নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

Quazi Hassan’ World of Writings

Quazi Hassan’ World of Writings

কাজীহা

“For every beauty there is an eye somewhere to see it. For every truth there is an ear somewhere to hear it. For every love there is a heart somewhere to receive it.”

কাজীহা › বিস্তারিত পোস্টঃ

নী ভালবাসা

২৭ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ সকাল ৮:১৯

ছবি তোলা হচ্ছে।

বলাই বাহুল্য কিছুক্ষণের মধ্যে এর থেকে কয়েকটা ছবি ফেস বুকে চলে যাবে। এক জনের ছবি গুলোর জন্যে সেই সাত সমুদ্রের ওই পারে অপেক্ষা করার কথা। ইলেক্ট্রনিক ক্যামেরা, ফোন ক্যামেরা আর ফেসবুক, ছবি তোলা আর প্রচারের ব্যাপারটা সারা পৃথিবীতে খুবই সহজ করে দিয়েছে। এখন এর জন্যে বাড়তি খরচ আর সময় দিতে হয় না বললেই চলে।

তিন দিনের সফরে দু জোড়া মানুষ এসেছে কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকতে। মানে এক জোড়া স্বামী-স্ত্রী। সাথে আরেকজনের আসার কথা ছিল; টুটুলের। কিন্তু শেষ মুহূর্তে ওর আসা হয়ে উঠে নি। ফোন করে বলল, শেষ মুহূর্তে ঝামেলা হয়ে গেল রে। তার পরেও বাকীরা সব এসেছে। অনেকটা টুটুলের পীড়াপীড়িতে। বলল, টিকিট কাটা হয়ে গেছে, হোটেলের রুম পর্যন্ত বুক। এখন এক জনের জন্যে তো আর, বাকী চার জন প্রোগ্রাম বাতিল করতে পারে না। টুটুল বলল, যা যা, কোন অসুবিধা নাই। তোদের ভাল কিছু সময় কাটলেই আমি খুশী। অনেক অনেক ছবি উঠাবি। ফেসবুকে দিয়ে দিস। আমার দেখলে মনে হবে আমিও তোদের সাথে ছিলাম। তোরা আমার জন্যে মন খারাপ করিস না। আমি তোদের চার জনের হাসি মুখ, একসাথে একই ছবিতে দেখতে চাই। তবে শর্ত একটাই, প্রথম যেই ছবিটা পোস্ট করবি,সেখানে চার জনকে এক সাথে থাকতে হবে। তার পরে টুটুল হেসে বলেছিল, “ছবি তোলার সময় আমার জন্যেও কিন্তু একটা জায়গা রাখিস। হয়ত উড়ে এসে আমিও হাজির হতে পারি। হা হা হা......”



যে চার জন বেড়াতে এসেছে, তারা হল কাজল আর তার বউ ইলা, ইমন আর তার বউ রিনি। তারা একই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত। ইলা, রিনি দু জন ইংলিশ ডিপার্টমেন্টে আর কাজল, ইমন ছিল ভূগোল আর সমাজ বিজ্ঞানে। কিভাবে যে এদের এক জনের সাথে আরেকজনের ভাব হয়ে গেল বলা, তা এখন বলা মুশকিল। কোন রকমে ক্লাস শেষ করতে পারলেই হল, আরম্ভ হয়ে যেত ওদের দিন ব্যাপী আড্ডা, আনন্দ; এইদিক ওইদিক যাওয়া, সিনেমা দেখা আরও কত কি!

পঞ্চম যে মানুষ ওই দলে ভিড়েছিল, তার নাম টুটুল। খুব রসিয়ে কথা বলতে পারত। সে ছিল ইমনের বন্ধু। কিন্তু পড়ত ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটিতে। চার জনের হট্টগোলে সব সময় যোগদান করতে পারত না। তার ক্লাসের সংখ্যাও বেশী ছিল, সাথে সাথে পড়া লেখার মেলা চাপ। বাসাটাও ছিল বেশ দূরে, সেই এয়ারপোর্ট ছাড়িয়ে উত্তরায়।

