![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সব সময় সৎ থাকতে চেষ্টা করি, সৎ চিন্তুা করি, অন্যের উপকার করতে চাই নিজের ক্ষতি করে হলেও। সম্পর্ককে খুব গুরুত্ব দিয়ে থাকি।
মেহেদী হাসান পলাশ
আগামী ৯ আগস্ট বিশ্ব আদিবাসী দিবস। অন্যন্যা বছরের মতো এ বছরেও বাংলাদেশের উপজাতি জনগোষ্ঠী সাড়ম্বরে দিনটি উৎযাপনের আয়োজন করেছে। কিন্তু বাংলাদেশে আদিবাসী কারা তা নিয়ে বিস্তর বিতর্ক রয়েছে। আদিবাসী শব্দের ইংলিশ প্রতিশব্দ Indigenous people. অনেকে আদিবাসী শব্দের প্রতিশব্দ হিসেবে Aborigine ব্যবহার করেন। কিন্তু Aborigine বলতে সার্বজনীনভাবে আদিবাসী বোঝায় না। Aborigine বলতে সুনির্দিষ্টভাবে অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের বোঝায়। অক্সফোর্ড ডিকশনারীতে Aborigine শব্দের অর্থ বলা হয়েছে ‘a member of a race of people who were the original living in a country, especially Australia’. একইভাবে Red Indian বলতে মার্কিন আদিবাসীদের বোঝায়, অস্ট্রেলীয় Aborigine বা আদিবাসীদের বোঝায় না। এ ছাড়াও বিভিন্ন ডিকশনারীতে আদিবাসী বিষয়ে যে সংজ্ঞা ও প্রতিশব্দ ব্যবহার করা হয়েছে তা নিম্নরূপ:
Aborigine: noun. a member of a race of people who were the original living in a country, especially Australia. Indigenous: belonging to a particular place rather than coming to it from somewhere else. Native. The indigenous people/indigenous area. Aborigine: earliest. Primitive. Indigenous. Indigenous: adj. Native born or produced naturally in a country, not imported (opposite to exotic).
অন্যদিকে বাংলা একাডেমীর অভিধানে Indigenous শব্দের অর্থ বলা হয়েছে: দেশী, দৈশিক, স্বদেশীয়, স্বদেশজাত। কোলকাতা থেকে প্রকাশিত সংসদ অভিধানে Indigenous শব্দের অর্থ হিসেবে বলা হয়েছে, স্বদেশজাত, দেশীয়। আবার চেম্বার্স ডিকশনারীতে Indigenous শব্দের অর্থ হিসেবে বলা হয়েছে, native born, originating or produced naturaly in a country, not imported. একই ডিকশনারীতে Indigenous শব্দের বিপরীত শব্দ হিসেবে exotic শব্দটিকে ব্যবহার করা হয়েছে- যার অর্থ বহিরাগত। অর্থাৎ অভিধানিকভাবে আদিবাসী শব্দের অর্থ দেশী, স্বদেশজাত বা ভূমিপুত্র। সে হিসাবে বাংলাদেশে বসবাসকারী উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর কোন সম্প্রদায়ই এখানকার আদিবাসিন্দা বা ভূমিজ সন্তান নয়, বহিরাগত। ৩০০-৮০০ বছর পূর্বে নানা কারণে বার্মা ও ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।
অবশ্য আদিবাসী বিষয়ে আভিধানিক সংজ্ঞার বাইরে জাতিসংঘের তরফ থেকে একটি সংজ্ঞা আমরা পেয়ে থাকি। এ বিষয়ে জাতিসংঘ ও এর অধিভূক্ত প্রতিষ্ঠান থেকে এ পর্যন্ত প্রধানত: তিনটি চার্টারের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। এগুলো হলো: ১৯৫৭ সালের ৫ জুন অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের অধিভূক্ত প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ৪০তম অধিবেশনে প্রদত্ত- Indigenous and Tribal Populations Convention, 1957 (No. 107), আইএলও’র ১৯৮৯ সালের ৭ জুন অনুষ্ঠিত ৭৬তম অধিবেশনে প্রদত্ত-Indigenous and Tribal Peoples Convention, 1989 (No. 169) , এবং ২০০৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত ৬১তম অধিবেশনে The United Nations Declaration on the Rights of Indigenous Peoples.
