নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি জাতিস্মর। সপ্তমবার মানব জন্ম। অষ্টমবার মানব জন্ম নিয়ে আবার পৃথিবীর বুকে ফিরবো। সীতারাম নন্দী(১ম), কৃষ্ণকান্ত নন্দী(২য়),কাশিমবাজার রাজা কৃষ্ণনাথ রায়(৩য়),বিজয়কৃষ্ণদুলাল পাল(৪র্থ),হরিদাস মুখার্জী(৫ম),রমেশ সাহা(৬ষ্ঠ),প্রদীপ হালদার(৭ম)।

প্রদীপ হালদার

আমি জাতিস্মর। সপ্তমবার মানব জন্ম, অষ্টমবার মানব জন্ম নিয়ে আবার পৃথিবীর বুকে ফিরবো। সীতারাম নন্দী(১ম), কৃষ্ণকান্ত নন্দী(২য়),কাশিমবাজার রাজা কৃষ্ণনাথ রায়(৩য়),বিজয়কৃষ্ণদুলাল পাল(৪র্থ),হরিদাস মুখার্জী(৫ম),রমেশ সাহা(৬ষ্ঠ),প্রদীপ হালদার(৭ম)।

প্রদীপ হালদার › বিস্তারিত পোস্টঃ

আমিই কৃষ্ণকান্ত নন্দী ( ষষ্ঠ খণ্ড )।

০৭ ই নভেম্বর, ২০১৫ সকাল ১০:০৫

রবার্ট ক্লাইভ এবং ওয়ারেন হেস্টিংস এবং আমি
-------------------------------------------------
কৃষ্ণকান্ত নন্দী
----------------


রবার্ট ক্লাইভ - জন্ম ২৯ সেপ্টেম্বর, ১৭২৫ সাল। ইংল্যাণ্ডের ওয়েস্ট মিডল্যাণ্ডের শ্রোপসায়ার কাউণ্টির মার্কেট ড্রাইটোনে ক্লাইভের জন্ম। তার বাবার নাম ছিল রিচার্ড ক্লাইভ এবং মায়ের নাম রেবেকা গ্যাসকেল ক্লাইভ। তেরো ভাইবোনের মধ্যে ক্লাইভ ছিলেন বড়। সাত কন্যা এবং ছয় পুত্র সন্তানের মধ্যে ক্লাইভ ছিলেন বড়। প্রথমে মার্কেট ড্রাইটোন গ্রামার স্কুলে ভর্তি হন। পরে স্কুল কর্তৃপক্ষের অভিযোগের ভিত্তিতে তার বাবা তাকে লণ্ডনের মার্চেন্ট টেইলর স্কুলে ভর্ত্তি করে দেন। এরপর তাকে হার্টফোর্ডশায়ারের একটি স্কুলে ভর্ত্তি করে দেওয়া হয়। এই স্কুল থেকে তিনি প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করতে সক্ষম হন। রবার্টের বাবা ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানিতে তার জন্য একটি লেখকের চাকরির ব্যবস্থা করে দেন। এই সূত্রে ১৭৪৩ সালে শুরুর দিকে তিনি জাহাজে করে ভারতে রওনা দেন। কিন্তু ওই জাহাজের মেরামতির জন্য ব্রাজিলের রিও দি জেনেরিও বন্দরে প্রায় নয় মাস অবস্থান করে। এই সময়ে তিনি কিছুটা পর্তুগিজ ভাষা রপ্ত করতে সক্ষম হন। ভারতে তার এই ভাষা বিশেষ কাজে লেগেছিল। জাহাজ মেরামত হওয়ার পর,উত্তমাশা অন্তরীপে তাদের জাহাজ কিছুদিন থাকে। অবশেষে তাদের জাহাজ যখন মাদ্রাজ উপকূলে পৌঁছায়,তখন তার কাছে খরচ করার মতো কোনো অর্থ ছিল না। ফলে জাহাজের ক্যাপ্টেনের কাছ থেকে তিনি চড়া সুদে ঋণ নেন। ভারতে পৌঁছে তিনি প্রথমেই তেমন কাজ জোগাড় করতে পারেন নি। কথিত আছে, এই সময় তিনি দুইবার আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিলেন। ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি সেই সময় মাদ্রাজের পাটনাম গ্রামের কাছে ফোর্ট সেইণ্ট জর্জ নামে এক দুর্গে অবস্থান করছিল। ১৭৪৪ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাসে ক্লাইভ এই দুর্গে পৌঁছান। তিনি কোম্পানিতে লেখালেখির পাশাপাশি নানা ধরণের কাজে দুই বছর কাটান। আঠারো বছর বয়সে মাদ্রাজে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানিতে চাকরি গ্রহণ করেন। ভারতে বাণিজ্যিক আধিপত্য বিস্তার নিয়ে ফরাসি এবং ব্রিটিশ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে দ্বন্দ্ব ছিল। তারই জের ধরে,১৭৪৫ সালে ব্রিটিশ নৌসেনারা ফরাসি নৌবহরের উপর আক্রমণ চালায়। এই অবস্থায় ফরাসি নৌসেনারা ফরাসি গভর্ণর জেনারেল ডুপ্লেইক্সের কাছে অতিরিক্ত সৈন্যের জন্য আবেদন করে। ১৭৪৬ সালে ৪ঠা সেপ্টেম্বর লা বুরদনাইসের নেতৃত্বে ফরাসি বাহিনী সেণ্ট জর্জ দুর্গ আক্রমণ করে। কয়েকদিনের যুদ্ধের পর ব্রিটিশ বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। ফরাসিরা বন্দী ইংরেজদের পণ্ডিচেরীতে স্থানান্তরিত করে। এই সময় ক্লাইভও ফরাসিদের হাতে বন্দী হন। লা বুরদনাইস ক্ষতিপূরণ নিয়ে মাদ্রাজ ইংরেজদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব করে। মাদ্রাজ আক্রমণের আগে, ডুপ্লেইক্স কর্ণাটকের নবাব আনোয়ার উদ্দিনকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, দখলকৃত মাদ্রাজ তার কাছে হস্তান্তর করবে। যুদ্ধ জয়ের পর, এ নিয়ে কালক্ষেপণ করতে থাকলে নবাব ফরাসি বাহিনীর বিরুদ্ধে দশ হাজার সৈন্য পাঠান। যুদ্ধের প্রথমাবস্থায় ফরাসিরা পরাজিত হয়। শেষ পর্যন্ত ফরাসি বাহিনী জয়লাভ করতে সক্ষম হন। ফলে ইংরেজ ও নবাবের সৈন্যদের বিরুদ্ধে জয়লাভের সূত্রে ডুপ্লেইক্স ভারতে উপনিবেশ স্থাপনের স্বপ্ন দেখতে থাকেন। ৯ই নভেম্বর ডুপ্লেইক্সের অধীনস্থ সেনাদল মাদ্রাজে প্রবেশ করে। সেই সময়ে পণ্ডিচেরীতে বন্দী ইংরেজদের প্যারোলে মুক্তি দেওয়া হয়। সেই সাথে মাদ্রাজ থেকে সকল ইংরেজদের বহিস্কার করা হয়। অন্যান্য ইংরেজরা ফরাসিদের আনুগত্য মেনে নিলেও ক্লাইভ এবং কতিপয় ইংরেজ কর্মকর্তা তা মেনে নিতে পারেন নি। ফরাসিদের কাছে পরাজয়ের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তিনি ছদ্মবেশে পণ্ডিচেরী থেকে পালিয়ে ইংরেজদের ফোর্ট ডেভিডে চলে যান। এই সময় এই দুর্গের অধিপতি ছিলেন মেজর স্ট্রিঙ্গার লরেন্স। ১৭৪৮ সালে আয়-লা-স্যাপল চুক্তির মাধ্যমে অষ্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে। এই চুক্তির সূত্রে ফরাসিরা মাদ্রাজকে ইংরেজদের ফিরিয়ে দেয়। এর বিনিময়ে ফরাসিরা আমেরিকা মহাদেশের লুইবার্গের অধিকার লাভ করে। ডুপ্লেইক্স অনিচ্ছাসত্ত্বে এই সন্ধি মেনে নিয়ে মাদ্রাজ থেকে তাদের সৈন্য ফিরিয়ে নেয়। ক্লাইভ কোম্পানির চাকরি ছেড়ে দেন এবং ১৭৪৮ সালে মাদ্রাজ সেনাবাহিনীতে সর্বনিম্ন কমিশন প্রাপ্ত অফিসার হিসাবে যোগদান করেন। লেফটেন্যাণ্ট হিসাবে তিনি একবার এক মারাঠা নেতার বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন এবং দেবীকোট দুর্গ অধিকার করেন। সেই সময় সৈন্যদের থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করার কারণে ক্লাইভের বিরুদ্ধে হঠকারিতার অভিযোগ আনা হয়েছিল। ক্লাইভের পরবর্তী সামরিক তৎপরতার নিদর্শন তার আর্কট অভিযান, যাতে তিনি প্রচলিত সামরিক নিয়ম নীতি লঙ্ঘন করে নবাবের দুর্গে নৈশ অভিযান পরিচালনা করেন এবং কোনো প্রাণহানি না ঘটিয়ে সিপাহিদের পালাতে বাধ্য করেন। ক্লাইভের দেবীকোট ও আর্কট অভিযান তার বেপরোয়া স্বভাবের সাক্ষ্য বহন করে। ১৭৫৩ সালের প্রথম দিকে ক্লাইভ লণ্ডনে ফিরে গেলে দাক্ষিণাত্যে তার অব্যাহত বিজয়ের কৃতিত্বের জন্য তাকে বীরোচিত সংবর্ধনা দেওয়া হয়। কর্ণাটকের যুদ্ধে তার সাফল্যের জন্য কোর্ট অব ডাইরেক্টরস তাকে সম্মানিত করে এবং ভোজসভায় 'জেনারেল ক্লাইভ' নামে আখ্যাত করে তাকে রত্নখচিত তরবারি উপহার দেওয়া হয়। ১৭৫৩ সালে ১৮ ফেব্রুয়ারিতে তিনি তার বন্ধু নেভিলের ছোট বোন মারগারেট মেইস্কিলিনকে বিয়ে করেন।
তিনি ১৭৫৫ সালে মাদ্রাজে প্রত্যাবর্তন করেন। তিনি লেফটেন্যাণ্ট কর্ণেল পদে নিযুক্ত হন। তিনি এমন এক সময়ে আসেন যখন ফরাসিগণ নিজামের সাথে অধীনতামূলক মিত্রতায় আবদ্ধ হয়ে দক্ষিণ ভারতে তাদের প্রাধান্য বিস্তার করেছে। নিজামকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য ক্লাইভকে সেনাবাহিনীর দায়িত্ব প্রদান করা হয়। তিনি অতর্কিতে আক্রমণ করে নিজামের শক্তিশালী গেরিয়া দুর্গ অধিকার করেন ১৭৫৬ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে।