টুটুল অল্প কথায় আসর মাৎ করতে ছিল মহা ওস্তাদ। তার কথায় হাসবে না, এমন মানুষ পাওয়া মুশকিল ছিল। ওর ভাণ্ডারের মজার কথার কোন ইয়ত্তা ছিল না। একদিন টুটুল হন্তদন্ত হয়ে ওদেরকে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা বল তো জন্মদিনের আগে কি হয়? ইলা বলল, কি আবার হয়, মায়ের প্রসব বেদনা হয়। কাজল বলল, বাচ্চা ডেলিভারি করতে ডাক্তারের কাছে যেতে হয়।

মস্তিষ্ক খাটিয়ে একেক জন একেকটা উত্তর দিতে লাগল। সবার কথা শুনার পরে, অনেকটা বিচারপতিদের রায় পড়ার ভঙ্গিতে টুটুল বলতে লাগল, কারোটাই হল না। আসলে জন্মদিনের আগে হল, “শুভ”, প্রথমে শুভ, তার পরে জন্মদিন। আজকে হল, টুটুলের শুভ জন্মদিন।

হৈ হৈ করে হাসির রোল পড়ে গেল। ইমন মুখ বাঁকা করে বলল, আগে বলবি না। একটা না হয় কেকের ব্যবস্থা করা যেত। ইলা একটা সোহাগী গলা করে বলল, এই ভাবে হঠাৎ করে বললে, জন্ম দিন আর শুভ থাকে না।

টুটুল রোমান্টিক এক গলা করে বলল, আগে জানলে কি বউ সেজে আসতে না কি?

ইলা তেড়ে আসল, তবে রে বদমাশ…………



বদমাশের সাথে ভাল লাগা, ভালবাসা হতে বেশী দেরী হল না। টুটুলের পরের জন্মদিনে ইলা ঠিকই শাড়ি পড়ে এসেছিল। এক সাথে তারা ঘুরে ফিরে বেড়াল। অবশ্য বেশীর ভাগ সময় সাথে রিনা, ইমন, কাজল ছিল। টুটুল অনেকটা সিনেমার বিজ্ঞাপন পড়ার ঢঙে বলল, সুধী মণ্ডলী যদি একটু সুযোগ-সুবিধা না দেয়, তবে নায়ক-নায়িকা একটু একান্তে সময় কাটাবে কি করে। তোরা আর কতক্ষণ কাবাবে হাড্ডি হয়ে থাকবি?

কাজলের কথাটা খুব গায়ে লাগল, কি, কি বললি? আমরা কাবাবের হাড্ডি?? কেক খাওয়ালাম, লাঞ্চ করালাম। এখন এ রকম অপমানজনক কথা। যা যা তুই এখান থেকে যা। আমরা সবাই ঢাকা ইউনিভার্সিটির, আর তুই হলি বহিরাগত- বুয়েটের, দি রিয়েল গ্রেট কাবাবকে হাড্ডি। গেলি, নাকি পুলিশ......

টুটুল অনেকটা ব্যঙ্গ করে করল, তা ঠিক। আর ঢাকা ইউনিভার্সিটির সব চেয়ে সুন্দরী যে মেয়ে, সে হল আমার জানে মান, ডার্লিং। এখন তোরা ভাগ। আমি এখন প্রিয়তমা ইলা মিত্রের সাথে সময় কাটাব। গত জন্মদিন ফ্লপ করার জন্যে এই বার একটা বিশেষ প্রস্তুতি নিয়ে এসেছি। একান্তে গান শুনাবো আমার প্রিয়তমাকে।

ইমন একেবারে হাটে হাঁড়ি ভেঙ্গে দিয়ে বলল, তুই জীবনে কখন বাথরুম ছাড়া কোথাও গান গেয়েছিস না-কি? যেই হেঁড়ে গলা। তোর গান শুনলে সব দৌড়ে পালিয়ে জান বাঁচাবে।

টুটুলের উত্তরটা মনে হয় ঠোঁটের ভিতরে প্রস্তুত ছিল। কবিতা আবৃত্তি করার মত করে বলতে লাগল, আমার প্রিয়তমার কাছে আমার প্রতিটা শব্দই সুর, প্রতিটা বাক্যই গানের কলি, আর.........।



অন্যরা টুটুল-ইলাকে চান্স দেয়ার জন্যে কিছুক্ষণের মধ্যে সরে পরল। ইলা টুটুলকে বলল, তুমি কি আমার লাস্ট নেম জান না। আমাকে সবার সামনে ইলা মিত্র ডাকলে কেন?

