নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
শহীদুল ইসলাম প্রামানিক
শহীদুল ইসলাম প্রামানিক
১৯৭১ সালের এপ্রিলের ছব্বিশ তারিখ। দেশে তখন ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়েছে। উচ্চ শিক্ষিত এবং কলেজ পড়ুয়া ছাত্রদের নিয়েই বেশি সমস্যা। তাদেরকে খুঁজে খুঁজে ধরে নিয়ে হত্যা করছে। এরকম খবরে যাদের ছেলে মেয়ে শিক্ষিত এবং কলেজ পড়ুয়া ছিল তারা বড়ই আতঙ্কে দিন কাটাতে লাগল। কলেজ ছাত্ররাও মৃত্যুভয়ে পালাতে লাগল। মনোজ কুমার সরকার তখন আমাদের গ্রামের একমাত্র বিএ পাশ। সংক্ষেপে আমরা তাকে মনোজ দা’’ নামেই ডাকি। মনোজ দা’র বাবা রুহিনী কান্ত ডাক্তার তাকে নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন। আমাদের গ্রামে আর কোন বিএ পাশ ছিল না তবে বিএ পড়ুয়া ছিল। তাদের একজন হলেন সিংড়িয়া উত্তর গ্রামের দেলোয়ার হোসেন বিকম এবং দক্ষিণ গ্রামের আমার বড় ভাই ইছাহক আলী বিএসসি, তারা দুইজনেই বিএ দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন।
গ্রামে খবর আাসলো কলেজ পড়ুয়া বা শিক্ষিত যুবক ছেলেদের যেখানে পাচ্ছে সেখান থেকেই ধরে নিয়ে গুলি করে মারছে। এইরকম খবর শুনে এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে গেল। মনোজ দা’র বাবা রুহিনী কান্ত ডাক্তার নিজের ছেলের জানের নিরাপত্তার জন্য আমার বাবাকে এসে খুব করে ধরলেন। ভাই আমার ছেলেকে আপনার বাড়িতে কয়দিন লুকিয়ে রাখেন, তা না হলে আমার ছেলেকে যদি খান সেনারা ধরে নিয়ে যায় তাহলে ওর সাথে আমারো মরণ ছাড়া উপায় থাকবে না। তার দুশ্চিন্তা হলো মনোজ দা তার একমাত্র সন্তান। মনোজ দা ছাড়া তার আর কোন ছেলে সন্তান নাই। যে কোন ভাবেই হোক ছেলেকে রক্ষা করতে হবে।
মনোজ দা তখন বিবাহিত ছিলেন। দেড় বছর বয়সী মানিক নামের একটি ছেলে আছে। তখন আমাদেরই নিরাপত্তা নাই আওয়ামীলিগের সক্রিয় সদস্য হওয়ায় বড় ভাইকে নিয়েই বাবা খুব দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন, সেখানে মনোজ দা’কে কি নিরাপত্তা দিবে। কিন্তু ডাক্তার এমনভাবে বাবাকে ধরেলেন বাবা না করতে পারলেন না। ডাক্তারের অনুরোধে বাবা মনোজ দা’কে আমাদের বাড়িতে থাকার জায়গা দিতে রাজি হলেন। মনোজ দা তার স্ত্রী এবং বাচ্চাসহ রাতের আঁধারে আমাদের বাড়িতে চলে আসলেন। বাবা আমাদের দক্ষিণ দুয়ারী ঘরেই তার থাকার ব্যাবস্থা করে দিলেন। তখন এই ঘরকে আমরা বড় ঘর বলতাম, বড় ঘর বলার কারণ হলো এই ঘর সাইজে যেমন বড় ছিল তেমনি আমাদের ধান চাল সব থাকতো এই ঘরেই।
বড় ঘরে থাকতে দেয়ার কারণ হলো অন্যান্য ঘরে এলাকার অনেক মানুষ এসে আড্ডা দিত কিন্তু এই ঘরে নিজেদের লোক ছাড়া বাইরের কেউকে ঢুকতে দেয়া হতো না। নিরাপদ এবং নিরাপত্তার জন্য এই ঘরেই বাবা তার থাকার ব্যাবস্থা করে দেন।
দুই দিন দুই রাত কাটতে না কাটতেই মনোজদার শিশু বাচ্চা মানিককে নিয়ে হলো বিপদ। মানিকের বয়স তখন দেড় দু’বছর। এই ছোট্ট বাচ্চা বাড়ির খোলামেলা উঠানে খেলাধুলা করা অভ্যাস। সেই বাচ্চা কোনভাবেই ঘরে আবদ্ধ থাকতে চাচ্ছে না। তাকে যতোই ঘরে আটকে রাখার চেষ্টা করে ততই সে কান্না করে। সারাদিন কান্না করে মা বাবাকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। সারা দিন ঘ্যান ঘ্যান করে একটাই কথা বলতো, হাট মা বাড়িত যাই হাট মা বাড়িত যাই। মায়ের কাপড় ধরে সারা দিনই টেনে হিঁচড়ে তাদের বাড়ির দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতো। দুই দিন দুই রাত থাকার পরে মনোজ দা তার বাচ্চার জ্বালায় টিকতে পারলেন না। ২৯ তারিখ রাতে বৌদিসহ নিজের বাড়ি চলে গেলেন।
