![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ঢাকার এদিকটা বেশ সুন্দর, ছিমছাম। আগে যখন আসা হত তখনও এতটা ছিমছাম ছিলনা। কত আগে যে
আসা হয়েছিল কে জানে! বব ক্যাফে টা খুঁজছিলাম। খুঁজে পেয়ে ক্যাফের ভিতরে কোণার একটা সিটে বসে
পড়লাম।
জন্ম আমার এই ঢাকা শহরেই, পুরান ঢাকার দিকে। অনেক ছোটবেলা টা ওখানে কেটেছে, পরের দিকে
ধানমন্ডিতে সপরিবারে এসে পড়ি। শৈশব থেকে অনেক চুপচাপ গোছের ছিলাম, ভালবাসতাম বই পড়তে।
রাস্তায় পড়ে থাকা কাগজের টুকরা থেকে শুরু করে যা পেতাম হাতের সামনে তাই পড়ে ফেলতাম এক
নিশ্বাসে। আমার ছোট দুই ভাই ছিল অসম্ভব দুরন্ত, পড়াশুনায় ওদের কোন ইন্টেরেস্ট ছিলনা।
আর ভালবাসতাম কবিতা লিখতে, গান গাইতে আর গল্প লিখতে। কিন্তু এই ব্যাপারটা আব্বা আম্মা কখনই
নিতে পারেননি। কেন জানি তারা সহ্যই করতে পারতেন না এসব। আমার শখের লিখালিখি গুলো কোথাও
ছাপা হলে উনারা কখন উৎসাহী দৃষ্টিতে লিখাগুলা পড়েননি, আমার গান গেয়ে পাওয়া পুরষ্কার গুলোও ছিল
অবহেলিত। তারা শুধু আমাকে পড়তে বলতেন।
এর পিছনে অবশ্যই কারণ ছিল, কারণ হল আমার পরিবারের অস্বচ্ছলতা। আমার মাঝে পড়াশুনার সম্ভাবনা
দেখে উনারা আমাকে হয়ত ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বানাতে চেয়েছিলেন। স্কুল কলেজ পর্যন্ত অনেক ভাল ফলাফল
দেখালাম। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির সময় আমি সাহস করে বলে উঠতে পারিনি যে , আব্বা আম্মা! আমি এসবে
ভাল করব না, আমাকে বাংলা সাহিত্য বা ক্রিয়েটিভ কিছু বা আমার মত করে কিছু পড়তে দাও, আমি
অনেক বড় কিছু হব, অনেক দূর আগাতে পারব। কিন্তু পারিনি বলতে, আমার ভরাডুবি হল রীতিমত।
কোথাও কোন সুযোগ হল না। আমি ভেঙ্গে পড়লাম একদম।
যারা এতদিন আমার থেকে পিছিয়ে ছিল তাদেরকে আমার থেকে অনেক এগিয়ে যেতে দেখলাম, আমি কাজের
কাজ কিছুই করতে পারলাম না। সিগারেট ধরে ফেললাম হতাশায়। প্রতিদিন বিকেলে বের হতাম একটু
লেকের দিকে হাঁটতে। বাসার মানুষের কাছে নিজেকে ওয়োর্থলেস মনে হত। লেকের দিকে এক ভদ্রলোকের
সাথে কথা হত, জামশেদ সাহেব। উনি আমাকে সবসময়ই বলতেন আমার জন্ম নাকি অন্য কিছু করতে
হয়েছে। সবসময় অদ্ভুত দার্শনিক মার্কা কথা বলতেন উনি।
আরেকজন ছিল আমার বন্ধু সনেট। সে সবসময় আমাকে আশ্বাস দিয়েছে," দোস্ত একদিন তুই আসলেই
অনেক বড় হবি এসব ভর্তি টর্তি দিয়ে কি হবে। তুই লেগে থাক, হয়ে যাবে।" সনেট আর জামশেদ
সাহেবের কথার একটা মিল ছিল, তাই জামশেদ সাহেবের সাথে সনেটের দেখা করাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু
জামশেদ সাহেব মানা করতেন, বলতেন উনি চান না।
একদিন জামশেদ সাহেব আমাকে অদ্ভুত স্বরে আমাকে কিছু টাকা দিতে বললেন। তিনি নাকি বিনিয়োগ করে
দিবেন আমার জন্য সে টাকা এবং তাতে নাকি আমরা নিজেই ব্যবসা দিতে পারব। আমি টাকার ব্যাপারে
আমার অপারগতা জানালাম। তখন উনি খনখনে গলায় আমার আব্বার আলমারি থেকে লুকিয়ে টাকা আনার
কথা বললেন। আমি উঠে গেলাম। এই কাজ আমি করতে পারবনা।
বাসায় এসে পড়লাম। ওইদিন রাতে আমি জামশেদ সাহেব কে আবার দেখি, আব্বা আম্মার রুমের সামনে।
