নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
শহীদুল ইসলাম প্রামানিক
শহীদুল ইসলাম প্রামানিক
আমাদের গ্রামের দক্ষিণ দিকে প্রায় এক মাইলের মত ফাঁকা মাঠ এবং মাঠের শেষ প্রান্তে পাগলা নদী। পাগলা নদীর দক্ষিণ পাড়ে পূর্ব-পশ্চিম লম্বা গ্রাম। গ্রামের পশ্চিম পার্শ্বে মসজিদ। এই মসজিদের ভোরের আযান শুনে আমাদের ঘুম ভেঙে যেত। আযান যিনি দেন তাঁর নাম আব্দুল লতিফ। গায়ের রং শ্যামলা। লম্বা সাড়ে ছয়ফুটের কম নয়। প্রশস্ত বক্ষ। মুখ ভর্তি মাঝারি ধরনের দাড়ি। বলিষ্ঠ জোয়ান। দৈহিক শক্তি অনেক। লেখাপড়া মক্তব পর্যন্ত। কোরান শরীফ পড়া জানেন। বাংলা খুব একটা জানেন না। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন। ইসলামী নিয়ম অনুযায়ী হাঁটুর নিচে সব সময় লুঙ্গি পরেন, তবে পায়ের গাঁটের নিচে কখনও তাকে লুঙ্গি পড়তে দেখিনি।
তাঁর বিশেষ গুণ হলো অতি চমৎকার সুরেলা কণ্ঠ। তাঁর আযানের ধ্বনি কর্ণ কুহুরে মধুর মত লাগে। ভোরের আযান শুনে যে কেউ মুগ্ধ হয়ে যায়। তখনও গ্রামের মসজিদে মাইক ছিল না। কিন্তু বিনা মাইকে তার আযান অনেক দুর থেকেও শোনা যেত, আর কারো কণ্ঠের আযান এতদুর থেকে শোনা যেত না। আল্লাহ যেন আজানের এক বিশেষ ক্ষমতা তার কণ্ঠে আলাদাভাবে দিয়েছে।
দেশ স্বাধীনের দু’এক বছর আগে হঠাৎ তার ভিতর পাগলামীভাব শুরু হলো। গ্রামের প্রত্যেক বাড়িতেই হুক্কার প্রচলন ছিল। গ্রামে-গঞ্জে হুক্কায় তামাক খাওয়া একটা স্বাভাবিক রেওয়াজ। গ্রামের লোকজন কারো বাড়িতে বেড়াতে গেলে সচারাচর পান তামাক দিয়েই সমাদর করা হতো। গেরস্থরা সব সময় হুক্কার তামাক মজুদ রাখতো। ক্ষেতে-খামারে, মাঠে-ঘাটে কাজ করা অবস্থায় কামলা কিষাণদের ঘন্টায় ঘন্টায় তামাক দিতে হতো। হুক্কা না খেলে তারা কাজে মনোযোগ দিতে পাড়তো না। কাজের ফাঁকে ফাঁকে তামাক খাওয়া কামলা কিষাণদের একটা নেশা ।
অন্য কিছু নয়, ইসলামের দিকে তার দৃষ্টি। হুক্কা খাওয়া বা ধুমপান করাকে সে পাপ মনে করত। গ্রামে কারো বাড়িতে হুক্কা দেখলেই তার মেজাজ বিগড়ে যেত। হুক্কা হাতে নিয়েই শক্ত মাটির উপর আছাড় দিয়ে বা মাটির তৈরী হুক্কার কলকির উপর জোরে বাড়ি দিয়ে ভেঙে ফেলতো। অনেক বাড়ির হুক্কা ভেঙেছে। হুক্কা ভাঙলেও কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পায় না। কারণ, তার সাথে দৈহিক শক্তিতে গ্রামের কেউ পেরে উঠবে না। পাগলামী ভাব থাকায় আরো মানুষ ভয় পায়। পাগলার সাথে ধ্বস্তাধ্বস্তি করতে গিয়ে যদি জানে মেরে ফেলে! ইসলামের দোহাই দিয়ে হুক্কা ভাঙার কারণেও সবাই নিশ্চুপ থাকত। ধর্মের প্রতি মানুষ অনেক দুর্বল। ধর্মের প্রতি দুর্বলতার কারণে তার এই কাজটি সমর্থন না করলেও প্রতিবাদও কেউ করতো না। হুক্কা ভাঙার পাগলামীর কারণে আব্দুল লতিফ নামটি পরিবর্তন হয়ে লতিফ পাগল বলে পরিচিতি লাভ করে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই নামেই সে পরিচিত ছিল।
