছপালা রোদ শিশু,জোনাকির সামান্য আলোক ।

চর পড়ে নদী জুড়ে ,ছাইয়ে ঢাকে ধানক্ষেত মধুমতি মেঘনার তীর।

যখন তাদের দেখি মনে হয় কোনো দিন

জড়িয়ে ধরি নি কাউকে, চিরকাল দিকে দিকে খুঁড়েছি কবর,

শুধু খুলি উঠে আসে দুই হাতে অঢেল মাটির তলদেশ থেকে,

পাই নি ফুলের গন্ধ অন্ধকারে; পরিচিত শুধু ঘৃণা, মহামারী, জ্বর।

লেলিহান লাল রক্তে চাপা পড়ে চাঁদ আর সূর্যের আকাশ।

যখন তাদের দেখি অবিরাম বজ্রপাত হয় নিল থেকে।

পোকা জন্মে আম্রফলে, শবরিতে; ইক্ষুর শরীর ভরে কালান্তর বিষে,

প’চে ওঠে পাকা ধান,পঙ্গপাল মেতে ওঠে আদিগন্ত ছড়ানো সবুজে,

ভেসে ওঠে মরা মাছ , বিছানায় বিষাক্ত সাপ ওঠে এঁকেবেঁকে।

স্বপ্নাতুর দুই ঠোঁট ভ’রে ওঠে মরারক্তে- ঘনীভূত পুজে।

যখন তাদের দেখি হঠাৎ আগুন লাগে চষীদের মেয়েদের

বিব্রত আচলে; সমস্ত শহর জুড়ে শুরু হয় খুন, লুঠ,সম্মিলিত অবাধ ধর্ষণ,

ভেঙ্গে পড়ে শিল্পকলা, গদ্যপদ্য; দাউদাউ পোড়ে পৃষ্টা সমস্ত গ্রন্থের;

ডাল থেকে গোঙিয়ে লুটিয়ে পড়ে ডানা ভাঙা নিঃসঙ্গ দোয়েল,

আর্তনাদ করে বাঁশি যখন ওঠেন মঞ্চে রাজনিতিবিদগন ।





যে তুমি ফোটাও ফুল





যে তুমি ফোটাও ও ফুল ঘ্রাণে ভরো ব্যাপক সবুজ

জমিতে বিছিয়ে দাও ধান শিম খিরোই তরমুজ

কুমডোর সুস্বাদ , যে তুমি ফলাও শাখে ফজলি আম

কামরাঙা পেয়ারা, বাতাসে দোলায় গুচ্ছগুচ্ছ জাম ,

যে তুমি বহাও নদী , পাললিক নদীর ভেতরে

লালনপালন করো ইলিশ বোয়াল স্তরেস্তরে ,

যে তুমি উঠাও চাঁদ মেঘ ছিড়ে নীলাকাশ জুড়ে

বাজাও শ্রাবণ রাত্রি নর্তকির অজস্র নুপুরে ,

যে তুমি পাখির ডাকে জেগে ওঠো, এবং নিশ্চুপে

বলিকার সারা দেহ ভ’রে দাও তলেতিলে রূপে

আর কণকচাঁপার গন্ধে আর ভাটিয়ালি গানে ,

যে তুমি বইয়ে দাও মধুদুগ্ধ গাভীর ওলানে

খড় আর ঘাস থেকে, যে তুমি ফোটাও মাধবী

আর অজস্র পুত্রকে দাও ছন্দ- ক’রে তোলো কবি,

যে তুমি ফোটাও ফুল বনে বনে গন্ধভরপুর-

সে তুমি কেমন ক’রে, বাঙলা , সে তুমি কেমন ক’রে

দিকে দিকে জন্ম দিচ্ছো পালেপালে শুয়োরকুকুর ?









আমি আর কিছুই বলবো না



যা ইচ্ছে করো তোমরা আমি আর কিছুই বলবো না ,

রক্তে সাজাও উঠোন, শিরশ্ছেদ করো জনকের,

কন্যাকে পীড়ন করো, আমি আর কিছুই বলবো না ।

বাইরে বাগান ক’রে অভ্যন্তরে কুটিল গোখরা ছাড়ো,

বান্ধবের পানীয়তে মেশাও বিষ,সৌন্দর্য ধর্ষণ করো,

আমি আর কিছুই বলবো না।সত্যের বন্দনা করো দিবালোকে,

মিথ্যার মন্দিরে গিয়ে প’ড়ে থাকো নষ্ট আঁধারের নিপুণ আশয়ে,

মন্ঞ্চে স্তব করো মানুষের আর শাণাও কুঠার সংগোপন ষড়যন্ত্রে ,

আমি আর কছুই বলবো না ।

পাঠ করো কপটতা , দিনে দানবকে দুয়ো দাও , রাতে বসো পদোতলে,

আমি আর কিছুই বলবোনা। দেখবো শিশুর মুখ বৃষ্টিধারা পাখির উড়াল

আথবা দু-চোখ উপড়ে মুখ ঘষবো সুগন্ধী মাটিতে







কথা দিয়েছিলাম তোমাকে



‘ কথা দিয়েছিলাম তোমাকে’

