নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
শহীদুল ইসলাম প্রামানিক
শহীদুল ইসলাম প্রামানিক
আরপি সাহার পুরো নাম রণদাপ্রসাদ সাহা। সংক্ষেপে দানবীর আরপি সাহা নামেই পরিচিত। বাবা দেবেন্দ্র নাথ পোদ্দার দলিল লেখক ছিলেন। আরপি সাহার বয়স যখন মাত্র সাত বছর, তখন তার মা কুমুদিনী দেবী সন্তান প্রসবকালে ধনুষ্টংকার রোগে মারা যান। মা মারা যাওয়ার পর আরপি সাহার জীবনে নেমে আসে চরম দুঃখ। কিছুদিন পরে ঘরে সৎ মা আসে। সৎ মায়ের অত্যাচার, অনাচার আর নির্যাতনে আরপি সাহা একরোখা ও বেয়ারা হয়ে যায়। লেখাপড়ায় হাতে খড়ি হলেও মা মারা যাওয়ার পর আর লেখা পড়া করা সম্ভব হয়নি।
মানুষের অত্যাচারে মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এটা যেমন সত্য ঠিক তার পাশাপাশি অনেকে অত্যাচারের কারণে উচ্চ শিখরেও পৌছে যায়। তেমনিই ঘটনা ঘটেছিল রণদাপ্রসাদ সাহার।
একদিন খেলাধুলা করে এসে রণদাপ্রসাদ সৎমায়ের কাছে ভাত খেতে চায়। সৎ মা থালায় করে ভাত দিয়েছিল বটে তবে ভাতের এক পাশে কিছু ছাইও দিয়েছিল। ভাতের থালায় ভাতের পাশে ছাই দেখে রণদা সৎ মাকে জিজ্ঞেস করেছিল, মা ভাতের পাশে ছাই কেন? সৎ মা জবাবে বলেছিল, তোদের কপালে ভাত নয় ভাতের বদলে ছাই-ই দেওয়া উচিৎ, তাই দিয়েছি। অতটুকু বয়সেই সৎমায়ের কথাটি তার আত্মসম্মানবোধে আঘাত হানে। চোখ মুছতে মুছতে ভাত না খেয়েই উঠে যায়। আর বাড়ির দিকে ফিরে আসেনি।
একটা পর্যায়ে রণদা কলিকাতা গিয়ে পৌছে। এই কলিকাতা যাওয়ার কাহিনীটিও আমার কাছে ভাল লাগে। কাহিনীটি সত্যও হতে পারে আবার প্রপাগান্ডাও হতে পারে।
আমার বাউন্ডুলে জীবনের একটা পর্যায়ে আমি কয়েকদিন মির্জাপুরে ছিলাম। তখন এক বৃদ্ধের কাছে কাহিনীগুলো শুনেছিলাম।
কুমুদিনী হাসপাতালের পূর্ব পার্শ্বে চিৎকাত বোর্ডিংয়ে থাকি। থাকার ভাড়া লাগে না। দু’বেলা তাদের হোটেলে ভাত খেলেই থাকার অনুমতি মিলে যায়। দুর দুরান্ত থেকে লোকজন চিকাৎসা বা রুগী দেখতে এসে ওই হোঠেলগুলোতে এভাবেই থাকে।
আমার সেখানে কয়েকদিন থাকার কারণ হলো, ১৯৭৯ সালে আমার ন্যাংটা কালের বন্ধু নরেন্দ্রনাথ সরকার তার গন্ডদেশের টিউমার অপারেশন করার জন্য এই হাসপাতালে এসেছিল। সে চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফিরলে তার কাছে হাসপাতালের অনেক কাহিনী শুনতে পাই (বর্তমানে বন্ধুটি স্বর্গবাসী)। হাসপাতলটি দেখার জন্য মন ছটফট করতে থাকে। দুর্গা পুজার সময় কলেজ বন্ধ থাকায় কাউকে না জানিয়ে হাসপাতাল দেখার জন্য চলে আসি। এসেই আমার ভ্রমণ পিপাসু মন হাসপাতালের চারদিক ঘুরে দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠে। হাসপাতালের দক্ষিণ পাশেই নদী। নদী পার হয়ে গ্রামের বিভিন্ন বাড়ির দুর্গ পুজার প্রতিমা দেখতে দেখতে এক সময় রণদাপ্রসাদ সাহার বাড়িতে ঢুকে পড়ি। বিশাল বাড়ি, তবে