টুটুল মিষ্টি করে বলল, ডার্লিং আজকের এই শুভ দিনে রাগ কর না। তোমাকে ইলা মিত্র বলে আমি এক বিখ্যাত নায়িকা বানিয়ে দিলাম। এক সময় তাকে সবাই এক নামে চিনত।

ইলা বলল, আমাকে এক নামে সবার চেনার কোন দরকার নাই। যাদের আমার চেনার কথা, শুধু তারা চিনলেই চলবে। তোমার যদি না পোষায়, তা হলে আরেক জন ইলা মিত্র খুঁজতে বের হয়ে পড়। আমাকে আর বিরক্ত না করলেই খুশী হব। তা ছাড়া for your kind information ইলা মিত্র কোন নায়িকা ছিলেন না, তিনি ছিলেন তেভাগা আন্দলনের একজন সংঘঠক।

টুটুল একটু চুপ করে থেকে বলল, সরি ভুল হয়ে গেছে। আমাকে মাফ করে দাও। একটু রসিকতা করার জন্যেই তো কথাটা বলা। এখন দেখি হিতে বিপরীত হচ্ছে। আমার জানে মান, আমাকেই ভুল বুঝছে! আসলে নারীর মন বুঝা আমার কর্ম না। কত বড় বড় কবি-সাহিত্যিক এই বিশেষ বিষয়ে একেবারে তেত্রিশের নীচে নাম্বার পেয়ে ফেল করেছে।

ইলা বিরক্ত হয়ে বলল, আমার সব সময় সব কিছু নিয়ে রসিকতা করাটা পছন্দ না।



তার পরের ঘটনাগুলো অনেকটা ছক বাঁধা নিয়মে চলতে লাগল। টুটুল-ইলার প্রেম বেশ জমে উঠল। ভালবাসা, বিরহ কোনটারই কোন কমতি ছিল না। টুটুল স্বভাব সুলভ রসিকতায় ক্ষণিকে রেগে যাওয়া ইলাকে বেশ সহজেই মান ভাঙ্গিয়ে ফেলত।

টুটুল এক বার সময় দিয়ে ইলার সাথে দেখা করতে আসতে পারল না। শেষ মুহূর্তে রহমান স্যার ক্লাসে একটা এসাইনমেন্ট দিলেন। বললেন, যারা আজকেই শেষ করতে পারবে, তাদের তিনি স্পেশাল বোনাস পয়েন্ট দিবেন। টুটুল ভাবল, এক ঘণ্টার মধ্যে কাজ শেষ করে, তার পরে ইলার কাছে গেলেই হবে।

কিন্তু না; কাজটা শেষ করতে করতে তিন ঘণ্টা লেগে গেল। কয়েকবার অবশ্য ইলার কথা মনে পড়েছিল। কোন ভাবেই কাজটা ছেড়ে উঠা সম্ভব ছিল না। সেই সময়ে আবার মোবাইল ফোন চালু হয় নি। তিন ঘণ্টা পরে যেয়ে টুটুল আর ইলাকে পেল না। ইমন বলল, ভয়ঙ্কর অবস্থা। ইলা কান্নাকাটি করে বাসায় চলে গেছে। একেবারে ঘোষণা দিয়ে জানিয়ে গেছে, যেই ছেলে সময় দিয়ে কথা রাখতে পারে, তার সাথে সে সম্পর্ক রাখবে না।

কাজলও ছিল সেখানে। সে দাঁত কেলিয়ে বলল, ইলা বলেছে সে তোর সাথে আর কোন সম্পর্ক রাখবে না। আমাদের জানিয়ে গেছে, তোর মাথার মুড়োঘণ্ট সে নিজের হাতে বানাবে। এখন তুই সাবধানে থাক। পেছন দিক থেকে আক্রমণ আসতে পারে। যে কোন সময়ে মাথা গুড়ো হয়ে যাবে। তোর প্রেম তো গেলই; এখন নিজের মাথাটাকে কিভাবে বাঁচাবি, সেটা নিয়ে চিন্তা ভাবনা আরম্ভ করতে পারিস। ।



পরের দিন সকালেই টুটুল ইলার বাসায় হাজির। মাথার চুল একেবারে কামান, মানে ন্যাড়া। সাথে ইয়া বড় একটা হাঁড়ি। বেল বাজাতে ইলার বাবা দরজা খুলে দিলেন। অল্প সময়ের মধ্যেই দু জনের খুব খাতির হয়ে গেল। দেখলে মনে হত লাগল, তাদের অনেক দিনের জানা শোনা।

