নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মনোয়ারা মণি

মনোয়ারা মণি

ব্লগপাতায় কামরুন নাহার

কামরুন নাহার আমার নাম নয় আমার নাম মনোয়ারা মণি

ব্লগপাতায় কামরুন নাহার › বিস্তারিত পোস্টঃ

কাঁটাতার ও একজন মেঝদি

৩১ শে জানুয়ারি, ২০১৭ ভোর ৬:০০

বিদেশের একটি পত্রিকার পূজা সংখ্যায় আমাকে লেখা দিতে হবে। হ্যাঁ, ভারতের পশ্চিম বাংলা তো এখন বিদেশই। ভারত ভাগ হয়ে যাওয়ার পর এপার আর ওপার বাংলার মানুষেরাও ভাগ হয়ে গেছে। এখন তাঁদের আত্মীয়স্বজনদের দেখতে যেতে হলে ভিসা নেয়ার প্রয়োজন হয়।
যে কথা বলছিলাম, পূজা সংখ্যাতে কি বিষয় নিয়ে লেখা যায় এ কথা ভাবতে ভাবতেই অনেকটা সময় কেটে গেলো। ভেবেছিলাম একটি আনন্দে ভরপুর গল্প কিংবা একটি পরিনত বয়সের প্রেম কাহিনি অথবা একটি ভ্রমণ বৃত্তান্ত লিখবো। ভাবনা ভাবনাই থেকে গেলো লেখা আর হয়ে ওঠে নাই।
পশ্চিম বাংলা কিংবা ভারতের কথা মনে হলেই মেঝদির মায়া ভরা মুখখানি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। মনে পড়ে কাঁটাতারের ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেঝদির আকুতি, " আমি বাবার ভিটেয় যাবো, আমি আমার ভাইদের দেখতে যাবো..."।
আজ তাহলে আমাদের মেঝদির গল্পই বলি। ভারত বিভক্ত হওয়ার সাথে সাথে দিনাজপুর জেলাও ভাগ হয়ে যায়। খান খান হয়ে যায় ঐ এলাকার অনেক মানুষদের পারিবারিক সম্পর্কের আদানপ্রদান। মেঝদির বাবার বাড়ি বাংলাদেশের দিনাজপুরে আর স্বামীর বাড়ি পশ্চিম বাংলার দক্ষিণ দিনাজপুরে। এই দুই বাড়ির দূরত্ব মাত্র আট মাইল। দিদিদের বাড়ি আগে বাংলাদেশেই ছিলো। নিত্য অত্যাচারের ঝামেলা থেকে নিস্তার পাওয়ার আশায় ষাটের দশকে জায়গাজমি রদবদল করে মাত্র এক মাইল দূরে গিয়ে ভারত সীমানায় বসতি গড়েছিলেন তাঁরা। তখনকার দিনে ভূমি রদবদল করা যেতো বলেই এটা সম্ভব হয়েছিলো। গোলার ধান, পুকুরের মাছ নিয়ে সাচ্ছন্দেই ছিলেন দিদিরা। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ থেকে যাওয়া তাঁর পরিবারের ২২ জন মানুষকে মাসের পরে মাস আশ্রয় দিয়েছিলেন তাঁর বাড়িতে। ছেলেপুলের জন্ম না দিয়েও একজন মানুষ কত ভালো মা হতে পারে মেঝদি'কে না দেখলে হয়তো জানতেও পারতো না তিতি। জামাইদাদা যখন বেঁচে ছিলেন তখন তাঁরা দু'জনে মিলে বর্ডারে এসে মাঝে মধ্যেই বাংলাদেশে রেখে যাওয়া ভাইবোনদের দেখে যেতেন। কখনো কাঁটাতারের ওপাশে থেকে কখনো বা জিরো পয়েন্ট দাঁড়িয়ে।
এক সময়ের তাঁর নিজের দেশ বাংলাদেশে যেতে হলেই তাঁদেরকে ভিসা নিতে হয়। দিদিদের পাসপোর্ট ছিলো না। ভয়ে তাঁরা পাসপোর্ট করে না। তাঁদের ধারণা পাসপোর্ট করতে গেলে যদি আবার ভারত থেকে তাঁদের বের করে দেয় তাহলে কোথায় যাবে তাঁরা? কার কাছে দাঁড়াবে? এভাবেই বছরের পর বছর কেটে গিয়ে সকাল দুপুর গড়িয়ে এখন অপরাহ্ন। ভাইয়েরা যখন সুস্থ্য ছিলো তখন মাঝে মাঝে বোনকে দেখতে তাঁর বাড়িতে যেতো। এখন অসুস্থ্যতা তাঁদের থামিয়ে দিয়েছে। তিতি'র মনে হয় এই তো সেদিন ধপধপ করে মেঝদি চাঙ (লফট) থেকে পোলাও এর চাল এনে পোটলা ভরে ভাইদের জন্য পাঠাতো। এখন সেই মেঝদি লাঠিতে ভর করা ছাড়া চলতে পারে না।
ভাইবোনদের সাথে দেখা না হাওয়ার কষ্ট তিতি ভালো করেই জানে। তাইতো মেঝদিকে দেখতে গেলেই সব ভাইবোনদের এক নজর দেখা করানোর ফন্দি আঁটে। নিরামিষ ভোজী যে মেঝদি মাংস খেতো বলে নিজের ভাইকে পূজোর ঘরের কাছে যেতে দিতো না সেই মেঝদিই কিনা ভিনধর্মী তিতি'কে পূজো ঘরের কাছে তাঁর নিজের বিছানায় ঘুমাতে দেয়! প্রথম দেখায় মেঝদির ভালোবাসার সেই কাছেই বন্দি হয়ে আছে তিতি।
সময় পেলেই তিতি স্নেহবৎসল মেঝদিকে দেখতে যায়। ভিসা পাওয়ার ঝামেলা, পথের দুরত্ব কিছুই তার কাছে আর বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। কখনো কখনো দিদিকে দেখে দিনাদিন ফিরে আসতে হয় তিতিকে। বর্ডারের ফর্মালিটিজ পূরণ করতে করতেই তিনচার ঘন্টা লেগে যায়। তারপর গাড়ি করে দিদির বাড়ি যাওয়া। দিদির সাথে অল্পকিছু সময় কাটাতে না কাটাতেই পশ্চিমাকাশে ঢলে যাওয়া সূর্য্য ম্লান মুখে ফিরে যাবার কথা মনে করিয়ে দেয়। ছুটতে ছুটতে এসে কাঁটাতারের বেড়া পেরুবার নিয়মাবলী, তারপরে বাড়ি ফেরা।