১৭৫৬ সালে ৯ই এপ্রিল, আশি বছর বয়সে নবাব আলিবর্দী খাঁর মৃত্যু হলো। আলিবর্দী খাঁর পূর্ব ঘোষণা অনুসারে সিরাজউদ্দৌলা সিংহাসন লাভ করেন। সিংহাসন লাভের পর তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করেন ঘসেটি বেগম। সেই সময় পূর্ণিয়ার শাসনকর্তা ছিলেন শওকত জঙ্গ। সিংহাসন লাভের পর সিরাজউদ্দৌলা ঘসেটি বেগমের সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেন। এরপর তিনি শওকত জঙ্গের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। কিন্তু নবাবের আদেশ উপেক্ষা করে, কলকাতায় ইংরেজরা দুর্গ নির্মাণ করেছে, এই সংবাদ পেয়ে তিনি এই যুদ্ধ যাত্রা বন্ধ করে ফিরে আসেন। ১৭৫৬ সালে সিরাজউদ্দৌলা প্রায় ত্রিশ হাজার সৈন্যের একটি বিশাল বাহিনী নিয়ে ইংরেজদের শায়েস্তা করার জন্য অগ্রসর হন। সিরাজ পথিমধ্যে ২রা জুন কাশিমবাজারে ব্রিটিশ ফ্যাক্টরি আক্রমণ করলেন। ৫ই জুন ফ্যাক্টরির প্রধান উইলিয়াম ওয়াটস আত্মসমর্পণ করলেন। ওয়াটস এবং কালেক্টকে বন্দী করলেন। বাটসন এবং সাইকেস পালিয়ে গেলেন। লেফটেন্যান্ট এলিওটের মাথা উড়ে গেলো। হেস্টিংস ধরা পড়লেন এবং ৯ই জুন তাকে বন্দী করা হলো। যখন নবাব কলকাতা অভিযান করলেন,তখন বন্দী ওয়াটস এবং কালেক্টকে সঙ্গে নিয়েছিলেন। কৃষ্ণকান্ত নন্দী ওলন্দাজ ফ্যাক্টরির প্রধান ভার্নেটের নির্দেশে এবং তার কাছ থেকে তিন হাজার টাকা নিয়ে নবাবের কারাগার থেকে হেস্টিংসকে মুক্ত করলেন। কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে হেস্টিংস কাশিমবাজারে ছিলেন ১৭৫৬ সালে জুলাই মাস অবধি। নবাবের বাহিনী ২০শে জুন ইংরেজদের ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ অবরোধ করে। এই যুদ্ধে একসময় ইংরেজরা আত্মসমর্পণ করে। বন্দীদের সাথে নবাবের সৈন্যরা দুর্গের সম্পদ লুণ্ঠন করে,তবে বন্দীদের সাথে ভালো ব্যবহারও করে। হলওয়েল নবাবের কাছ থেকে নিরাপত্তার আশ্বাসও লাভ করেন। কিন্তু রাতে ইংরেজ সৈন্যরা মাতলামি শুরু করে এবং নবাবের বাহিনীর প্রহরীদের আক্রমণ করে। এই পরিপ্রেক্ষিতে নবাব ইংরেজ সৈন্যদের বন্দী করে রাখার নির্দেশ দেন। হলওয়েলের মতে ১৮ ফুট দৈর্ঘ্য এবং ১৪ ফুট ১০ ইঞ্চি প্রস্থবিশিষ্ট একটি কক্ষে ১৪৬ জন ইংরেজকে রাখা হয়। এই ঘরে একটি মাত্র জানালা ছিল। সকালবেলায় দেখা যায়,ঘরের ১২৩ জন মৃত্যুবরণ করে। হলওয়েল কর্তৃক প্রচারিত এই ঘটনাকে অন্ধকূপ হত্যা নামে অভিহিত করা হয়। সিরাজউদ্দৌলা মাণিকচাঁদের হাতে কলকাতার শাসনভার অর্পণ করে ১২ই জুলাই মুর্শিদাবাদে ফিরে আসেন।
কলকাতা বিজয়ের পর নবাব সিরাজ ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দে সেপ্টেম্বর মাসে পূর্ণিয়া অভিমুখে সসৈন্যে অগ্রসর হন। ইত্যবসরে শওকত জঙ্গ দিল্লীর সম্রাট দ্বিতীয় আলমগীরের নিকট থেকে বাংলা বিহার ও উড়িষ্যার নিযামতের ফরমান লাভ করেন। এদিকে সিরাজউদ্দৌলার প্রতিনিধি রায় রাসবিহারী সসৈন্যে রাজমহল অভিমুখে অগ্রসর হন। তিনি রাজমহলে পৌঁছে নবাব সিরাজের একটি পত্র শওকত জঙ্গের নিকট প্রেরণ করেন। ঐ পত্রে নবাব সিরাজউদ্দৌলা তার প্রতিনিধি রায় রাসবিহারীর নিকট পূর্ণিয়ার শাসনভার হস্তান্তরের জন্য শওকত জঙ্গকে নির্দেশ দেন। কিন্তু শওকত জঙ্গ তার সভাসদদের পরামর্শে পত্রের জবাবে সিরাজউদ্দৌলাকে মুর্শিদাবাদের মসনদ ত্যাগ করে ঢাকায় গিয়ে তার নায়েব হিসেবে উক্ত এলাকা শাসন করার অথবা অবসর ভাতা গ্রহণ করার নির্দেশ দেন।
শওকত জঙ্গের পত্র পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সিরাজউদ্দৌলা পূর্ণিয়া অধিকারের জন্য রাজা মোহনলালের অধীনে এক বাহিনী প্রেরণ করেন। পথে পাটনার নায়েব নাযিম রাজা রামনারায়ণ তার বাহিনী নিয়ে মোহনলালের সঙ্গে যোগ দেন। বিহারের জমিদারদের সম্মিলিত বাহিনীও এই অভিযানে যুক্ত হয়। রাজা মোহনলালের নেতৃত্বে বাহিনীর অগ্রবর্তী অংশ রাজমহলের নিকটে গঙ্গানদী অতিক্রম করে। এরপর হায়াতপুর ও বসন্তপুর গোলার ( পুরাতন কোশি নদীর পূর্ব তীরবর্তী) পথ ধরে দক্ষিণ পূর্ণিয়ার মনিহারীতে পৌঁছায়। বাংলার বাহিনীর অপর অংশ এবং রাজা রামনারায়ণের অধীনে বিহারের সেনাবাহিনী খানিকটা দূরে থেকে অগ্রবর্তী বাহিনীকে অনুসরণ করছিল।
শওকত জঙ্গ তার বাহিনী নিয়ে শত্রু বাহিনীর মোকাবিলার জন্য অগ্রসর হন এবং মনিহারীর চার মাইল উত্তরে নবাবগঞ্জে পরিখা খনন করে অবস্থান নেন। সেনাপতি শ্যামসুন্দরকে তার গোলন্দাজ বাহিনীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। সুচিন্তিত পরিকল্পনার অভাব এবং তার নিছক দম্ভের কারণে শওকত জঙ্গ তেমন কার্যকর প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারেন নি। ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দে ১৬ অক্টোবর মনিহারীতে উভয় পক্ষে এক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধে শওকত জঙ্গের বিপুল সংখ্যক সৈন্য নিহত এবং বহু সৈন্য আহত ও বন্দী হয়,অবশিষ্ট সৈন্য যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যায়। তাদের অনেকে অস্ত্রধারণ করার সুযোগ পর্যন্ত পায় নি। হস্তীপৃষ্ঠ থেকে সৈন্যদের পরিচালনা কালে অকস্মাৎ মাথায় শত্রুর গুলির আঘাতে শওকত জঙ্গ নিহত হন। মোহনলাল পূর্ণিয়া দখল করে শওকত জঙ্গের ধনসম্পদসহ তার পরিবার পরিজনকে বন্দী করে মুর্শিদাবাদে ফিরে আসেন।