ইলার বাবা বললেন, এই হাঁড়ির মধ্যে কি? টুটুল বলল, চাচা ইলা গত কাল জানাল, ওর মুড়োঘণ্ট খেতে ইচ্ছা করছে। তাই সারা রাত ধরে বাজার করে নিজের হাতে আমি রেঁধেছি। কথাটা শুনে ইলার বাবা যেন আকাশ থেকে পড়লেন, তুমি নিজের হাতে রেঁধেছ! বুয়েটে পড়, আবার রাঁধতেও পার। তোমার তো অনেক গুন।

ইলা রক্ত চক্ষু করে টুটুলের সামনে হাজির হল। গলা ছোট করে জানতে চাইল, আমার বাসায় আসতে তোমাকে কে বলল? টুটুল পরিবেশটাকে হালকা করার জন্যে বলল, তুমি আমার মাথার মুড়োঘণ্ট বানাতে চেয়েছ। কিন্তু নিজের মাথা তো আর ভাংতে পারলাম না। তাই মাথার সব চুল ফেলে দিয়েছি। আর নিজের হাতে মহারানী ভিক্টোরিয়ার জন্যে ফ্রেশ মাছের মুড়োঘণ্ট রেঁধে নিয়ে এসেছি।

কিন্তু টুটুলের এত বড় আত্মত্যাগ আর কষ্ট ইলার মনে একটুও রেখাপাত করতে পারল না। ইলা রাগে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, এই হাঁড়ি নিয়ে এখান থাকে বিদায় হও। না হলে তোমার মাথায় তোমার রাঁধা মুড়োঘণ্ট ঢালব। এই সব ভাঁড়ামো আমার এক দম ভাল লাগে না। এখনই এখান থেকে বের হয়ে যাও। তোমার ওই পোড়া মুখ আমি দেখতে চাই না।





তার পরে দু জনের আসলেও দেখা হয় নি। কিন্তু এক জন আরেকজনের খবর ঠিকই পেয়েছে। ইলা বড় একটা চিঠি লিখেছিল টুটুলকে, আমি অনেক ভেবে দেখেছি, আমরা আসলে একজন আরেকজনের সাথে ঠিক যাই না। তুমি আমাকে বুঝতে পার না, হয়ত আমিও তোমাকে না। তুমি রসিকতা দিয়ে আমাকে জয় করে নিতে চাও। কিন্তু আমার কাঁদতে ভাল লাগে, আকাশের তারা গুনতে ভাল লাগে। তুমি এই গুলো কিছু বুঝবে না। তুমি সুখী হও, জীবনে অনেক দূর এগিয়ে যাও, সেটাই কায়মনো বাক্যে কামনা করি। আজ থেকে আমাদের দু জনের পথ দু দিকে বেঁকে গেছে। আমাকে আর না খুঁজলেই খুশী হব।

ইলার ব্যাবহার আর চিঠি টুটুলকে ভীষণ কষ্ট দিল,তার আত্মসম্মানে প্রচণ্ড লাগল। কাজলকে ডেকে বলল, আমি ইলার রাগ ভাঙ্গাতে যাব না। রাগ কি শুধু ওরই হতে পারে? যে আমার দিকটা বুঝতে কখন চেষ্টা করে না, তার সাথে আমার সম্পর্ক শেষ।

এর বছর খানেকের মধ্যে টুটুল এমেরিকায় স্কলারশিপ নিয়ে চলে গেল। পড়া লেখায় মেধাবী, কথা বার্তা আর রসিকতায় চৌকস টুটুল এমেরিকার হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে স্থান করে দিল। এমএস, পিএইচডি করার পর খুব ভাল বেতনের চাকরি পেয়ে গেল। কয়েক দিন পর খবর আসল, টুটুল এক মার্কিন সুন্দরীকে বিয়ে করে সুখের সংসার আরম্ভ করেছে।