নিজের বাড়িতে রাতটা তাদের ভালোই কেটেছিল। কিন্তু সকাল বেলায় ঘটল দুঃখজনক ঘটনা। বেলা আটটা নয়টার দিকে ফুলছড়ি থানার দারোগা হেদায়েতুল্লাহ (যতটুকু মনে পড়ে দারোগার নাম এটাই ছিল) এসে আমার বাবা ছোলেমান আলী প্রামানিক, নিবারণ কাকা এবং নিবারণ কাকার বড় ভাই রুহিনী কান্ত ডাক্তারকে ডেকে নিয়ে কাতলামারির সামছুল মেম্বারের বাড়ি যায়। দারোগার সাথে যাওয়ার কারণ হলো, এই দারোগা আগে থেকেই এলাকার লোকজনের কাছে পরিচিত ছিল। একেতো বাঙালি তারোপর ফুলছড়ি থানায় অনেক দিন হলো চাকরি করছে। মাঝে মাঝে রাতের টহলে আসলে আমাদের বাড়িসহ অনেকের বাড়িতেই আশ্রয় নিত। নিবারণ কাকার সাথেও তার ভালো সম্পর্ক ছিল। নিবারণ কাকার বাড়ি ডাকাতি হলে এই দারোগা তদন্তের জন্য প্রায়ই আসতো এবং কাকার বাড়িতে খাওয়া দাওয়া করতো। এই কারণে এলাকার লোকজনের বিশ্বাস ছিল তার দ্বারা কারো কোন ক্ষতি হবে না।
আমাদের গ্রাম থেকে আমার বাবা ছোলেমান আলী প্রামানিক, নিবারণ কাকা ও নিবারণ কাকার বড় ভাই রুহিনী কান্ত ডাক্তার এই তিনজন দারোগার সাথে গিয়ে দেখেন সেখানে কাতলামারি গ্রামের আরো লোকজনকে ডেকে জড়ো করা হয়েছে। দারোগা বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে মিটিং করার কথা বলে ডেকে নিয়ে পাকিস্থানের পক্ষে এবং বিপক্ষে কারা আছেন তাদের নাম জানতে চান। বিশেষ করে পাকিস্থানের বিপক্ষে কারা আছে তাদের নাম জানতে চাচ্ছিলেন। ওখানে যারা গিয়েছিলেন তারা সবাই প্রায় মাতাব্বর ধরনের লোক। কেউ এবিষয়ে কোন তথ্য না দিয়ে উল্টো তাকে বোঝাতে থাকে আমাদের এলাকায় এধরনের কেউ নাই। কিন্তু সে মানতে নারাজ। কারো কাছ থেকে কোন তথ্য না পেয়ে উল্টো কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে দারোগা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন। দারোগার সামনে বাবা বসা ছিলেন। প্রথমেই বাবাকে লাথি মারেন এরপরে নিবারণ কাকাকে লাথি মেরে অন্যদের লাথি মারতে গেলে সব দৌড়ে পালিয়ে যায়। বাবা নিবারণ কাকাসহ অন্যরা পালিয়ে আসলেও রুহিনী ডাক্তার আর আসতে পারেন নাই। দারোগা তাকে পাকরোও করে থানায় নিয়ে যায়। কয়েক দিন আগেই পাক সেনারা ফুলছড়ি থানা দখল করে ঘাঁটি গেরেছে। তারা এসেই চারদিকে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। সেই ভয়ে কেউ আর ফুলছড়ি থানায় যাওয়ার সাহস পেল না। মনোজ দা’র বাবা রুহিনী কান্ত ডাক্তারকে সেই যে ধরে নিয়ে গেল আর তিনি ফিরতে পারেন নাই।
এই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই ঠিক তার পরদিনই সকাল বেলা গ্রামের পশ্চিম পাশ দিয়ে খান সেনারা দুটি গাড়ি নিয়ে অকস্মাৎ ঢুকে পড়ে। সকাল বেলা কিছু বুঝে উঠার আগেই আর্মিদের গাড়ি দেখে অনেকে দৌড়াদৌড়ি করে পালাতে সক্ষম হলেও ছয়জনের ভাগ্যে পালানো সম্ভব হয় নাই। তারা আর্মিদের হাতে ধরা পরে যায়। হাত বেঁধে গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর আজ পর্যন্ত তাদের আর কোন খোঁজ খবর পাওয়া যায় নাই।
২৫ শে মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৪৪
প্রামানিক বলেছেন: মন্তব্য করার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ।
২| ২৫ শে মে, ২০২৪ রাত ৯:০৪
কামাল১৮ বলেছেন: এরা যুদ্ধে কি ভাবে নিহত।নিরপরাধ লোক জনকে পাক বাহিনীর লোকেরা হত্যা করেছে।
২৬ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১
প্রামানিক বলেছেন: ওরা বাঙালিদের দেখলেই পাখির মতো গুলি করে মারতো। যার ভয়াবহ চিত্র লেখায় ফুটিয়ে তোলা সম্ভব নয়। ধন্যবাদ মন্তব্য করার জন্য
৩| ২৫ শে মে, ২০২৪ রাত ৯:৪৭
গোবিন্দলগোবেচারা বলেছেন: কি ভয়ানক অবস্থা!
