নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
চিত্ত যেথা ভয় শূন্য, উচ্চ যেথা শির, জ্ঞান যেথা মুক্ত,
যে অঞ্চলটা নিয়ে আমাদের বাংলাদেশ, সেটা প্রাচীন বঙ্গ, গৌড়, চন্দ্রদ্বীপ, তাম্রলিপ্ত, সমতট, পুন্ড্রবর্ধন , হরিকেল, বরেন্দ্র র অংশ নিয়ে গঠিত । খ্রিষ্টপূর্ব অব্দে এটা মগধের অন্তর্ভুক্ত ছিল । লোকায়ত ভাষার দিক থেকে ওড়িশা, আসাম মগধ(বিহার) ও বাংলার বন্ধন অবিচ্ছেদ্য । আমাদের বর্তমান ভুখন্ডে প্রাগৈতিহাসিক পূর্ব পুরুষদের কোন প্রাতিষ্টানিক ধর্ম ছিল না, ছিল উদার সংস্কৃতি - সেটাই বাঙ্গালী সংস্কৃতি । ধর্ম এবং সংস্কৃতি পুরো ভিন্ন জিনিস। কেউ কারো আত্মীয় নয় । হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, ইসলাম কোনটাই আমাদের পূর্বপুরুষের ধর্ম ছিল না। সূচনা পর্ব থেকে ধরলে সবাই বহিরাগত। সুদীর্ঘ কাল ধরে এখানে কোন ধর্ম ঢুকেনি । তার কারন আমাদের অন্ত্যজ আরুন্যক জীবন সংস্কৃতিকে কেউ সম্মানের চোখে দেখেনি । ঋগ্বেদে আমাদের পূর্বপুরুষদের দেরকে হীন উপাধি দিয়ে অনেক বক্তব্য উল্লেখিত আছে। আমাদের সেই সংস্কৃতি এতোই প্রবল ছিল, খ্রিষ্টের জন্মের কয়েক শতাব্দী আগে বৈদিক ও বৌদ্ধ ধর্ম এখানে এসে তার মূল আদল হারিয়ে ফেলে। যেমন বিভিন্ন দেব দেবী সেখানে প্রবেশ করে যা মূল বৈদিক ধর্মে ছিল না। অনেক দেব দেবী এবং মরমীয়াবাদ, সহজিয়া, তান্ত্রিকতা বৌদ্ধ ধর্মে ঢুকে পরে। যাদের হাত দিয়ে চর্যাপদ তৈরি হয় । এতে মন্ত্র, যন্ত্র, মন্ডল, মুদ্রা, ধারণি ইত্যাদির চর্চা করা হয়। এর সঙ্গে আরও থাকে মৈথুন, যোগ, দেবালয়, পূজা ও আচার-অনুষ্ঠান, জাদুবিদ্যা, সম্মোহন, প্রেতালাপ, জ্যোতিষ, প্রতীকীত্ব, ধাতুবিদ্যা, প্রকৃত অদ্বৈতের মধ্যে আপাত দ্বৈতের ধারণা, নারীসঙ্গীর সহযোগিতা ইত্যাদি, যা মূল বৌদ্ধ ধর্মের সাথে কোন সম্পর্ক নেই । এসব আমাদের আদি উপাদান । এই বৈচিত্র্য র কারনেই প্রাচীন বাংলাদেশ কে জ্ঞানের প্রকোস্ট বলা হয় । সপ্তম শতাব্দীতে চীনা পর্যটক হিউয়েন সাং তাঁর ট্রাভেলগ এ লিখেছেন যে, তিনি বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী স্থানীয় লোকদের ধর্মীয় দর্শন, আচার-আচরণ এবং সামাজিক রীতিনীতিতে অনেক সাদৃশ্য দেখেছেন। তিনি আরও লক্ষ্য করেন যে, বঙ্গীয় বৌদ্ধধর্ম মূল বৌদ্ধধর্ম থেকে অনেকটাই আলাদা। ঐতিহাসিক পর্বে আমরা দেখি এখানে বর্ণাশ্রম প্রথা যা আমাদের অতীতে ছিল না।সেই প্রথা যখন প্রবিষ্ট হয় বিশেষত সেন আমলে। তার প্রভাবের ফলে বৌদ্ধরা শূদ্র হিসেবেই বিবেচিত হতো। তত্বগত ভাবে ইসলামের কোন বর্ণ প্রথা নেই, কিন্তু বাংলায় এসে বৃত্তি ভেদে বর্ণ ভেদ জনিত আশরাফ আতরাফ এই দুই ভাগে মুসলিম রা বিভাজিত হয় । আতরাফ ছিলেন প্রধানত দেশীয় এবং প্রান্তিক মুসলমানরা। এই শ্রেণিভেদ প্রথা দিয়ে মুসলমানরা এতোটাই প্রভাবিত হয়েছিলেন যে তারা মসজিদেও এটা বজায় রাখেন । সেখানে সুলতান এবং তাঁর ঘনিষ্ঠজনদের জন্যে থাকতো উঁচু আসন। এ ছাড়া, আশরাফ এবং আতরাফদের মধ্যে বিবাহ হতো না, অথবা তারা একত্রে খাওয়া দাওয়াও করতেন না। এই প্রথাও ছিল বহিরাগত , যা কালে কালে আত্মস্থ হয়েছিল। খ্রিস্টের জন্মের কয়েক শতাব্দী আগে মোটামুটি