কথা দিয়েছিলাম তোমাকে রেখে যাব

পুষ্ট ধান মাখনের মতো পলিমাটি পূর্ণচাঁদ ভাটিয়ালি

গান উড্ডীন উজ্জ্বল মেঘ দুধের ওলান মধুর চাকের মতো গ্রাম

জলের অনন্ত বেগ রুইমাছ পথপাশে শাদা ফুল অবনত গাছ

আমের হলদে বউল জলপদ্ম দোয়েল মৌমাছি

তোমার জন্য রেখে যাচ্ছি নষ্ট ফলে দুষ্ট কীট

ধানের ভেতরে পুঁজ টায়ারের পোড়া গন্ধ পম্কিল তরমুজ

দুঃস্বপ্নআক্রান্ত রাত আলকাতরার ঘ্রাণ ভাঙা জলজান অধঃপাত

সড়কে ময়লা রক্ত পরিত্যক্ত ভ্রুণ পথনারি বিবস্ত্র ভিকারি

শুকনো নদী হন্তারক বিষ আবর্জনা পরাক্রান্ত সিফিলিস

কথা দিয়েছিলাম তোমাকে রেখে যাবো

নিকোনো শহর গলি লোকোত্তর পদাবলি রঙের প্রতিভা

মানবিক গূঢ় সোনা অসম্ভব সুত্রে বোনা স্বাধীনতা শুভ্র স্বাধিকার

অন্তরঙ্গ অক্ষরবূত্ত দ্যুতিময় মিল লয় জীবনের আনন্দনিকিল

গাঢ় আলিঙ্গন সুবাতাস সময়ের অমল নিশ্বাস



তোমার জন্যে রেখে যাচ্ছি নোংরা বস্তি সৈন্যাবাস

বর্বর চিৎকার বুট রাস্ট্রধর্ম তেলাপোকা মধ্যযুগ অন্ধ শিরস্ত্রান

মৌলবাদ রেখে যাচ্ছি মরণাস্ত্র আততায়ীর উল্লাস পোড়া ঘাস সন্ত্রাস

মরছে-পড়া মাংস রেখে যাচ্ছি কালরাত্রি সান্ধ্য আইন অনধিকার

সমুহ পতন খাদ তোমার জন্যে রেখে যাচ্ছি অসংখ্য জল্লাদ ।







তৃতীয় বিশ্বের একজন চাষির প্রশ্ন







আগাছা ছাড়াই, আল বাধি, জমি চাষি, মই দেই,

বীজ বুনি, নিড়োই, দিনের পর দিন চোখ ফেলে রাখি শুকনা আকাশের দিকে।

ঘাম ঢালি খেত ভ’রে, আসলে রক্ত ই ঢেলে দেই নোনা পানি রূপে;

অবশেষে মেঘ ও মাটির দয়া হ’লে খেত জুড়ে জাগে প্রফুল্ল সবুজ কম্পন।

খরা ,বৃষ্টি, ও একশো একটা উপদ্রব কেটে গেলে প্রকৃতির কৃপা হলে এক সময়

মুখ দেখতে পাই থোকা থোকা সোনালি শস্যের ।

এতো ঘামে , নিজকে ধানের মতোই সেদ্ধ ক’রে ফলাই সামান্য এক মুঠো,

গরিব শষ্য। মুর্খ মানুষ, দুরে আছি, জানতে ইচ্ছে করে

দিনরাত লেফ-রাইট লেফ- রাইট করলে ক’মন শষ্য ফলে এক গণ্ডা জমিতে।







মানুষের সঙ্গ ছাড়া



মানুষের সঙ্গ ছাড়া আর সব ভাল লাগে, আমের শাখায়

কালো কাক, বারান্দায় ছোট্ট চড়াই, শালিখের ঝাঁক

আফ্রিকার অদ্ভুত গন্ডার, নেকড়ে, হায়েনা, রাস্তার কোণায়

মলপরিতৃপ্ত নোংরা কুকুর, বহু দূরে ডাহুকের ডাক

সুখী করে, এইসব সুখ আছে ব’লে আজো বেঁচে আছি, এবং এখনো

বাঁচতে ইচ্ছে করে, তাই হয়তো আত্মহত্যায় যাবো না কখনো।



মানুষ সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করতে চাই না; শুধু ভাবি।



এতো কুৎসিৎ কি ক’রে হলো এই জন্তুগুলো? প্রত্যেকের মুখে

কি করে জমলো এতো আবর্জনা? কি ক’রে সবাই এতো অস্বভাবী?

হয়ে উঠলো? আজ তারা প্রত্যেকেই সংঘ, প্রত্যেকের চোখে

হিংসা, প্রত্যেকেই আগ্নেয়াস্ত্র; প্রত্যেকেই একেকটি তীব্র মতবাদ,

গ্রীবা চেপে উপভোগ করতে চায় জীবনের মনোরম স্বাদ।



মানুষের সংগ ছাড়া আর সব ভালো লাগে; অতিশয় দূরে বেঁচে আছি

পথের কুকুর দেখে মুগ্ধ হই, দেখি দূরে আজো ওড়ে মুখর মৌমাছি।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ০৭ ই মে, ২০১৬ সকাল ৯:২৭

রুদ্র জাহেদ বলেছেন: দারুণ।প্রিয় সব কবিতা

২০ শে অক্টোবর, ২০১৬ ভোর ৫:৪০

অপরাজিতা মুন্নি বলেছেন: ধন্যবাদ! :)

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.