মানুষ যদি মানুষের জীবনের মূল্য না বোঝে, এর চেয়ে নির্মম কি হতে পারে !
২৬ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪২
প্রামানিক বলেছেন: ওরা এতই নিষ্ঠুর ছিল যে বাঙালিদের মানুষই মনে করতো না।
৪| ২৫ শে মে, ২০২৪ রাত ৯:৪৮
গোবিন্দলগোবেচারা বলেছেন: পুরাতন একটি পোষ্টের কমেন্ট থেকে জানলাম কোন এক সময় পথ ভুলে রাতের বেলা গোরস্থানে পৌঁছে সারা রাত ক্ষেতে কাটিয়েছিলেন।
যদি কিছু মনে না করেন এই বিষয়টির উপরে কি ব্লগ বা ফেসবুক কোথাও পোস্ট দিয়েছিলেন? দিয়ে থাকলে তার লিংক পাওয়া কি সম্ভব?
এ বিষয়ে পোস্ট দিয়ে না থাকলে অভিজ্ঞতাটি পুরোপুরি শেয়ার করার অনুরোধ করলাম।
২৬ শে মে, ২০২৪ দুপুর ২:০৬
প্রামানিক বলেছেন: এতো পুরানো লেখা এখনো আপনি মনে রেখেছেন জেনে খুব ভালো লাগল। আপনার জন্য আন্তরিক অভিনন্দন রইল
কানাভুলা ভুত (প্রথম পর্ব)
কানাভুলা ভুত (২য় পর্ব)
কানাভুলা ভুত (শেষ পর্ব)
৫| ২৬ শে মে, ২০২৪ সকাল ৮:১৮
শ্রাবণধারা বলেছেন: ভালো লিখেছেন প্রামানিক ভাই।
আপনার আগের লেখায় ফুলছড়ি থানার দারোগা রাজাকারের লাথি মারার ঘটনাটি পড়েছিলাম,সেখানে রুহিনী কান্ত ডাক্তারকে পাক মিলিটারির ধরে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা টিও বলেছিলেন। সেই মনোজদা"র পরবর্তী সময়ের জীবন কেমন ছিল। দেশেই ছিলেন নাকি দেশ থেকে চলে যেতে হয়েছিলো?
২৬ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪৩
প্রামানিক বলেছেন: আগের লেখার পিছনের ঘটনা ছিল এইটি। মনোজ দা’র পরবর্তী কাহিনী সামনে লিখবো। ধন্যবাদ মন্তব্য করার জন্য
৬| ২৬ শে মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩
অপু তানভীর বলেছেন: মুক্তিযুদ্ধের এমন কত গল্প রয়েছে আমাদের চারিপাশে । কিন্তু যত যাচ্ছে এই বাস্তব গল্পগুলোর বলার মানুষ ততই কমে যাচ্ছে । সেই সময়ের প্রত্যেকেরই উচিৎ তাদের অভিজ্ঞতা গুলো বলে যাওয়া ।
পোস্টে প্লাস রইল ।
২৬ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪৫
প্রামানিক বলেছেন: ঠিকই বলেছেন, সবার ঘটনাা যদি সবাই লিখে যেত তাহলে মানুষ যুদ্ধের অনেক অজানা ঘটনা জানতে পারতো। ধন্যবাদ আপনাকে
৭| ২৭ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৪০
মরুভূমির জলদস্যু বলেছেন:
- যুদ্ধের সময় কত অজানা এমন করুন ঘটনা ঘটেছে।
২৮ শে মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩০
প্রামানিক বলেছেন: সেই সময় অনেকের ভাগ্যেই অমানুষিক করুণ কাহিনী ঘটেছে।
৮| ২৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:১১
নয়ন বড়ুয়া বলেছেন: আহা...
২৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৫
প্রামানিক বলেছেন: ধন্যবাদ
©somewhere in net ltd.
১| ২৫ শে মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৩৩
মনিরা সুলতানা বলেছেন: এমন কত যে কাছের জন আত্মীয় স্বজন কে আর ফিরে পাওয়া যায় নাই।
আপনার অভিজ্ঞতার বর্ণনা ভালো হচ্ছে।