অন্য দিককার ব্যাপার আরও চমকপ্রদ। যেই কাজলকে ডেকে টুটুল তার ইলার সাথে সম্পর্কের ইতির কথা জানিয়েছিল, সেই কাজলের মধ্যে ইলা নিজের ভালবাসাকে নতুন করে খুঁজে পেল। পড়া লেখা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই দু জনেরই ঢাকা শহরে চাকরি হয়ে গেল। এক শুভক্ষণে দু জনের বিয়ে হয়ে গেল। ইমন আর রিনির গল্প অনেকটা একই রকম। তারাও কাজল-ইলার বিয়ের কিছু দিনের মধ্যেই ইমন-রিনি একজন আরেকজনের গলায় মালা পড়াল।

তার পরে অনেকটা গড্ডালিকার মত ওদের পাঁচ জনের জীবন কাটতে লাগল। প্রায় বছর পনের পরে টুটুলই ওদের সবাইকে খুঁজে বের করল। ফেসবুক থেকে এক এক করে বাকী চার জনকে পেল। তার পরে চলল নিয়মিত কথা বার্তা আর হাসি ঠাট্টা। সপ্তাহে দুই একবার করে টুটুল সবার সাথে ফোনে কথা বলে নিত।

প্রথমে ইলা টুটুলের ফোন আসলে অন্য দিকের সরে পড়ত। একবার কাজল কিছুটা জোর করেই ইলার হাতে টুটুলের ফোন গছিয়ে দিল। আবার আরম্ভ দু জনের এ কথা, সে কথা, নানা কথা। টুটুল দেখা গেল এতগুলো বছরে একদম বদলায় নি। হৈ হৈ করে সব রসিকতা করতে থাকে।

একবার ইলা জানতে চাইল, তোমার বিদেশী ললনা বউয়ের কথা যে বল না, কি বিষয়? টুটুল ওই দিক থেকে হাসতে হাসতে বলল, আমি তো বিয়েই করিনি, বউ আসবে কোথা থেকে? তুমি যাতে কাজলকে বিয়ে কর, সেই জন্যে আমার বিয়ে খবরটা রটিয়ে দিয়েছিলাম। এর পরে টুটুল আবার রসিকতা আরম্ভ করল, তোমার জন্যে আমি আজও মজনু হয়ে আছি। হৃদয়টা পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে। ওখানে আর কেও বসত বাঁধতে পারবে না। ওই দিক থেকে টুটুল ইলাকে অবাক করে দিয়ে গান ধরল:

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো

যম যাতনা সকল যেতো দূরে।

সে আর লালন একখানে রয়

তবু লক্ষ যোজন ফাঁক রে।।

গান শেষ করে টুটুল বেশ গম্ভীর গলায় বলল, জান আমি এখন লালনের গান গাইতে পারি। প্রায়ই তার গান গাই, আর যখন গাই চোখ দুটো থেকে শুধু পানি পড়তেই থেকে, পড়তেই থাকে। জান এই পৃথিবীতে শুধু মায়া আর মায়া, শুধু মরীচিকা আর মরীচিকা। কোন কিছুই ধরা যায় না; শুধু ছোঁয়া যায়।

ইলা বুঝল টুটুল যা বলছে, তা সবটুকুই অন্তর থেকে বলছে। এখানে সদা হাস্যময়ী টুটুল কোন রসিকতা করার চেষ্টা করছে না। ফোনটা রেখে ইলা অনেকক্ষণ কাঁদল। চোখ দিয়ে অঝর ধারায় পানি আসতে লাগল। বুকের কোথায় যেন সূক্ষ্ম এক কষ্টের কাঁটা এসে বিঁধল, ইলা বুঝল না, এমন কেন হচ্ছে! তা হলে এইটা কি ভালবাসা? ভালবাসা কি কষ্টের। ভালবাসা রঙ কি নীল?

ইলা বিড় বিড় করতে লাগল, কষ্টের ভালবাসা, নীল ভালবাসা। নী ল ভালবাসা। নী ভালবাসা। নী ভালবাসা।

কি অদ্ভুত ইলার ভিতর থেকেও সুর বের হয়ে আসল। আসলে লালনের গানতো তো আর শুধু গলা থেকে আসে না; আসে একেবারে ভিতর থেকে, বুকের ঠিক মধ্য খান থেকে। হৃদয়, মন, আর সুর একাকার হয়ে যায়ঃ