সে বছর জামাইদাদা বেশ অসুস্থ্য। বাংলাদেশ থেকে মেঝদির ভাইদের ডেকে এনে বলেছিলেন, "দেখ এই সব দলিলপত্র, আমার সব সম্পত্তি তোদের দিদির নামে লিখে দিলাম। আমি নাই, আমাদের সন্তানও নাই, যাতে তাঁর কোনো অভাব অনাটন না হয় তাই এই ব্যবস্থা।"
তিতি এসব দেখে আর ভাবে, মানুষ এতো ভালো হয় কি করে?
জামাইদাদা না ফেরার দেশে চলে যাওয়ার পর দিদিটি খুব একা হয়ে যায়। তাঁর কাছের মানুষদের বলে কয়ে অনেক কষ্টে মেঝদির জন্য একটা পাসপোর্টের ব্যবস্থা করা হলো। সে বছরই ভাইপো'র বিয়েতে বাবার বাড়ী আসলো মেঝদি। বিয়ের হট্টগোলের মধ্যে এক অবসরে ছোটো ভাইকে ডেকে তার হাতে একটা বাক্স দিয়ে দিদি বললো, " নে তোর কাছে ঋণী ছিলাম, ঋণ শোধ করে গেলাম।" বাক্সটি খুলে ভাইটি হতভম্ব হয়ে সজল চোখে দেখলো তাঁদের স্বর্গীয় বাবার চশমা। বাবার চশমা ভাইয়ের হাতে দিতে পেরে মেঝদি সেদিন যে ঋণমুক্ত হলেন তা তাঁর মুখ দেখেই বুঝা গেলো। বাবা তাঁর সমস্ত জীবন নিজের দেশ বাংলাদেশেই কাটিয়ে দিয়েছেন।
মেঝদি আর তাঁর ফেলে যাওয়া স্বজনদের দেখা দেখি এভাবেই চলে। দিদিকে দেখতে গিয়ে আট মাইল রাস্তা পেরুতে কখনো বা দুইদিন লেগে যায়। যখন ভিসা না থাকার কারণে যেতে পারে না তিতি তখন দিদিকে বর্ডারে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করে। আবার সেই কাঁটাতার, সেই জিরো পয়েন্টের মিলন মেলা আর নিরাপত্তা কর্মীদের সতর্ক দৃষ্টি।
ওপাশে দাঁড়িয়ে ভাইদের দিকে তাকিয়ে দিদির হাত তোলা দেখে অনেকদিন কেঁদেছে তিতি। মাত্র চার পাঁচ হাত পেরুলেই দেশের মাটি, বাবা'র বাড়ি। এতোটুকু জায়গা পেরুতে পারে না সে কারণ তাঁর ভিসা নেই। সে বছর ভাইঝির বিয়েতে আসার জন্য সব ঠিকঠাক, আচানক স্ট্রোক থেকে পক্ষাঘাত, বাবার বাড়িতে আর আসা হলো না মেঝদির। খবর পেয়ে অসুস্থ্য দিদিকে দেখতে ছুটে যায় তিতি। একজন কর্মঠ মানুষকে হুইল চেয়ারে বসে থাকতে দেখে প্রচন্ড কষ্ট হয় তার। তিতির জন্য বালুরঘাট থেকে দু'টি শাড়ি আনিয়েছে দিদি। একটা শাড়ি নিবো বলতেই দু'টি শাড়ি নেয়ার জন্য দিদির ধমকের কথা আজও ভুলতে পারে না সে। তিতি দিদিকে হাত নেড়ে নেড়ে ব্যায়াম শেখায়, দিদি প্রাণপণে এক হাত দিয়ে আরেক হাত উপড়ে তোলে আর বিড়বিড় করে বলে, "একবার না পারিলে দেখো শতবার... "। দিদির মনোবল দেখে বিস্মিত হয় তিতি। ফিরে আসার সময় ঘনিয়ে আসে, দিদির দিকে তাকিয়ে তিতি জিজ্ঞাসা করে, ভাইদের দেখতে বর্ডারে যাবেন, মেঝদি? সদ্য হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়া দিদির মুখে উচ্ছল হাসি। চোখ ভরা আনন্দ। তিতি'র চোখও জলে ভরে যায়।
এরপরে ওপাশ থেকে হুইল চেয়ারে বসিয়ে বোনকে আর এপাশ থেকে ধরে ধরে ভাইদের নিয়ে আসা হলো জিরো পয়েন্টে। বোনকে দিদি বলে ডেকেই এক ভাই জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পরে। ভাইবোনদের সবার কথাই এখন অস্পষ্ট, তাঁদের আর কথা বলা হয় না। দিদি কিছুতেই ফিরে যাবে না, বাচ্চাদের মতো আবদার ধরে বলে, " আমি বাবার বাড়ি যাবো, আমি ভাইদের কাছে যাবো..." এর মাঝেই দেখা করার নির্ধারিত সময় শেষ হয়ে যায়।
মেঝদির সেই পাসপোর্ট এখন অচল। ডিজিটাল পাসপোর্ট ছাড়া বাংলাদেশে যাওয়ার ভিসা পাওয়া যায় না। ডিজিটাল পাসপোর্ট বানাতে হলে অনেক দুবে যেতে হবে মেঝদিকে, সেই শক্তি তাঁর আর নাই। আর হয়তো দিদি'র বাবার ভিটেয় যাওয়া হবে না কখনোই।
না জানি এরকম কতো মেঝদি কাঁটাতার পেরোতে পারে না পাসপোর্ট আর ভিসা নামের বন্দীত্বের জন্য। কত বোনদের আট মাইল রাস্তা হয়ে যায় অগম দুরত্ব! তবুও আশা হারায় না তিতি। অস্বীকার করতে চায় কাঁটাতারের তীক্ষ্ণ কন্টক। মেঝদিকে তাঁর বাবা'র ভিটেতে ফিরিয়ে নেয়ার স্বপ্ন আজও তার চোখে।