শান শওকত তেমন কিছু নেই। বাড়ির উত্তর পাশে মন্দিরটি পাকা। পূর্ব পাশের টিনের দোতালা ঘর। এই ঘরেই নাকি রণদা প্রসাদ সাহা থাকতেন। পশ্চিম পার্শ্বে পাকা দালান। দক্ষিণ পার্শ্বেও ঘর আছে। মাঝখানে বিশাল উঠান। উঠানের মাঝখানে স্থায়ীভাবে মঞ্চ করা আছে। মঞ্চের চারদিকে দেড় দু’ হাজার লোক বসতে পারে। কৃষ্ণ নীলা, কৃত্তন, ভাজন থেকে শুরু করে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের পাশাপাশি গান বাজনা, নাটক, যাত্রা সবই এই মঞ্চে হয়ে থাকে। গিয়ে দেখি দুর্গা পুজা উপলক্ষ্যে যাত্রা এসেছে। টিকিট লাগবে না, সবার জন্য ফ্রী। প্রয়াত রণদাপ্রসাদ সাহার পরিবার থেকেই পুজাসহ যাত্রার সব খরচ বহন করা হচ্ছে। একে তো নাচুনী বুড়ি তারোপর ঢোলের বাড়ি, আমি কি আর থাকতে পারি। সারাদিন এগ্রাম ওগ্রাম ঘুরে ঘুরে বেড়াই, হোটেলে গিয়ে খাই আর রাতে গিয়ে যাত্রা দেখি। ১৯৮০ সালের ঘটনা, যাত্রা দলের নামটি আজ আর খেয়াল করতে পারছি না। সম্ভাবত ‘চারণিক নাট্য গোষ্ঠী’ বা ‘নব বঙ্গশী’ এরকম একটি নামিদামি যাত্রা পালা হবে।
গ্রামের বৃদ্ধ মানুষ দেখলেই হাসপাতালের মালিক সম্পর্কে কিছু জানতে চাইতাম। তিনি কিভাবে এতবড় হাসপাতাল চালান? এত টাকা কিভাবে পেলেন? ইত্যাদি বিষয় জানার খুব ইচ্ছে।
একদিন দুপুর বেলা হোটেলে বসে আছি। একজন পাকা দাড়িওয়ালা বৃদ্ধ লোক পাশের চেয়ারে বসে আছেন। তিনি এলাকারই লোক। জিজ্ঞেস করলাম আরপি সাহা, আগে কি করতেন? বৃদ্ধ আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার বাড়ি কই?
বাড়ির কথা বলায় বলল, এই জন্য তুমি হের সম্বন্ধে কিছু জানো না। আরপি সাহা ছোট কালে খুব পাজি আছিল। একদিন করছে কি, নদীর ধার দিয়া ঘুইরা বেড়াইতেছে। এমন সময় দেখে এক লোক জামা কাপড় খুইলা নদীতে গোসল করবার নামছে। আরপি সাহা করছে কি, লোকটার জামার পকেটে হাত দিয়া দেহে ট্যাকা। ট্যাকা না পাইয়া, এক দৌড়ে পালাইয়া গেছে। লোকটা গোসল কইরা কাছারের উপরে উইঠা পকেটে হাত দিয়া দেখে একটা ট্যাকাও নাই। নদীর পানি কাছারের অনেক নিচে থাকায় কাছারের উপরে কে কি করছে কিছুই দেখে নাই। আশেপাশে চায়া দেহে কেউ নাই। রণদাপ্রসাদ এই ট্যাকা নিয়া আর দেশে থাকে নাই। সোজা কলিকাতা গেছে।
কলিকাতা যায়া হইছে কি, ঘুইরা ঘুইরা বেড়ায়া ট্যাকা খায়া শ্যাষ। এখন কি করে, কি খায়? কাজ নাই কাম নাই, মনের দুঃখে এক দোকানের বারান্দায় গালে হাত দিয়া বইসা রইছে। এমন সময় দেখে এক কোম্পানির মালিক মটর গাড়ি নিয়া হাজির। গাড়িটা রাস্তার পাশে রাইখা বাজারে গেছে বাজার করতে। গাড়ি ধুলাবালিতে মাইখা গেছে। আরপি সাহা করছে কি, সেই গাড়ি নিজের ঘাড়ের গামছা দিয়া সুন্দর কইরা মুইছা কাছেই বইসা রইছে। গাড়িওয়ালারা বাজার কইরা আইসা দেখে ময়লা গাড়ি পরিস্কার ঝকঝক তকতক করতেছে। গাড়ির এই অবস্থা দেইখা মালিক তো আশ্চার্য। কে