বাড়ির কাছে আরশিনগর

সেথা এক পড়শি বসত করে।

আমি একদিনও না দেখিলাম তাঁরে।।



কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকতে, কাজল ইলা, ইমন-রিনি বেশ কিছু ছবি তুলল হাসি হাসি মুখ করে। ইমন বলল, হোটেলে যেয়ে তার প্রথম কাজই হবে ফেসবুকে ছবিগুলো আপলোড করা। ওইদিকে হয়ত টুটুল অস্থির হয়ে পড়েছে ছবিগুলো দেখার জন্যে। অন্যরা সায় দিল কথায়, তাই সই।

হোটেলে ফিরে ইমন ছবিগুলো দেখে নিচ্ছিল, কোন ছবিটা আগে দেয়া যায়। একটা ছবি দেখে সে একেবারে অবাক। তাদের চার জনের সাথে আরেক জন দেখা যাচ্ছে। ইলার পেছনে, ঝাপসা; কিন্তু বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না। একেবারে মনে হচ্ছে টুটুল। ইমন চিৎকার দিয়ে অন্যদের ডাকল। সবাই একমত হল, পঞ্চম মানুষটা হুবহু টুটুলের মত। কিন্তু সেটা কি করে সম্ভব? সে ত এমেরিকা থেকে আসতে পারে নি। সে এই ছবির মধ্যে কোন ভাবেই আসতে পারে না।

কাজলের মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল। টুটুলের বোন নীরা ফোন করেছে, সেও এমেরিকায় থাকে। আসলে টুটুলের দেশে আপন আত্মীয়স্বজন বলতে কেও নেই। নীরা বলতে লাগল, কাজল ভাই, ভাইয়া কিছুক্ষণ আগে মারা গেছে। কাজল নীরাকে ভাল করেই চিনত আর সে যে টুটুলকে, ভাইয়া, বলে তাও জানত। কাজল চিৎকার করে বলল, কি কি বললে? এইটা কি করে সম্ভব? কখন, কিভাবে?? নীরা ওই দিকে বলতে লাগল, এইতো কয়েক ঘণ্টা আগে। সময় ছিল এখানকার সকাল পাঁচটা দশ। কাজল হতবম্ভ হয়ে বলল, কি কি বললে? ওই দিক থেকে নীরা শান্ত গলায় বলতে লাগল, ভাইয়ার তো গত দু বছর ধরে লিউকোমোনিয়া ভুগছিল। কথাটা সে আপনাদের কাছে গোপন রেখেছিল। খুব ইচ্ছা ছিল আপনাদের, বিশেষ করে ইলা আপুর সাথে শেষ বারের মত দেখা করে আসার। দেশের যাবার জন্য টিকিটও করেছিল। কিন্তু বেচারা এয়ারপোর্টে যেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে। আমাকে আপনার ফোন নাম্বার দিয়ে রেখেছিল, বলেছিল তার জীবন যদি শেষ হয়ে যায়, তা হলে আপনাকে যাতে জানাই।

১০

ইমন ছবিটার দিকে আবার নজর দিল। সময় বিকাল চারটা পনের। বাংলাদেশ আর এমেরিকার সময়ের ব্যাবধান এগার ঘণ্টা। তার মানে মৃত্যুর পাঁচ মিনিট পরে টুটুল ওদের কাছে এসেছিল। আর কেও তাকে দেখতে পারল না। আসবেই বা কি করে এইটা সম্ভব?? ইলা, রিনি কাঁদতে আরম্ভ করল। কাজল গম্ভীর হয়ে গালে হাত দিয়ে টুটুলের কথা ভাবতে লাগল।

ইমন বিষয়টা বুঝার জন্যে কম্পিউটার অন করল। আসলে ল্যাপটপটা আনা হয়েছিল ফেসবুকে ছবি আপলোড করার জন্যে। সব ছবিই ডিজিটাল ক্যামেরায় তোলা। ছবিগুলো আবার কম্পিউটারে প্রথম নিতে হয়। ফোনের থেকে কম্পিউটারে ইন্টারনেটের কানেকশান দিল। গুগলে যেয়ে সার্চ করা আরম্ভ করল। কিছুক্ষণের মধ্যে জানা হল; মানুষ মারা যাবার পরেও, প্রিয় জনের কাছে এসেছে---এমন ঘটনা আগেও বেশ কয়েকবার ঘটেছে। এইটা আর কারোর চোখে না পড়লেও, ক্যামেরার লেন্সে তা ধরা পড়তে পারে। ইমন অন্যদের ঘটনাটা জানাল।

রিনি কাঁদতে কাঁদতে বলল, টুটুল তা হলে আমাদের কাছে এসেছিল? ইস বেচারা!!