এখানে আইএলও’র প্রথম চার্টার দুটি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। চার্টার দুটির শিরোনাম হচ্ছে- Indigenous and Tribal Populations Convention . অর্থাৎ আদিবাসী ও উপজাতি জনগোষ্ঠী বিষয়ক কনভেনশন। অর্থাৎ এই কনভেনশনটি আদিবাসী ও উপজাতি বিষয়ক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট। কনভেনশনে পাস হওয়া ধারাগুলো একই সাথে আদিবাসী ও উপজাতি নির্ধারণ ও তাদের স্বার্থ সংরক্ষণ করে। শুধু আদিবাসীদের নয়। অথচ বাংলাদেশে এই চার্টারকে আদিবাসীদের জন্য এক্সক্লুসিভ করে উপস্থাপন করা হয়।
এই কনভেনশনে উপজাতি ও আদিবাসীদের জন্য আলাদা সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়েছে। Indigenous and Tribal Peoples Convention, 1989 (No. 169) – এর আর্টিকল ১ এর (a)তে ট্রাইবাল বা উপজাতির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে,
‘tribal peoples in independent countries whose social, cultural and economic conditions distinguish them from other sections of the national community, and whose status is regulated wholly or partially by their own customs or traditions or by special laws or regulations’’.
অর্থাৎ একটি দেশের মূল জনগোষ্ঠী থেকে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে ভিন্নতর যারা তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও আইন দ্বারা সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে পরিচলিত তাদেরকে উপজাতি বলা হয়। এখন আইএলও’র এই সংজ্ঞাটি যদি আমরা বাংলাদেশের চাকমা, মারমা, সাঁওতাল ও অন্যান্য সাবস্পেসিসসমূহের সাথে বিচার করি তাহলে পরিষ্কার বোঝা যায় এরা Tribal বা উপজাতি। কিন্তু বাংলাদেশের মতলববাজ বুদ্ধিজীবীরা আইএলও কনভেনশনের আর্টিকল ১-এ উপস্থাপিত ট্রাইবাল ডেফিনেশনটি সম্পূর্ণ চেপে গিয়ে শুধু ইনডিজিন্যাসের সংজ্ঞাটি উপস্থাপন করে।
এখন আমরা ইনডিজিন্যাসের সংজ্ঞাটি বিশ্লেষণ করবো। Indigenous and Tribal Peoples Convention, 1989 (No. 169)– এর আর্টিকল ১-এর (b)তে ইনডিডজিন্যাস বা আদিবাসীর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে,
`peoples in independent countries who are regarded as indigenous on account of their descent from the populations which inhabited the country, or a geographical region to which the country belongs, at the time of conquest or colonization or the establishment of present state boundaries and who, irrespective of their legal status, retain some or all of their own social, economic, cultural and political institutions’.
অর্থাৎ আদিবাসী তারা যারা একটি নির্দিষ্ট রাষ্ট্রে বংশানুক্রমে বসবাস করছে বা অধিকৃত হওয়া ও উপনিবেশ সৃষ্টির পূর্ব থেকে বসবাস করছে। এবং যারা তাদের কিছু বা সকল নিজস্ব সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও আইনগত অধিকার ও প্রতিষ্ঠানসমূহ ধরে রাখে।
আইএলও কর্তৃক উপজাতি ও আদিবাসী সংজ্ঞার মূল পার্থক্য হচ্ছে, নির্দিষ্ট রাষ্ট্রে বংশানুক্রমে বসবাস বা অধিকৃত হওয়ার বা উপনিবেশ সৃষ্টি পূর্ব থেকে বসবাস। বাকি শর্তগুলো মোটামুটি এক। অর্থাৎ একজন উপজাতি আদিবাসী হবেন বা হবেন না তা একটি রাষ্ট্রে ‘নির্দিষ্ট রাষ্ট্রে বংশানুক্রমে বসবাস বা অধিকৃত হওয়ার বা উপনিবেশ সৃষ্টি পূর্ব থেকে বসবাস’ শর্তের ভিত্তিতে বিবেচিত হবে। আদিবাসী বিষয়ক আরো একটি আন্তর্জাতিক আইন রয়েছে। তাহলো: ২০০৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের জাতিসংঘ সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত ৬১তম অধিবেশনে The United Nations Declaration on the Rights of Indigenous Peoples চার্টার। এটি এক্সক্লুসিভলি আদিবাসীদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট, উপজাতিদের নয়।
Indigenous and Tribal Populations Convention, 1957 (No. 107)- ১৯৫৭ সালে পাস হলেও এ পর্যন্ত বিশ্বের মাত্র ২৭টি দেশ এই কনভেশন র্যাটিফাই করেছে। ১৯৭২ সালের ২২ জুন বাংলাদেশ এই কনভেনশন র্যাটিফাই করেছে। বাংলাদেশের বাইরে উপমহাদেশের পাকিস্তান ও ভারত এই কনভেনশন র্যাটিফাই করেছে। যদিও এরই মধ্যে ৮টি দেশ এই কনভেনশনকে নিন্দা করে তা থেকে বেরিয়ে গেছে। অন্য দিকে Indigenous and Tribal Peoples Convention, 1989 (No. 169)- পাস হলেও এখন পর্যন্ত বিশ্বের মাত্র ২২টি দেশ এই কনভেনশন র্যাটিফাই করেছে। এরমধ্যে কনভেনশন-১০৭ থেকে বেরিয়ে আসা ৮টি দেশও রয়েছে। উপমাহদেশের একমাত্র নেপাল ছাড়া আর কোনো দেশ এই কনভেনশন র্যাটিফাই করেনি। কনভেনশন- ১৬৯ অবশ্য ১০৭-এর মডিফিকেশন, তবুও তা আলাদা করে র্যাটিফিকেশন করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। একটি আন্তর্জাতিক চার্টার কোনো দেশ র্যাটিফাই না করলে তা তার জন্য প্রযোজ্য নয়। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, আইএলও কনভেনশন ১০৭ ও ১৬৯ যে দেশগুলো র্যাটিফাই করেছে তাদের বেশিরভাগই আফ্রিকান ও দক্ষিণ আমেরিকান দেশ যাদের প্রধান বা অন্যতম প্রধান জনগোষ্ঠী বা গোষ্ঠীগুলো আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃত।
অন্যদিকে ২০০৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের ৬১তম অধিবেশনে আদিবাসী বিষয়ক একটি ঘোষণাপত্র উপস্থাপন করা হয়। এ ঘোষণাপত্র উপস্থাপন করলে ১৪৩টি দেশ প্রস্তাবের পক্ষে, ৪টি দেশ বিপক্ষে, ১১টি দেশ ভোট দানে বিরত এবং ৩৪টি দেশ অনুপস্থিত থাকে। ভোট দানে বিরত থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বিরুদ্ধে ভোট দেয়া দেশগুলো হচ্ছে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্র। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, বাংলাদেশে আদিবাসীদের অধিকার রক্ষায় খুব সোচ্চার ও পৃষ্ঠপোষক দেশগুলোর বেশিরভাগই কিন্তু নিজ দেশের জন্য আইএলও কনভেনশন ১০৭, ১৬৯ ও জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক চার্টারের সিগনেটরি বা ভোটদানকারী নয়। এ থেকেই নিজ দেশের আদিবাসীদের জন্য তাদের নিজেদের অবস্থান এবং অন্যদেশের ‘আদিবাসীদের’ জন্য কুম্ভিরাশ্রু বর্ষণের কারণ ও মতলব পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়। উল্লিখিত চারটি দেশ শুধু ইউএন চার্টারের বিপক্ষে ভোট দিয়েছে তাই নয় বরং অধিবেশনে তাদের প্রতিনিধিরা এই চার্টারের প্রবল সমালোচনা করে বক্তব্য দিয়েছে।
