![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
মাতৃত্ব
ইসলাম নারীকে প্রতিটি সম্পর্কে সম্মানিত করেছে। আর সর্বোচ্চ মর্যাদা দান করেছে মায়ের ভূমিকায়। মাতৃত্বের প্রতিটি স্তরকে ইসলাম ধর্মে পূর্ণ মাত্রায় মূল্যায়ণ করা হয়েছে। মাতৃত্বের সূচনালগ্ন থেকে শুরু করে একজন মায়ের মৃত্যু পরবর্তী সময়েও তার সন্তানের নেক আমল দ্বারা উপকৃত হওয়ার সকল পথ উন্মুক্ত রেখেছেন, যা কোরআন হাদিসের আলোকে সুস্পষ্ট তুলে ধরা যায়। একদা জনৈক সাহাবী নবীজী ﷺ এর কাছে এসে তার সদাচার পাওয়ার অধিক হকদার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে, নবীজী ﷺ তিন বারই মায়ের কথা উল্লেখ করেন এবং চতুর্থ বারে বাবার কথা বলেন। (বুখারী: ৫৯৭১) নিম্নে মাতৃত্বের প্রতিটি স্তরে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি ও কল্যানকর দিকনির্দেশনা তুলে ধরা হলো।
ঋতুস্রাব
যখন একটি মেয়ে বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছায়, তখন তার ৩/৪ লাখ ডিম্বাণু থাকে। প্রতি মাসিক চক্রে নারীদেহে একটি পূর্ণাঙ্গ ডিম্বাণু গঠিত হয় এবং ১২ থেকে ২৪ ঘন্টা অক্ষত থাকে, এ সময়ের মাঝে শুক্রাণু দ্বারা নিষিক্ত হলে নারী গর্ভধারণ করতে পারে। অন্যথায় এই ডিম্বাণুটি ভেঙে অতিরিক্ত আরো অপূর্ণ ডিম্বাণু ও জরায়ুর মুখে জমা রক্ত সহ ৩০ থেকে ৯০ মিলিলিটার তরল শরীরের বাইরে ২ থেকে ৭ দিনের মধ্যে বেরিয়ে আসে যা প্রতি মাসে একবার কিংবা নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর ঘটে যাকে ঋতুস্রাব বলে। নারীদেহে ডিম্বাণু পরিপক্ব হওয়া শুরু মানে একটি মেয়ে গর্ভধারণে সক্ষম। (thinkschool.org)
বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতিতে ঋতুস্রাব
প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই মেয়েদের ঋতুস্রাব নিয়ে নানাবিধ কুসংস্কার ও কুপ্রথা প্রচলিত আছে। বিশেষত ভারতীয় উপমহাদেশ, আফ্রিকার কিছু অঞ্চলে মেয়েদের মাসিকের সময়টা যন্ত্রণায় পরিণত হয়। মাসিক নিয়ে বহুল প্রচলিত মিথের একটা হলো এই সময় মেয়েরা দুর্ভাগ্য বয়ে আনে। নেপালে মাসিকের সময় মেয়েদেরকে বাধ্য হয়ে বাড়ির বাইরে একটা কুড়ে ঘরে বাস করতে হয় নেপালি ভাষায় যাকে বলে “ছুয়াপদি”। মাসিক হলে মেয়েরা অশুচি হয়ে যায়। এই সময়ে তারা কোন ধর্মীয় কাজে অংশগ্রহণ করতে পারে না। এমনকি রান্নাঘরে প্রবেশও তাদের জন্য নিষেধ । জার্মানিতে মাখন নাকি ঘন হয় না, ফ্রান্সে মেয়নিজে স্বাদ পাওয়া যায় না, ইটালিতে ময়দা দলা বাঁধে না। মাসিকের সময় মেয়েরা অপরিষ্কার হয়ে যায় ফলে শাস্ত্রে তাদের মন্দিরে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আছে। রোমানিয়াতে মাসিকের সময় ফুল ধরা নিষেধ। এতে ফুল নাকি কিছুক্ষণের মধ্যে মরে ঝরে যায়। কম্বোডিয়াতে মানুষের