![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
শহীদুল ইসলাম প্রামানিক
শহীদুল ইসলাম প্রামানিক
গাইবান্ধা জেলার সব চেয়ে বড় বধ্যভূমি হলো ফুলছড়ি বধ্যভূমি। এই বধ্যভূমি জীবন্ত স্বাক্ষি ছিলেন জমের পাগলা ওরফে মাবুদের ইশারা। দেড় হাজারের অধিক মানুষকে মেরে মাটি চাপা দেয়া হয়েছে এই বদ্ধ ভুমিতে। হিন্দু মুসলিমকে আলাদা করা হয় নাই হত্যা করার পর একই কবরে সবাইকে গণ কবর দেয়া হয়েছে। এইসব ঘটনার প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত স্বাক্ষী ছিলেন জমের পাগলা। বন্দী অবস্থায় তার হাতেই অনেক কবর খোড়ানো হয়েছিল।
জমের পাগলার আসল নাম হলো জমের আলী। মাবুদের ইশারা নামেই সে বেশি পরিচিত ছিল। বাড়ি গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি থানার চর এলাকায়। ভিক্ষা করতেন। জমের আলী থেকে মাবুদের ইশারা নাম হওয়ার কারণ হলো-- তিনি প্রত্যেক কথায় মাবুদের ইশারা বাক্যটি ব্যাবহার করতেন। যেমন-- কেউ যদি জিজ্ঞেস করতো চাচা, সকালে কি খেয়েছেন? তিনি স¦াভাবিক ভাবেই জবাব দিতেন, মাবুদের ইশারায় সকালে পান্তা ভাত খাইছি, আজকে কোন গ্রামে ভিক্ষা করতে যাবেন? মাবুদের ইশারায় ঐ গ্রামে, সারা দিনে ভিক্ষা কতটুকু পাইছেন? মাবুদের ইশারায় দুই তিন সের হইবো। কথায় কথায় মাবুদের ইশারা বলার কারণে এলাকার আবাল বৃদ্ধ বণিতা সবাই তাকে মাবুদের ইশারা নামেই চিনতো।
পঞ্চাশোর্ধ্ব জমের পাগলার শারীরিক গঠন মাঝারি ধরনের, গায়ের রং অনেকটা ফর্সা, মুখ ভর্তি দাড়ি আর চান্দি মাথা। কমদামের ছোটখাটো লুঙ্গির সাথে ছেঁড়া গেঞ্জি আর মাথায় আধা ময়লা টুপি পড়তেন। ভিক্ষায় যখন বের হতেন তখন বাম কাঁধে ভিক্ষার ঝোলা আর ডান হাতে একটি বাঁশের লাঠি থাকতো। কোরান পড়তেন এবং দোয়া দরুদও জানতেন। সবাই তাকে সম্মানের চোখে দেখতো। ভিক্ষা চাইলে কেউ খালি হাতে ফিরাতো না। অন্য ভিখারিদের তুলনায় দোয়া দরুদ বেশি জানায় ভিক্ষাও বেশি পেতেন।
যুদ্ধের প্রথম দিকেই এই পাগল পাক সেনাদের হাতে আটক হন। হাত পা বাঁধা অবস্থায় পরদিন হত্যা করার জন্য ফুলছড়ি বধ্যভূমিতে নিয়ে গেলেও যে কোন কারণেই হোক তাকে হত্যা না করে বাঁচিয়ে রাখে। মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচলেও বন্দী দশা থেকে এই পাগল মুক্ত হতে পারে নাই। হাত বাঁধা অবস্থায় আবার তাকে পাক সেনাদের ক্যাম্পে ফিরিয়ে আনে।