এখন বিবেচনা করা যাক, বাংলাদেশের উপজাতীয় জনগোষ্ঠীসমূহ বাংলাদেশের বর্তমান ভূখণ্ড অধিকৃত হওয়ার পূর্ব থেকে বা প্রি-কলোনিয়াল কি-না? তবে এ আলোচনার পূর্বে একটি বিষয় নির্ধারণ করা জরুরি যে, বিবেচনাটি কি সম্পূর্ণ বাংলাদেশ ভূখণ্ডের উপর হবে, না বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলভিত্তিক হবে। কারণ অঞ্চলভিত্তিক হলে সেন্টমার্টিন দ্বীপে যিনি প্রথম বসতিস্থাপন করেছেন তিনিও বাংলাদেশের আদিবাসী দাবীদার এবং আগামীতে যদি বাংলাদেশ ভূখণ্ডে নতুন কোনো দ্বীপ সৃষ্টি হয় আর সেই দ্বীপে যারা বা যিনি নতুন বসতি গড়বেন তিনিও আদিবাসী হবেন। একইভাবে ঢাকার আদি বাসিন্দা যারা তারাও বাংলাদেশের আদিবাসী এবং যেসকল উপজাতি ঢাকায় নানাভাবে স্যাটেল করেছেন তারা স্যাটেলার। কারণ এই সংজ্ঞার উপাদানগুলো ইংলিশ OR শব্দদ্বারা বা অথবা শব্দ দ্বারা বিভক্ত।
আর যদি সমগ্র বাংলাদেশ ভূখণ্ড ধরা হয়, তবে বাংলাদেশের প্রথম উপনিবেশকারী হচ্ছে আর্যজাতি। আর্যরা উত্তরবঙ্গ দিয়ে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে প্রবেশ করেছে। তখন বাংলাদেশ ভূখণ্ডে চাকমা, মারামা, গারো, হাজং, সাঁওতাল কারো অস্তিত্ব ছিল না। অর্থাৎ আর্যদের আগমনের পূর্বে এখানে যে অনার্য জনগোষ্ঠী বসবাস করতো তারা প্রি-কলোনিয়াল। আর্যদের আগমণের পূর্বে এখানকার অনার্য বাসিন্দারা প্রাকৃত ধর্মে বিশ্বাসী ছিল। আর্যদের প্রভাবে তারা সনাতন ধর্ম গ্রহণ করে। পরবর্তীতে হিন্দু রাজাদের নিকট থেকে বাংলা বৌদ্ধ রাজাদের দখলে যায়। বাংলাদেশে বৌদ্ধদের ইতিহাস সমৃদ্ধির ও গৌরবের ইতিহাস। বাংলা সাহিত্যের আদি কিতাব চর্যাপদ তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ। পাল রাজারা বাঙালি ছিলেন, যেমন ছিলেন মহামতি অতীশ দীপঙ্কর। বাংলায় বৌদ্ধদের ইতিহাস আর চাকমাদের ইতিহাস এক নয়।
অন্যদিকে উয়ারী বটেশ্বরের সমৃদ্ধ নাগরিক সভ্যতার কথা কিম্বা মেগাস্থিনিস ও টলেমির কিতাবে গ্রীক বীর আলেকজাণ্ডরের মনে ভীতি ছড়ানো গঙ্গরিড়ঢ়ী সভ্যতার কথা যারা জানেন তারা কখনোই চাকমা মারমা সাঁওতালদের প্রি-কলোনিয়াল বলতে পারেন না। চাকমাদের আলোচনায় অনেকে বৌদ্ধ-মুসলিম ইতিহাস টানেন যা অপ্রয়োজনীয় কুতর্ক। সেন রাজাদের অত্যাচার থেকে রক্ষা পেতে বাংলায় মুসলিম আগমন বৌদ্ধ সম্প্রদায় কর্তৃক স্বাগত হয়েছিল। এক কথায় বাংলাদেশের প্রি কলোনিয়াল জনগোষ্ঠী হচ্ছে এখানকার অনার্য জনগোষ্ঠী, ইতিহাসবিদরা যাকে প্রাকৃতজন বা প্রাকৃত জনগোষ্ঠী বলে আখ্যা দিয়েছেন। শত শত বছর ধরে হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলিম, খ্রিস্টান নানা ধর্মীয় পরিচয়ের মধ্যদিয়ে পরিবর্তিত হয়ে নানা ধর্মে বিভক্ত হয়ে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালি পরিচয়ে টিকে থাকা মূল জনগোষ্ঠী।