মাঝে প্রচার আছে, মাসিকের সময় প্যাড ব্যবহার করলে মেয়েদের কৌমার্য নষ্ট হয়ে যায়। দক্ষিণ কোরিয়ার একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা রেনা পার্ক বলছেন, “কোরিয়ান সমাজের কিছু মানুষের বিশ্বাস স্যানিটারি প্যাড কোম্পানি তাদের ব্যবসার প্রচার প্রসারের জন্য মাসিক নিয়ে মিথ বানিয়েছে। বাজারে ব্যবসা করার জন্য তারা মেয়েদের কৌমার্য ও সতীত্ব নষ্ট করছে।" (thinkschool.org)
নারীজীবনে ঋতুস্রাবের প্রভাব
ঋতুস্রাবের দরুন নারীদের হরমোনাল পরিবর্তন শরীর এবং মস্তিষ্ককে নানাভাবে প্রভাবিত করে। ঋতুস্রাবের প্রায় দুই সপ্তাহ আগে হরমোন ও স্নায়ুসন্ধির নিউরোট্রান্সমিটারের মাত্রা পরিবর্তনের ফলে বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক লক্ষণ দেখা দিতে পারে। যেমন ক্লান্তি, খাবারে অনীহা বা ক্ষুধা বেড়ে যাওয়া, ফোলাভাব, অনিদ্রা, স্তনের কোমলতা, মাথাব্যথা, এবং জয়েন্ট বা পেশী ব্যথা, জ্বরজ্বর ভাব। ঋতুস্রাব চলাকালীন জরায়ুমুখ উন্মুক্ত থাকে, জরায়ু অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় থাকে, সামান্য আঘাতেও মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। রক্তপাতজনিত ক্লান্তি ও অস্বস্তি ছাড়াও কিছু মেয়ের এই সময়ে মারাত্মক পেটে ব্যথা হয়। এ সময় হরমোনের প্রভাবে মানসিক ও শারীরিক বেশ কিছু পরিবর্তন ঘটে। মস্তিষ্কের উপর যেসব প্রভাব পড়তে পারে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল: মেজাজের ওঠানামা বা মুড ফ্লাকচুয়েশন, বিষণ্নতা, বদমেজাজ বা উদ্বেগ। এছাড়া, অনেকের মনোযোগের সমস্যা দেখা দেয়। ধারণা করা হয় যে প্রতি ৪ জন মহিলার মধ্যে ৩ জন এ লক্ষণগুলির কোনো না কোনো ধরন অনুভব করেছেন।(houseofvolunteers.org)
ইসলামের দৃষ্টিতে ঋতুস্রাব :
নারীর শারীরিক দুর্বলতা ও মন-মানসিকতার দিক বিবেচনা সাপেক্ষে শরীয়তে ঋতুবতী নারীর জন্য এমন সমাধান দিয়েছেন সহজ ও কল্যাণকর। আল্লাহ তায়ালা কোরআনে কারিমে উল্লেখ করেছেন,
“আর তারা তোমাকে হায়েজ(ঋতুস্রাব) সম্পর্কে প্রশ্ন করে,বল তা কষ্টকর। সুতরাং তোমরা হায়েজকালে স্ত্রী সঙ্গম (যৌনমিলন) বর্জন করবে এবং তারা পবিত্র না হওয়া পর্যন্ত স্ত্রী সঙ্গম করবে না। অতঃপর তারা যখন পবিত্র হবে তখন তাদের নিকট ঠিক সে ভাবে গমন করবে যেভাবে আল্লাহ্ তোমাদেরকে আদেশ দিয়েছেন। নিশ্চয় আল্লাহ তাওবাকারীদেরকে ভালবাসেন এবং ভালবাসেন অধিক পবিত্রতা অর্জনকারীদেরকে।”।(সুরা বাকারাহঃ ২২২)
