নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

প্রজ্ঞা মৌসুমী

প্রজ্ঞা মৌসুমী › বিস্তারিত পোস্টঃ

ফসলি ধাঁধার কাকতাড়ুয়া

০৪ ঠা অক্টোবর, ২০১৮ ভোর ৫:৫৭

যা প্রমাণিত হয়ে যায় তা নিয়ে সন্দেহের প্রয়োজনও ফুরোয়। প্রমাণিত হয় না বলেই উড়ো আর নিশ্চিত খবরের মধ্যবর্তীতে সন্দেহ, কৌতূহল, অসূয়া আর প্রশ্নের ওপর পেণ্ডুলামের মতো দুলতে থাকে সুলতানের বিয়ে। একই সাথে পুরনো এবং নতুন এই প্রসঙ্গটি সোবহানের চায়ের দোকান ঘেঁষা কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে দুটো বেঞ্চিতে বসা ক’জন মানুষকে আরও একবার বিভ্রান্ত করে। কখনো শমসের, কখনো সুদেব, কখনো মাহমুদ অথবা ইসতিয়াক শেষ ক’বছরে অনেকবার এসে প্রচার করেছে- সুলতানের মধুর পরিণতি, শালা এইবার দুলাভাই হইতেছে, বিবাহ পিঁড়ি ইজ মিসিং, সুলতান দ্যা গ্রেটের আরো একটি রোমাঞ্চকর বিয়ে।

প্রতিবারই বিয়ের খবরের সাথে একটি সম্ভাব্য তারিখও ওরা জেনেছে। চৈত্র মাসের ধবধবে দুপুর- তাপমাত্রা ২৩ দশমিক চার ডিগ্রি সেলসিয়াস, এমনও দিনে তারে বলা যায়- একটানা বৃষ্টির চতুর্থ দিনে, পৌষের সকালে ঘন কুয়াশার শহরে অথবা আসছে পঞ্চমীর রাতে বিবাহের দিন ধার্য করা হয়েছে। এইসব অভূতপূর্ব পরিকল্পনায় এই যে ক’জন মানুষ যারা বেঞ্চিতে বসে আছে, তারা হেসেছে, ঠাট্টা করেছে, চমৎকৃত হয়েছে এবং অপেক্ষা করেছে।

এদের মধ্যে যারা বিয়েকে জীবনের অপচয় মনে করে সুলতানের সংযম ও একাগ্রতায় মুগ্ধ হয়েছিল, তারা ‘হারাধনের রইলো বাকি’ মনে করে আফসোস করেছে ঠিকই কিন্তু গোপনে অপেক্ষায় থেকেছে। যারা পত্রিকার দ্বিতীয় নাকি শেষ পাতার আগের পাতায় আবহাওয়ার খবর থাকে মনে করতে পারেনি বা ভুলে গেছে ফারহেনহাইট-সেলসিয়াসের ব্যবধান, তারাও জানার চেষ্টা করেছে দিনের তাপমাত্রা তেইশ দশমিক চার ডিগ্রি কিনা। কখনো একটানা তিনদিনের বৃষ্টিতে ভেজা ছাতা সারারাত মেঝেতে মেলে দিয়ে অপেক্ষায় থেকেছে বৃষ্টিময় চতুর্থতম সকালের।

বিয়ের মুহুর্ত তৈরি না হওয়ায় কিংবা সুলতানেরই সরে আসার কারণে বা অন্য যে কোন কারণেই হোক চিরকুমার সভার সভ্য তালিকায় সুলতানের নামটা আটকেই থাকে। হঠাৎ কখনো সুলতানের সাথে দেখা হলে এবং প্রশ্ন করলে ‘কি মিঞা, বিয়ার খবর কদ্দুর?’ উত্তরে সুলতান কেবল হাসে। সুলতানের হাসি আবারও তাদের বিভ্রান্ত করে। আপনি কেন বিয়ে করেননি? প্রশ্নের উত্তরে কবি হেলাল হাফিজ বলেছিলেন- 'এমনওতো হতে পারে আমি চেয়েছিলাম, নারীই আমাকে গ্রহণ করেনি।' এরকম গ্রহণের সুখ কিংবা অসুখ সুলতানের আছে কিনা বেঞ্চিতে বসে থাকা মানুষগুলো নিশ্চিত জানে না। তবে কোন একদিন তারা এক কন্যার নাম জেনেছিল- অতসী।