আলিবর্দী খান প্রথম জীবনে মির্জা মুহম্মদ আলী নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি ছিলেন আরব বংশোদ্ভূত। মুহম্মদ আলী বয়োপ্রাপ্ত হলে আওরঙ্গজেবের দ্বিতীয় পুত্র মির্জা আজম শাহ তাকে হাতিশালার তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে নিয়োগ করেন। অচিরেই তাকে জরিদার বস্ত্রের গুদামঘরের তত্ত্বাবধায়কের পদ প্রদান করা হয়। আজম শাহ ১৭০৭ সালে এক যুদ্ধে নিহত হলে আলিবর্দী চাকুরিহারা হন। ফলে তার পরিবার আর্থিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। জীবিকা নির্বাহের জন্য ভাগ্যান্বেষণে তিনি বাংলায় যাবার সিদ্ধান্ত নেন। তৎকালীন বাংলা অন্যান্য প্রদেশের তুলনায় রাজনৈতিক ঝামেলামুক্ত ছিল। ১৭২০ সালে তিনি তার পরিবার পরিজন নিয়ে বাংলার উদ্দেশ্যে রওনা হন। কিন্তু বাংলার নবাব মুর্শিদকুলী খান তাকে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেন নি। ফলে তিনি কটকে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। কটকের শাসনকর্তা সুজাউদ্দীন তাকে সসম্মানে গ্রহণ করে একশ টাকা মাসিক বেতনে চাকুরি প্রদান করেন। পরবর্তী সময়ে তার বিশ্বস্ততা এবং উড়িষ্যার অবাধ্য জমিদারদের দমনে সাফল্যের জন্য তাকে উচ্চপদে নিয়োগ করা হয়। এইভাবে উড়িষ্যা হয়ে ওঠে বাংলার ভবিষ্যত নবাব মির্জা মুহম্মদ আলীর অনুশীলনের ক্ষেত্র।
সুজাউদ্দীনের শ্বশুর মুর্শিদকুলী জাফর খানের মৃত্যুর পর মির্জা মুহম্মদ আলী সুজাউদ্দীনকে বাংলার মসনদে অধিষ্ঠিত হওয়ার ব্যাপারে সক্রিয় সাহায্য করেন। মুর্শিদকুলীর কোনো পুত্র সন্তান না থাকায় সুজাউদ্দীনই ছিলেন বাংলার সম্ভাব্য উত্তরাধিকারী। কিন্তু জামাতা এবং শ্বশুরের মধ্যে সুসম্পর্ক ছিল না। ১৭২৭ সালে ৩০ জুন মুর্শিদকুলীর মৃত্যুর পর সুজাউদ্দীন মির্জা মুহম্মদ আলীর চেষ্টায় বাংলার মসনদে আরোহণ করতে সমর্থ হন। বুদ্ধিভিত্তিক পরামর্শ এবং অকৃত্রিম সেবার জন্য সুজাউদ্দীন মির্জা মুহম্মদ আলীর পরিবারকে নানাভাবে পুরস্কৃত করেন। তিনি ১৭২৮ সালে মির্জা মুহম্মদ আলীকে গুরুত্বপূর্ণ আকবরনগর(রাজমহল) চাকলার(প্রশাসনিক বিভাগ) ফৌজদার নিয়োগ করেন,এবং তাকে 'আলীবর্দী' উপাধিতে ভূষিত করেন। সকল রাষ্ট্রীয় কার্যে সুজাউদ্দীন আলীবর্দীকে উপদেষ্টা নিয়োগ করেন। আলীবর্দীর উপদেশের ওপর সুজাউদ্দীন এতটাই নির্ভরশীল ছিলেন যে, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে তার মতামত নিতে সুজাউদ্দীন আলীবর্দীকে বছরে একবার রাজমহল থেকে মুর্শিদাবাদে ডেকে পাঠাতেন। ১৭৩২ সালে যখন সম্রাট মুহম্মদ শাহ বিহারকে বাংলা সুবাহর সাথে একীভূত করেন,তখন স্বাভাবিকভাবেই নবাব সুজাউদ্দীনকেই এই একীভূত বৃহত্তর প্রদেশের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। কিন্তু সুজাউদ্দীন সম্পূর্ণ প্রদেশকে তার একক শাসনাধীনে রাখা সমীচীন মনে করেন নি। বিহার তার পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবে মনে করে সুজাউদ্দীন ১৭৩৩ সালে আলীবর্দীকে বিহারের শাসনভার অর্পণ করেন। আলীবর্দীর এই দায়িত্ব নেওয়ার কয়েকদিন পূর্বে তার সর্বকনিষ্ঠ কন্যা আমিনা বেগমের ( যার স্বামী ছিলেন জৈনুদ্দীন আহমদ খান) গর্ভে সিরাজউদ্দৌলার জন্ম হয়। আলীবর্দীর কোনো পুত্র সন্তান ছিল না এবং সেই কারণে এই শিশুকেই তিনি তার উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন এবং তাকে লালন পালন করেন। ১৭৩৯ সালে ১৩ মার্চ সুজাউদ্দীনের মৃত্যু হলে তার পুত্র সরফরাজ বাংলার মসনদে আসীন হন। কিন্তু মাত্র এক বছর এক মাসের মধ্যেই ক্ষমতালিপ্সু বিশ্বাসঘাতক চক্রের ষড়যন্ত্রের ফলে তার সরকারের পতন হয়। আর এই সময় দিল্লীর সম্রাট মুহম্মদ শাহ নাদির শাহের আক্রমণে দিশেহারা হয়ে পড়েন। ১৭৪০ সালে ১০ এপ্রিল সংঘটিত গিরিয়ার যুদ্ধে আলীবর্দী সরফরাজকে পরাজিত ও নিহত করেন। সেই বছর এপ্রিল মাসের শেষ দিকে তিনি বাংলার নবাব হিসাবে সম্রাট মুহম্মদ শাহের স্বীকৃতি লাভ করেন। গিরিয়ার যুদ্ধ আলীবর্দীকে বাংলা ও বিহারের অবিসংবাদিত নেতার মর্যাদায় উন্নীত করে। কিন্তু উড়িষ্যা তখনও তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকে, কারণ তখনও উড়িষ্যার ডেপুটি গভর্ণর রুস্তম জং ( নিহত সরফরাজের আত্মীয়) তার কর্তৃত্ব স্বীকার করেন নি। কিন্তু ১৭৪১ সালে ৩ মার্চ ফুলওয়ারিয়ন নামক স্থানে এক যুদ্ধে আলীবর্দী রুস্তম জংকে পরাজিত করেন। পরে মির্জা বকরও আলীবর্দীর কর্তৃত্ব অস্বীকার করেন, কিন্তু যুদ্ধে আলীবর্দীর হাতে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন। ১৭৪১ সালের শেষ নাগাদ আলীবর্দী তার সব শত্রুকে পরাভূত করে সমগ্র বাংলা বিহার ও উড়িষ্যায় তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু শীঘ্রই তিনি মারাঠা আক্রমণের হুমকির সম্মুখীন হন। তার এলাকায় সর্বপ্রথম মারাঠা আক্রমণ সংঘটিত হয় ১৭৪২ সালে। ১৭৪৬ সালে মারাঠাদের বিরুদ্ধে অভিযানে কিশোর সিরাজকে আলীবর্দী তার সঙ্গে নেন। তারপর ১৭৫১ সাল পর্যন্ত প্রায় প্রতি বছরই মারাঠারা তার রাজ্য আক্রমণ করে। আলীবর্দী মারাঠাদের পরাজিত করেন এবং ১৭৫১ সালে মে অথবা জুনে নাগপুর শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করতে মারাঠাদের বাধ্য করেন। তবে মারাঠা আক্রমণে বাংলার বাণিজ্য,শিল্প, কৃষি ও অন্যান্য আর্থিক ক্ষেত্রে ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। ১৭৫২ সালে মে মাসে আলীবর্দী খান সিরাজউদ্দৌলাকে তার উত্তরাধিকারী হিসাবে ঘোষণা করেন। এই সময় বাংলার ইউরোপীয় কোম্পানিগুলিও তাকে অভিনন্দন জানায়। আলীবর্দীর শাসন ১৬ বছর স্থায়ী হয়। প্রথম এগারো বছর তিনি বিদ্রোহ দমনে ব্যস্ত থাকায় তার শাসনাধীন অঞ্চলে তিনি তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক উন্নয়ন কর্মসূচী হাতে নিতে পারেন নি। ১৭৫১ সালে মারাঠাদের সঙ্গে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলে উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড হাতে নেন। যে সব অঞ্চল মারাঠা আক্রমণে ধ্বংস হয় সেগুলির পুনর্গঠনে তিনি আত্মনিয়োগ করেন এবং কৃষকদের চাষাবাদে উদ্বুদ্ধ করেন। কিন্তু পুনর্গঠন কাজ সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই নবাব আলীবর্দী পরলোক গমন করেন।

নবাব পদে সিরাজের মনোনয়ন প্রাপ্তিতে ঘসেটি বেগম,রাজবল্লভ,মীরজাফর আলী খান এবং শওকত জঙ্গ তার প্রতি প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠেন। ঘসেটি বেগম ছিলেন বিপুল পরিমাণ ধন সম্পত্তির অধিকারী,যা ছিল তার প্রভাব ও শক্তির উৎস। ঘসেটি বেগমের কাছ থেকে প্রবল বিরোধিতা অনুমান করে সিরাজ বেগমের মতিঝিল প্রাসাদের সব সম্পদ বাজেয়াপ্ত করেন এবং তাকে নিষ্ক্রিয় করে রাখেন। এক পর্যায়ে সিরাজ পূর্ণিয়ার শাসনকর্তা শওকত জঙ্গকে দমন করেন এবং এক সংঘর্ষে শওকত নিহত হন। সিরাজের ক্ষমতারোহণ মুর্শিদাবাদের শাসক শ্রেণীর প্রভাবশালী অংশের জন্য ছিল হুমকিস্বরূপ। সিরাজের সিংহাসন লাভ ইংরেজদের পক্ষেও ছিল হুমকিস্বরূপ। কেননা পূর্ববর্তী নবাবদের মতো সিরাজ ইংরেজ কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসা ও বণিকগোষ্ঠী কর্তৃক দস্তকের অপব্যবহার মেনে নিতে অস্বীকার করেন। সিরাজ এমন এক সময়ে ঘোষণা করেন যখন ইংরেজ কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসায়ে এক মারাত্মক সংকট চলছিল। ইংরেজ ঈস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে সিরাজ বাস্তবিকপক্ষেই অসন্তুষ্ট ছিলেন। কোম্পানির বিরুদ্ধে তার অভিযোগগুলির মধ্যে ছিল প্রথমত, নবাবের অনুমতি ব্যতীত ফোর্ট উইলিয়ম নামক দুর্গ নির্মাণ, দ্বিতীয়ত,ইংরেজরা মুগল শাসকদের প্রদত্ত বাণিজ্যিক সুবিধার অপব্যবহার করতে থাকে। ফলে সরকার বিপুল অঙ্কের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়। এবং তৃতীয়ত,ইংরেজরা সরকারী তহবিল তছরূপকারী কৃষ্ণদাসকে ( রাজবল্লভের পুত্র) আশ্রয় প্রদান করে। ইংরেজরা যদি প্রচলিত অবস্থার পরিবর্তন ঘটায় এবং মুর্শিদকুলী খান প্রদত্ত বিধি ও শর্তানুসারে বাণিজ্য করতে সম্মত হয়, তাহলে নবাব তাদের ক্ষমা করবেন বলে ঘোষণা করেন। কিন্তু কোম্পানি এই ক্ষেত্রে নবাবের প্রতি কোনরূপ সম্মান প্রদর্শন করে নি। উপরন্তু কলকাতা কাউন্সিলের গভর্ণর রজার ড্রেক ফোর্ট উইলিয়মে প্রেরিত নবাবের বিশেষ দূত নারায়ণ সিংহকে অপমান করেন। এসব ঘটনায় ক্ষুব্ধ নবাব ইংরেজদের সমুচিত শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে প্রথমে কাশিমবাজার কুঠি অবরোধ করেন এবং পরবর্তীকালে কলকাতা অধিকার করে ইংরেজদের বিতারিত করেন।
ঘসেটি বেগম - ঘসেটি বেগম আলীবর্দী খানের জ্যেষ্ঠা কন্যা। আসল নাম মেহেরুন্নেসা। নবাব আলীবর্দী খান তার তিন কন্যাকে তার বড় ভাই হাজী আহমদের তিন ছেলের সহিত বিবাহ দেন।
ঘসেটি বেগমের বিবাহ হয়েছিল নওয়াজিস মুহম্মদ শাহমত জং-এর সাথে এবং শাহমত জংকে ঢাকার নায়েব নাজিম নিযুক্ত করা হয়েছিল। নি:সন্তান নওয়াজিস - ঘসেটি দম্পতি সিরাজউদ্দৌলার কনিষ্ঠ ভাই ইকরামউদ্দৌলাকে পালক পুত্র হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে ইকরামউদ্দৌলার মৃত্যু হয় এবং তার মৃত্যুর পর নওয়াজিস অল্প কিছুদিন জীবিত ছিলেন। ঘসেটি বেগম তার স্বামীর বিপুল ধন সম্পদের মালিকানা লাভ করেন। পূর্বেকার সঞ্চিত ধন সম্পদসহ উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত তার ধন সম্পদ তিনি মতিঝিল প্রাসাদে সঞ্চিত করেন।
বৃদ্ধ নবাব তার কনিষ্ঠা কন্যার পুত্র সিরাজউদ্দৌলাকে তার উত্তরাধিকারী মনোনীত করলে ঘসেটি বেগম এই মনোনয়নের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন এবং সিরাজউদ্দৌলার পরিবর্তে তার দ্বিতীয় বোনের পুত্র শওকত জঙ্গকে সিংহাসনে বসানোর জন্য চেষ্টা করেন। মাতামহের মৃত্যুর পর সিরাজ মসনদে আরোহণ করেন এবং অনতিবিলম্বেই তিনি ঘসেটি বেগমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাস্বরূপ তাকে প্রাসাদে অবরুদ্ধ করেন। সিরাজউদ্দৌলা রাজবল্লভের কাছ থেকেও ঢাকার কোষাগারের একটি বিবরণ চান। কিন্তু রাজবল্লভ সঠিক বিবরণ দিতে ব্যর্থ হন। তার পুত্র কৃষ্ণদাস বল্লভ পালিয়ে কলকাতায় ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির ফোর্ট উইলিয়মে আশ্রয় নেন। কৃষ্ণদাস বল্লভককে তার নিকট হস্তান্তর করার জন্য নবাব কলকাতার ইংরেজ গভর্ণর রজার ড্রেকের নিকট পত্র প্রেরণ করেন। আলীবর্দীর প্রধান সেনাপতি মীরজাফরও সিরাজউদ্দৌলার মসনদ লাভে স্বস্তি বোধ করেন নি। ঘসেটি গোপনে মীরজাফরের সাথে মিত্রতা গড়ে তোলেন। ব্যবসায়ী জগৎ শেঠ এবং উমিচাঁদ, ঘসেটি বেগম ও মীরজাফরের সাথে ষড়যন্ত্রে যোগ দেন। সকল ষড়যন্ত্রকারীর অভিন্ন উদ্দেশ্য ছিল নবাবকে উচ্ছেদ করা। পলাশীর যুদ্ধের পর সিরাজউদ্দৌলা নিহত হন এবং ইংরেজদের দ্বারা মীরজাফর বাংলার নবাব হন। মীরজাফর মুর্শিদাবাদে প্রথমেই পরাজিত নবাবের মাতা আমিনা বেগমসহ ঘসেটি বেগমকে বন্দী করেন। অত:পর তাদের ঢাকায় সরিয়ে দেন এবং ঢাকার জিনজিরা প্রাসাদে অন্তরীণ করে রাখেন। মীরজাফরের পুত্র মীরন ঘসেটি বেগমকে বন্দী অবস্থায়ও বিপজ্জনক শত্রু বলে বিবেচনা করেন।
মীরন ঘসেটি বেগম ও আমিনা বেগমকে মুর্শিদাবাদে সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেন। কথিত আছে যে, উভয়েরই বুড়িগঙ্গা নদীতে সলিল সমাধি ঘটে।