এতদ্ব্যতীত হাদিসের আলোকে ঋতুবতী নারীর করণীয় ও বর্জনীয় সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। সালাত এমন একটি ফরজ বিধান যা প্রতিটি সুস্থ মস্তিস্ক সম্পন্ন সাবালেগ নরনারীর জন্য সর্বাবস্থায় ফরজ, দাঁড়িয়ে বসে পড়তে অক্ষম হলে শুয়ে ইশারায় সালাত আদায় করতে হবে এমনকি যুদ্ধের ময়দানেও সালাতের হুকুম রয়েছে। কিন্তু একমাত্র নারীদের ক্ষেত্রে ঋতুস্রাব চলাকালীন দিনগুলোতে সালাতে ছাড় আছে এবং পরবর্তীতে কাযা আদায় করারও বিধান নেই। (মুসলিম হা/৩৩৫; আবূদাউদ হা/২৬২; নাসাঈ হা/৩৮২) এ সময় নারীদের পর্যাপ্ত পানি পানের প্রয়োজন হয়, শরীয়তে এ অবস্থায় সিয়াম পালনও নিষেধ কিন্তু পরবর্তী সময়ে তা আদায় করতে হবে। এ থেকে বুঝা যায় ইসলামি বিধান ঋতুবতী নারীর পূর্ণ বিশ্রামের ব্যবস্থা রেখেছেন। (বুখারী হা/৩০৪, ১৯৫১; মিশকাত হা/১৯) ইসলামে ঋতুবতী নারীকে অপবিত্র বলা হয়নি যার ফলে নারীদের মসজিদে প্রবেশও নিষিদ্ধ নয়। তবে ইতিকাফ করার অনুমতি নেই। (মুসলিম হা/২৯৮; আবূদাউদ হা/২৬১; মিশকাত হা/৫৪৯) নবীজি ﷺ ঋতুবতী নারীদেরও ঈদের আনন্দ উপভোগের জন্য ঈদগাহে শামিল হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন তবে তারা নামাজ থেকে বিরত থাকবে। (মুসলিম: ৮৯০) তাওয়াফ ব্যতিত হজ্জের যাবতীয় বিধান পালনে কোন বাধা নেই। (বুখারী হা/৩০৫; ও মুসলিম হা/১২১১) এ সময় নারীরা মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্ত থাকে, শরীয়তে ঋতুবতী নারীকে তালাক দেয়াও নিষেধ। (বুখারী হা/৫২৫১; মিশকাত হা/৩২৭৫) উম্মুল মুমিনীনরা ঋতুস্রাবের সময় আলাদা কাপড় ব্যবহার করতেন এবং ঋতুস্রাবের পর ভালোমত সুগন্ধি দ্বারা পরিচ্ছন্ন হতেন ও গোসল করে নিতেন, যা নারীদের পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা শিক্ষা দেয়। (বুখারী :৩২৩, ৩১৫)
গর্ভধারণ
গর্ভধারণ হলো নারীর দেহের অভ্যন্তরে শুক্রাণু দ্বারা নিষিক্ত ডিম্বাণু থেকে একটি সন্তান গঠিত হওয়ার দীর্ঘ ও জটিল প্রক্রিয়া। ৩৬ থেকে ৪০ সপ্তাহ পর্যন্ত মাতৃগর্ভে মায়ের রক্ত হতে অক্সিজেন, পুষ্টি ও প্রয়োজনীয় উপাদান শিশুর রক্তে প্রবেশ করে এবং শিশুর রক্ত হতে বর্জ্য পদার্থগুলো মাতৃরক্তে প্রবেশ করে। (proshikkhon.net)
নারীজীবনে গর্ভাবস্থার প্রভাব
গর্ভধারণের পুরো সময় জুড়ে মায়েদের বিভিন্নরকম শারীরিক মানসিক পরিবর্তন ঘটে। শরীরে দুর্বলতা ও অবসাদ অনুভূতি, প্রাতঃকালীন অসুস্থতা যেমন মাথা ঘোরা, বমি বমি ভাব, কোষ্ঠকাঠিন্য, স্তন পরিবর্তন, বুক জ্বালা, হজম প্রক্রিয়ার পরিবর্তন, ক্ষুধাবৃদ্ধি কিংবা খাদ্যে অরুচি, তলপেটে ব্যথা, জরায়ু প্রসারিত হওয়া, হরমোনের পরিবর্তন, লিগামেন্ট প্রসারিত হওয়া, শরীরের বিভিন্ন জায়গায় বিশেষ করে মাংসপেশিতে ব্যথা, শরীর বিভিন্ন অংশে কালোদাগ দেখা দেয়া, পেট বড় হয়ে যাওয়া, আগের তুলনায় অধিক ওজন বেড়ে যায়, মেরুদণ্ডের নিচের দিকে বা কোমরে ব্যথা, প্রসাবের চাপ বৃদ্ধি বিশেষ করে রাতের বেলা, ঘুমের সময় অস্বস্তি বোধ, শালদুধ নিঃসরণ, এবং শ্বাসকষ্ট হওয়া। (my.clevelandclinic.org) অন্তঃসত্ত্বা নারীদের অনেক সময় রক্তে চিনির পরিমাণ বেড়ে যায়, যাকে বলে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস। বেশিরভাগ সময় সন্তান প্রসবের পর এটি চলে যায়। দাঁতের মাড়ি ফুলে যাওয়া, ব্রাশ করার সময় রক্ত বের হওয়া, মাড়িতে ব্যথা হতে পারে। গর্ভাবস্থায় রক্তশূন্যতা হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কারণ শরীরে আয়রনের চাহিদা বাড়ে। এ সময় নারীর শরীরে তরল উৎপাদন বেড়ে যায়। এতে পায়ে পানি জমে ফোলা ভাব হতে পারে। অনেকের উচ্চ রক্তচাপ হয়ে থাকে। এসব শারীরিক পরিবর্তন নারীর মনের ওপর প্রবল চাপ তৈরি করে। এ সময় উদ্বেগ, অনিশ্চয়তা, বিষণ্ণতা, রাগ, মুড সুইয়িং বা মেজাজ বদল এ রকম অনেক কিছু ঘটে নারীর মনে। অনেকে আবেগের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে তাঁরা খুব অল্পতেই কেঁদে ফেলেন, বিরক্ত হন, রেগে যান, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। (samakal.com)
গর্ভাবস্থায় ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি
নারীর গর্ভধারণের জটিল প্রক্রিয়াটি ১৪০০ বছর পূর্বেই আল্লাহ তায়ালা কোরআনে লিপিবদ্ধ করেছেন এবং মায়ের কষ্টকে মূল্যায়ন করেছেন।
" তিনি তোমাদের মাতৃগর্ভের ত্রিবিধ অন্ধকারে* পর্যায়ক্রমে সৃষ্টি করেছেন। "(সুরা যুমার :৬) *প্রথম অন্ধকার মায়ের পেট, দ্বিতীয় গর্ভাশয়, তৃতীয় ঝিল্লী; সেই পাতলা আবরণ যাতে বাচ্চা জড়ানো থাকে। (তাফসীরে আহসানুল বায়ান)
"তারপর আমি তাকে শুক্রবিন্দুরূপে এক সংরক্ষিত আধারে স্থাপন করেছি। তারপর শুক্রকে আমি ‘আলাকায় পরিণত করি। তারপর ‘আলাকাকে মুদগাতে পরিণত করি। তারপর মুদগাকে হাড়ে পরিণত করি। তারপর হাড়কে গোশ্ত দিয়ে আবৃত করি। অতঃপর তাকে অন্য এক সৃষ্টিরূপে গড়ে তুলি। অতএব সর্বোত্তম স্রষ্টা আল্লাহ কত বরকতময়!" (সুরা মুমিমুন :১৩,,১৪)
"হে মানুষ! যদি তোমরা পুনরুত্থানের ব্যাপারে সন্দেহে থাক তবে নিশ্চয়ই জেনে রেখো, আমি তোমাদেরকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছি, তারপর শুক্র থেকে, তারপর আলাকা* থেকে, তারপর পূর্ণাকৃতিবিশিষ্ট অথবা অপূর্ণাকৃতিবিশিষ্ট গোশ্ত থেকে। তোমাদের নিকট বিষয়টি সুস্পষ্টরূপে বর্ণনা করার নিমিত্তে। আর আমি যা ইচ্ছা করি তা একটি নির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত মাতৃগর্ভে অবস্থিত রাখি। অতঃপর আমি তোমাদেরকে শিশুরূপে বের করি,......" (সুরা হজ্জ :৫)
ইসলামী শরীয়তে গর্ভাবস্থায় একজন মায়ের জন্য ইবাদত সহজ করে দেয়া হয়েছে। অন্তঃসত্ত্বা নারীর নামাজের বিধান অসুস্থ ব্যক্তির মতোই। সে তার সাধ্য অনুযায়ী নামাজ পড়বে। দাঁড়িয়ে কষ্ট হলে বসে পড়বে। সম্ভব হলে জমিনের ওপর সিজদা করবে অথবা ইশারায় সিজদা করবে। (সুনানে বাইহাকি: ৩৪৮৪) সিয়াম পালনের ক্ষেত্রেও ছাড় রয়েছে, যদি সিয়াম রাখা মা অথবা সন্তান কারো