ইলা দাঁড়িয়ে জানালার কাছে যেয়ে দাঁড়াল। সেখান থেকে রাতের সমুদ্র স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে আর স্রোতের অবিরাম শব্দ ভেসে আসছে। মনে হচ্ছে সমুদ্রও চিৎকার করে কোন এক দুঃখে অবিরাম কেঁদে চলেছে।

যে মেয়েকে আগে কেও কখন গান গেতে শুনে নি, সে গান ধরল; একেবারে নিখুঁত লালনের সুরে। ইলার গানের সুরের কাছে সমদ্রের কান্না কোথায় যেন হারিয়ে গেল:

পারে লয়ে যাও আমায়।

আমি অপার হয়ে বসে আছি ওহে দয়াময়।।

আমি একা রইলাম ঘাটে

ভানু সে বসিলো পাটে

তোমা বিনে ঘোর সংকটে

না দেখি উপায়।।



ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১৪

http://www.lekhalekhi.net

মন্তব্য ১৪ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (১৪) মন্তব্য লিখুন

১| ২৭ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ সকাল ৯:৫১

উদাস কিশোর বলেছেন: ভাল লাগা রেখে গেলাম

০২ রা মার্চ, ২০১৪ রাত ৩:০৬

কাজীহা বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ। ভাল থাকবেন।

২| ২৭ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ সকাল ১০:০০

মামুন রশিদ বলেছেন: ভালো লেগেছে । কিন্তু আপনার আগের গল্পের মত ছুঁয়ে যায়নি ।

০২ রা মার্চ, ২০১৪ রাত ৩:১১

কাজীহা বলেছেন: মামুন রশিদ---ভাই আপনার মন্তব্যের জন্যে ধন্যবাদ। আসলে গল্পের সাথে সাথে প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হয়ে যায়, উপস্থাপন অন্যরকম হয়ে যায়। চেষ্টা থাকবে প্রতি বারই যাতে সবাইকে ছুঁয়ে যায়। ভাল থাকবেন।

৩| ২৭ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ দুপুর ১২:১৯

রূপা কর বলেছেন: ভাললাগলো ভীষন +++++

০২ রা মার্চ, ২০১৪ রাত ৩:১২

কাজীহা বলেছেন: রুপা কর--অসংখ্য ধন্যবাদ।

৪| ২৭ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ দুপুর ১২:৩৪

দেশ প্রেমিক বাঙালী বলেছেন: সুন্দর পোস্ট!!







প্লাস দিলাম। ++

০২ রা মার্চ, ২০১৪ রাত ৩:২৯

কাজীহা বলেছেন: ধন্যবাদ ++

৫| ২৭ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ রাত ১১:৪১

রাসেলহাসান বলেছেন: অনেক ভালো লাগা রইলো। শুভ কামনা নিরন্তন।

০২ রা মার্চ, ২০১৪ রাত ৩:৩০

কাজীহা বলেছেন: ধন্যবাদ।

৬| ২৮ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ রাত ১০:৪৭

স্বপ্নচারী গ্রানমা বলেছেন:

বদমাশের সাথে ভাল লাগা, ভালবাসা হতে বেশী দেরী হল না।
টুটুলের পরের জন্মদিনে ইলা ঠিকই শাড়ি পড়ে এসেছিল।


যে মেয়েকে আগে কেও কখন গান গেতে শুনে নি, সে গান ধরল; একেবারে নিখুঁত লালনের সুরে। ইলার গানের সুরের কাছে সমদ্রের কান্না কোথায় যেন হারিয়ে গেল:

অনেক ভালো লাগলো আপনার নী ভালোবাসার গল্প ।

ভালো থাকুন ।

০২ রা মার্চ, ২০১৪ রাত ৩:৩১

কাজীহা বলেছেন: আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।

৭| ০১ লা মার্চ, ২০১৪ সকাল ৯:৩৬

এহসান সাবির বলেছেন: বেশ......!!

০২ রা মার্চ, ২০১৪ রাত ৩:৩২

কাজীহা বলেছেন: ্ধন্যবাদ......!!

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.