১৭২৭ সালে মুর্শিদকুলী খানের মৃত্যুর পর সুজাউদ্দীন খান ক্ষমতা দখল করলে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি তাদের দাবি সমূহকে পুরোপুরি কার্যকরী করার সুযোগ পায়। সুজাউদ্দীন খানের আমলে (১৭২৭ - ১৭৩৯) ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্য ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়।
মারাঠাদের দ্বারা বার বার আক্রমণে বিপর্যস্ত আলীবর্দী খান অনুধাবন করেন যে, ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির দুর্নীতি এবং বাড়াবাড়ির বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে আরও সংকট বাড়ানো সমীচীন হবে না। পরবর্তীতে মুর্শিদাবাদের মসনদে সিরাজউদ্দৌলা আসীন হওয়ার পর মারাঠাদের আক্রমণও বন্ধ হয়ে যায়। সিরাজউদ্দৌলা কোম্পানিকে বাংলায় ব্যবসা বাণিজ্য পরিচালনা করার জন্য তিনটি শর্ত মেনে চলার নির্দেশ দেন। (ক) কলকাতার অবৈধ প্রতিরক্ষা স্থাপনা ভেঙে ফেলতে হবে। (খ) দস্তকের অপব্যবহার বন্ধ করতে হবে। (গ) এদেশের আইন মেনে চলতে হবে। ফোর্ট উইলিয়ম কাউন্সিল নবাবের নির্দেশ অমান্য করায় নবাব কলকাতা অভিযান করেন এবং ইংরেজদের কলকাতা থেকে বিতাড়ন করেন। বিতাড়িত ইংরেজরা হুগলী নদীর তীরে ফলতায় নিরাপদ আশ্রয় নেয়। এই বিজয়কে স্মরণীয় করার জন্য সিরাজউদ্দৌলা তার মাতামহের নামানুসারে কলকাতার নাম রাখেন আলীনগর। ইংরেজদের বিরুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলার এই অভিযানের প্রতি ফরাসিদের নৈতিক সমর্থন ছিল।

মীরজাফর আলী খান - ১৬৯১ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন আরব বংশোদ্ভূত এবং সৈয়দ আহমদ নাজাফীর পুত্র। আলীবর্দী খানের মতোই তিনি একজন ভাগ্যান্বেষী হিসাবে ভারতে আসেন। আলীবর্দী খান তার দূর সম্পর্কীয় বোন শাহ খানমকে মীরজাফর আলীর সাথে বিয়ে দিয়ে তাকে বখশী পদে উন্নীত করেন। ১৭৪১ খ্রিষ্টাব্দে কটকের নিকটে শত্রু কবলিত শওকত জংকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করে এবং ১৭৪৬ খ্রিষ্টাব্দে ১৪ ডিসেম্বর মারাঠা বাহিনীকে পরাজিত করে মীরজাফর কিছুটা সাহসিকতার প্রমাণ দিলেও ১৭৪৭ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে ভোঁসলের নেতৃত্বে মারাঠা বাহিনীর অগ্রযাত্রার খবর পেয়ে তিনি মেদিনীপুর ছেড়ে বর্ধমানে পালিয়ে আসেন। কিছুদিনের মধ্যে তিনি রাজমহলের ফৌজদার আতাউল্যার যোগসাজসে আলীবর্দীকে ক্ষমতাচ্যুত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। কিন্তু ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে গেলে তাকে বখশী পদ থেকে অপসারণ করা হয়।
জগৎ শেঠ - বাংলার অত্যন্ত ধনী ব্যাংকার ফতেহ চাঁদকে 'জগৎ শেঠ' উপাধি প্রদান করা হয়। জগৎ শেঠ পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মাণিকচাঁদ। তিনি আঠারো শতকের প্রথম দিকে পাটনা থেকে ঢাকা আসেন এবং এখানে একটি বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। বাংলার নবাব মুর্শিদকুলী খান তার রাজধানী মুর্শিদাবাদে স্থানান্তর করলে, মাণিকচাঁদ তার সাথে নতুন রাজধানীতে চলে আসেন। মুর্শিদাবাদে তিনি ছিলেন নবাবের খুবই প্রিয়ভাজন এবং পরে নবাবের ব্যাংকার ও অর্থনৈতিক উপদেষ্টার পদ লাভ করেন। ১৭১২ সালে দিল্লীর সম্রাট ফারুখ সিয়ার 'নগর শেঠ' উপাধি প্রদান করে মাণিকচাঁদকে সম্মানিত করেন। ১৭১৪ সালে মাণিকচাঁদের মৃত্যুর পর তার ভ্রাতুষ্পুত্র (দত্তক পুত্র) ও উত্তরাধিকারী ফতেহ চাঁদের নেতৃত্বে পরিবারটি বিপুল খ্যাতি অর্জন করে। ১৭২৩ সালে সম্রাট মাহমুদ শাহ ফতেহ চাঁদকে 'জগৎ শেঠ' উপাধি প্রদান করলে এই ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানটি দেশে এক অনন্য মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়।
এর সদর দফতর ছিল মুর্শিদাবাদে এবং ঢাকা,পাটনা ও দিল্লীসহ বাংলার গুরুত্বপূর্ণ শহর ও বাংলার বাইরে এই ব্যাঙ্কের শাখা ছিল। সমকালীন দলিল দস্তাবেজে জগৎ শেঠের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির কারবার, যেমন ঋণগ্রহণ, ঋণ পরিশোধ, সোনারুপার ক্রয়-বিক্রয় ও অন্যান্য লেনদেনের উল্লেখ রয়েছে।
ফতেহ চাঁদের পর তার পৌত্র মাহতাব চাঁদ ১৭৪৪ সালে উত্তরাধিকার সূত্রে 'জগৎ শেঠ' উপাধি লাভ করেন। তিনি ও তার সম্পর্কিত ভাই মহারাজা স্বরূপ চাঁদ নবাব আলীবর্দী খানের সময়ে অত্যন্ত প্রভাবশালী ছিলেন। আলীবর্দীর উত্তরাধিকারী সিরাজউদ্দৌলা এই পরিবারের দুভাইকে বৈরী করে তোলেন। ফলে তারা তার বিরুদ্ধে ইংরেজদের সাথে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন এবং পলাশীর যুদ্ধের আগে ও পরে তাদেরকে বিপুল অর্থ দিয়ে সাহায্য করেন। বাংলার জনগণ বিশ্বাস করে যে, জগৎ শেঠের অর্থ আর ইংরেজদের তলোয়ার মিলে বাংলায় মুসলিম শাসনের পতন ঘটিয়েছে।
মীরজাফরের নবাবী আমলেও তাদের শক্তি ও প্রভাব অব্যাহত ছিল। কিন্তু তারা তার উত্তরাধিকারী মীরকাসিমের বিরাগভাজন হন। মীরকাসিম ১৭৬৩ সালে শেঠ পরিবারের নেতৃস্থানীয় এই দুই ভাইকে হত্যার নির্দেশ দেন। এই ঘটনার পরই নবাবের কাছ থেকে ক্ষমতা কোম্পানির হাতে চলে যায় এবং আঠারো শতকের শেষের দিকে এই পরিবারের পতনের সূচনা হয়। এই পরিবার বেশ কয়েক বছর কোম্পানির ব্যাংকার ছিল। কিন্তু ১৭৭৩ সালে মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতায় কোষাগার স্থানান্তরিত হলে কোম্পানির ব্যাংকার হিসাবে জগৎ শেঠ পরিবারের কার্যক্রমের অবসান ঘটে।