আমি চিৎকার করে উঠি , আপনি বাসায় ঢুকলেন কীভাবে? উনি বারবারি বলছিলেন, টাকাটা যোগাড় কর,
অনেক বড় কিছু করতে পারবা রবিন। আমার চিৎকার শুনে আব্বা আম্মা বেরিয়ে এলেন। তারা জামশেদ
সাহেব কে দেখলেন ই না। জামশেদ সাহেব পাশ থেকে কেটে পড়লেন। আমি উনার পিছু করলাম , পেলাম
না আর।
পরদিন দুপুরে আব্বা আম্মার আল্মারির সামনে আমি আবার সেই লোককে দেখলাম। সে সমস্ত টাকা বের
করে নিয়েছে,আমি তার হাত খপ করে ধরে ফেললাম। এদিকে চিৎকার চেঁচামেচি শুনে আব্বা এসে পড়লেন,
পিছনে সনেট। আবার তাদের পাশ থেকে দুইজন তাগড়া মত লোক এসে আমাকে ধরল। অদ্ভুত ভাবে খেয়াল
করলাম , সব টাকা আমার হাতে। দুই হাত দূরে জামশেদ সাহেব দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
লোকগুলা ইঞ্জেকশন পুশ করে দিল আমার হাতে, পরক্ষণেই আমি নেতিয়ে পড়লাম
ঘুম ভাঙ্গল একদম রাতে। অনেক দুর্বল, নড়চড়া করার মত শক্তি নেই। এদিক ওদিক চেয়ে দেখলাম পুরানো
শ্যাওলা জমা দেওয়াল আর কাঠের ক্ষয়ে যাওয়া দরজা। একটু পর আব্বা দরজা ঠেলে ঢুকলেন, সাথে সনেট
আর একটা ডাক্তার গোছের লোক। আমি জানতে পারলাম যে, আমি এখন এক্তা মানসিক রোগ নিরাময়
ক্লিনিকে আর আমি নাকি মানসিক রোগী। আমি নাকি শুন্যে চেয়ে একা একাই কথা বলি আর চিৎকার
চেঁচামেচি করি। জামশেদ সাহেব লোকটার নাকি কোন অস্তিত্ব নাই, আমার কল্পনার সৃষ্টি সে। সনেট লেকের
পাড়ে আমাকে একা কথা বলতে দেখে ব্যাপারটা আব্বা কে জানায়। আম্মা জানেনা এখনো আমি এখানে।
প্রায় দু মাস পর আমি সেই কারাগারের মত ক্লিনিক থেকে বের হই। এর মাঝে অনেক অসহনীয় কিছু সহ্য
করা হয়ে গিয়েছে। আম্মা ঝরঝর করে কেদে দিলেন আমাকে দেখে। আমি বাসায় রেস্টে থাকলাম। এখন
নিয়মিত ওষুধ খেতে হয়। হয়ত এর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ায় আর আগের মত লিখতে পারিনা, গাইতে পারিনা।
ডাক্তার ও প্রেসার নিতে মানা করে দিলেন।
এর মধ্যে আমি একটা সাধারণ একটা কলেজে অনার্সের উদ্দেশ্যে ঢুকি। অনার্স শেষ হতে হতে আব্বা আম্মা
আমার জন্য একটা সম্বন্ধ আনলেন, একটা চাকরিও হয়ে গেল। আমার জীবনটাকে গোছানোর জন্য বিয়েটা
ঠিক ও হয়ে গেল, কিন্তু রিয়া নামের মেয়েটাকে আর জানানো হল না আমার আগের অসুস্থতার কথা।
বিয়ে হল যথাসময়য়ে। সুন্দর সময় কাটছিল, রিয়া অনেক ভাল একটা মেয়ে। আমার মত চুপচাপ একটা
ছেলের জীবনে প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা একটা হাশিখুশি মেয়ে এসে যেন একটা পরিপুর্ণতা এনে দিল আমার জীবনে।
চাকরিতে বেতন হয়ত খুব বেশি ছিল না, কিন্তু যা ই ছিল, আমাদের অনেক সুন্দর চলে যেত।ওষুধ গুলো
লুকিয়ে খেতাম ভয়ে। পাছে রিয়া জেনে যাবে আর আমাকে ছেড়ে যাবে। একটা সময়ে ডিসকন্টইনিউশন এসে
পড়ল ওষুধ খাওয়াতে।
রিয়া একদিন সুখবরটাও জানালো। বাবা মা হতে যাচ্ছি আমরা । অদ্ভুত একটা অনুভুতির সঞ্চার হল
খবরটা শুনে। ওকে নিয়ে বাইরে খেতে গেলাম। বাসায় আসার পথে অদ্ভুত একটা ব্যাপার হল, ট্যাক্সি
চালককে বহুদিনের পরিচিত মনে হল। অনেক্ষণ ভেবে মনে হল আরে সে তো জামশেদ সাহেবের মত দেখতে।
খুব ভয় হল। আবার ফেরত আসছে না তো ?