এখন খুব সংক্ষেপে আইএলও কনভেনশনের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ঐতিহ্য, আইন ও রাজনৈতিক বিষয়ের দিকে আলোকপাত করা যাক। বাংলাদেশের উপজাতি জনগোষ্ঠীগুলো শুরু থেকে আজ পর্যন্ত কোনো নির্দিষ্ট সামাজিক ও আইনি কাঠামো মেনে চলছে না। একই সাথে পরির্বতন এসেছে ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক ধারাতেও। রাষ্ট্র ও শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তনের সাথে সাথে তাদের রাজনৈতিক অবস্থানেরও পরিবর্তন হয়েছে। শুরুতেই চাকমাদের নিয়ে কথা বলা যায়। চাকমাদের নিজস্ব স্থায়ী কোনো রাজনৈতিক কাঠামো কোনো কালে ছিল বলে ইতিহাসে প্রমাণিত নয়। বর্তমানে চাকমারা প্রাচীনকালের বিভিন্ন চাকমা রাজার নানা বীরত্বগাথার কথা বলে থাকেন। চাকমাদের লেখা বইতেই বলা হচ্ছে, এগুলো কিংবদন্তী। কিংবদন্তী ইতিহাসের উপাদান হিসেবে গণ্য হতে পারে কিন্তু ইতিহাস হিসেবে বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত নয়। মোগল আমলে বিভিন্ন মুসলিম নামধারী চাকমা রাজার ইতিহাস রয়েছে। কিন্তু তারা মোগল সুবাদার। অবশ্য অনেক গবেষকদের মতে চাকমা রাজাগণ রাজত্ব টিকিয়ে রাখতে মুসলিম উপাধী ও জীবনদর্শন গ্রহণ করে। চাকমারা তাদের রাজা মেনে নিয়েছিল ও মানতে বাধ্য হয়েছিল। আজকের চাকমা রাজার কাঠামোটি ব্রিটিশদের দেয়া। এর প্রকৃত নাম সার্কেল চিফ। কার্যত তা কালেক্টর বা প্রধান খাজনা আদায়কারী। মোগল বা ব্রিটিশরা তাদের রাজা বলে কোনো সনদ দেয়নি। ব্রিটিশ সরকার সমতলের জমিদারদের জমিদারী দিলেও সার্কেল চিফদের জমির মলিক ছিল ডিস্ট্রিক্ট সুপরিন্টেন্ড তথা সরকার। কিন্তু খাজনা আদায়ের দায়িত্ব পেয়ে চাকমা সার্কেল চিফ নিজেকে সামন্ত রাজায় পরিণত করেন খাজনা আদায়ের নানা আচার যোগ করে। সাম্যবাদী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা শুরুতে এই সামন্ততন্ত্রের শোষণ থেকে উপজাতীয় জনগণকে মুক্তি দিতে সমাজতান্ত্রিক (বামধারা) আন্দোলন শুরু করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু সাংবিধানিক ভুল না করলে এমএন লারমাকে বিশ্ব হয়তো সাম্যবাদী নেতা হিসেবেই চিনতো। কিন্তু ’৭২-এর সংবিধান ইতিহাসের গতি পাল্টে দিলেও সন্তু লারমা ও দেবশীষ রায়ের সেই দূরত্ব এখনো বিদ্যমান ভেতরে ভেতরে। কিন্তু এমএন লারমার প্রতিষ্ঠিত জেএসএস বা পরবর্তীকালের ইউপিডিএফ কোনো নির্দিষ্ট জাতিগোষ্ঠীর রাজনৈতিক কাঠামো নয়, এটি অঞ্চলভিত্তিক রাজনৈতিক কাঠামো। তাছাড়া সকল উপজাতি সম্প্রদায়ের লোকেরাই এখন বিএনপি, আওয়ামী লীগের মতো বাংলাদেশের মূল ধারার রাজনীতির সাথে জড়িত। এভাবেই চাকমা সমাজদেহেও নানা পরিবর্তন এসেছে। চাকমারা নিজ সম্প্রদায়ের মধ্যেই বিয়ে করে। কিন্তু চাকমা রাজা দেবাশীষ রায় নিজে দ্বিতীয় পাণি গ্রহণ করেছেন রাখাইন সম্প্রদায়ের এক মেয়েকে। অষ্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিত এই বিয়ের অনুষ্ঠানে বর কনে ঐতিহ্যবাহী পোষাকের পরিবর্তে পাশ্চত্যের স্যুট, টাই ও গাউন পরেছিলেন।