এই কাজ করছে তারে খোঁজা খুঁজি শুরু করছে। আরপি সাহা আগায়া আইসা কয়, স্যার আমি করছি। গাড়িওয়ালা মালিক কয়, তুমি আমার গাড়ি পরিস্কার করলা ক্যান? আরপি সাহা জবাবে কইছিল, স্যার আমার কোন কাজ নাই। বেকার বইসা রইছি, তাই আপনার গাড়িটা ময়লা দেইহা পরিস্কার করছি। অন্য কোন উদ্দেশ্য নাই স্যার। মালিক আরপি সাহার কথা শুইনা খুশি হয়া তারে বাসায় নিয়া কাজ দিছে।
জানিনা গল্পটি কতখানি সত্য। তবে আরপি সাহার বাল্যকালের দুখী জীবনে এরকম ঘটনা ঘটাও বিচিত্র নয়। কলিকাতা গিয়ে কুলিগিরী, মুঠেগিরী, হকারীসহ অনেক ধরনের কাজই তিনি করেছেন। একটা পর্যায়ে তিনি বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। সৎমায়ের অত্যাচার নির্যাতনের কারণে রণদাকে একরোখা বেয়ারা যাই বলি না কেন, তবে তিনি দুঃসাহসী হয়েছিলেন। এম্বুলেন্স কোরে থাকা অবস্থায় হঠাৎ সামরিক হাসাপাতালে আগুন লাগলে সবাই যখন জীবন নিয়ে পালাতে ছিল, সেই সময় জ্বলন্ত আগুনের ভিতর থেকে রণদা রুগী বের করে আনেন। শেষ রুগীটি বের করে আনার পর তিনি অজ্ঞান হয়ে যান। তার এই দুঃসাহসিকতার জন্য যুদ্ধ শেষে দেশে ফিরে এলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও তাকে ধন্যবাদ জানান।
ব্রিটিশরা যুদ্ধ শেষে ভারতীয় সৈনদের যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরী দিয়েছিল। সেই সুযোগে রণদাপ্রসাদ সাহাও রেলওয়ের টিকিট কালেক্টরেটের চাকরী পান। কর্মস্থল ছিল সিরাজগঞ্জ থেকে শিয়ালদহ পর্যন্ত। একটা পর্যায়ে মিথ্যা মামলায় জড়ালে তিনি রেলওয়ের চাকুরী ছেড়ে দেন। রেল কোম্পানী থেকে ক্ষতিপুরণ হিসাবে কিছু টাকা পান। এই টাকা দিয়েই তিনি কয়লার ব্যাবসা শুরু করেন। বাড়ি বাড়ি কয়লা সরবরাহের সামান্য ব্যাবসা শুরু করলেও পরবর্তীতে কয়লার বড় ব্যাবসায়ী হন। একটা পর্যায়ে কয়লার ব্যাবসার পাশাপাশি নৌপরিবহনের ব্যাবসা, পাটের ব্যাবসা, চামড়ার ব্যাবসাসহ বিভিন্ন ধরনের ব্যাবসা করে ধনকুবেরে পরিণত হন।
সামান্য কুলি থেকে ধনকুবেরে পরিণত হলেও মায়ের মৃত্যুর কথা তিনি ভুলতে পারেননি। তাই ১৯৪৪ সালে মায়ের নামে কুমুদিনী হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। ২০ শয্যা নিয়ে হাসপাতালটি শুরু হলেও পরবর্তীতে ৭৫০ শয্যায় উন্নীত হয়। এর পরে ভারতেশ্বরী হোমস, মানিকগঞ্জ দেবেন্দ্র কলেজ, কুমুদিনী মহিলা কলেজসহ অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন।
এইখানে তার একটি কথা না বললে লেখায় অতৃপ্তি থেকে যাবে। সেটা হলো, রণদাপ্রসাদ সাহা ধনকুবের হলেও “বাড়া ভাতে ছাই” দেয়া সেই সৎমাকে কিন্তু তিনি ফেলে দেননি। নিজের সচ্ছল অবস্থা ফিরে এলে তিনি সেই সৎমাকে নিজের কাছে রেখেছেন এবং তাকে নিজের মায়ের মতই সর্ব্বোচ্চ মর্যাদা দিয়েছেন। তার শারীরিক, আর্থিক, মানসিক কোন রকম কষ্ট যাতে না হয়, সেদিকে তিনি সবসময় সজাগ ছিলেন এবং গর্ব করে বলতেন, এই মা যদি আমাকে “বাড়া ভাতে ছাই” না দিত, তাহলে আমার পক্ষে এতদুর আসা সম্ভব হতো না, কাজেই আমার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পিছনে এই মায়ের অবদান সর্ব্বোচ্চ।