জন্য ক্ষতিকর হয় তবে অসুস্থ ব্যক্তির ন্যায় পরবর্তী সময়ে কাযা তুলবে। (সুরা বাকারা :৮৪) ইসলামে একজন গর্ভবতী নারীর মানসিক ও আর্থিক নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে তালাকের ইদ্দত ধার্য করা হয়েছে বাচ্চা প্রসব পর্যন্ত, ততদিন পর্যন্ত তার ব্যয়ভার বহন করবে সন্তানের পিতা এবং প্রত্যাহারযোগ্য তালাক হলে সে তার তত্বাবধানে থাকবে। (সুরা তালাক:৪) একজন গর্ভবতী নারীকে ইসলামে এতো বেশি মর্যাদা দেওয়া হয়েছে যে, গর্ভধারণের কারণে মারা গেলে তাকে শহীদ বলা হয়েছে। (আবু দাউদ :৩১১১) আবার গর্ভাবস্থায় যদি সন্তান মারা যায় তাহলে সে সন্তান মাকে জান্নাতে নিয়ে যাবে। (ইবনে মাজাহ :১৬০৯)
প্রসব
গর্ভের সন্তানকে জরায়ু থেকে বের করে বাইরের জগতে নিয়ে আসার প্রক্রিয়াটি হলো প্রসব, যোনীপথ দিয়ে বের করার প্রক্রিয়া নরমাল ডেলিভারি নামে পরিচিত। আরেকটি পদ্ধতি হচ্ছে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে পেট কেটে শিশু বের করা, যাকে সিজারিয়ান ডেলিভারি বলা হয়। গর্ভাবস্থার ৩৮ থেকে ৪২ সপ্তাহের মাঝে সাধারণত প্রসব ব্যথা শুরু হয়ে থাকে, যা সন্তানের পৃথিবীতে ভূমিষ্ট হওয়ার পূর্ব মূহুর্ত ইঙ্গিত করে।
নারীর জীবনে প্রসবের প্রভাব :
সন্তান প্রসবের সময় হলে অক্সিটোসিন নামক হরমোনের প্রভাবে জরায়ুতে সংকোচন শুরু হয়। এই সংকোচন মূলত গর্ভের সন্তানকে ঠেলে নিচে নামানোর জন্য হয়। প্রসব প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপে জরায়ুর সংকোচনের ফলে জরায়ুমুখ প্রসারিত হয়। সন্তান তলপেটের দিকে নেমে যাওয়ার কারণে শ্বাস নেওয়া আগের চেয়ে সহজ হয়ে যেতে পারে। যদি গর্ভাবস্থায় বুকে অ্যাসিডিটির কারণে জ্বালাপোড়া থেকে থাকে সেটিও এসময় দূর হয়ে যেতে পারে। তবে এসময় কিডনির ওপর বাড়তি চাপ পড়ার কারণে ঘন ঘন প্রস্রাবের বেগ পাওয়ার সমস্যা দেখা দিতে পারে। সক্রিয় প্রসব প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেলে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি স্রাব বের হওয়া, সাধারণের চেয়ে আলাদা স্রাব (যেমন: পানি পানি, আঠালো কিংবা রক্তমিশ্রিত স্রাব) বের হওয়া, রক্ত বের হওয়া বা কাপড়ে ছোপ ছোপ রক্ত দেখতে পাওয়া, পেটে ব্যথা, মাসিকের ব্যথার মতো মোচড় অনুভব করা। তলপেটে বেশি চাপ অনুভব করা, কোমরে ব্যথা হওয়া, পানি ভাঙা, জরায়ু মুখ ১০ সে.