পরদিন আবার তাকে বধ্যভূমিতে নিয়ে যায়। জমের পাগলসহ একসাথে কয়েক জনকে ধরে এনেছে। সবার হাত পিছন দিকে রশি দিয়ে বাঁধা। অন্যদের হাত বাঁধা থাকলেও একজন পাক সেনা এসে শুধু পাগলের হাতের বাঁধন খুলে দেয়। পাগলের হাতের রশি খুলে দিয়ে তার হাতে একটি কোদাল ধরিয়ে দিয়ে কবর খুঁড়তে আদেশ করলে পাগল দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। মনে মনে ভাবে তার নিজের হাতে খোঁড়া কবরেই হয়তো তাকে গুলি করে ফেলে দিবে। কিন্তু পাক সেনারা তাকে গুলি না করে তার খোঁড়া কবরে অন্যদেরকে গুলি করে ফেলে দেয়। পাগল ভয়ে আঁৎকে উঠে। জীবনে কোন দিন কাউকে হত্যা করতে দেখে নাই, অথচ তারই সামনে কয়েকজনকে হত্যা করে তারই খোড়া কবরে ফেলে দিয়ে তাকে দিয়েই মাটি চাপা দিতে বাধ্য করল। ভয়ে কাঁপতে থাকলেও কোন কথা বলেতে পারল না, খান সেনারা তার দিকেও অস্ত্র তাক করে দাঁড়িয়ে আছে।
ঐ দিন থেকে যুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত পাগল পাক সেনাদের হাতেই বন্দী ছিল। বন্দী অবস্থায় তাকে বসিয়ে রাখে নাই। প্রতি দিনই তাকে দিয়ে নতুন নতুন কবর খোঁড়াতো আর সেই কবরেই বাঙালিদের মেরে হিন্দু মুসলিম এক সাথে মাটি চাপা দিত।
পাক সেনাদের হাতে বন্দী হওয়ার পর সবাই মনে করেছিল পাগলকে হয়তো খান সেনারা হত্যা করেছে। যুদ্ধের সময় তাকে আর দেখা যায় নাই। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর হঠাৎ করেই পাগল জন সম্মুখে বেরিয়ে আসে। আবার ভিক্ষা করা শুরু করে, তাকে দেখে সবাই আশ্চার্যই হয়ে যায়। খান সেনাদের হাতে আটক হওয়া পাগল কি করে জীবন্ত ফিরে এলো।
স্বাধীনতার কয়েক দিন পরের ঘটনা। বাড়ির সামনে আমি আর মা দাঁড়িয়ে আছি। জমের পাগলা ভিক্ষা করতে এসেছে। বয়স্ক এবং পূর্ব পরিচিত হওয়ায় মা তাকে জিজ্ঞেস করল, বাপুরে, আপনি তো মেলেটারির কাছে বন্দী আছিলেন, আপনারে কি হাত পা বাইন্ধা রাখছিল? আমার সহজ সরল মায়ের প্রশ্ন শুনে পাগল সহজভাবেই উত্তর দিয়ে বলল, মাবুদের ইশারায় প্রথম তিন চার দিন হাত পা বাইন্ধা রাখঝছিল পরে আর বান্ধে নাই।
যহন আপনারে হাত পা ছাইড়া দিল তহন আপনে কই আছিলেন?
মাবুদের ইশারায় হেগো ক্যাম্পেই নজরবন্দী আছিলাম।
খাইবার দেয় নাই?
মাবুদের ইশারায় খাইবার দিছে বইসা থাকপার দেয় নাই, সারাদিনই গোর খোদার কাম করাইছে।
মা আবার প্রশ্ন করলেন, চরের বাহেস দেওয়ানীরে যেদিন মারে ঐদিন কি আপনি ঐহানে আছিলেন?
হ গো মা, মাবুদের ইশারায় আমার হাতেই বাহেস দেওয়নীর কবর হইছে।
আপনি চিনছেন তারে? চিনমু না ক্যা, মাবুদের ইশারায় তারে প্রথম দেইখাই চিনছি, আমি তার বাড়িতে ভিক্ষা করবার যায়া কত ভাত খাইছি না।
বাহেস দেওয়ানীর জানাজা করছিলেন?