একদিনের ঘটনা। বৈশাখ মাস। কয়েক দিন আগে বৃষ্টি হয়েছে। ধান-পাটের ক্ষেতে প্রচুর ঘাস দেখা দিয়েছে। প্রত্যেক গেরস্থ তার সাধ্যমত কামলা-কিষাণ নিয়ে ক্ষেত নিড়ানি দিচ্ছে। আমাদেরও দশবারোটি কামলা নেয়া হযেছে। কামলারা আমাদের বাড়ির সামনে পাট ক্ষেতে নিড়ানির কাজ করছে। ক্ষেতের পশ্চিম পার্শ্বের আইলে হুক্কা তামাক ও মাটির আলোয়ানে (ঘুটের আগুন জ্বালিয়ে রাখার জন্য বিশেষ ধরনের মাটির হাঁড়ি) ঘুটের আগুন জ্বলিয়ে রেখেছে। কৃষাণেরা জমিনের পশ্চিম প্রান্তের আইল থেকে পূর্ব প্রান্তের আইল পর্যন্ত একবার নিড়িয়ে এসে পশ্চিমের আইলে বসে তামাক খেয়ে আবার নিড়ানি শুরু করে। ক্ষেত নিড়ানো অবস্থায় কামলারা নানান ধরনের গল্প গুজোব করে থাকে। মাঝে মাঝে কিচ্ছা কাহিনীও বলে। শুনতে ভাল লাগে। এইসব গল্প শোনার জন্য ক্ষেতের আইলে বসে আছি। আমাদের বাড়ির চাকর ছিল এন্তাজ ভাই। ক্ষেত নিড়ানো অবস্থায় ক্ষেতের মাঝামাঝি গিয়ে পশ্চিম দিকে তাকিয়ে দেখে লতিফ পাগলা ক্ষেতের দিকে আসতেছে। দেখা মাত্রই এন্তাজ ভাই চিৎকার দিয়ে উঠে, আইলোরে - - - - ! চিৎকার দিয়েই দৌড়ে পশ্চিম আইলে এসে হুক্কটা হাতে নিয়েই পূর্ব দিকে দৌড়াতে থাকে। লতিফ পাগলা তখন একশ’ গজ দুরে। লতিফ পাগলা ওখান থেকেই এন্তাজ ভাইকে ধরার জন্য হৈ হৈ করে দৌড়াতে লাগল। দশ বারোজন কামলা ঘটনার আকস্মিকতায় হকচকিয়ে গেল। যদি এন্তাজ ভাইকে ধরে মারধোর করে, এই আশঙ্কায় পাঁচ ছয়জন কামলা লতিফ পাগলার পিছনে পিছনে দৌড়াতে লাগল। এন্তাজ ভাই খুব একটা লম্বা ছিল না। পাগলার সাথে দৌড়িয়ে পারল না। পাগলা তার লম্বা ঠ্যাং লম্বা লম্বা করে ফেলে দৌড়াতে লাগল। কয়েক শ’ গজ যাওয়ার পরে এন্তাজ ভাইকে ধরে ধরে অবস্থা। অবস্থা বেগতিক দেখে এন্তাজ ভাই হুক্কা ফেলে দিয়ে দৌড়াতে লাগল। হুক্কা পেয়ে লতিফ পাগল আর দৌড়ালো না। হুক্কাটা হাতে নিয়েই হুক্কার মাথা থেকে কলকি খুলে এক হাতে হুক্কা অন্য হাতে কলকি রেখে কলকির উপর ঠাস করে বাড়ি মেরে ভেঙে ফেলল। নারিকেলের মালার হুক্কা কলকির সাথে বাড়ি দিতেই টুকরা টুকরা হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে গেল। হুক্কার নইচা (মাঝখানে পাইপের মত ছিদ্রিযুক্ত কাঠের দন্ড) হাতে নিয়ে গালাগালি করতে করতে আবার আমাদের ক্ষেতে চলে এলো। আমি তার ফিরে আসা দেখে ভয়ে বাড়ি চলে এলাম। বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে তার তামাশা দেখতে লাগলাম। লতিফ পাগলা ক্ষেতে এসে ঘুটের আগুন জ্বালানো মাটির আলোয়ানটি এক আছাড় মেরে ভেঙে ফেলল।