মি. পর্যন্ত প্রসারিত হয় যার ফলে বাচ্চা বেড়িয়ে আসে। এরপর জরায়ু থেকে গর্ভফুল আলাদা হয়ে বের হয়ে আসে। এই গর্ভফুলের মাধ্যমেই গর্ভাবস্থায় শিশু মায়ের থেকে অক্সিজেন ও পুষ্টি পেয়ে এসেছে। আবার সন্তানের বর্জ্য পদার্থগুলোও বের হয়ে থাকে এই গর্ভফুলের মাধ্যমেই। প্রসবের পরে মায়ের কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে, ঘন ঘন প্রস্রাব হতে পারে, প্রস্রাবে কিছুটা জ্বালা-পোড়া থাকতে পারে। প্রসবের পর স্বাভাবিকভাবেই তলপেটের নিচের দিকের পেশিগুলো আগের চেয়ে কিছুটা দুর্বল হয়ে যাবে। যদি আগে থেকে হার্টে বা অন্য কোথাও কোনো অসুস্থতা থেকে থাকে তাহলে প্রসবের পর সেখানে জটিলতা দেখা দিতে পারে। প্রসবের পথ ও তার পার্শ্ববর্তী জায়গাটুকু সাধারণত সেরে উঠতে প্রসবের পর ৪ থেকে ৬ সপ্তাহ সময় প্রয়োজন হয়, সিজারের পরও স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরতে প্রায় ১.৫ মাস সময় লাগতে পারে। এছাড়াও রক্তপাত হয়ে থাকে এবং সাধারণত প্রায় ৬-৮ সপ্তাহের মধ্যে তা বন্ধ হয়ে যায়। তবে এই সময়কাল একেক জনের ক্ষেত্রে কিছুটা কম-বেশি হতে পারে। এ ছাড়াও এসময়ে ঋতুস্রাবের ব্যথার মতো পেটে ব্যথাও অনুভব হতে পারে। তবে অতিমাত্রায় রক্তক্ষরণ কিংবা গর্ভফুল ঠিকমত বের না হলে মায়ের মৃত্যু ঘটতে পারে । (shohay.health)
ইসলামের দৃষ্টিতে প্রসব:
আল্লাহ তায়ালার অসীম কুদরতে মায়ের শরীরের ভিতর একটি সন্তান তৈরী হয় তেমনি সেই সন্তানকে পৃথিবীর বুকে ভূমিষ্ঠ করার রাস্তাও আল্লাহ সহজ করে দেন। সেই সাথে আল্লাহ তায়ালা কোরআনে মায়ের কষ্টকে উল্লেখ করে তার মর্যাদা বৃদ্ধি করেছেন। এবং একজন প্রসূতি মায়ের জীবন সহজ করার জন্য শরীয়তে সহজ বিধান প্রদান করেছেন।
"এক তরল ফোঁটা থেকে তিনি তাকে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তাকে সুগঠিত করেছেন। তারপর তিনি তার পথ সহজ করে দিয়েছেন।" (সুরা আবাসা ;১৯ ,২০)অর্থাৎ আল্লাহ্ তা'আলা স্বীয় ক্ষমতা-বলে মাতৃগর্ভে মানুষকে সৃষ্টি করেন। তারপর তিনিই তার অপার শক্তির মাধ্যমে মাতৃগর্ভ থেকে জীবিত ও পুর্নাঙ্গ মানুষের বাইরে আসার পথ সহজ করে দেয়। ফলে দেহটি সহী-সালামতে বাইরে চলে আসে এবং মায়েরও এতে তেমন কোন দৈহিক ক্ষতি হয় না। (তাফসীরে জাকারিয়া)
"আর আমি মানুষকে তার মাতা-পিতার প্রতি সদয় ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছি। তার মা তাকে অতিকষ্টে গর্ভে ধারণ করেছে এবং অতি কষ্টে তাকে প্রসব করেছে।...."(সুরা আহকাফ :১৫)
হাদিসে প্রসব পরবর্তী ৪০ দিন নারীদের অপেক্ষা করতে বলা হয়েছে। (আবু দাউদ :৩১১) এ সময় সালাত, সিয়াম ও সহবাস থেকে বিরত থাকার নির্দেশ এসেছে। পরবর্তীতে সুস্থ অবস্থায় সিয়াম আদায় করতে হবে। প্রসব বেদনায় নিহত মহিলাকে শহীদী মর্যাদা দান করা হয়েছে। (মুসনাদে আহমাদ, ১০৭৭২; ইবনু মাজাহ, ২৮০৪)
স্তন্যদান
স্তন্যদান বলতে সাধারণত একজন মা সদ্যোজাত শিশুকে স্তন থেকে দুধ খাইয়ে বড় করে তোলা বা প্রতিপালন করাকে বোঝায়। প্রসবের পরে তৃতীয় বা চতুর্থ দিনে মায়ের বুকে দুধ আসে বা এর উৎপাদন বাড়ে। তবে গর্ভবতী মহিলারা সাধারণত গর্ভাবস্থার ১৬তম থেকে ২২তম সপ্তাহের মধ্যে স্তন্যদুগ্ধ তৈরি করেন। এই প্রাথমিক দুধকে কোলোস্ট্রাম বা শালদুধ বলা হয়।