রজার ড্রেক - ১৭৫২ সালে ৮ আগস্ট থেকে ১৭৫৮ সাল পর্যন্ত বাংলার ফোর্ট উইলিয়ম কাউন্সিলের গভর্ণর ছিলেন। রজার ড্রেক ১৭৩৭ সালে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির চাকরিতে একজন রাইটার বা সর্বনিম্ন কর্মকর্তা হিসেবে কলকাতায় আগমন করেন। কোম্পানির কাজে তার প্রশংসনীয় অবদান ও যোগ্যতার বলে তিনি ফোর্ট উইলিয়মের গভর্ণর পদে উন্নীত হন। কিন্তু সংকট মোকাবেলার দৃঢ়তা বা যোগ্যতা তার ছিল না। নবাবের পূর্ব অনুমতি ছাড়াই তিনি কলকাতার দুর্গ সুরক্ষিত করেন। এই ধরণের বেআইনি কার্যক্রমের পরিণতি অনুধাবনের চেষ্টাও তিনি করেন নি। নবাব আলীবর্দী খানের প্রশাসন রজার ড্রেকের বেআইনি কার্যকলাপ উপেক্ষা করলেও নবাব সিরাজউদ্দৌলা সিংহাসনে আরোহণের পরপরই অবৈধভাবে নির্মিত সকল প্রতিরক্ষামূলক পরিকাঠামো ভেঙে ফেলার এবং সেই সঙ্গে কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসায়ে দস্তকের বে-আইনি ব্যবহার বন্ধ করার জন্য কয়েকটি পরওয়ানা জারি করেন। রজার ড্রেক নবাবের আদেশ অমান্য করেন। সিরাজউদ্দৌলা ক্রুদ্ধ হয়ে ফোর্ট উইলিয়ম কাউন্সিলকে দেশের আইন মেনে চলতে বাধ্য করার জন্য তাদের বিরুদ্ধে এক অভিযান পরিচালনা করেন। ১৭৫৬ সালে ১৬ জুন তিনি কলকাতা আক্রমণ করেন। এর দুদিন পর কোম্পানির কর্মকর্তাদের ফেলে রেখে রজার ড্রেক হুগলী নদীর প্রায় ২০ মাইল দূরে ফলতা নামক স্থানে পালিয়ে যান। পলাশীর যুদ্ধের পর কোর্ট অব ডাইরেক্টরস রজার ড্রেককে পদচ্যুত করে।
উইলিয়ম ওয়াটস (১৭২২ - ১৭৬৪) - ১৭৫৬ সালে এপ্রিলে বাংলার মসনদে সিরাজউদ্দৌলার অধিষ্ঠান কালে ইংরেজ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির কাশিমবাজার কুঠির প্রধান ছিলেন উইলিয়ম ওয়াটস। উইলিয়ম ওয়াটস দীর্ঘকাল বাংলায় বসবাস করেন এবং বাংলা, হিন্দী ও ফারসি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন। দেশের অপরাপর লোকদের সঙ্গে দীর্ঘকাল কাজ করার ফলে তিনি স্থানীয় রীতিনীতি, অভ্যাস ও আচার- আচরণ সম্পর্কে জ্ঞানলাভে সমর্থ হন। ব্যবসায়িক প্রয়োজনে তিনি তৎকালীন নামকরা সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ীদের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসেন। জগৎ শেঠ পরিবারের প্রধান,এবং উমিচাঁদ ছিলেন তার ব্যক্তিগত বন্ধু। রবার্ট ক্লাইভ মুর্শিদাবাদে নবাবের দরবারে ইংরেজ কোম্পানির প্রতিনিধির দায়িত্ব উইলিয়ম ওয়াটসের উপর অর্পণ করেন। যথাসময়ে ক্লাইভ নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে চূড়ান্তভাবে উৎখাত করে তাদের পছন্দমত একজনকে মসনদে বসাবার প্রস্তুতির নকশা প্রণয়নের দায়িত্ব ওয়াটসের উপর ন্যস্ত করেন। ওয়াটস তখন মীরজাফর, রায়দুর্লভের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন। সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে বিরাট ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার এবং পরিণামে তার সম্পূর্ণ উৎখাতের ক্ষেত্রে উইলিয়ম ওয়াটস সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তার কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৭৫৮ সালে ২২ জুন রজার ড্রেকের স্থলে তাকে ফোর্ট উইলিয়মের গভর্ণর নিযুক্ত করা হয়। কিন্তু মাত্র চার দিন পরই রবার্ট ক্লাইভের অনুকূলে তাকে এই পদ ছেড়ে দিতে হয়।
উমিচাঁদ - পলাশী ষড়যন্ত্রের প্রধান উমিচাঁদ ছিলেন নবাবী আমলের একজন সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ী। আগ্রার অধিবাসী মধ্য ভারতীয় ব্যবসায়ী উমিচাঁদ আঠারো শতকের দ্বিতীয় দশকে বাংলায় আসেন। পরবর্তী সময়ে তিনি কলকাতায় নিজেকে একজন নেতৃস্থানীয় ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি আলীবর্দী খানের প্রশাসনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। উমিচাঁদ মূলত শোরা ও আফিমের ব্যবসা করতেন। তিনি ছিলেন ইংরেজ কোম্পানিতে শোরা সরবরাহের একজন বড় ঠিকাদার। উমিচাঁদ মুর্শিদাবাদ প্রশাসনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। প্রশাসনকে উৎকোচ প্রদানের মাধ্যমে তিনি অত্যন্ত লাভজনক শোরার ব্যবসায়ে একচেটিয়া অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। আলীবর্দী খানের ভাই হাজী আহমদ কোম্পানি এবং সেই সঙ্গে মুর্শিদাবাদের নবাবের নিকট উমিচাঁদের ব্যবসায়িক জামিনদার ছিলেন। বিশাল ধনসম্পদ ও অভিজাত মহলের সঙ্গে ব্যাপক যোগাযোগের ফলে তিনি আলীবর্দী খান এবং পরবর্তীকালে সিরাজউদ্দৌলার ঘনিষ্ঠ বিশ্বাসভাজনে পরিণত হন।
পলাশী ষড়যন্ত্রের ক্ষেত্রে কোম্পানি মুর্শিদাবাদ দরবারে উমিচাঁদের প্রভাবকে পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগায়। উমিচাঁদের মাধ্যমেই কলকাতা ফোর্ট উইলিয়ম কাউন্সিলের সঙ্গে মুর্শিদাবাদ দরবারের যোগাযোগ পরিচালিত হতো। উমিচাঁদ প্রথমে সিরাজউদ্দৌলার স্থলাভিষিক্ত হিসেবে কোম্পানির কাছে সেনাপতি ইয়ার লতিফ খানের নাম প্রস্তাব করেন। কিন্তু এই প্রস্তাব গৃহীত হয় নি। পরবর্তী সময়ে উইলিয়ম ওয়াটস, মীরজাফরের সাথে যোগাযোগ করেন এবং উমিচাঁদ তখন মীরজাফরের অনুকূলে সমর্থন জ্ঞাপন করেন।
পলাশী চক্রান্ত তৈরী হওয়ার পর তা বাস্তবায়নের অব্যবহিত পূর্বে উমিচাঁদ নবাবের সকল ধনসম্পদের পাঁচ শতাংশ দাবি করে বসেন। তখন এই সম্পদের পরিমাণ ধরে নেওয়া হয়েছিল চল্লিশ কোটি টাকার মতো যা নি:সন্দেহে ছিল অতিরঞ্জিত।
ষড়যন্ত্রে সাফল্যের পর কে কি পাবেন এই বিষয়ে সম্পাদিত আনুষ্ঠানিক চুক্তিপত্রে এই বলে উমিচাঁদের নাম বাদ দেওয়া হয় যে, তাকে বিশেষভাবে পুরস্কৃত করা হবে। তবে তার দাবিকৃত শতকরা পাঁচ ভাগ সম্পদ প্রাপ্তির নিশ্চয়তা নিয়ে তার সঙ্গে একটি পৃথক চুক্তি করা হয়।
কিন্তু পলাশীর যুদ্ধের পর রবার্ট ক্লাইভ তাকে তার প্রাপ্য অর্থ দিতে এই বলে অস্বীকৃতি জানান যে, তার মতো 'দ্বৈত চর' কে খুশি রাখার জন্যই নিছক চাতুরি হিসেবে এই চুক্তি করা হয়েছিল। এই কথা শোনামাত্রই উমিচাঁদ অজ্ঞান হয়ে পড়েন এবং আরোগ্যলাভ করলেও পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে কয়েক বছর বেঁচেছিলেন।