এন্তাজ ভাইয়ের পাছে পাছে লতিফ পাগলের দৌড়াদৌড়ি তার পিছনে পিছনে আরো পাঁচ ছয়জন কামলার দৌড়াদৌড়ি দেখে পুরো মাঠে হৈ হৈ রৈ রৈ শুরু হয়ে গেল। মারামারি লেগেছে মনে করে অনেকেই দৌড়াদৌড়ি করে এগিয়ে এলো। কিন্তু যখন তারা লতিফ পাগলকে দেখল তখন নিজেদের হুক্কা সামাল দেয়ার জন্য পিছন দিকে দৌড়াতে লাগল। বিশাল মাঠে কয়েক শ’ কামলা কিষাণ কাজ করছে। পুরো মাঠের দৌড়াদৌড়ি আর হৈ হৈ রৈ রৈ আওয়াজে মাঠের চারিদিকে গেরস্থ বাড়ির বউঝিরাও বাড়ির বাইরে এসে জড়ো হলো। মুহুর্তের মধ্যেই পুরো এলাকা লোকজনে ভরে গেল। যুদ্ধের পরে মানুষ যেভাবে যুদ্ধ ক্ষেত্র দেখতে আসে এরকম পরিস্থিতি হলো। লতিফ পাগল আমাদের হুক্কা, আলোয়ান ধ্বংস করার পর মাঠের মাঝখান দিয়ে দক্ষিণ দিকে দৌড়াতে লাগল। তার দৌড়ানো দেখে হুক্কাওয়ালারা হুক্কা নিয়ে যে যেদিকে পারল সে দিকেই দৌড়াতে লাগল। সবার হুক্কা সরিয়ে নেয়ায় পাগল আর কোন হুক্কা ভাঙতে পারল না।
ঘন্টা খানেকের জন্য মাঠের কর্মকান্ড বন্ধ। ঘটনা জানার জন্য অনেকেই আমাদের ক্ষেতে চলে এলো। তাতে প্রায় কয়েক শ’ লোক জড়ো হলো। এন্তাজ ভাই আর পাগলের হুক্কা নিয়ে দৌড়াদৌড়ির কাহিনী শুনে অনেকেই হাসতে হাসতে বাড়ি চলে গেল।
এই ঘটনার পর থেকে লতিফ পাগলকে দেখলেই সবাই সতর্ক হয়ে যেত। এর পরেও অনেকের হৃক্কা ভেঙেছে। যে কারণে পাগল আগমনের চিহ্ণ পেলেই সবাই হুক্কা লুকিয়ে ফেলতো। পরবর্তীতে যুগের পরিবর্তনে বিড়ির আধিক্যে আস্তে আস্তে হুক্কার প্রচলন উঠে যায়। হুক্কার অভাবে লতিফ পাগলা আর হুক্কা ভাঙতে পারে নাই।
দেশ স্বাধীন হওয়ার তিন চার বছর পরের ঘটনা। আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় এক মাইল উত্তরে কুঁদলী বিলে কিছু জমি আছে। সেখানে মাছ চাষ হয়। মাছ চাষ করার জন্য বিলের মাঝখানে দু’টি পগাড় করা আছে। পগাড়ের মাছ ধরার জন্য পাওয়ার পাম্প বসিয়ে পানি নিষ্কাশন করা হচ্ছে। মাছ যাতে চুরি না হয় সেই জন্য আমাদের বাড়ির চাকর নাদুকে সাথে নিয়ে উচু জায়গায় বিছনা পেতে শুয়ে আছি। ভোরের দিকে আর কারো নয় লতিফ পাগলার আযান কানে এলো। আমাদের বাড়ি থেকে যে রকম শব্দ শোনা যায় ঠিক সেই পরিমান শব্দই কানে আসতে লাগল। আমার মনে হলো পাগলা ব্রীজের মসজিদে নয় সে যেন বিলের কাছাকাছি এসে আযান দিচ্ছে। আশ্চার্য হয়ে গেলাম, এই দিকে তো কোন মসজিদ নেই ফাঁকা মাঠ। মনের মধ্যে প্রশ্ন দেখা দিল তবে কি ফাঁকা মাঠে এসে আযান দিচ্ছে। পরের দিনও শেষ রাতে একই রকম আযান শুনতে পেলাম। বুঝতে পেলাম তার আযান ফাঁকা মাঠে নয় পাগলা পুলের মসজিদ থেকেই দেয়া হচ্ছে।
আরো কয়েক বছর পরের ঘটনা। কার্তিক মাসের শেষে যমুনা নদীতে মাছ ধরতে গিয়েছি। সাথে আছে আমার সমবয়সী জ্যাঠাতো ভাই মজিবর এবং আমাদের চেয়ে বয়সে বড় ছবুর ভাই। আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় দুই মাইল পূর্ব দিকে নদীতে মাছ ধরছি। মজিবর আর ছবু ভাই জাল ফেলে মাছ ধরছে, আর আমি খালুই নিয়ে পিছনে পিছনে ঘুরছি। হঠাৎ কানে শেষ রাতের আযান ভেসে এলো। আর কারো আযান নয়, লতিফ পাগলার আজান। আমি ছবুর ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, লতিফ পাগলা কি পাগলা মসজিদ থেকে আজান দিচ্ছে না এই দিকের কোন মসজিদ থেকে আজান দিচ্ছে?