স্তন্যদানের উপকারিতা :
প্রায় সব মায়ের শরীরে তার শিশুর জন্য প্রয়োজনীয় মাতৃদুগ্ধ তৈরি হয়। শিশুরা প্রথম যে কলোস্ট্রাম বা শালদুধ পায়, তা এন্টিবডি তৈরি করে এবং শিশুর দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। তাছাড়া মায়ের বুকে দুধ পানের স্থানে কিছু পদার্থ তৈরি হয় যার ঘ্রাণ শিশুরা পায় এবং তাতে এক ধরনের ভালো ব্যাকটেরিয়াও থাকে। এগুলো শিশুর শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করে। বুকের দুধ শিশুর কানের সংক্রমণ, ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া ও অন্যান্য রোগ প্রতিরোধ করে। মায়ের দুধ শিশুদের সবচেয়ে ভালো পুষ্টি যোগায়ই শুধু তাই নয়, শিশুর মস্তিষ্ক গঠনেও তা গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও মায়ের দুধ পানের মধ্য দিয়ে শিশুর সঙ্গে মায়ের বন্ধন আরও জোরালো হয়। এটি প্রমাণিত যে, দুই বছর পর্যন্ত দুধ খাওয়ানো শিশু ও তার মা উভয়ের জন্যই মঙ্গলজনক। (unicef.org)
বুকের দুধ খাওয়ালে মায়ের জরায়ু দ্রুত সংকুচিত হয়, গর্ভাবস্থার বাড়তি ওজন কমে যায়। শিশুর জন্মের পরের দিনগুলিতে বুকের দুধ খাওয়ানোর সময় শরীরে যে অক্সিটোসিন উৎপন্ন হয় তা অধিক রক্তক্ষরণ রোধ করতে সাহায্য করে, তাই আয়রনের অভাবজনিত রক্তাল্পতায় ভোগার সম্ভাবনা কম থাকে। স্তন্যপান হৃদরোগ এবং ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমায়, পরবর্তী সময়ে অস্টিওপোরোসিস এবং ফ্র্যাকচারে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে, প্রতি অতিরিক্ত মাস ধরে বুকের দুধ খাওয়ালে স্তন, ডিম্বাশয় এবং জরায়ু সহ বিভিন্ন ধরণের ক্যান্সারের ঝুঁকিও কমে যায়। বুকের দুধ খাওয়ালে মায়ের শরীরে অক্সিটোসিনের মাত্রা বেড়ে যায় যার ফলে প্রসবোত্তর বিষন্নতা ও উদ্বেগ হ্রাস পায়। বুকের দুধ খাওয়ালে ডিম্বস্ফোটনও দমন করা হয়, ফলে মাসিক বন্ধ হয়ে যায়, এর অর্থ হল, শুধুমাত্র বুকের দুধ খাওয়ানো গর্ভনিরোধের একটি বেশ ভালো পদ্ধতি - এটি কমপক্ষে ৯৮% কার্যকর। (medela.com)
ইসলামের দৃষ্টিতে স্তন্যদান :
মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে দুগ্ধপোষ্য শিশুকে স্তন্যদানের বিষয়টি উল্লেখ করেছেন এবং তার মেয়াদ ও মর্যাদা সম্পর্কে শরীয়ত প্রদান করেছেন। যদি সন্তানের মা তালাকপ্রাপ্তা হয় কিংবা অন্য কোন ধাত্রী স্তন্যদান করে তবে তার ব্যয়ভার বহনের দায়িত্বও সন্তানের পিতার।
"আর আমি মানুষকে তার মাতাপিতার ব্যাপারে (সদাচরণের) নির্দেশ দিয়েছি। তার মা কষ্টের পর কষ্ট ভোগ করে তাকে গর্ভে ধারণ করে। আর তার দুধ ছাড়ানো হয় দু’বছরে; সুতরাং আমার ও তোমার পিতা-মাতার শুকরিয়া আদায় কর। প্রত্যাবর্তন তো আমার কাছেই।" (সুরা লোকমান :১৪)
