নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ব্লগে আপনাকে স্বাগতম !!

অশ্লীল রাজ

সাধারন এর মধ্যে কিছুটা অসাধারণ !!

অশ্লীল রাজ › বিস্তারিত পোস্টঃ

বিদায় -

১২ ই নভেম্বর, ২০১৬ বিকাল ৪:৫৯

বিদায়
'
"দেখ বাজান তুই গাও গেরামের পোলা, শহরে
গিয়া কিছুই বুঝিবি না। শহরে মানুষগুলো কেমন রে
বাজান তা তুই জানস না। সুযোগ পাইলেই কেমনে
টকায়া খাইতে হয় তা ওরা ভালো জানে। ঐহানে গিয়া
তুই বাদাম বিক্রি করতে পারবি না।
তুই আমার কাছেই থাক বাজান, আমার দেখাশুনা করবি।
"বাবা তুমি বুঝ না কেন ঐহানে গেলে আমি
অনেক টাকা রুজি করুম। তোমার ঔষধ কিনুম,
লুঙ্গী কিইন্যা দিমু, পাঞ্জাবী কিইন্যা দিমু। মাসে
মাসে আমি অনেক টাকা রুজি করুম বাবা, আমাগো
কষ্ট আর থাকবো না। একদিন দেখবা এই 'মতি'
মেলা টাকার মালিক হইয়া গেছে।
"আমি কিচ্ছু বুঝি না রে বাজান, তুই শহরে গিয়া টাকা রুজি
করবি, হঠাৎ যদি আমি মইরা যাই, তয় কে আমারে
দেখব।? দরকার নাই আমার টাকা রুজির। আমার বাজান
আমার কাছে থাকবো।
"বাবা হেইটা নিয়া তুমি চিন্তা কইরো, কয়দিন পরপর
আমি তোমারে দেখতে আসুম। আর যেইদিন
তোমার মতি অনেক বড় হইবো, মেলা টাকা
হাতে নিয়া ঘুরবো, সেইদিন তোমারেও শহরে
নিয়া যাইবো। হেইটা নিয়া তোমার চিন্তা করোন
লাগতো না।"
"জানি না রে বাজান আমার কি হইবো, তয় আমি তো
তোরে ছাড়া থাকতে পারুম না। আমার মনটা খালি
হাহাকার করবো রে বাজান। তুই এক কাজ করিস, কয়দিন
পরপর আমারে দেখতে আহিস, তয় মনটা শান্তি
থাকবো।
'
মতি শহরে যাইবো, ওখানে গিয়া বাদাম বিক্রি কইরা
অনেক টাকার মালিক হইবো। মতির অনেক দিনের
শখ, ও মেলা টাকা রুজি করবো তারপর বাবারে নিয়া
শহরে চইলা যাইবো। ওখানে অনেক নামকরা
ডাক্তার আছে, মতি তার বাবারে নিয়া ডাক্তারের কাছে
যাইবো। কিন্তু তার বাবা তাকে কিছুই করতে দেয়
না। না জানি ছেলেটা কোথায় গিয়া কেমনে থাকে,
কি খায়।
মতি ছাড়া উনার দেখবাল করার আর কেউ নেই, তাই
মতির বাবা মতিকে কোথাও যেতে দেন না।
এজন্য মতির মন খানিক খারাপ।
আজ থেকে প্রায় পাঁচ বছর আগে মতির মা মারা
গিয়েছিলেন পয়সার অভাবে, ভালো চিকিৎসা না
পেয়ে ধুঁকে ধুঁকে। তখন মতি ছিলো দশ
বছরের এক ছোট্ট অপারগ ছেলে মাত্র।
মায়ের জন্য তার কিছুই করার ছিলো না, শুধু দাঁড়িয়ে
দাঁড়িয়ে মায়ের চলে যাওয়ার কষ্টগুলো সযতনে
বুকের ভিতর পুষে রাখা ছাড়া।
আজ মতি বড় হয়েছে। খানিক বুঝ জন্ম নিয়েছে।
নিজের উপর একটা দায়িত্ব তুলে নিয়েছে, বাবাকে
আর চিকিৎসার অভাবে ধুঁকে ধুঁকে মরতে দেবে
না। সে শহরে গিয়ে বাদাম বিক্রি করবে। কিন্তু মতি
তার বাবার কাছ থেকে একটা বিষয় এড়িয়ে চলছে।
বাদাম বিক্রি করার জন্য ওর যে সামান্যতম পুঁজির
প্রয়োজন তার একটাও তার কাছে নেই। এর জন্য
প্রথমে সে বাড়ি বাড়ি কাজ করবে। এরপর কিছু টাকা
জমিয়ে বাদাম বিক্রি শুরু করবে। মতি বাবাকে এটা
কখনই বুঝতে দিচ্ছে না। কারণ তাতে তিনি নিশ্চয়
তাকে মাইনষের বাড়িতে কাজ করতে বারন
করবেন। মতি তার বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে। মা
মারা যাওয়ার পর বাবা তাকে খুব চোখে চোখে
রাখেন। উনার ছেলে আরও আট-দশটা ছেলের
