নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

www.oputanvir.com

অপু তানভীর

আমার চোখে ঠোঁটে মুখে তুমি লেগে আছো

অপু তানভীর › বিস্তারিত পোস্টঃ

বরফমানব এবং ইভের সাত কন্যা

১৫ ই জুন, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

১৯৯১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের এক সকাল বেলা। আল্পস পর্বতমালার ইতালী অস্ট্রিয়া সীমানায় এরিকা এবং হেলমুট সাইমন নামের দুইজন অভিজ্ঞ জার্মান পর্বতারোহী তাদের হাইকিংয়ের প্রায় শেষ সময়ে এসে পৌঁছেছেন। গতরাতে আবহাওয়ার কারণে তাদের হঠাৎ করেই থামতে হয়েছিল। তারা অল্পাসের ওটজটাল অংশে তাবু টাঙিয়ে রাতে অবস্থান করছিলেন । পরিকল্পনা ছিল যে সকালবেলা এখান থেকে হেঁটে তারা তাদের গাড়ির কাছে পৌঁছাবে। কিন্তু সকালটা এত চমৎকার রৌদ্রজ্জ্বল ছিল যে তাদের ইচ্ছে হলো তারা ফিরে যাওয়ার বদলে বরং ওটজটালের আরও একটু উপরে উঠা যাক। গতরাতের তাবু গোটাতে গিয়ে তারা একটা ব্যাপার খেয়াল করল। তাদের তাবুর থেকে দুরে এক স্থানে বরফ সরে গেছে। রাতের আবহাওয়ার কারণেই এমনটা হয়েছে। সেই সরে যাওয়া বরফের ভেতরে একজন পুরুষ দেহের উপরের অংশ আটকে আছে।

(ছবি সুত্র: উইকিপিডিয়া)

বরফাচ্ছন্ন পাহাড়ে এমন মৃত দেহ পড়ে থাকার ব্যাপারটা অস্বাভাবিক নয়। এমন অনেক পর্বতারোহী পাহাড় চড়তে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হয় এবং মারা পড়ে। বরফের নিচে এক সময় ঢাকা পড়ে যায়। তারপর কোনো কারণে যদি বরফ সরে যায় তাহলে এই মৃতদেহ সবার চোখের সামনে আসে। সাইমনদের দেখা এই মৃতদেহটাও সম্ভবত সেই রকম একটা মৃতদেহ ছিল। অন্তত তারা এমনটাই ভেবেছিল। তারা ভেবেছিল যে এই মৃতদেহটা হয়তো বিশ-পঁচিশ বছর পুরোনো কোনো মাউন্টেনিয়ারের হবে যে কিনা পাহাড়ে এসে মৃত্যু বরণ করেছে। তারা কর্তৃপক্ষকে এই ব্যাপারে অবহিত করলেন।
পরের দিন দুইজন মাউন্টেইন কিপার এসে হাজির হয় নির্ধারিত স্থানে। তারা চেষ্টা করে মৃতদেহটাকে বরফের থেকে বের করার তবে খারাপ আবহাওয়ার কারণে সেদিন তাদের ফিরে যেতে হয় । পরের দিন আটজনের একটা দল এসে হাজির হয় এবং আরও দুইদিন পরে দেহটাকে তারা বরফ থেকে মুক্ত করতে সক্ষম হয়। পরে দেহটাকে নিয়ে যাওয়া হয় অস্ট্রেইয়ার ইনসবুর্কের (Innsbruck) একটি মেডিক্যাল সেন্টারে।
মৃতদেহের সাথে পাওয়া কয়েকটি জিনিসের ভেতরে একটা জিনিস অনেকটা আইসপিকের মত দেখতে ছিল । সেটা দেখে তারা একটু অবাক হলো। এই ধরনের আইসপিক সেই সময়ে আর কেউ ব্যবহার করত না। এটা একটু পুরানো ধরনের আইসপিক। পুলিশে খবর দেওয়া হলো। তারা খোঁজ-খবর নিয়ে ধারণা করলেন যে এই লাশটা সম্ভবত কার্লো ক্যাপসোনি নামের একজন সঙ্গীত প্রফেসরের। তিনি ১৯৪১ সালে এই এলাকায় হারিয়ে গিয়েছিলেন। সবাই প্রথমে এমনটাই মনে করেছিল ।
কিন্তু আরও ভালো করে যখন পরীক্ষা করা হলো, তখন দেখা গেল যে আইসপিকটা আসলে কোনো আইসপিক নয়। সেটা অনেকটা প্রাচীন কোনো কুঠারের মতো দেখতে। নিচে সেই কুঠারের একটা রেপ্লিকার ছবি দেওয়া হল:

(ছবি সুত্র: উইকিপিডিয়া)

এছাড়া তার সাথে পাওয়া একটা প্রাচীন ছুরি, ১৪টা তীর সমেত একটা তীরের ব্যাগ, তীরমাথা, তীর সুচালো করার যুন্ত্রও পাওয়া গিয়েছিল। এসবই প্রচীন মানবেরা ব্যবহার করত ।
তাদের ধারণা হল যে এই দেহটা একশ কিংবা দুইশ বছর পুরোনো নয়, বরং প্রায় হাজার বছর পুরোনো। কার্বন ডেটিং করে জানা গেল যে আমাদের এই বরফ মানবের বয়স ৫০০০ থেকে ৫৩০০ বছর। সাথে সাথে হইচই পড়ে গেল। বিশেষজ্ঞরা এসে হাজির হলেন। মৃতদেহ সংরক্ষণ করা হলো এবং খুব কষ্টে ডিএনএ সংগ্রহ করা হলো। বহু পুরোনো মৃতদেহ থেকে সহজে ডিএনএ সংগ্রহ করা যায় না। আমাদের এই আইসম্যানের নাম দেওয়া হল অটজি (Ötzi) দি আইসম্যান। আইসম্যান দেখতে অনেকটা নিচের ছবির মত হতে পারে । সেই সময়ের ছবি আসলে পাওয়া সম্ভব না । এটা মমির উপর নির্ভর করে উচ্চ প্রযুক্তি ব্যবহার এমন ছবি তৈরি করা হয়েছে।
(Reconstruction by Kennis © South Tyrol Museum of Archaeology, Foto Ochsenreiter)

এর আগে এতো পুরানো কোন মানুষের দেহ পাওয়া যায় নি। বিশেষ করে প্রাকৃতিভাব মমিকৃত এমন মানুষ পাওয়াটা এই প্রথম । আইসম্যানের ডিএনএ পরীক্ষা করে আরেকটা মহাবিস্ময়কর তথ্য পাওয়া গেল। সেটা হলো এই বরফ মানবের ডিএনএর সাথে ইউরোপীয় মানুষের ডিএনএর অদ্ভুত মিল রয়েছে। ল্যাবে অনেক মানুষের ডিএনএর নমুনা থাকে। এমন অনেক মানুষই গবেষণার জন্য স্বেচ্ছায় নিজের ডিএনএ দিয়ে থাকেন। এমনই একজন স্বেচ্ছাসেবীর নাম ছিল ম্যারি মোসলে এবং এই ম্যারির সাথেই আমাদের এই আইসম্যানের ডিএনএর অদ্ভুত মিল পাওয়া গেল। আরও পরিস্কার করে বললে এই ম্যারির অতীত আত্মীয় ছিলেন এই আইসম্যান।একেবারে সরাসরি আত্মীয় । এর আগে এমন ভাবে অতীতের কোন ব্যক্তি এবং বর্তমানের কোন ব্যক্তির মধ্যকার এমন সরাসরি আত্মীয়তা খুজে পাওয়া যায় নি । এটাই ছিল প্রথম ।
এই ডিএনএর নমুনা যারা দিয়ে থাকেন, তাদের পরিচয় গোপন থাকে সব সময়। তবে ম্যারির কাছে যখন জানতে চাওয়া হলো যে মিডিয়ার সামনে তার নাম প্রকাশ করা যাবে কিনা, ম্যারি তখন এককথায় রাজি হয়ে গেল। সানডে টাইমের পরের সংখ্যার শিরোনাম ছিল ‘Iceman’s relative found in Dorset.’

কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই ম্যারি বিখ্যাত হয়ে গেলেন। পত্রিকায় সাক্ষাতকার দিলেন, টিভিতে গিয়ে হাজির হলেন । মানুষজন তার বাসায় তার সাথে দেখা সাক্ষাৎ করতে আসতে লাগল । ম্যারির খারাপ লাগছিল না। সুনাম বয়ে আনার সাথে সাথে ম্যারি নিজের মধ্যে একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করল। ম্যারি তার এই পাঁচ হাজার বছর পুরোনো আত্মীয়ের ব্যাপারে কিছু একটা অনুভব করতে শুরু করলেন। যেমন আমরা আমাদের কাছের আত্মীয়-স্বজনদের ব্যাপারে মায়া-ভালবাসা অনুভব করি, ম্যারিও তার এই প্রাগঐতিহাসিক আত্মীয়ের জন্য মায়া অনুভব করতে লাগলেন।

এই যে ম্যারির সাথে সেই পাঁচ হাজার বছর পুরোনো আইসম্যানের একটা ডিএনএ লিংক তৈরি করা গেল- এমন কি হতে পারে যে আধুনিক সব মানুষের বেলাতেই এই ডিএনএ লিংক তৈরি করা সম্ভব? ব্রায়ান সাইকসের মাথায় এই প্রশ্নটাই ঘুরপাক খাচ্ছিল। তিনি এই কঠিন কাজটাই করে দেখিয়েছেন তার গবেষণায়। তিনি দেখিয়েছেন যে ইউরোপের জীবিত প্রায় সবাই কোনো না কোনোভাবে অতীতের কারো ডিএনএর সাথে যুক্ত। এবং এর থেকেও মজার ব্যাপার হচ্ছে সব ইউরোপীয়দের ডিএনএ মাত্র সাতজন মহিলার থেকে এসেছে। মাত্র সাত জন! এই সাতজন মহিলা ৬৫০ মিলিয়ন আধুনিক ইউরোপীয়দের সরাসরি আদিমাতা! ব্রায়ান তাদের নামকরণ করেন। নামগুলো হল Ursula, Xenia, Helena, Velda, Tara, Katrine, and Jasmine। ব্রায়ান যখন তার গবেষণা প্রকাশ করলেন, তখন এই আদিমাতা গুলো বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ল। সবাই তাদের নিয়ে আলোচনা করতে শুরু করল। টিভিতে তাদের নিয়ে সংবাদ প্রকাশ হতে শুরু করল। লেখকরা তাদের নিয়ে গল্প লিখতে শুরু করলেন, শিল্পীরা ছবি আঁকতে শুরু করলেন।

পুরো গবেষণা এবং এর সাথে সমস্ত খুটিনাটি ব্রায়ান তার লেখা বই ‘The Seven Daughters of Eve’ প্রকাশ করেছেন। এতক্ষণ যা লিখলাম সেটা মূলত এই বইয়ের ভূমিকার একটা অংশ। এরপরেই আসল লেখা শুরু। ডিএনএ কী, সেটা দিয়ে শুরু করে একেবারে শেষ করেছেন কিভাবে সাতজন আদিমাতার সাথে পুরো ইউরোপ যুক্ত!

জেনেটিক্স এবং আদিমানব ইতিহাস নিয়ে আগ্রহ আছে কিংবা সায়েন্স ব্যাকগ্রাউন্ড না থাকা সত্ত্বেও সবাই বইটা পড়তে পারেন। এই বইয়ের পরের অধ্যায় গুলো নিয়ে আরও কয়েকটা পোস্ট দেওয়া ইচ্ছে আছে । আস্তে ধীরে সময় করে সেই পোস্টগুলো দিব আশা করি।



বইটা পড়ে ফেলুন। আশা করি সময় ভাল কাটবে । অন্যান্য নন-ফিকশন বই যেমন হয় এই বইটা তেমন না । এটা অনেকটা ফিকশনের মতই পড়তে মনে হয় ।


তথ্যসুত্র:
> The Seven Daughters of Eve by Bryan Sykes
> উইকিপিডিয়া

মন্তব্য ৮ টি রেটিং +৫/-০

মন্তব্য (৮) মন্তব্য লিখুন

১| ১৫ ই জুন, ২০২৪ সকাল ১১:৫৮

আহলান বলেছেন: হুম ! এক সময়ে আদম আর হাওয়া (আঃ) পর্যন্ত পৌছে যাওয়া যাবে ... ডারউইনের বান্দর তত্ব আবারো কি ধরা খেলো না কি?