ছবুর ভাই আদর মাখা কন্ঠে বলল, না রে ভাই, সে সব সময় ফজরের আজান পাগলা পুলের মসজিদ থেকেই দেয়। আমি তার আজানের শব্দ শুনে আশ্চার্য হয়ে গেলাম। মাইক ছাড়া খালি মুখের আজান এত দুরে আসার নজির আর কখনও দেখি নাই। লতিফ পাগলার আজানের আরেকটা গুন ছিল, মসজিদের কাছে থেকেও যে রকম আজানের শব্দ শোনা যেত দুরে থেকেও তেমনই আজানের শব্দ শোনা যেত। যতদুর পর্যন্ত আযান যেত একই রকম শব্দ শোনা যেত।
(চলবে)
০২ রা জুন, ২০১৫ রাত ১১:২২
প্রামানিক বলেছেন: আমার বাড়ি পাগলা নদীর পারে না মসজিদটা ছিল পাগলা নদীর পারে।
২| ০৩ রা জুন, ২০১৫ সকাল ১১:০৪
কামরুন নাহার বীথি বলেছেন: ভাল লাগছে লতিফকে নিয়ে এই লেখা!
যত পাগলই হোক সে সুরেলা আজানের ধ্বনি, সেই সাথে ইসলামকে বক্ষে ধারণ করে আছে!!
চলতে থাকুক আপনার এই সিরিজ, সাথে শুভেচ্ছা থাকবে!
০৩ রা জুন, ২০১৫ বিকাল ৪:০৭
প্রামানিক বলেছেন: ধন্যবাদ বোন কামরুন্নাহার আপা। কাহিনীটি পড়ার জন্য শুভেচ্ছা রইল।
৩| ০৩ রা জুন, ২০১৫ দুপুর ১২:৫৬
জুন বলেছেন: ভালোলাগলো পাগল লতিফের কাহিনি । লিখতে থাকুন, আছি
+
০৩ রা জুন, ২০১৫ বিকাল ৪:০৯
প্রামানিক বলেছেন: ধন্যবাদ বোন জুন। অনেক অনেক শুভেচ্ছা রইল।
৪| ০৩ রা জুন, ২০১৫ বিকাল ৪:৪৪
আবু উমায়ের বলেছেন: ভালোই লিখছেন
০৩ রা জুন, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:৫৯
প্রামানিক বলেছেন: ধন্যবাদ ভাই আবু উমায়ের। অনেক অনেক শুভেচ্ছা রইল।
৫| ১১ ই জুন, ২০১৫ দুপুর ২:৩৮
আহমেদ আলিফ বলেছেন: ভালো লাগলো, শেষটা জানার আশায় থাকলাম।
১১ ই জুন, ২০১৫ বিকাল ৫:৪২
প্রামানিক বলেছেন: ধন্যবাদ ভাই শুভেচ্ছা রইল।
৬| ১১ ই জুন, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:০৯
জনাব মাহাবুব বলেছেন: এরাই ছিলেন একসময়ের গ্রাম বাংলার আদর্শ মানুষ। সালাম জানাই সেই লতিফা পাগলা হুজুরকে।
আপনার লেখার ষ্টাইল অনেক ভালো লাগলো। পরের পর্বের অপেক্ষা।
১১ ই জুন, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:৩৫
প্রামানিক বলেছেন: ধন্যবাদ ভাই মাহবুব। আমার লেখা কষ্ট করে পড়ার জন্য আন্তরিক শুভেচ্ছা রইল।
৭| ১৭ ই জুন, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:২৬
তৌফিক মাসুদ বলেছেন: সত্যি লতীফ পাগলার গল্প পড়ে সেই দিনগুলি দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে।
দারুন লেখা।
১৯ শে জুন, ২০১৫ রাত ১২:৪১
প্রামানিক বলেছেন: ধন্যবাদ ভাই তৌফিক মাসুদ। শুভেচ্ছা রইল।
©somewhere in net ltd.
১| ০২ রা জুন, ২০১৫ রাত ১০:৪৪
চাঁদগাজী বলেছেন:
পাগলা নদীর পারে আপনাদের বাড়ী?