মত মাইনষের বাড়িতে কাজ করুক, এটা তিনি কখনই চান
না। মতিও ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছে না যে,
কেনো তিনি বারবার তাকে বারণ করেন।?
মতির বাবা যখন ছোট ছিলেন তখন তিনি এক বিরাট
বড়লোকের বাড়িতে কাজ করতেন। সর্বদাই তিনি
ঐ বাড়িতে অবহেলার পাত্র ছিলেন। মতির বাবাকে
খাবার হিসাবে দেওয়া হতো, পুরনো দু'তিন দিনের
বাসি খাবার আর মেহমানদের ফেলে যাওয়া তরকারির
মশলা।
একদিন মতির বাবা নিত্য দিনের খাবারে অতিষ্ট হয়ে
লুকিয়ে লুকিয়ে রান্না ঘরে ডুকে পড়েন। এবং নিজ
ইচ্ছামতো সেখান থেকে কিছু সদ্য রান্নাকৃত
খাবার সাবাড় করে বেরিয়ে পড়েন। ঐ
বড়লোকের বাড়িতে সেদিন কিছু মেহমান
এসেছিলেন, যা প্রথমে মতির বাবা জানতেন না।
মেহমানগুলো যাওয়ার পরে বাড়ির কর্তা মতির
বাবাকে খাবার চুরির অপরাধে এক বেধড়ক মার
মারলেন। তারা কিভাবে জেনে গিয়েছিলো যে
খাবারগুলো মতির বাবাই খেয়েছেন। মেহমানের
খাবারে সেদিন কিছু গড়মিলও হয়েছিলো। মারের
পরিমাণটা একটু বেশী হওয়ার কারণে প্রায় দু'তিন দিন
বিছানা থেকে উঠতে পারেন নি।
এর কিছুদিন পর তিনি সেই বাড়ি থেকে পালিয়ে যান।
মতি যখন মাইনষের বাড়িতে কাজ করার কথা বলেন
তখন তিনি এ কারণেই তাকে বার বার বারণ করেন।
"বড়লোকের দয়া মায়া নাই রে বাজান, ওরা শুধু
অন্যায়, আর নিজের স্বার্থ চিনে, আর কিছু না"
'
মতি এখন নাছড়বান্দা সে শহরে গিয়ে বাদাম বিক্রি
করবে। কিন্তু মতির বাবা রহমান মিয়া ছেলেকে একা
একা শহরে দিতে রাজী নন। শহরের আগ-পিছ
উনি নিজেই জানেন না, আর ছেলে কি করে
জানবে।?
'
মতির বাবা রহমান মিয়ার বয়স প্রায় ষাটোর্ধ। এটুকু
বয়সে নানা রোগ আর কর্মভারে একদম নুয়ে
পড়েছেন। অজকাল এমনও হয়েছে ঘর থেকে
বের হওয়া সম্ভব হচ্ছে না। নিজের অস্তিত্বের
কথা চিন্তা করে মতির কথায় খানিকটা সায় দিলেন, যদিও
অন্তর থেলে এ সিদ্ধান্তটা মানতে পারছেন না।
জীবনটা যদি ঠিক এই যায়গায় এসে থেমে যেত
তবে কতইনা ভালো হতো। খাওয়া দাওয়া, বস্ত্র
পরিধান, মূত্র ত্যাগ কোন কিছুরই প্রয়োজন
হতো না। আমার মতিকে আর টাকা রুজির জন্য শহর
অদূরে যেতে হতো না। মাইনষের দুয়ারে
দুয়ারে ঘুরতে হতো না।
কিন্তু এমনটা তো কখনই সম্ভব না। মাঝ পথে
থেমে যাওয়ার নিয়ম যে জীবনের নীতিতে
নেই। চলতে চলতে হঠাৎ একদা থেমে যাবে
চিরচায়িতভাবে, তখন অার কারো পক্ষে
জীবনকে নিয়ে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না।
মতির বাবা রহমান মিয়া মনে মনে ভাবছেন,
জীবনের সেই থেমে যাওয়ার সময়টা যদি ঠিক
এই মুহূর্তে চলে আসতো তবে খুব ভালো
হতো। আমার মতির চেহারাখাবা দর্শন করতে
করতে চির শান্তির ঘুমে চলে যেতে পারতাম।
একটু পরে চোখের কোণ বেয়ে খানিক জল
গড়িয়ে পড়লো।
"বাজান তুমি কাঁনদো কেন?"
"না রে বাজান কাইলকা তো তুই চইলা যাবি তাই কাঁনতাছি"
ভোর ঘনিয়ে আাসার সাথে সাথে মতির বাবার
বুকের ভিতর হাহাকারটা যেন আরো তীব্র হতে
লাগলো।
দুটি প্রাণ কান্নাকাটা আর আর্তনাদের সীমা অতিক্রম
করে অসহায়ত্বকে কাছে টেনে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে
আছে। মতি তার চোখযোগলকে হাতের দ্বারা
মিছে শান্তনা দিতে দিতে, বাবার কাছ থেকে বিদায়