নবাব সিরাজউদ্দৌলার হাতে কলকাতার পতনের সংবাদ এমন এক সময়ে মাদ্রাজে পৌঁছায় যখন কোম্পানির লোকেরা ক্লাইভ কর্তৃক অর্জিত সামরিক ও কূটনৈতিক বিজয় উপলক্ষে উৎসব উদযাপনে ব্যস্ত ছিল। সংবাদ আসে যে,কলকাতা ও অপরাপর ইংরেজ বসতি থেকে বিতাড়িত সকল ইংরেজ বণিক ফলতায় আশ্রয় গ্রহণ করেছে।
মাদ্রাজের বিজয়ী ইংরেজরা কলকাতায় বিপদগ্রস্ত ইংরেজদের রক্ষায় সর্বাপেক্ষা যোগ্য বিবেচনা করেন ক্লাইভকে। ১৭৫৬ সালে ১৬ অক্টোবর রবার্ট ক্লাইভের নেতৃত্বে একটি সেনাবাহিনী নৌপথে মাদ্রাজ থেকে যাত্রা শুরু করে এবং ডিসেম্বর মাসে ফলতায় পৌঁছায়। ক্লাইভের সাহায্যকারী ছিলেন অ্যাডমিরাল ওয়াটসন। এই সময় নবাবের কোনো বড় সেনাবাহিনী কলকাতায় ছিল না। ক্লাইভ ও ওয়াটসনের যৌথ অভিযানের ফলে ১৭৫৭ সালে ২ জানুয়ারি কলকাতা পুনর্দখল করে ইংরেজরা।
এই সংবাদ পাওয়ার পর, সিরাজউদ্দৌলা ১৭৫৭ সালে দ্বিতীয়বারের মতো কলকাতা আক্রমণ করেন। কয়েকদিন যুদ্ধের পর, উভয় পক্ষ শান্তি আলোচনায় সম্মত হন। ৯ ফেব্রুয়ারি, ১৭৫৭ সালে উভয় পক্ষের ভিতর সন্ধিপত্র স্বাক্ষরিত হয়। একে আলীনগর সন্ধি নামে অভিহিত করা হয়।
এই সন্ধির শর্তানুসারে, নবাব দিল্লীর সম্রাটের দেওয়া সকল বাণিজ্যিক সুবিধা ইংরেজদের দেন। একই সাথে নবাব কলকাতায় ইংরেজদের দুর্গ নির্মাণে অনুমতি দেন। এই সময় নবাবের অনুমতিক্রমে কোম্পানি নিজের নামে মুদ্রা প্রচলনের অধিকার লাভ করে।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত ইংরেজরা এই সন্ধিপত্র মানা প্রয়োজন মনে করে নাই। ১৭৫৭ সালে ২৪ মার্চ ইংরেজরা চন্দননগর দখল করে নেয়। এই সময় আহম্মদশাহ আবদালী দিল্লী আক্রমণ করে লুটতরাজ করে। এতে শঙ্কিত হয়ে সিরাজউদ্দৌলা ইংরেজদের সাথে নতুন করে যুদ্ধে যেতে সাহসী হন নি। ফলে সহজেই ইংরেজরা ফরাসী কুঠি দখল করে নেয়। পলাতক ফরাসিরা মুর্শিদাবাদে আশ্রয় নেয়।

রাজবল্লভ - রাজবল্লভ জাতিতে একজন বৈদ্য। তিনি ১৭১৭ খ্রিস্টাব্দে কানুনগো বিভাগে একজন মুহরি ( কোষাধ্যক্ষ) হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ঐ ক্ষুদ্র সরকারী অবস্থান থেকে তিনি মুগলদের অধীনে চাকরিতে দ্রুত উন্নতিসাধন করে মহারাজা খেতাব পেয়ে ঢাকার দেওয়ান হন (১৭৫৬ - ৫৭)। পরবর্তীকালে তিনি মুঙ্গেরের ফৌজদারের পদ লাভ করেন। ঢাকা,ফরিদপুর, বরিশাল এবং ত্রিপুরা হতে ভূসম্পত্তি দখল করে তিনি রাজনগর নামে নতুন পরগণা গঠন করেন।
১৭৫৬ - ৬৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাকালে রাজবল্লভ এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হন। মীরজাফর আলী খান এবং ঘসেটি বেগমের একজন অনুষঙ্গী রাজবল্লভ ঢাকার দেওয়ান পদে নিয়োজিত থাকাকালীন বিশাল অর্থের অর্থ আত্মসাৎ করে নবাব সিরাজউদ্দৌলার মনে অসন্তোষ সৃষ্টি করেছিলেন। তার প্ররোচনায় পুত্র কৃষ্ণদাস আত্মসাৎকৃত অর্থসহ কলকাতায় পালিয়ে যান এবং ইংরেজদের আশ্রয় গ্রহণ করেন। বিষয়টি পরবর্তীকালে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে সিরাজের সশস্ত্র সংঘর্ষের একটি কারণ হয়ে দাঁড়ায়। নবাব মীরকাসিম ইংরেজদের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত সন্দেহ করে তাকে জলে ডুবিয়ে হত্যা করেন (১৭৬৩)।

সব ধরণের গোলমাল মোটামুটি শান্ত হওয়ার পর সিরাজউদ্দৌলা সেনাপতিদের অপকর্মের বিচার শুরু করেন। মাণিকচন্দ্রকে কারাবন্দী করা হয়। এটা দেখে রাজবল্লভ, জগৎ শেঠ ও মীরজাফর সবাই ভীত হয়ে গেলেন। স্বার্থরক্ষার জন্য জগৎ শেঠের মন্ত্রণাভবনে মিলিত হয়ে তারা ইংরেজদের সাহায্যে সিংহাসনচ্যুত করে মীরজাফরকে সিংহাসনে বসাবার চক্রান্ত শুরু করলো। ইয়ার লতিফ গোপনে ওয়াটসনের সঙ্গে মিলিত হয়ে কুমন্ত্রণা দিলেন যে, সিরাজউদ্দৌলা খুব শীঘ্রই ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবেন। আর এই কারণেই তিনি পলাশীতে শিবির স্থাপন করেছেন।
১৭৫৭ সালে ১৭ মে কলকাতায় ইংরেজ দরবারে এক গোপন সন্ধিপত্রের খসড়া নিয়ে আলোচনা হয়। মীরজাফরের স্বাক্ষরের জন্য এই গোপন সন্ধিপত্র ১০ জুন তার কাছে পাঠানো হয়। কিন্তু এই গুপ্ত বৈঠক আর গোপন থাকলো না।ক্লাইভ যুদ্ধের যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করলেন। এদিকে গোপন সন্ধিপত্রের সংবাদ জানতে পেরে সিরাজউদ্দৌলা মীরজাফরকে বন্দী করার ব্যবস্থা নিলেন। ওয়াটসন রাজধানী থেকে পালিয়ে গেলেন।
১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে ১২ জুন কলকাতার ইংরেজ সৈন্যরা চন্দননগরের সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিলিত হয়। সেখানে দুর্গ রক্ষার জন্য অল্প কিছু সৈন্য রেখে তারা ১৩ জুন অবশিষ্ট সৈন্য নিয়ে যুদ্ধযাত্রা করে।
কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদের পথে হুগলি,কাটোয়ার দুর্গ,অগ্রদ্বীপ ও পলাশীতে নবাব সিরাজের সৈন্য থাকা সত্ত্বেও তারা কেউ ইংরেজদের পথ রোধ করলো না। নবাব বুঝতে পারলেন,সেনাপতিরাও এই ষড়যন্ত্রের সামিল।
বিদ্রোহের আভাস পেয়ে সিরাজ মীরজাফরকে বন্দী করার চিন্তা বাদ দিলেন। তিনি মীরজাফরকে ক্ষমা করে তাকে শপথ নিতে বললেন। মীরজাফর পবিত্র কোরাণ স্পর্শ করে অঙ্গীকার করলেন যে, তিনি শরীরের এক বিন্দু রক্ত থাকতেও বাংলার স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ণ হতে দেবেন না। গৃহবিবাদের মীমাংসা করে তিনি রায়দুর্লভ,ইয়ার লতিফ,মীরজাফর, মীরমদন,মোহনলাল ও ফরাসি সেনাপতি সিনফ্রেঁকে সৈন্য চালানোর দায়িত্ব দিয়ে তাদের সঙ্গে যুদ্ধযাত্রা শুরু করলেন।
১৭৫৭ সালে ২২ জুন মধ্যরাতে রবার্ট ক্লাইভ কলকাতা থেকে তার বাহিনী নিয়ে পলাশী মৌজার লক্ষীবাগ নামে আম্রকাননে এসে উপস্থিত হন। বাগানের উত্তর পশ্চিম দিকে গঙ্গা নদী। এর উত্তর পূর্ব দিকে দুই বর্গমাইলব্যাপী আম্রকানন।
১৭৫৭ সালে ২৩ জুন সকাল থেকেই পলাশীর প্রান্তরে ইংরেজরা মুখোমুখি যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার জন্য প্রস্তুত হলো। ইংরেজরা লক্ষীবাগ নামক আম্রকাননে সৈন্য সমাবেশ করলো। বেলা আটটার সময় হঠাৎ করেই মীরমদন ইংরেজবাহিনীকে আক্রমণ করেন। তার প্রবল আক্রমণে টিকতে না পেরে ক্লাইভ তার সেনাবাহিনী নিয়ে আমবাগানে আশ্রয় নেন। নবাবের পক্ষে সৈন্য ছিল প্রায় পঞ্চাশ হাজার। পক্ষান্তরে ইংরেজদের পক্ষে সৈন্য ছিল মাত্র তিন হাজার। কিন্তু মীরজাফর, রায়দুর্লভ এই যুদ্ধে নিরপেক্ষ থেকে দর্শকের ভূমিকায় থাকেন। নবাবের পক্ষে যুদ্ধ করেন মীরমদন, মোহনলাল এবং সিনফ্রে নামক ফরাসি সেনাপতি। যুদ্ধের প্রথমাবস্থায় নবাব বাহিনী জয়লাভ করে। কিন্তু মীরজাফর, ইয়ার লতিফ,রায়দুর্লভ যেখানে সৈন্যসমাবেশ করেছিলেন সেখানেই নিস্পৃহভাবে দাঁড়িয়ে থাকলেন। তাদের সামান্য সহায়তা পেলেও হয়তো মীরমদন ইংরেজদের পরাজয় বরণ করতে বাধ্য করতে পারতেন। দুপুরের দিকে হঠাৎ বৃষ্টি নামলে সিরাজউদ্দৌলার গোলাবারুদ ভিজে যায়। তবুও সাহসী মীরমদন ইংরেজদের সাথে লড়াই চালিয়ে যেতে লাগলেন। কিন্তু হঠাৎ করে গোলার আঘাতে মীরমদন মৃত্যুবরণ করেন।
মীরমদনের মৃত্যুতে হতভম্ব নবাব সিরাজ মীরজাফরকে ডেকে পাঠান এবং তার জীবন ও সম্মান রক্ষার জন্য তাকে সনির্বন্ধ অনুরোধ করেন। মীরজাফর ও রায়দুর্লভ নবাবের নির্দেশ অমান্য করলেন। তাদের যুক্তি হলো গোলন্দাজ বাহিনীর আশ্রয় ছাড়া অগ্রসর হওয়া আত্মঘাতী ব্যাপার। কিন্তু ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি ও নবাবের বাহিনীর মধ্যে তখন দূরত্ব মাত্র কয়েক শ গজ।

