![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
নিহত স্মৃতির আহত সত্তা বিধ্বস্ত কায়া।
একবার আমি হাজ্জ্বে গমন করেছিলাম। সেখানকার একটি রাস্তা অতিক্রম করার সময় দেখলাম একজন বৃদ্ধা মহিলা বসে আছেন। বৃদ্ধার পরিধেয় ছিল পশমের কামিছ আকৃতির একটি পোশাক ও সাড়ে তিন হাত দৈর্ঘ্যের একটি ওড়না। আমি তার নিকট গমন করে সালাম দিলাম। বৃদ্ধা মহিলাটি জওয়াব স্বরুপ মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের একটি আয়াত তিলাওয়াত করলেন,
—“সালাম, দয়াবান রবের পক্ষ থেকে সম্ভাষণ।” [সূরঃ ইয়াসীন; আয়াত ৫৮]
আমি বললাম, আল্লাহ্ আপনার উপর রহম করুন। আপনি এখানে বসে কী করছেন?
— “আল্লহ্ যাকে পথহারা করেন তাকে পথ দেখাবার আর কেউ থাকে না।” [সূরাঃ আরাফ; আয়াত ১৮৬]
আমি বুঝতে পারলাম মহিলাটি পথ হারিয়ে ফেলেছে তাই জিজ্ঞাসা করলাম, আপনার গন্তব্য কোথায়?
— “তিনি একটি পবিত্র সত্ত্বা যিনি তাঁর (আল্লাহ’র) বান্দাকে রাত্রিবেলায় মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসায় নিয়ে গিয়েছিলেন।” [সূরাঃ ইসরা; আয়াত ১]
বুঝতে পারলাম মহিলাটি হাজ্জ্বের কাজ সমাধা করেছেন- এখন তিনি বায়তুল মুকাদ্দাস (বর্তমান নাম জেরুজালেম; ইহুদিদের দেওয়া এই নাম) গমন করতে চান। আমি ওনাকে জিজ্ঞাসা করলাম, কতক্ষণ এখানে বসে আছেন?
— “পূর্ণ তিনটি রাত ধরে।” [সূরাঃ মারইয়াম; আয়াত ৭৯]
আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম- আপনার নিকট খাবারের কিছু দেখছি না; কি খেয়ে আপনি দিন অতিবাহিত করছেন?
— “তিনি আমাকে খাইয়ে থাকেন এবং তিনিই আমাকে পান করিয়ে থাকেন।” [আল-কুরআন]
কিসের দ্বারা অযূ করে থাকেন? -আমি বললাম।
— “পাক পবিত্র মাটি দিয়ে তখন তায়াম্মুম করে নিও।” [সূরাঃ নিসা; আয়াত ৪৩]
আমি বললাম, আমার নিকট কিছু খাবার আছে, খাবেন?
— “রাত হবে তখন ইফতার করিও।”
[সূরাঃ বাকারাহ্; আয়াত ৮৭]
এটাতো রমজান মাস নয়- আমি বললাম।
— “যে ব্যক্তি নেক হাসিলের উদ্দেশ্যে নফল এবাদাত করে থাকে আল্লাহ্ তার কদর করে থাকেন এবং তিনি তো সর্বজ্ঞ।” [সূরাঃ বাকারাহ্; আয়াত ১৫৮]
আমি বললাম, মুসাফির অবস্থায় রোযা না রাখা জায়েয আছে।
— “(কত যে নেকী) তোমরা যদি জানতে তাহলে রোযা রাখাটাই ভালো মনে করতে।” [সূরাঃ বাকারাহ্; আয়াত ১৮৪]
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি আমার মত করে কেন কথা বলেন না?