নিয়ে বেরিয়ে পড়লো গন্তব্যের
উদ্দেশ্যে।
অনেকক্ষণ পর বাস শহরে এসে থামলো। গাড়ি
থেকে নামার পর খানিকক্ষণ বিস্ময়ের চোখে
চারিদিকে তাকালো। শহরটা যেন তার কাছে একখানা
স্বর্গ মনে হতে লাগলো, কত মানুষ গাড়ি, বিরাট
বিরাট দালানকোঠা, বুকের ভিতর একটা তৃপ্তি খুঁজে
পেলো।
শহর দেখার তৃপ্তি!!
এই শহর দেখার জন্য ছিলো কতইনা আক্ষেপ।
আগেকার দিনে যখন মতি ছোট ছিলো, তখন তার
শহর খুব ইচ্ছা ছিলো।
মতির এক দুঃসম্পর্কের মামা শহরে থাকতেন। উনি
যখন গ্রামে আসতেন তখন মতি উনার কাছে কাকুতি
করতো শহরে যাওয়ার জন্য। সেই কাকুতির দৃশ্যটা
এখনও মতির চোখে ভাসছে। পূর্ববর্তি পরিকল্পনা
অনুযায়ী মতি শহরের বাসায় বাসায় কাজ খোঁজার
জন্য বেরিয়ে পড়লো। মাইনষের বাসায় কাজ করার
খাটুনি যে কত কষ্টদায়ক তা এখন মতি হাড়ে হাড়ে
টের পাচ্ছে। এ জন্য বাবা হয়ত তাকে মাইনষের
বাসায় কাজ করতে বারণ করতেন।
এদিকে মতির বাবার আর্তনাদের কণ্ঠটা দিনকার দিন
ভারী উঠছে। রাত্রির অন্ধকারে মতির নাম ধরে
চিৎকার, সাথে কাশির শব্দ, দু'য়ে মিলে এক ভীবৎস
রুপ।
'
কিছু টাকা রোজগার হওয়ার পর, মতি বাদাম কিনে
শহরের নামি-দামি স্কুলগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে বিক্রি
করতে লাগলো।
দুপুরের তীব্র রোধে শরীর থেকে
ঘামের অস্তিত্বটা নিরাকার হয়ে ঘড়িয়ে পড়তে
লাগলো। সমবয়সি ছেলেগুলো মতির লেখাপড়া
না করার আক্ষেপ আরো বাড়িয়ে দিলো। এদের
দিকে তাকালে নিজেকে খুব হতভাগা মনে হয়।
বেশ কিছুদিন হলো মতির ব্যবসা খুব
জোড়ালোভাবে এগিয়ে চলছে। তবে শহরে
এই ব্যবসার দ্বারা যে সে অনেক টাকার মালিক হতে
পারবে না, তা বুঝতে আর একটুও বাকি রইলো না।
রহমান মিয়ার রোগগুলো সময়ের সাথে সাথে
খুব তীব্রভাবে আঁকড়ে ধরতে শুরু করলো।
অনেকদিন হয়ে গেলো মতির কোন খোঁজ-
খবর নেই।
শহরের সেই দুঃসম্পর্কের মামাকে রহমান মিয়া
মতির কথা জিজ্ঞেস করলেন। মানুষের ভীড়ভরা
শহরে কে কাকে খুঁজে পাবে,? কথা শুনে
আশাহত হয়ে ফিরে আসলেন।
'
প্রচণ্ড কাশি আর বুকের ব্যাথায় হঠাৎ একদিন মতির বাবা
ছটফট করতে লাগলেন। চারিদিক অন্ধকার হয়ে
অাসতে শুরু করলো। ঠিক সেই মুহূর্তে মতিকে
দেখার প্রবল ইচ্ছায় রহমান মিয়া কাতর হয়ে
উঠলেন। এর একটু পর সবকিছু নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে
রইল।
কিছুদিন পর মতি বাবার জন্য ঔষধ, লুঙ্গী, আর একটা
পাঞ্জাবী নিয়ে, গ্রমে চলে আসলো। ঘরের
বাইরে থেকে কোন কাশির শব্দ না পেয়ে,
খানিক আতংকিত হয়ে উঠলো। ভিতরটা একদম ফাকা
পড়ে আছে, বাবা ডাকার আর কেউ নেই। মতি তার
অশ্রুকণাগুলোকে আটকে রাখতে পারলো না।
দূরের প্রতিবেশির দ্বারা জানতে পারলো ঐ
স্থানটায় বাবা শুয়ে আছেন চিরনিদ্রায়। মতির
আর্তনাদমিশ্রিত কান্নায় চারিদিক ভারী হয়ে
উঠলো। প্রকৃতি যে সবসময় কারো সহায় হয় না,
এটাই এর জলন্ত দৃষ্টান্ত।
বাবার কবর নিকটে দাড়িয়ে অজর ধারায় কান্না হচ্ছে
মতির।
এমন সময় হঠাৎ বৃষ্টির বার্তাহীন আগমণ। দু'য়ে
মিলে এক করুন দৃশ্য।
বিদায়ে চিরশায়িত বাবা আর নেই। আসা হবে না কভু
ভবে, চলে গেছেন দূরে, অনেক দূরে।।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.