একজন সুতনুকা রিক্সায় করে বাড়ি ফিরছে। আঁচল দিয়ে মুছে নিচ্ছে গোঁফের রেখায় ছুঁয়ে থাকা ঘাম। হঠাৎ মেয়েটির পায়ের কাছে এসে পড়ে টকটকে এক শিমুল ফুল- অতসী নাম্নী এক নারীকে ঘিরে এইসব দৃশ্য তাদের ভাবনায় ঘোর তুলেছে সেওতো অনেক বছর। এই যে এতসব অপেক্ষা, হয়ত সে কেবল অতসী নামের অদেখা কোন নারীর জন্য যে চেয়েছিল চৈত্র মাসের এক ধবধবে দুপুর, একটানা বৃষ্টির চতুর্থ দিন, ঘন কুয়াশার শহর...

বেঞ্চিতে বসে থাকা মানুষগুলো এটুকু জানতো অবনিপাড়ার একটিমাত্র বাড়ি যেখানে সফেদা ফলের হদিস মেলে, ছোট ছোট ছেলেমেয়ে কিংবা আপনারাও হয়ত দু’একবার ঢিল ছুঁড়েছেন অথবা হলদে পাঁচিলের সামনে দাঁড়িয়ে মাটিতে ইতিউতি দু’একটা সফেদা খুঁজেছেন। সেই বাড়িটার অনেকটা পেছনে সাড়ে দু'তলা বাড়ির একটি ঘরে ভাড়া থাকে সুলতান। বেঞ্চিতে বসে থাকা মানুষগুলো আরিটোলা সড়ক ধরে ভবানী কলোনীর শেষে সেই গার্লস স্কুলের পেছনের গেট অব্দিও গিয়েছিল।

ওরা জানতো পেছনের গেট দিয়ে ঢুকে স্কুলের মাঠ পেরুলেই অবনিপাড়া। কিন্তু সেদিন শুক্রবার আর পূজোর ছুটি থাকায় স্কুল-গেটের তালাটি তাদের চমকে দেয়। স্কুলের পেছনে নার্সারীর সামনে বসে বা দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে নিজেদের কী ভীষণ প্রতারিত মনে হয়। অন্তত নার্সারীটা খোলা থাকলে হয়ত ওরা জানতে চাইত অতসী ফুল দেখতে কেমন হয়। সান্ত্বনার মতো অতসী ফুলের গল্প নিয়ে বাড়ি ফিরত।

প্রতারিত হওয়ার ক্ষোভেই হয়ত চেপে বসে দুর্দান্ত রোখ। অচেনা ভূগোলে কম্পাসের মতো ওদের বয়ে নিয়ে যায় সেলুনের ছোকরা, চায়ের দোকানদার, জমায়েতের মুসল্লি। মৃণালিনী দেবী মহিলা হোষ্টেলের পেছনে ট্রেনের লাইন বরাবর অনেকটা হাঁটলে দূর থেকে দেখা যায় ‘উত্তম জলযোগ’, পাশে কালী মন্দীর। এই শ্যামলী পাড়া বরাবর হেঁটে গেলেই মিঠাবাজার। মিঠাবাজারের পেছনে অবনিপাড়া যেখানে একটি মাত্র বাড়িতেই সফেদা ফলের হদিস মেলে এবং যে বাড়িটার অনেকটা পেছনে সাড়ে দু'তলা বাড়ির একটি ঘরে ভাড়া থাকে সুলতান। নার্সারীর পাশে দাঁড়ানো আহত মানুষগুলো ঘোরপথে অবনিপাড়ায় পৌছুলেও সফেদা ফলের কোন গাছ খুঁজে পায় না তারা। কে জানে হয়তো সেই গাছ কেটে ফেলা হয়েছে কিংবা গেলো বৈশাখের ঝড়ে আপনি পড়ে গেছে। তবে একটি বাড়িতে হরেক ফলের গাছ ঠিকই দেখা যায়। বাড়িটার অনেকটা পেছনে সাড়ে দু’তলার বাড়িও চোখে পড়ে।