না গো মা, মাবুদের ইশারায় মেলেটারিরা আমারে জানাজা করবার দেয় নাই, জানাজ করবার চাইলেই বন্ধুক নিয়া মারবার আইছে, তবে মাবুদের ইশারায় আমি চুপে চুপে দোয়া দরুদ যা জানি তাই পইড়া মাটি দিছি।
হুনছি ফুলছড়িতে ম্যালা মানুষ মারছে এতো মানুষের গোর কেমনে খুরছেন?
মা গো, মাবুদের ইশারায় আলাদা আলাদা কবর দিবার দেয়া নাই, এক কবরে চারজন পাঁচজন কইরা মাটি দিছে, হের পরেও মাঝে মাঝে কবর খুইড়া কুলাইবার পারি নাই। মাবুদের ইশারায় ওরা আমারে এতো কষ্ট দিছে তা কইবারও পারি নাই সইবারও পারি নাই, এই কয় মাস ভাই বেরাদার কাউরে চোক্ষে দেহি নাই। খালি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পইড়া চুপে চুপে কানছি আর দ্যাশের মাইনষের নামে দোয়া পড়ছি।
পাগলের কথা শুনে মা আবার বলল, এতো কষ্ট না কইরা পলাইবার পারেন নাই?
মাবুদের ইশারায় পলাইবার চেষ্টা করছিলাম মা ওগো নজর এরায়া পালাইবার পারি নাই। সারাদিনই মেলেটারিরা আমারে পাহারা দিছে, পেচ্ছাব করবার গেলেও পাছের মুরা বন্দুক নিয়া খারায়া থাকছে, পালামু কেমনে!
(বাহেস দেওয়ানী সম্পর্কে আমার মায়ের জানতে চাওয়ার কারণ হলো। চর এলাকায় আমাদেরও জমি জমা আছে। আমাদের জমির পাশাপাশি বাহেস দেওয়ানীরও জমি আছে। দূর সম্পর্কের আত্মীয় হওয়ায় পারিবারিকভাবে তাদের সাথে আমাদের যোগাযোগ ছিল এবং এখনও আছে। যুদ্ধের সময় চর এলাকা ছিল নিরাপদ জায়গা। আমরাও চরে আশ্রয় নিয়েছিলাম। যে চর থেকে তাকে খান সেনারা ধরে নিয়ে যায় ঐ চরের পশ্চিমের চরে সেদিন আমরাও লূকিয়ে ছিলাম। দুর্গম চর এলাকা থেকে খান সেনারা তাকে ধরে নিয়ে মেরে ফেলবে এটা আমরা কল্পনাও করি নাই। ধরে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য দূর থেকে অনেকেই দেখেছে কিন্তু ফুলছড়ি সেনা ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার পর তার ভাগ্যে কি ঘটেছে এইটা আর কেউ দেখে নাই। সেইটা জানার আগ্রহ থেকেই মা জমের পাগলাকে প্রশ্নগুলো করেছিল। )
যুদ্ধের পরে জমের পাগলার সাথে আরো অনেকবার দেখা হয়েছে কিন্তু তার যুদ্ধ জীবন নিয়ে তার সাথে আর কোন দিন কোন কথা হয় নাই। সেদিনের মায়ের করা প্রশ্ন এবং পাগলের উত্তরগুলো এখনো মনে আছে। একদিন এসব কাহিনী লিখবো কল্পনাতেও ছিল না। এখন মনে হয় পাগল যদি বেঁচে থাকতো তাহলে তার বন্দী জীবনে স্বচক্ষে দেখা মানুষ হত্যার বাস্তব কাহিনীগুলো জানতে পারতাম। খান সেনাদের বর্বরতা, নিষ্ঠুর নির্মমতার চিত্র কত ভয়ঙ্কর ছিল তা মানুষের সামনে তুলে ধরতে পারতাম।
©somewhere in net ltd.