মীরজাফর নবাবকে ঐ দিনে যুদ্ধ বিরতির এবং পরদিন সকালে নতুন উদ্যমে যুদ্ধ শুরু করার পরামর্শ দেয়। বিকেল পাঁচটায় সিরাজউদ্দৌলার বাহিনী নির্দেশনার অভাবে এবং ইংরেজবাহিনীর গোলন্দাজি অগ্রসরতার মুখে সিরাজউদ্দৌলা যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করলেন। আর এই খবর শীঘ্রই ক্লাইভের নিকট পৌঁছায়। পরামর্শমত নবাবের সেনানায়কেরা পিছুতে থাকলে ইংরেজ সেনারা নতুন করে প্রচণ্ড আক্রমণ চালায় এবং ফলে নবাব বাহিনী বিশৃঙ্খলভাবে যত্রতত্র পালিয়ে যায়। নবাবের ছাউনি ইংরেজদের অধিকারে আসে। আর কোন উপায় না দেখে সিরাজউদ্দৌলা রাজধানী রক্ষা করার জন্য দুই হাজার সৈন্য নিয়ে মুর্শিদাবাদের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। কিন্তু রাজধানী রক্ষা করার জন্যেও কেউ তাকে সাহায্য করে নি। সিরাজউদ্দৌলা তার সহধর্মিণী লুৎফাউন্নেসা ও চার বছরের শিশুকন্যাকে নিয়ে রাজধানী থেকে বের হয়ে স্থলপথে ভগবানগোলায় পৌঁছে যান এবং সেখান থেকে নৌকাযোগে পদ্মা ও মহানন্দার মধ্য দিয়ে উত্তরদিক অভিমুখে যাত্রা করেন। এইভাবে নবাব সিরাজ পলাশীর যুদ্ধে পরাজিত হলেন। তিনি ছিলেন ষড়যন্ত্রের শিকার। তার আশা ছিল পশ্চিমাঞ্চলে পৌঁছাতে পারলে ফরাসি সৈনিক মসিয়ে নাসের সহায়তায় পাটনা পর্যন্ত গিয়ে রামনারায়ণের কাছ থেকে সৈন্য সংগ্রহ করে ফরাসি বাহিনীর সহায়তায় বাংলাকে রক্ষা করবেন।
মীরজাফর রাজধানীতে পৌঁছে নবাবকে খুঁজে না পেয়ে চারদিকে লোক পাঠালেন।
২৯ জুন ক্লাইভ সিরাজউদ্দৌলার প্রাসাদ হীরাঝিলে মীরজাফরের সাথে মিলিত হন। দেশীয় রাজন্যবর্গ ও সভাসদদের উপস্থিতিতে তিনি মিরজাফরকে মসনদে বসান এবং অনুরূপভাবে সভাসদরাও তার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন। মেদিনীপুরের শাসনকর্তা রামরাম সিংহ, বিহারের শাসনকর্তা রাজা রামনারায়ণ মীরজাফরের সিংহাসন লাভকে অবৈধ ঘোষণা করে। এই বিদ্রোহের সাথে রায়দুর্লভ যুক্ত আছে এই সন্দেহে মীরজাফর তাকে শাস্তি দিতে উদ্যত হন। পরে ক্লাইভের মধ্যস্থতায় তা মিটে যায়। এরপর মীরজাফর অন্যান্য বিদ্রোহীদের শাস্তি দেওয়ার উদ্যোগ নিলে,ক্লাইভের মধ্যস্থতায় সেই সকল দ্বন্দ্বের অবসান হয়।
ক্লাইভ মীরজাফরের কাছ থেকে নগদ ত্রিশ লক্ষ টাকা এবং চব্বিশ পরগণার জায়গীরদারি লাভ করেন।

সিরাজউদ্দৌলা মহানন্দা নদীর স্রোত অতিক্রম করে এলেও তাতে জোয়ার ভাটার ফলে হঠাৎ করে জল কমে যাওয়ায় নাজিমপুরের মোহনায় এসে তার নৌকা চড়ায় আটকে যায়। তিনি নৌকা থেকে নেমে খাবার সংগ্রহের জন্য একটি মসজিদের নিকটবর্তী বাজারে আসেন। সেখানে কিছু লোক তাকে চিনে ফেলে অর্থের লোভে মীরজাফরের সৈন্যবাহিনীকে খবর দেয়। রাজমহলের কাছে সিরাজ সপরিবারে ধরা পড়েন। মীরজাফরের সৈন্যবাহিনী তাদেরকে বন্দী করে মুর্শিদাবাদে নিয়ে আসে। বন্দী হবার সময় নবাবের সাথে ছিলেন তার স্ত্রী লুতফাউন্নেসা বেগম এবং চার বছর বয়সী কন্যা উম্মে জহুরা। এর পরের দিন ২রা জুলাই,১৭৫৭ সালে মীরজাফরের পুত্র মীরনের নির্দেশে মুহম্মদ আলি বেগ নামের এক ঘাতক সিরাজউদ্দৌলাকে হত্যা করে। মুর্শিদাবাদের খোশবাগে নবাব আলিবর্দী খানের কবরের কাছে তাকে কবর দেওয়া হয়।
সিরাজউদ্দৌলার স্ত্রী লুতফাউন্নেসা বেগম, তার শিশু কন্যা এবং সিরাজের মাতা আমিনা বেগম সহ ঘসেটি বেগমকে ঢাকার জিনজিরা প্রাসাদে বন্দী করে রাখা হয়। পরবর্তীকালে মীরনের নির্দেশে ঘসেটি বেগম এবং আমিনা বেগমকে নৌকায় করে নদীতে ডুবিয়ে মারা হয়।

রবার্ট ক্লাইভ ফোর্ট উইলিয়মের গভর্ণর পদে অধিষ্ঠিত হন। তিনি ১৭৫৭ - ১৭৬০ সাল পর্যন্ত ফোর্ট উইলিয়মের গভর্ণরের দায়িত্ব পালন করেন। রজার ড্রেক ১৭৩৭ সাল থেকে কোম্পানির চাকরি তে ছিলেন এবং সিরাজউদ্দৌলা কর্তৃক কলকাতা দুর্গ অধিকার হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ফোর্ট উইলিয়মের গভর্ণর পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। অনুরূপভাবে রিচার্ড বেকার ১৭৩৭ সাল থেকে কোম্পানির চাকরিতে ছিলেন এবং একজন সিনিয়র বণিক ও ড্রেকের পর তার ছিল অবস্থান। অ্যাডমিরাল ওয়াটসন পদমর্যাদায় ক্লাইভের চেয়ে সিনিয়র ছিলেন। তাসত্ত্বেও ক্লাইভ ফোর্ট উইলিয়মের গভর্ণর পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। পলাশী যুদ্ধের অব্যবহিত পরে মুর্শিদাবাদ কোষাগার লুণ্ঠনে তার অংশগ্রহণের কারণে তাকে ব্রিটিশ পার্লামেণ্টের একটি তদন্ত কমিটির সম্মুখীন হতে হয়।
মীরজাফরের অসহায়তার সুযোগে ইংরেজরা ক্রমাগত তার উপর অর্থের দাবি করতে থাকে। ইংরেজদের সেই সকল দাবি পূরণ করার পরও,বর্ধমান, নদীয়া, হুগলি প্রভৃতি পরগণার রাজস্ব ইংরেজদেরকে দেওয়ার জন্য মীরজাফরকে বাধ্য করা হয়। ইংরেজদের এই সকল আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে, মীরজাফর ওলন্দাজদের সাথে মিত্রতা স্থাপন করেন। ওলন্দাজরা মনে করেছিল যে,নবাব মীরজাফর তাদের পক্ষে যুদ্ধ করবে। তাই তারা মীরজাফরের সাথে কোনো আলোচনা না করেই, ১৭৫৯ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজদের আক্রমণ করে বসে। বিদরের যুদ্ধে ওলন্দাজরা ইংরেজবাহিনীর হাতে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। ইংরেজবাহিনীর পক্ষে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন রবার্ট ক্লাইভ। ইংরেজরা এই যুদ্ধের জন্য মীরজাফরকে দায়ী করলেও, রবার্ট ক্লাইভ মীরজাফরকে দোষী প্রমাণ করতে পারেন নি।
১৭৬০ সালে ক্লাইভ ইংল্যাণ্ডে ফিরে আসেন। এই সময় ফোর্ট উইলিয়মের অন্তর্বর্তীকালীন গভর্ণর ছিলেন ভ্যান্সিটার্ট।
ইতিমধ্যে মীরজাফরের পুত্র মীরনের মৃত্যু হয়। এই কারণে মীরজাফরের মনোবল ভেঙে পড়ে। ইংরেজদের অর্থ প্রদান করতে গিয়ে রাজকোষ শূন্য হয়ে পড়ে। এই সময় ইংরেজ গভর্ণর ভ্যান্সিটার্ট এবং ইংরেজ রাজকর্মচারীদের অর্থলোলুপতায় মীরজাফর প্রায় নি:স্ব হয়ে যান।
এই সময় ভ্যান্সিটার্ট মীরজাফরের জামাতা মীরকাসিমের সাথে এক গোপন চুক্তি করেন। মীরজাফর যখন বুঝতে পারলেন যে,ইংরেজদের ক্রমবর্ধমান লোভলালসার দাবি পূরণ করা তার পক্ষে আর সম্ভব নয়,তখনই ইংরেজরা প্রচার শুরু করেন যে,মীরজাফর তাদের প্রতিশ্রুতি পালনে ব্যর্থ হয়েছেন। ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে অক্টোবর মাসে ইংরেজরা মীরজাফরকে স্বীয় জামাতা মীরকাসিমের অনুকূলে নবাবী ছেড়ে দিতে বাধ্য করে। অবশ্য এজন্য মীরকাসিম ইংরেজদেরকে দুই লক্ষ পাউণ্ড উৎকোচ প্রদান করে।
সুদক্ষ ও উচ্চাভিলাষী মীরকাসিম প্রথম সুযোগেই স্বীয় স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠায় বদ্ধ পরিকর হন। ইংরেজ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির শোষণের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন ভারতের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। তবে বাংলার নবাবী লাভের জন্য এরই মধ্যে তিনি তার দেশের ভাগ্যকে বন্ধক দিয়েছেন। ইংরেজ সেনাবাহিনীর ব্যয় নির্বাহের জন্য তিনি বর্ধমান, মেদিনীপুর ও চট্টগ্রাম এই তিনটি জেলার রাজস্ব আয় তুলে দিয়েছিলেন ইংরেজদের হাতে। মীরজাফরের বকেয়া দেনা পরিশোধোর দায়িত্ব তার উপরই পড়েছিল। এছাড়াও কলকাতা কাউন্সিলকে নগদ দুই লক্ষ পাউণ্ড দিতে হয়েছিল। মীরকাসিম ভেবেছিলেন,যেহেতু তিনি ইংরেজ কোম্পানি ও কর্মকর্তাদের প্রচুর অর্থের বিনিময়ে তার সিংহাসনে বসানোর ঋণ শোধ করেন,সেহেতু কোম্পানির উচিত তাকে স্বাধীনভাবে বাংলা শাসন করতে দেওয়া। তিনি অনুধাবন করেন যে,স্বাধীনভাবে বাংলা শাসন করার জন্য অপরিহার্য ছিল একটি পরিপূর্ণ রাজকোষ এবং একটি দক্ষ সেনাবাহিনী। এভাবে বাংলায় দুটি প্রতিপক্ষ শক্তির উদ্ভব হয়,যারা নিজ নিজ শক্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়ার উদ্দেশ্যে জরুরি তহবিল সংগ্রহে মনোনিবেশ করে। তবে এক পক্ষের সামরিক ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নির্ভরশীল ছিল অপর পক্ষের ধ্বংসের ওপর। ফলে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে। তবে নবাবের সুচতুরতায় এবং কলকাতা কাউন্সিলে দলাদলির কারণে তিন বছর পর্যন্ত যুদ্ধ এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয়।