অন্যদিকে উপজাতীয় সংস্কৃতি প্রধানত ধর্ম থেকে উৎসারিত। কিন্তু বাংলাদেশের উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা বাদে অন্যান্য উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর অধিকাংশ ভাগ ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেছে। মারমা ও ত্রিপুরাদের মধ্যেও প্রায় ৫০ ভাগ খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত হয়েছে। চাকমাদের ক্ষেত্রে এই হার কিছুটা কম। কিন্তু চাকমাদের আদি ধর্ম বৌদ্ধ নয়। ব্রিটিশ আমলে রানী কালিন্দী রায়ের বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করার আগে চাকমা রাজারা বিভিন্ন ধর্মে ছিল। এভাবে ধর্ম পরিবর্তনের সাথে সাথে উপজাতি জনগোষ্ঠীর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আচার, রীতিতে পরিবর্তন এসেছে। শিক্ষা, অর্থনীতি ও প্রযুক্তির প্রভাবেও পাল্টে গেছে জীবনযাপনও। কয়েকটি অনুষ্ঠান ছাড়া নাগরিক ও সচ্ছল উপজাতিদের নিজস্ব পোশাকের ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায় না। সেখানকার মিশনারীরাও ধর্মান্তরিত উপজাতিদের পূজা আর্চায় বাধা দেয় না ‘আদিবাসী’ তকমা ধরে রাখার জন্য। একান্ত ব্যক্তিগত আলাপচারিতা ছাড়া নিজস্ব ভাষায় কথা বলেনা তারা।
মাইকেল সঞ্জীব দ্রং আদিবাসী নেতা হতে পারেন কিন্তু কোনো উপজাতি যদি ইসলাম ধর্মগ্রহণ করেন তাহলে তিনি আদিবাসী হওয়ায় যোগ্যতা হারান। যদিও খ্রিস্ট ও বৌদ্ধ ধর্ম সংখ্যাতাত্তিক বিচারে ইসলামের থেকে বৃহৎ ধর্ম। একইভাবে নিজস্ব বর্ণমালার কথা বলে বাংলা বর্ণমালা বর্জন করলেও ইউরোপীয় বর্ণমালাতে তাদের কোনো আপত্তি নেই। যদিও লেখালেখির সময় বাংলাবর্ণমালা ব্যবহারেই অভ্যস্ত তারা। যদি আদিম পদ্ধতিতে জীবনযাপনের কথা বলা হয়, তাহলে পৃথিবীর আদিম পেশা হচ্ছে কৃষি ও শিকার। সে বিচারে বাংলার কৃষক ও জেলেদের আদিবাসী বলতে হয়। এককথায় সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিচারেও বাংলাদেশের উপজাতিরা আদিবাসী নয়।
এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি জনগোষ্ঠীর একটা বিপুল অংশ নিজেদের আদিবাসী মনে করেন না। পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যতম প্রধান আঞ্চলিক দল ইউপিডিএফ এই আদিবাসী তত্ত্বে বিশ্বাসী নয়। তারা আদিবাসী দিবস পালনও করে না। ইউপিডিএফ’র অন্যতম শীর্ষ নেতা উজ্জ্বল স্মৃতি চাকমা এক সাক্ষাৎকারে আমাকে একথা পরিষ্কার করে বলেছিলেন তারা আদিবাসী কনসেপ্টে বিশ্বাসী নন। তবে উপজাতি শব্দের প্রতিও তাদের আপত্তি আছে। তাদের মতে বাংলাদেশে অনেক জাতিগোষ্ঠী বসবাস করে। যেমন বাঙালি একটি জাতি তেমনি চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা প্রভৃতিও এক একটি জাতি। সন্তু লারমার ঘনিষ্ঠদের সাথে কথা বলে জেনেছি, তিনিও শুরুতে এই আদিবাসী কনসেপ্টের সাথে একমত ছিলেন না। এখনও তার কাছে এটি মুফতে পাওয়ার মতো একটি বিষয়। গত ১১ আগস্ট ২০১৪ সালে সাবেক পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদার রাঙামাটিতে এক অনুষ্ঠানে বলেন, আমি ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশে যখন প্রথম আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উদযাপন করেছিলাম, তখন সন্তু লারমা বলেছিলেন এই দেশে কোন আদিবাসী নাই, এখানে আমরা সবাই উপজাতি। জুম্ম জনগণের আন্দোলন ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার জন্য আদিবাসী দিবস পালন করা হচ্ছে। সাবেক প্রতিমন্ত্রী আরো বলেন, ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চুক্তি সম্পাদনের সময়ে আমি সন্তু লারমাকে বলেছিলাম এসময়ে উপজাতির পরিবর্তে আদিবাসী বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করে ফেলি, তখনও সন্তু লারমা রাজি হননি। তখনও সন্তু লারমা বলেছিলেন আমরা আদিবাসী নই, আমরা উপজাতি।
অপরদিকে, বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিশেষ উপদেষ্টার দায়িত্ব পালনকালে চাকমা সার্কেল চীফ রাজা ব্যরিস্টার দেবাশিষ রায় রাষ্ট্রীয়ভাবে অফিসিয়ালি লিখেছেন বাংলাদেশে কোন আদিবাসী নাই, কিছু জনগোষ্ঠী আছে উপজাতি। তাহলে এখন কেন আদিবাসী দাবিতে সংগ্রাম সংঘর্ষের পরিবেশ সৃষ্টি করা হচ্ছে। এটি কোন ষড়যন্ত্রের আলামত ? তবে আদিবাসী বিষয়টি একান্তভাবে সার্কেল চীফ দেবাশীষ রায়ের কনসেপ্ট।
কাজেই জাতিসংঘ ও আইএলওর সংজ্ঞার অপব্যাখ্যা বাংলাদেশের উপজাতি জনগোষ্ঠীদের আদিবাসী বানানোর কোনো সুযোগ নেই। বরং ওইসব কনভেনশন ও চার্টার অনুযায়ী ট্রাইবাল বা উপজাতির যে সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে তা বিচার করেই নিশ্চিতভাবে বলা যায় বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলো উপজাতি। একই কারণে আদিবাসী বিষয়ক জাতিসংঘ চাটার বাংলাদেশের উপজাতিদের জন্য প্রযোজ্য নয়। email: [email protected]
১০ ই আগস্ট, ২০১৫ বিকাল ৩:৪৭
পার্বত্যিনউজ বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ কষ্ট করে পড়ার জন্য। আশা করি এই সিরিজের বাকি লেখাগুলোও পড়বেন।
©somewhere in net ltd.
১|
০৯ ই আগস্ট, ২০১৫ সকাল ৭:০৬
কি করি আজ ভেবে না পাই বলেছেন: অ সা ধা র ণ একটি পোষ্ট
অধ্যাপক এন এম হাবিব উল্লাহ রচিত ''রোহিঙ্গা জাতির ইতিহাস'' গ্রন্থেও এ বিষয়ে মোটামুটি একটা ধারনা পাওয়া যায়।
অযাচিত ভূমিপূত্র সংজ্ঞায়িত করার ফল যে কতটা অপরিনামদর্শী তার ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত আমাদের আশেপাশের দেশগুলিতেই বিস্তর।ন্যায্য দাবীর পরও কাশ্মীর,সেভেন সিস্টারস্,ফিলিস্তিন,আরাকানী মুসলিম প্রভৃতি জাতি যুগ যুগ সংগ্রাম করে তাদের ঠিকানা/পরিচয় পাচ্ছেনা সেখানে উড়ে এসে জুড়ে বসা কতক ক্ষূদ্রাতিক্ষূদ্র নৃ-গোষ্ঠির ভূমিপূত্র দাবীকরণ হাস্যকার ছাড়া আর কিছুই না।এ যেনো বসতে দিলাম এবার শুতে চায়,শুতে দিলাম এবার জায়গার মালিকানা দাবী।এসব স্রেফ এদেশেই সম্ভব।
বুদ্বিবৃত্তিক চর্চার জন্য সবচাইতে জরুরী দেশপ্রেম এবং দূরদর্শীতা।সাত পাঁচ না ভেবে লাফায় মূর্খের দল।আর যেসব তথাকথিত বুদ্ধিজীবিরা লাফাচ্ছেন,হয় ঘটে কিছু নেই অথবা কারো স্বার্থ কিংবা অর্থে কাজ করছেন।
অনেক ধন্যবাদ স্যার
প্রিয়তে