"আর মায়েরা তাদের সন্তানদেরকে পূর্ণ দু’বছর দুধ পান করাবে, (এটা) তার জন্য যে দুধ পান করাবার সময় পূর্ণ করতে চায়। আর পিতার উপর কর্তব্য, বিধি মোতাবেক মাদেরকে খাবার ও পোশাক প্রদান করা। সাধ্যের অতিরিক্ত কোন ব্যক্তিকে দায়িত্ব প্রদান করা হয় না। কষ্ট দেয়া যাবে না কোন মাকে তার সন্তানের জন্য, কিংবা কোন বাবাকে তার সন্তানের জন্য। আর ওয়ারিশের উপর রয়েছে অনুরূপ দায়িত্ব। অতঃপর তারা যদি পরস্পর সম্মতি ও পরামর্শের মাধ্যমে দুধ ছাড়াতে চায়, তাহলে তাদের কোন পাপ হবে না। আর যদি তোমরা তোমাদের সন্তানদেরকে অন্য কারো থেকে দুধ পান করাতে চাও, তাহলেও তোমাদের উপর কোন পাপ নেই, যদি তোমরা বিধি মোতাবেক তাদেরকে যা দেবার তা দিয়ে দাও। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং জেনে রাখ, নিশ্চয় আল্লাহ তোমরা যা কর, সে সম্পর্কে সম্যক দ্রষ্টা।" (সুরা বাকারা :২৩৩)
শরীয়তে স্তন্যদানকারী নারীকে ফরজ সিয়াম পালনের ব্যাপারে ছাড় দেয়া হয়েছে। যদি সিয়াম পালনের কারণে মা অথবা দুগ্ধপোষ্য সন্তানের কোনরূপ ক্ষতির আশংকা থাকে তাহলে মা অন্য সময়ে তা পালন করবে। (ফাতাওয়াস সিয়াম) জন্মদানকারী মা ব্যতিত যদি অন্য কেউ স্তন্যদান করে, শরীয়ত সেক্ষেত্রে গড়া সম্পর্কগুলোও মূল্যায়ণ করেছে এবং যথাযোগ্য মর্যাদা দান করেছে। দুধ ভাই-বোনদের মধ্যে আপোসের বিবাহ ঐরূপ হারাম হয়ে যাবে, যেরূপ রক্তের সম্পর্কের ভাই-বোনদের সাথে হারাম। মহানবী (সাঃ) বলেছেন, ‘‘দুধপানেও তা হারাম হয়, যা রক্তের সম্পর্কের কারণে হারাম হয়।’’ (বুখারী ২৬৪৫)
প্রিয় দ্বীনি বোন, নিজের মা ও মাতৃত্বকে মূল্যায়ণ করুন, তথাকথিত প্রগতিশীল সমাজব্যবস্থা ও নারীবাদী চেতনায় বিভ্রান্ত হয়ে নিজের অস্তিত্বকে অবমূল্যায়ন করবেন না। বাহ্যিক দৃষ্টিতে একই রক্তে মাংসে গড়া মানুষ হলেও আপনার অভ্যন্তরীণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ও হরমোন ভিন্ন ভাবে আপনাকে পরিচালিত করে। আপনি মোটেই একজন পুরুষের মত নন, বরং ইসলাম আপনাকে একজন পুরুষের চেয়ে অধিক মর্যাদা দান করেছে।
প্রিয় দ্বীনি ভাই, আপনার মা আপনার সম্মানের সবচেয়ে বেশি হকদার। সময় থাকতে তার কষ্ট, মর্যাদা বুঝার চেষ্টা করুন। তেমনি আপনার স্ত্রী আপনার সন্তানের সম্মানের সবচেয়ে বেশি হকদার। আপনার কাছ থেকেই তারা মায়ের প্রতি ভালো আচরণ করা শিখবে। পরিবারের নারীদের কোন কথা বা আচরণে আঘাত পাওয়ার আগে একবার ভাবুন যে, তাদের অভ্যন্তরীন রাসায়নিক বিক্রিয়ার কারণে অধিকাংশ সময় তাদের শারীরিক ও মানসিক অবস্থা নিজের আয়ত্তে থাকে না। তাদের প্রতি সদয় হোন, যত্নবান হোন, যেখানে আল্লাহ স্বয়ং নারীদের বিভিন্ন বিষয়ে ছাড় দিয়েছেন।
©somewhere in net ltd.
১|
২৭ শে আগস্ট, ২০২৫ সকাল ৮:২৫
কামাল১৮ বলেছেন: ইসলাম দাসি সহবতকে যায়েজ করে নারীকে করেছে মহান।