১৫ ই জুন, ২০২৪ দুপুর ১২:১১

অপু তানভীর বলেছেন: বইটা ২০০১ সালের লেখা । সেই হিসাবে একেবারে আদি মানব মানবীর কাছে পৌছে যাওয়া অস্বাভাবিক না ! যদি পৌছে যার তবে সেটা মনগড়া কোন গল্প হবে না ।

২| ১৫ ই জুন, ২০২৪ বিকাল ৩:৪৬

আরইউ বলেছেন:



বইটা ইন্টারেস্টিং হবে মনে হচ্ছে। ধন্যবাদ, অপু, শেয়ার করার জন্য।

আহলান বলেছেন: হুম ! এক সময়ে আদম আর হাওয়া (আঃ) পর্যন্ত পৌছে যাওয়া যাবে ... ডারউইনের বান্দর তত্ব আবারো কি ধরা খেলো না কি?

ডারউইনের “বান্দর তত্ব” বলে কোন তত্ত্ব নেই; ন্যাচেরাল সিলেকশন নিয়ে আরেকটু পড়ালেখা করুন, ডারউইন বুঝতে সুবিধা হবে।

৩| ১৫ ই জুন, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৮

মরুভূমির জলদস্যু বলেছেন:
- চমৎকার লিখেছেন, এক নিমিশে পড়ে ফেলেছি। বইটি পড়ার আগ্রহ জাগলো।

৪| ১৫ ই জুন, ২০২৪ রাত ৯:৫০

হাসান কালবৈশাখী বলেছেন:

বই টা বঙ্গানুবাদ করে ফেলেন।
ইংরেজি পড়তে ভালো লাগে না। টেকনিক্যাল জিনিস বোঝা গেলেও অনেক বাক্যের মূল অর্থ বোঝা মুশকিল। মাতৃভাষাটা ছাড়া আসল মজাটা পাওয়া যায় না।

৫| ১৭ ই জুন, ২০২৪ ভোর ৪:৪৭

সন্ধ্যা রাতের ঝিঁঝিঁ বলেছেন: ব্যাপারটা মজার তো... হিউম্যান সাইকোলজি আর পিজিওলজি নিয়ে যতই পড়ি ততই মুগ্ধ হই। কত কিছু যে জানার আছে। পড়তে হবে.. ধন্যবাদ পোস্টের জন্য।

৬| ১৭ ই জুন, ২০২৪ সকাল ১০:০৩

শ্রাবণধারা বলেছেন: আপনার পোস্টটা কৌতুহলোদ্দীপক।

এই বইটি কিন্তু বিজ্ঞানের বই নয়, বইটি সেমি-ফিকশনাল বা আধা-কাল্পনিক জনরার একটা বই। এগুলো আসলে পপুলার অপবিঞ্জানের বই, অনেক টা মরিস বুকাইলির বাইবেল কোরান, বিজ্ঞান এই ধরনের (তুলনাটা খুব যথার্থ হল না)। দ্য দ্যা ভিঞ্চি কোড বইটি পড়ে যদি কেউ মনে করেন যে তিনি যিশু খিষ্ট্রের জীবনের ইতিহাস পড়ছেন, এটা যেমন ভুল হবে, তেমনি এই বই পড়ে যদি কেউ মনে করেন যে বিবর্তনবাদ সঠিক তত্ত্ব নয়, সেটাও তেমন হবে।

৭| ২০ শে জুন, ২০২৪ দুপুর ১২:০২

নীল আকাশ বলেছেন: আপনি অনুবাদ করছেন? এবার যেটা অনুবাদ করেছেন সেটা ভালো হয়েছে। এটাও করে ফেলুন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.