সুদক্ষ কূটনীতির মাধ্যমে মীরকাসিম মুগল বাদশাহ দ্বিতীয় শাহ আলমের স্বীকৃতি সনদ লাভ করেন এবং তাকে বিহার ছেড়ে যেতে প্রলুব্ধ করেন। তিনি জানতেন যে,নৌশক্তির প্রাধান্যের কারণে বিগত পঞ্চাশ বছরে ইংরেজরা গঙ্গা নদীর নিম্নাঞ্চলে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছে। তিনি এমন একটি কৌশল অবলম্বন করেন যাতে ইংরেজরা নিম্ন গঙ্গার বদ্বীপ অঞ্চলে সীমাবদ্ধ থাকে এবং তাদের গানবোটসমূহ উত্তর গঙ্গা অঞ্চলে ঢুকতে না পারে। এরপর তিনি একটি সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনী গঠনের উদ্দেশ্যে এবং কলকাতা হতে ইংরেজ কোম্পানির অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ এড়ানোর লক্ষ্যে নদীবহুল মুর্শিদাবাদ থেকে পার্বত্য মুঙ্গের জেলায় তার রাজধানী স্থানান্তরে মনোনিবেশ করেন।
বিপুল পরিমাণ অর্থ প্রদানের পর রাজকোষের ঘাটতি পূরণের জন্য,মীরকাসিম মীরজাফরের আমলের উচ্চ পদস্থ কর্মচারীদের আয় ব্যয়ের হিসাব নিয়ে, সরকারী প্রাপ্য অর্থ জোরপূর্বক আদায় করেন। এই সময় সরকারী সম্পত্তি আত্মসাৎ করার অভিযোগে জরিমানা এবং সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেন। আলিবর্দী খানের বংশধর এবং মীরজাফরের আত্মীয় স্বজনদের উপর অতিরিক্ত কর আরোপ করেন। এছাড়া জগৎ শেঠের পরিবারের কাছ থেকে প্রায় জোর করে ঋণ গ্রহণ করেন। তবে তার সকল পদক্ষেপের ভিতর প্রশংসনীয় ছিল- সরকারী ব্যয় সংকোচন প্রক্রিয়া। এরপর তিনি ধীরে ধীরে ইংরেজদের কাছ থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করতে থাকেন। বাৎসরিক ছাব্বিশ লক্ষ টাকা রাজস্ব প্রদানের চুক্তি করে,তিনি দিল্লীর শাহ আলমের সমর্থন লাভ করেন। এরপর তিনি ইংরেজদের মিত্রভাবাপন্ন রাজকর্মচারী ও রাজাদের কঠোরভাবে দমন করেন। ইংরেজদের সংশ্রব এড়ানোর জন্য তিনি মুর্শিদাবাদ থেকে মুঙ্গেরে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন এবং সেখানে তিনি একটি দুর্গ নির্মাণ করেন।
ইংরেজদের মোকাবিলার উপযোগী করে তিনি সেনাবাহিনীকে নতুন করে সাজানোর চেষ্টা করেন। এছাড়া তিনি মুঙ্গেরে অস্ত্র তৈরীর কারখানা স্থাপন করেন।
ইতিমধ্যে ইংরেজদের সাথে মীরকাসিমের প্রধান দ্বন্দ্বের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল বাণিজ্যের অধিকার। ইংরেজরা পলাশীর যুদ্ধের পর,ক্রমে ক্রমে রীতি নীতি বর্জিত বণিক শ্রেণীতে পরিণত হয়। এদের অনেকেই বিনাশুল্কে বে-আইনি ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন কারণে মীরকাসিম রাজস্ব ঘাটতির কবলে পড়ে। কোম্পানির কর্মচারীদের অবৈধ ব্যবসা বন্ধ করার জন্য, মীরকাসিম দেশীয় বণিকদের উপর থেকে শুল্ক তুলে দেন। ফলে ইংরেজ বণিকদল প্রতিযোগিতামূলক বাজারে অসুবিধায় পড়ে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য পাটনা কুঠির ইংরেজ কর্মচারী এলিস পাটনা শহর দখল করার উদ্যোগ নেন। নবাবের সেনাবাহিনীর তৎপরতায় ইংরেজবাহিনী পরাজিত হয়ে পলায়ন করে। এর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য,মেজর এ্যাডামস দশ হাজার ইউরোপীয় সৈন্য ও চারশত দেশীয় সৈন্য নিয়ে মীরকাসিমের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করে। মীরকাসিমের অধীনে পনেরো থেকে কুড়ি হাজার সৈন্য ছিল। কিন্তু এদের অধিকাংশই ছিল অদক্ষ। ফলে ১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দে কাটোয়া,গিরিয়া এবং উদয়নালার যুদ্ধে মীরকাসিমের সৈন্য পরাজিত হয়।
১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দে মীরকাসিমের অধিকার খর্ব করার জন্য,ইংরেজরা মীরজাফরকে পুনরায় সিংহাসনে বসায়।
প্রতিটি যুদ্ধে পরাজিত হয়ে নবাব মীরকাসিম পাটনায় পালিয়ে যান। সেখান থেকে তিনি অযোধ্যায় যান। অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলা এবং তখনকার রাজ্যহারা মুগল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম ইংরেজদের বিরুদ্ধে তার সংগ্রামের প্রতি সমর্থন ঘোষণা করেন। তিন নেতা ত্রিপক্ষীয় শক্তিসংঘ গঠন করে ইংরেজদের হাত থেকে বাংলাকে পুনরুদ্ধারে সংকল্পবদ্ধ হন। ১৭৬৪ খ্রিস্টাব্দে শরৎকালে পুনরায় যুদ্ধ শুরু হয়। ২২ অক্টোবর বক্সার নামক স্থানে চূড়ান্ত যুদ্ধ সংঘঠিত হয় এবং ইংরেজবাহিনী জয়লাভ করে। পরাজিত মুগল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম ইংরেজদের সঙ্গে শান্তিচুক্তি সম্পাদন করেন। সুজাউদ্দৌলা রোহিলাখণ্ডে ফিরে যান এবং অযোধ্যা ইংরেজদের পদানত হয়। মীরকাসিম নিরুদ্দেশ হন।
১৭৬৪ সালে নবাব মীরকাসিমের বিরুদ্ধে বক্সারের যুদ্ধে ভ্যান্সিটার্টের নেতৃত্বে ইংরেজবাহিনীর জয়লাভের ফলে ব্রিটিশ ইস্ট ইণ্ডিয়া কতৃপক্ষ ক্লাইভকে আবার ফোর্ট উইলিয়মের গভর্ণর করে পাঠায়। বক্সারের যুদ্ধে জয়লাভ ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের ভিত্তি মজবুত করে।
১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে ১৭ জানুয়ারি মীরজাফরের মৃত্যু হলে তার বিপুল সম্পদের অধিকারী হন তার স্ত্রী মুন্নী বেগম।
ক্লাইভ ১৭৬৫ সালে মে মাসে ভারতবর্ষে আসেন। ক্লাইভ ১৭৬৫ সালে কলকাতায় পৌঁছান। ক্লাইভের সঙ্গে মীরজাফরের স্ত্রী মুন্নী বেগমের বিশেষ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। মুন্নী বেগম ক্লাইভকে পাঁচ লাখ টাকা প্রদানের বিনিময়ে তার পুত্র নাজমুদ্দৌলাকে মসনদে বসাতে সক্ষম হন।

বক্সারের যুদ্ধের পরে ক্লাইভের মধ্যস্থতায় এলাহাবাদে কোম্পানি,মুগল সম্রাট ও নবাবের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় শান্তি চুক্তি সম্পাদিত হয়। ১৭৬৫ সালে ১২ আগস্ট এলাহাবাদ চুক্তির মাধ্যমে কোম্পানি বাংলা,বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানী ক্ষমতা লাভ করেন। বিনিময়ে কোম্পানি আইন শৃঙ্খলা রক্ষা,রাজস্ব আদায়সহ রাষ্ট্র পরিচালনার সকল ব্যয় নির্বাহের জন্য বাংলার নবাবকে বার্ষিক তিপান্ন লাখ টাকা ও দিল্লীর সম্রাটকে বার্ষিক ছাব্বিশ লাখ টাকা প্রদান করবে।
রবার্ট ক্লাইভ সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের কাছ থেকে ( ১২ আগস্ট, ১৭৬৫) যে ফরমান লাভ করেন তাতে কোম্পানি শুধু দেওয়ানী ক্ষমতার সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রণকারীর মর্যাদা লাভ করে। রাজস্ব কেন্দ্রীয়ভাবে কোম্পানি নিয়ন্ত্রণ করলেও রাজস্ব আদায় করবে নবাবের কর্মচারীরা এবং যাবতীয় শাসনকার্য পরিচালনা করবে নবাব। কিন্তু অর্থবিভাগ কোম্পানি নিয়ন্ত্রণ করায় নবাব ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। এ ব্যবস্থায় নবাবের ছিল ক্ষমতাহীন দায়িত্ব,আর কোম্পানি লাভ করলো দায়িত্বহীন ক্ষমতা। ইতিহাসে এটি দ্বৈত শাসন নামে পরিচিত।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.