— “মানুষ যে কথাটি বলছে খবরদারীর জন্যে; তার নিকট ফেরেশতা প্রস্তুত আছে।” [সূরাঃ কা’ফ; আয়াত ১৮]
আপনি কোন গোত্রের মানুষ? -আমি আবার বৃদ্ধা মহিলাটিকে জিজ্ঞাসা করলাম।
— “যে বিষয়ে জানতে নেই সে বিষয়ে পেছনে লাগিও না।” [সূরাঃ ইসরা; আয়াত ৩৬]
আরজ করলাম বৃদ্ধা মহিলার কাছে; ভুল হয়ে গেছে, ক্ষমা চাইছি।
— “আজ তোমাদের প্রতি কোনো তিরস্কার নেই; আল্লাহ তোমাদেরকে ক্ষমা দিবেন।” [সূরাঃ ইউসূফ; আয়াত ৯২]
আমি বললাম, যদি চান তবে আমার উঁটনীর পিঠে সওয়ার হয়ে আপনার কাফেলার (মরুভূমিতে মরুদস্যু, মরুঝড় যা সাইমুম নামে পরিচিত, হিংস্র প্রাণি ও বিভিন্ন প্রকার নিরাপত্তার লক্ষ্যে মানুষ দলবদ্ধ হয়ে দূর-দূরান্তে যাতায়াত করে যাকে কাফেলা বলে।) মানুষের নিকট যেতে পারেন।
— “তোমরা যা কিছু উত্তম কাজ কর আল্লাহ্ তা জেনে থাকেন।” [সূরা বাকারাহ্; আয়াত ১৯৭]
এ আয়াত শ্রবণের পর আমি আমার উঁটনীটি মহিলার নিকট দিয়ে দিলাম। কিন্তু মহিলা উটনীর পিঠে সওয়ার হওয়ার আগে বললেন-
— “ঈমানদার ব্যক্তিদেরকে বলে দাও তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নিচের দিক করে রাখে।” [সূরাঃ নূর; আয়াত ৩০]
আমি আমার দৃষ্টিকে অবনত করে মহিলাকে বললাম, এবার আপনি সওয়ার হউন। বৃদ্ধা যখন উঁটনীর উপর সওয়ার হতে গেলেন তখন উঁটনীটি ভয় পেয়ে পালাতে উদ্দ্যত হলো এবং উঁটনীটির সাথে বৃদ্ধার ধ্বস্তা-ধ্বস্তির ফলে পোশাক ছিঁড়ে গেল। বৃদ্ধা (পোশাক ছিঁড়ে যাওয়ার ফলে এই আয়াত) তিলাওয়াত করলেন-
— “যত বিপদ এসে থাকে তা তোমাদের আমলের কারণে।” [সূরাঃ শুরা; আয়াত ৩০]
একটু অপেক্ষা করুন আমি উঁটনী বেঁধে দিচ্ছি তারপর আপনি সওয়ার হবেন- আমি বললাম।
— “এ বিষয়ে সমাধান আমি সুলাইমান (আলাইহিসালাম)-কে বুঝিয়ে দিয়েছিলাম।” [সূরাঃ আম্বিয়া; আয়াত ৭৯]
আমি উঁটনীটিকে উত্তম করে বাঁধলাম এরপর ওনাকে বললাম- এবার আপনি সওয়ার হউন। তিনি (বৃদ্ধা মহিলাটি) সওয়ার হয়ে নিচের আয়াতটি পড়লেন,
— “পবিত্র সেই সত্ত্বা যিনি এটাকে আমাদের আয়ত্ত্বাধীন করে দিয়েছেন, আমাদের ক্ষমতা ছিল না তাকে আয়ত্ত্ব করার; আর আমরা আমাদের পালনকর্তার নিকট নিঃসন্দেহে ফিরে যাবো।” [সূরাঃ যুখরুফ; আয়াত ১৪]
আমি উঁটনীর লাগাম ধরে হাঁটতে লাগলাম। খুব জোরে হাঁটছিলাম আর চিৎকার করে করে উঁটনী তাড়াচ্ছিলাম। উপরিউক্ত অবস্থায় বৃদ্ধা বললেন-
— “স্বাভাবিক পন্থায় হাঁট আর তোমার আওয়াজ অবনত কর।” [সূরাঃ লোকমান; আয়াত ১৯]
এবার আমি ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগলাম এবং একটি কবিতার কয়েকটি ছন্দ গুণ-গুণ (বেশি জোরেও না আবার বেশি আস্তেও না) করে গাইতে লাগলাম। এ অবস্থা দেখে মহিলাটি তিলাওয়াত করলেন-
— “কুরআন থেকে যে অংশ সহজ মনে হয় তাই পাঠ কর।” [সূরাঃ মুযজাম্মিল; আয়াত ২০]
আল্লাহ্ তা’য়ালা সত্যিই আপনাকে নেককার নারী হিসেবে সৃষ্টি করেছেন।
— “যাদের জ্ঞান আছে তারাই শুধু শিক্ষা গ্রহণ করে থাকে।” [সূরাঃ আল-ইমরান; আয়াত ৭]
কিছুক্ষণ নীরবে পথ চলার পর আমি মহিলাটিকে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনার কি স্বামী আছে?
— “এমন বিষয় জিজ্ঞাসা করিও না যা প্রকাশ করা হলে তোমাদের নিকট খারাপ লাগতে পারে।” [সূরাঃ মায়েদাহ; আয়াত ১০১]
এবার আমি নীরব হয়ে গেলাম। যতক্ষণ কাফেলা না পাওয়া গেল আমি তার সাথে কোন কথা বললাম না। এভাবে কিছু সময় চলার পর মহিলাটির হারিয়ে যাওয়া কাফেলা দেখতে পেলাম এবং তাকে (মহিলাকে) বললাম, এই যে সামনে কাফেলা এসে গেছে; এ কাফেলায় আপনার কে কে আছেন?