১৯৭১ সালের ৭ই মে নায়াণগঞ্জ থেকে পাক হানাদার বাহিনীর দোসর রাজাকার, আলবদররা রণদাপ্রসাদ সাহা এবং তার ছেলে ভবানী প্রসাদকে ধরে নিয়ে যায়। এরপর থেকে তাদের আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। হয়তো তাদের দু’জনকে সেদিনই মেরে ফেলা হয়েছে।
আজ দানবীর রণদাপ্রসাদ সাহার ৪৪তম অন্তর্ধান বা মৃত্যুবার্ষিকী। সমাজ সেবক এবং দানবীর রায় বাহাদুর রণদাপ্রসাদ সাহার মৃত্যুবার্ষিকীতে আমাদের গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলী।
(ছবি কালেকশন নুরু ভাই)
০৮ ই মে, ২০১৫ রাত ১২:৩৬
প্রামানিক বলেছেন: ধন্যবাদ ভাই, আপনার বাড়ি টাঙ্গাইল জেনে খুশি হলাম। আপনি কি টাঙ্গাইলের বিখ্যাত কইচা ডাকাতের কাহিনী জানেন। জানলে আপনার কাছ থেকে কিছু কাহিনী জেনে নিতাম।
২| ০৮ ই মে, ২০১৫ রাত ১:৩৭
চাঁদগাজী বলেছেন:
পাকীরা এই ভালো লোকটাকে হত্যা করলো।
০৮ ই মে, ২০১৫ রাত ২:১৯
প্রামানিক বলেছেন: পাকীরা ভাল লোকগুলোই আগে মেরেছে।
৩| ০৮ ই মে, ২০১৫ রাত ৩:২৭
সচেতনহ্যাপী বলেছেন: আর পি সাহা বা রনদা প্রসাদ সাহার কথা সেই ছোটবেলাতেই শুনেছিলাম। জানতাম ভারতেশ্বরী হোমস, মানিকগঞ্জ দেবেন্দ্র কলেজ, কুমুদিনী মহিলা কলেজের কথাও।। কিন্তু তার জীবনের অনেককিছুই জানলাম আপনার লেখায়।। ধন্যবাদ।।
০৮ ই মে, ২০১৫ সকাল ৮:২৮
প্রামানিক বলেছেন: ধন্যবাদ ভাই সচেতন হ্যাপী। অনেক অনেক শুভেচ্ছা রইল।
৪| ০৮ ই মে, ২০১৫ দুপুর ১২:৫৮
বঙ্গভূমির রঙ্গমেলায় বলেছেন:
অনেক অজানা তথ্য জানলাম।
ধন্যবাদ শেয়ারে।
০৮ ই মে, ২০১৫ দুপুর ১:৩০
প্রামানিক বলেছেন: ধন্যবাদ ভাই, শুভেচ্ছা রইল।
৫| ১০ ই মে, ২০১৫ রাত ১০:০৩
প্রোফেসর শঙ্কু বলেছেন: কুমুদিনি হাসপাতালে ছিলাম অনেক দিন। লোকটাকে অদ্ভুত ভাল লাগে আমার।
১১ ই মে, ২০১৫ রাত ৮:৫৬
প্রামানিক বলেছেন: ধন্যবাদ ভাই প্রফেসর শঙ্কু। শুভেচছা রইল।
৬| ১৩ ই মে, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:১০
জাকারিয়া জামান তানভীর বলেছেন: দিন কয়েক আগে পড়ছিলাম। সুন্দর এই লেখাটির জন্য আজ ধন্যবাদ জানাইয়া গেলাম। শুভেচ্ছা অবিরত।
১৯ শে মে, ২০১৫ সকাল ১১:০৩
প্রামানিক বলেছেন: ধন্যবাদ ভাই জাকারিয়া জামান তানভীর, অনেক অনেক শুভেচ্ছা রইল।
©somewhere in net ltd.
১| ০৮ ই মে, ২০১৫ রাত ১২:২৪
কাঠ পাতা বলেছেন: ধন্যবাদ অনেক তথ্য জানলাম। টাংগাইল আমার জন্মস্থান হওয়া সত্বেও এই তথ্য গুলো জানা ছিলনা। খারাপ লাগলো পাকিস্থানি হানাদার বাহিনীর হাতে তার মৃত্যু হয়েছে। বেচে থাকলে হয়তো আরো অনেক কিছু প্রতিষ্ঠা করে যেতেন।