মন্তব্য ৯ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৯) মন্তব্য লিখুন

১| ৩১ শে জানুয়ারি, ২০১৭ দুপুর ১:২৭

কানিজ রিনা বলেছেন: চোখে পানি নামল ।

০১ লা ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ বিকাল ৩:৫৩

ব্লগপাতায় কামরুন নাহার বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ আর কৃতজ্ঞতা, আপু কানিজ রিনা :)

২| ৩১ শে জানুয়ারি, ২০১৭ রাত ১০:২৭

ফেরদৌসা রুহী বলেছেন: না জানি এরকম কতো মেঝদি কাঁটাতার পেরোতে পারে না পাসপোর্ট আর ভিসা নামের বন্দীত্বের জন্য। কত বোনদের আট মাইল রাস্তা হয়ে যায় অগম দুরত্ব!

আহারে,হুম এমন কত মেঝদি পাসপোর্ট ভিসার জন্য কাঁটাতার পেরোতে পারেনা।

০১ লা ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ বিকাল ৩:৫৪

ব্লগপাতায় কামরুন নাহার বলেছেন: অশেষ ধন্যবাদ আর কৃতজ্ঞতা, আপু ফেরদৌসা রুহী :)

৩| ০১ লা ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ সকাল ১০:১০

সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: সুন্দর লিখেছ, করুণ কাহিনি।

তুমি যে এত বড় পোস্টও লিখতে পারো, তা আজ এই প্রথম দেখলাম।

শুভ কামনা।

০১ লা ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ বিকাল ৩:৫৫

ব্লগপাতায় কামরুন নাহার বলেছেন: অশেষ ধন্যবাদ আর কৃতজ্ঞতা, সোনাবীজ;
কমেন্ট পেয়ে আনন্দিত হলাম। অনেক শুভাকামনা তোমার জন্যও :)

৪| ০১ লা ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ সকাল ১০:৩৪

ধানক্ষেতের ইঁদুর বলেছেন: অসহায় রাজনৈতিক বলি।

০১ লা ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ বিকাল ৩:৫৬

ব্লগপাতায় কামরুন নাহার বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ ভাই, ধানক্ষেতের ইঁদুর:)

৫| ০৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ রাত ২:২৪

অন্তরন্তর বলেছেন:
এমন লিখাতে কমেন্ট করা যায় না।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.