দারোয়ান গোছের একজনকে জিজ্ঞেস করতেই লোকটি প্রথমে প্রশ্ন করে ‘কোন সুলতান?’ পরক্ষণেই আঙুল দিয়ে চোখের সামনে একটা পথ এঁকে দেয়। এক আশ্চর্য ঘোরে শমসের, সুদেব, মাহমুদ, ইসতিয়াক কিংবা ওরা সবাই হাঁটতে থাকে সেই আঙুল বরাবর। হয়ত গোপনে প্রত্যাশা করে দেখতে পাবে অসুস্থ সুলতানের মাথার কাছে এক বিষণ্ণ তরুণীর মুখ যাকে দেখলেই মনে হবে ঐতো অতসী যে চেয়েছিল চৈত্র মাসের এক ধবধবে এক ধবধবে দুপুর, একটানা বৃষ্টির চতুর্থ দিন, ঘন কুয়াশার শহর... হঠাৎ ঘন মুগ্ধতায় মানুষগুলো আবিষ্কার করে কুয়াশা মাখানো জাম কাঠের দরজাটি ভেজানো। হয়ত এ ঘরের লোক বড়ো আপনভুলা, হয়ত কিছুক্ষণের জন্য কাছেই কোথাও গেছে।

কাঠবাদামের ডালে ডেকে যায় অহর্নিশির কাক আর দরজা পেরুনো মানুষগুলো কোন উম্মুখ নারী নয়, দেখে দেয়াল জুড়ে ছড়ানো ছিটানো এক কবিতা- লাশকাটা ঘরে শুয়ে ঘুমায় এবার, যে জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের, মানুষের সাথে তার হয়নাকো দেখা…একপাশে এলোমেলো হয়ে থাকা গোটা ত্রিশেক বই, জানালায় ছুঁয়ে আছে বোগেনভিলিয়ার একটা লতা, মাটিতে তোষক পাতা। সমশের, সুদেব কিংবা ওরা অনেকেই বাথরুমের দিকে এগোয়। দরজায় ধাক্কা দিয়ে উৎকন্ঠা জানায়- ‘সুলতান ভাই আছেন?’ ছমছমে দরজাটা খুলে গেলে এবং হালকা আলোয় চোখ সয়ে গেলে ওদের চোখে পড়ে দড়িতে টাঙ্গানো এক আশ্চর্য ব্র্যাসিয়ার। বক্ষবন্ধনীটি ভেজা নাকি শুকনো ওখান থেকে দাঁড়িয়ে তারা স্পষ্ট বুঝতে পারে না। ভেজা হলে হয়তো টুপটুপ করে জল পড়তো, শব্দ হতো, নাকি অনেক কালের জল ঝরে গেছে তার।

ওরা কী তবে ভুল বাড়িতে এসে পড়েছে নাকি কোন ভুল সুলতানের কাছে যে সুলতান গোপনে শুকোতে দেয় বক্ষবন্ধনী। দারোয়ান কী তাই জানতে চেয়েছিল কোন সুলতান! নাকি এই সেই অতসী ফুল রঙা বক্ষবন্ধনী! দিঘল অপেক্ষার সেই অতসী, যে নারী প্রিয়তম পুরুষের কাছে চেয়েছিল লিলুয়া বাতাসের দুপুর। বক্ষবন্ধনীটা হয়ে উঠে যেন এক কাকতাড়ুয়া। কাকতাড়ুয়ায় চোখ সয়ে এলে, তাদের এবং বোধকরি আমাদের চোখেও ঘোর তুলে এক জীবন্ত ফসলি জমি। নিষিদ্ধ তোলপাড় নিয়ে আমরা এগুতে থাকি, হয়ত পিছুতেই থাকি –আমাদের দ্বন্দ্ব লাগে।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.