একই সময়ে বৈদিক এবং বৌদ্ধধর্ম আমাদের এখানে এসেছিল । বৌদ্ধরা এতো ব্যাপক ভাবে এই অঞ্চলকে আপন করে নেয়, দেখা যায় প্রায় দশাধিক বিশ্ব বিদ্যালয় বা বিশাল শিক্ষা কেন্দ্র বৃহত্তর বাংলায় নির্মিত হয় । সেক্ষেত্রে ঐতিহাসিক আদি বঙ্গদেশ এর গৌরব মূলত বৌদ্ধ দের । এখানে বাইরের যত ধর্ম এসেছে সব ধর্মের চিরাচরিত মৌল ভাবনা এখানে আসার পর আমাদের আদি সংস্কৃতির প্রভাবে সূচনা পর্যায়ে খসে পরে। যার ফলে স্বতন্ত্র ভাবে বাঙ্গালী সংস্কৃতি এখানে সব সম্প্রদায়ের মাঝে বিকশিত হয় দীর্ঘ সময় ধরে। ক্রমে ক্রমে যখন সব ধর্মের সেক্টেরিয়ান অর্থডক্সি বিকশিত হয় তখন থেকেই বাঙ্গালী সংস্কৃতি সঙ্কটের মুখে পড়তে শুরু করে যে সংকটের এখন পরিনত রূপ দৃশ্যমান। কোন অংশ সেখানে নিজেদেরকে সমন্বিত করতে পেরেছেন , কেউ তাকে কুক্ষিগত করেছেন, আর কেউ নিজেদের গুটিয়ে নিতে সচেষ্ট হয়েছেন। এসব ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার ফলাফল আমরা ভোগ করছি । এর জন্যে কোন এক পক্ষকে দায়ী করা যাবে না। আমি শৈশবে গ্রামীন প্রেক্ষাপটে যাদের কে দেখেছি বা যারা বেঁচে নেই, আর আজকে যাদের কে দেখছি তারা এক আদলের নয় । মঙ্গল শোভা যাত্রার 'মঙ্গল' শব্দ নিয়ে এখন অনেকেই বিভ্রান্ত । 'মঙ্গল' শব্দটি মূলত বাংলার আদি প্রাকৃত বা বৌদ্ধ থেকে আসা। ত্রিপিটকের 'মঙ্গল সুত্র' এখানে প্রনিধান যোগ্য । মোগল সম্রাট আকবর বা শশাঙ্ক- এরা নিজেদের স্বার্থে বাংলা অব্দকে নতুন করে সাজিয়েছেন , যা গোঁজামিলে ভরা । তার অনেক আগে থেকেই আমাদের পূর্বপুরুষ রা বুদ্ধ সাল বা বুদ্ধাব্দ ই মেনে চলতো। গৌতম বুদ্ধের জন্ম সময় ধরে সে হিসাবটা প্রচলন ছিল । সে হিসেবে এখন ২৫৬০ সাল। পরবর্তী তে আরও যারা আমাদের শাসন করেছে তারা শকাব্দ, হিজরি এবং সর্বশেষ খ্রিষ্টাব্দ এখন প্রতিষ্টিত । আজকের নক্ষত্রের নামে মাসের নাম গুলো শক দের থেকে পাওয়া। প্রাচীন বাংলার বিচিত্র ধর্মগুলোর মধ্যে যদি কোনো মিল থেকে থাকে, তা হলো এই গোঁড়ামিবর্জিত নমনীয়তা এবং সমন্বয়ধর্মী ভক্তিবাদ।মধ্যযুগে সুফিবাদের মতো ভক্তিবাদী দর্শনের উদ্ভব এবং বৈষ্ণব, সহজিয়া, বাউল, কর্তাভজা ও সখীভাবকের মতো ধর্মীয় সম্প্রদায় আত্মপ্রকাশ করার পর সত্যপীর/সত্যনারায়ণ এবং দক্ষিণ রায়/বড় খান গাজীর মতো লৌকিক দেবতার দেখা মেলে। এবং সাহিত্যেও একটা সমন্বয়বাদী ধারার সৃষ্টি হয়। এই সাহিত্য ছিল বাঙালিত্বের ধারণাপুষ্ট। এ রকম এক অর্থে ধর্মনিরপেক্ষ সহনশীল আবহ ইতিহাসে দুর্লভ। আমাদের বাঙ্গালী সংস্কৃতির মালিকানা কোন ধর্মের নয়। তাই এটাকে নির্বাসিত করা যায় না।এটা সেই গোড়া থেকেই বিকশিত হয়েছে। তার মাঝে সহজাত ভাবে অনেক সংযোজন বিয়োজন হয়েছে স্বাভাবিক পরিনতিতেই। ভুল বোঝাবুঝি র মূলে আমাদের অজ্ঞতা এবং আগে আসলে আগে পাবেন ভিত্তিতে ধারন করা হয়েছে বলেই আজ এতো বিভ্রান্তি । আমরা আমাদের পূর্বপুরুষের বৃত্তি বা জীবিকা কে নিয়েছি কিন্তু তার অবিচ্ছেদ্য সংস্কৃতিকে সঠিক ভাবে আত্মস্থ করতে পারিনি। আদিবাসী সমাজে তার শ্রমজীবন এবং আনন্দ উৎসব একের অপরের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক ।
©somewhere in net ltd.