কয়েকদিন পরের কথা। আমার ক্রমেই মনে হত থাকল রিয়া আমাকে চায় না, রিয়ার অন্য কোথাও সম্পর্ক
আছে। সে অনেকটা সময় ফোনে পার করে। খাবার আনতেও দেরি করে । ও খাবারে বিষ মিশিয়ে আমাকে
মেরে ফেলবে না তো? খুব জঘন্য চিন্তাও আসে অনাগত বাচ্চাটাকে নিয়ে । মনে হয় এটা তো আমার বাচ্চা
না!
রিয়ার প্রতি ঘৃণা ক্রমে ক্রমে বেড়েই চলেছিল। একদিন সে অনেক রান্নাবান্না করে আমাকে অফিস থেকে
তাড়াতাড়ি আস্তে বলল। আমি এসে দেখি সে অনেক সেজেগুজে বসে আছে টেবিলে। হঠাত আমি কাকে যেন
দেখলাম আমাদের বেডরুমে, একটা পুরুষ কন্ঠ শুনলাম। রিয়া আমাকে খাওয়া বেড়ে দিতে না দিতেই আমি
সব খাবার উড়িয়ে ফেললাম। বিষ! সব গুলাতে বিষ মেশানো! রিয়া কে চিৎকার করে বললাম যে আমাকে
মেরে ফেলে কার কাছে যাওয়ার কথা চিন্তা করছে সে। বেডরুমে গিয়ে সব তছনছ করে খুঁজলাম সে
আগন্তুক কে। পালিয়েছে শালা!
রিয়া হতভম্ব হয়ে আমার দিকে চেয়ে ছিল। সে আমার এই রূপের সাথে পরিচিত না। আমি তাকে রীতিমত
চার্জ করতে লাগলাম ," কই সেই হারামজাদা ! কোথায়!" এই বলে আমি গায়ে হাত তুললাম রিয়ার উপর।
আমি তার গায়ে হাত তুললাম।
রিয়া থাকেনি আর আমার সাথে। জানতেও পারেনি সে যে আমি একজন মানসিক রোগী। ডিভোর্স দিয়ে দেয়
সে আমাকে। চলে যায় অনেকদূর, কানাডা। আমাকে আরেক দফায় পাঠানো হয় ক্লিনিকে। বেড়ে যায়
ওষুধের ডোজ।
সনেটকে অনেকদিন আমার সহ্য হতনা কেন যেন, সে অনেক উন্নতি করেছে ওর জীবনে। আর বারবার
আমার সাথে যোগাযোগ করেছে, আমি ই যোগাযোগ করতাম না। ক্লিনিক থেকে বেড় হয়ে আসার পর সনেট
আমার সাথে আসত নিয়মিত দেখা করতে, আমাকে সাহস যোগাত। চাকরিটা আমার আর থাকেনি। সনেট
আমাকে কবিতা লিখার জন্য অনেক বলত, আমি একটু একটু করে লিখার চেষ্টা করতাম, লিখে লিখে ওকে
দিতাম। রিয়ার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি অনেক, কোনভাবেই কিছু হয়নি।
এর মাঝে সনেটের সাহায্যে আমার একটু একটু করে লিখা কবিতাগুলো বই আকারে প্রকাশিত হয়, একুশে
বইমেলায় যথেষ্ট নাম ডাক ও হয়। আমার দু একটা গল্প ও কয়েকজন নাট্যকারের অনেক পছন্দ হয়।
আমার গল্পে সিনেমাও হল। পুরষ্কারও পেয়েছি। একজন লেখক হিসেবে এখন মোটামুটি সবাই চিনে আমাকে।
পাঁচ বছর পরের কথা। এর মাঝে আমি আমার আম্মাকে হারিয়েছি। বন্ধু সনেট রিয়ার সাথে যোগাযোগ
করতে পেরেছে, তাকে জানিয়েছে আমার রোগের কথা, যেটার জন্য আমি আর আমি থাকিনাই, রিয়াকে কষ্ট
দিয়েছি। ওষুধ খাওয়াটা ঠিক আর নিয়মিত রাখছি এখন। আমার মেয়েটা এখন অনেক বড়। আমার মতোই
হয়েছে শুনলাম। এই ছোট্ট বয়সে নাকি সে গল্প লিখে, দুর্দান্ত পিয়ানো বাজায় আর গান গায় অসাধারন।
ওকে এক্টাবার কোলে নেওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছি আমি।
আজ ওরা আসবে আমাকে দেখতে । কানাডা থেকে এসেছে বাংলাদেশে ওরা। রিয়ার সাথে কথা হয়েছিল।
এতদিনের আর এতটা পথের দূরত্বে সম্পর্কের অনেক বিস্তর একটা ব্যবধান হয়ে গিয়েছে। আমি ই রিয়া কে
বব ক্যাফে তে আসতে বলেছিলাম। এখানেই আমরা খেতে আসতাম, এখানে আমি এখনো আসি। ওই যে,
দরজা ঠেলে রিয়া ঢুকল, সাথে একটা ফুটফুটে মেয়ে। এই সেই আমার মেয়ে? আমার মেয়ে! লিখাটা থামাই
আপাতত। আজ আমার যেঅনেক খুশির একটা দিন!
©somewhere in net ltd.