— “সম্পদ এবং পুত্র এসব দুনিয়া-জীবনের শোভা।” [সূরাঃ কাহাফ্; আয়াত ৪৬]
আমি বুঝতে পারলাম এ কাফেলায় তার সন্তান আছে। আরও জিজ্ঞাসা করলাম, কী কাজ করে সে এ কাফেলায়?
— “এবং পথ নির্ণায়ক চিহ্নসমূহও; আর নক্ষত্রের সাহায্যে তারা পথের নির্দেশ পায়।”(১) [আল-কুরআন]
[[ (১) সে যুগে (ইসলামের প্রথম দিককার যুগ) সূর্য, নক্ষত্র ও জ্যোতিবিদ্যার অনুসরণ করে পথসমূহ নির্ণয় করে বিভিন্ন ধরণের লোকজন একটি কাফেলার ন্যায় একসঙ্গে পথ চলত। এ সময় তাদের (কাফেলার লোকদের) সাথে অন্তত একজন হলেও রাহবার থাকত ]]
বুঝতে পারলাম তার সন্তান এ কাফেলার ‘রাহবার’ (পথ নির্দেশক)। বৃদ্ধাকে নিয়ে ঐ কাফেলার তাঁবুতে গেলাম এবং তিনাকে জিজ্ঞাসা করলাম, এবার বলুন আপনার এখানে কে আছে?
— “এবং আল্লাহ তা’য়ালা ইব্রাহীম (আলাইহিসসালাম)-কে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেছেন।” [সূরাঃ নিসা; আয়াত ১২৫]
“আর মূসা (আলাইহিসসালাম)-এর সাথে আল্লাহ্ তা’য়ালা কথা বলেছিলেন।” [সূরাঃ নিসা; আয়াত ১৬৪]
“হে ইয়াহিয়া! সজোরে কিতাব ধারণ কর।” [সূরাঃ মারইয়াম; আয়াত ১২]
এ আয়াতগোলো শ্রবণের পর আমি চিৎকার করে ডাকতে লাগলাম- হে ইব্রাহীম! হে মূসা! হে ইয়াহিয়া! কিছুক্ষণ পর চন্দ্রের ন্যায় শুভ্র ও নক্ষত্রের মত আলোকোজ্জ্বল তিনজন নওজোয়ান আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। আমরা সকলে স্থির হয়ে আসন গ্রহণ করলাম। এ সময়ে মহিলা তার সন্তানদেরকে উদ্দেশ্য করে বললেন-
— “এ টাকা দিয়ে তোমাদের মধ্য হতে কাউকে শহরে প্রেরণ কর; সে খোঁজ করে দেখবে কোন্ খাবারটি বেশি পবিত্র, তখন সে তোমাদের জন্যে সেখান থেকে কিছু খাবার নিয়ে আসবে।” [সূরাঃ কাহাফ; আয়াত ১৯]
এ আয়াত শ্রবণ করে তিনজন নওজোয়ানদের মধ্য থেকে একজন উঠে চলে গেল এবং অল্পসময়ের মধ্যেই সে কিছু খাবারসহ আবার আমাদের মাঝে ফিরে এল এবং খাবারসমূহ আমাদের সামনে পরিবেশন করল। এ-সময়ে মহিলাটি বললেন-
— “সানন্দে খাও এবং পান কর; এগুলো তোমাদের সেই কাজের বিনিময়ে যে-কাজ তোমরা পূর্বে করে এসেছো।”
[সূরাঃ আল-হাক্কাহ; আয়াত ২৪]
আমি আর ধৈর্যধারণ করতে পারলাম না। এমতাবস্থায় আমি মহিলাটির সন্তানদেরকে উদ্দেশ্য করে বললাম- এ খাবার আমার জন্য হালাল হবে না যতক্ষণ না তোমরা এ মহিলার রহস্য বলছো।
মহিলার ছেলেরা বলল, ‘চল্লিশ বৎসর ধরে আমাদের মায়ের এ-অবস্থা। এ চল্লিশ বৎসরে তিনি কুরআনুল কারীমের আয়াত ব্যতীত একটি বাক্যও বলেন নি। তদ্বজন্যে তিনি এ নিয়ম পালন করছেন যেন জিহ্বা থেকে কোনো অপ্রয়োজনীয় কথা বের হয়ে না পড়ে যাতে আল্লাহ্ নারাজ হন।’
আমি বললাম, “এ-সব আল্লাহ’র অনুগ্রহের নেয়ামত, যাকে ইচ্ছা দিয়ে থাকেন; আর আল্লাহ তা’য়ালা অনুগ্রহশীল মহান।” [সূরাঃ হাদীদ; আয়াত ২১]
উপরিউক্ত ঘটনাটি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক রাদিঅাল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত।
©somewhere in net ltd.