![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
একাকী আমি লিখছি জীবনের গলিতে গলিতে যে জীবন-গল্পের শেষ নেই... অন্তহীন !
বুদ্ধদেব বসুর ‘রাত ভ’রে বৃষ্টি’ উপন্যাসটা পড়লাম । একজন অনাহূত আগন্তুকের আবির্ভাবকে কেন্দ্র করে দু’জন মানব- মানবীর পারস্পরিক মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব ; বিশুদ্ধ – অবিশুদ্ধ চিন্তা , পবিত্র- অপবিত্র কল্পনা , অনুকূল- প্রতিকূল সিদ্ধান্ত, মঙ্গল-অমঙ্গল কামনা, দেহ-মনের বৈপরীত্য , জ্ঞানি –অজ্ঞানির অলিখিত প্রতিযোগিতা , ভাঙা- গড়ার অনিঃশেষ জটিল খেলা , ফেরা-না ফেরার দোলাচল , একটি মানবসন্তানকে ঘিরে দুজনের আপোষমুখী –বিমুখী মানসিকতা ...সবকিছু মিলিয়ে এককথায় অসাধারণ ।
সত্যিই তো ,সাত পাঁকে ঘুরে সঙ্গিনীর সিঁথিতে একদলা সিঁদুর কিংবা তিনবার কবুল বলার মাঝেই “ বিবাহ” ধারণার পরিসমাপ্তি নয়, বিবাহের মাধ্যমে জীবনসাথির মহাজীবনসমুদ্রে ডুবুরি হয়ে তুলে আনতে হয় সুখ, শান্তি,আপোষ ,ছাড়,শর্তহীন সম্মান আর আনুগত্যের টুকরো টুকরো নির্যাস । সে প্রচেষ্টা হতে হয় সহমর্মিতার সাথে, শ্রেষ্ঠত্ব কিংবা প্রভুত্ব জাহির করার মানসে নয় । নতুবা বিবাহ শব্দটা শুধুমাত্র মানব-মানবীর জৈবিক চাহিদার ধারণাকেই স্বীকৃতি দেবে কিন্তু অনন্ত মহাজীবনের সায়াহ্নে জীবন ভাগাভাগির স্বর্গীয় অনুভূতির স্রোতে হানা দেবে এক অপ্রতিরোধ্য,অকাট্য দানব – যার এক একটা নিঃশব্দ নিঃশ্বাস শান্ত, স্তব্ধ শহরে অতর্কিত বোমার মত বিস্ফোরিত হবে, যার পদচারণ জীবনানুভূতির সজীবতায় লেপটে দেবে নিবিড় গাঢ় অন্ধকার, যে অন্ধকারে মহাজীবনের ব্যর্থ পরিসমাপ্তির অপ্রত্যাশিত প্রত্যাশাই হবে অবধারিত নিয়তি ।
একটা বই দীর্ঘ সময় নিয়ে পড়াট আমার অভ্যাস । এই বইটা পড়তে গিয়ে বুদ্ধদেব বাবুর চিন্তার গভীরতা দেখে আমি যারপরনাই অবাক হয়েছি । মানুষের মনের গভীরে ঢুকে প্রতিটি সূক্ষ্ম অনুভূতিকে তুলে আনার কাজটা একমাত্র রবীন্দ্রনাথই পারেন – আমার এই ধারণার প্রশমন ঘটেছে “ রাত ভ’রে বৃষ্টি”তে ভিজতে ভিজতে । কিন্তু অবাক হয়েছি এই ভেবে যে মানবীয় সম্পর্কের এই অপরিত্যজ্জ দলিলকে “বিতর্কিত” করা হয়েছিল অশ্লীলতার অভিযোগে । যদিও উপন্যাসের পটভূমি অশ্লীলতার তথাকথিত আক্ষরিক অর্থকে অস্বীকার করছে চিন্তার,মননশীলতার, সময়োপযোগীতার ও সংস্কারহীন চেতনা সাপেক্ষে । নগ্নতাও এক ধরণের শিল্প । এ কথা মানতেই হয় যে নগ্নতা ও অশ্লীলতা শব্দ দুটো আপাতভাবে একই প্রান্তমুখি হলেও সমার্থক নয় । যেহেতু নগ্নতাকে শিল্পের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে । আর শিল্পকে কোন ধরাবাঁধা নিয়মের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করা যায়না , অনন্ত-অসীম আকাশ-সমুদ্রের মতই তার ব্যপ্তি । তবে নগ্নতার যে স্বরুপ সৌন্দর্যবোধের সীমাকে অতিক্রম করে যায় এবং ব্যক্তি,প্রতিষ্ঠান,সমাজ,রাষ্ট্রের দেহমনে অনৈতিক, নিয়মবিরুদ্ধ , অবিত্র চেতনার উদ্রেক করে তাই-ই অশ্লীলতা । নগ্নতা একটি শিল্প কিন্তু অশ্লীলতা একটি ব্যধি । উপন্যাসটিতে একটি মানুষের দেহ ও মনের গভীরে ঢোকার প্রয়াসটি স্পষ্ট, নিছক শারীরিক বর্ণনার অপ্রয়োজনীয় চিন্তাটি মাঠেই মারা যায় । কেননা চরিত্রগুলোর মানসিক,সামাজিক,পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়তায় সেইসব বর্ণনাগুলোকে প্রাসঙ্গিক মনে হয় । সেই বর্ণনাগুলোর অনুপস্থিতিতে হয়ত একটি “সুস্থ”, “সভ্যভব্য”, “সর্বজনবিদিত” উপন্যাস হিসেবে পরিগণিত হত কিন্তু একজন লেখকের চিন্তার ব্যপ্তিতে, সাহিত্য নামক আকাশে অবাধে বিচরণের স্বাধীনতায় বেড়ি দেওয়া হত। লেখকের অপ্রকাশিত সম্ভাবনার সামনে একটা অদৃশ্য দেয়াল বানিয়ে তাঁর কলম থেকে তথাকথিত “মডারেট” সাহিত্য আশা করা হত । এই জায়গায় বুদ্ধদেব অত্যন্ত সাহসিকতায় প্রচলিত চিন্তার পরিধিকে অতিক্রম করে গেছেন এবং সফলও হয়েছেন । বুদ্ধুদেব বসুর “আমরা তিনজন” ছোটগল্পটি পড়ে খুবই ভালো লেগেছিল আর “রাত ভ’রে বৃষ্টি” পড়ে সেই ভালোলাগা অনুরক্তির পর্যায়ে পৌঁছে গেছে । একজন মানুষের সৃষ্ট যেকোনো কিছুই যখন অপর একজন মানুষকে বাস্তবতা, চিন্তা কিংবা বিবেক তথা এক অদৃশ্য দর্পণের মুখোমুখি করে তাঁর মনের রুদ্ধ দ্বারগুলোর উন্মোচনে নৈপথ্যে ভূমিকা পালন করেন , তিনি সফল স্রষ্টা না হয়ে পারেনই না ।
©somewhere in net ltd.