![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বিশাল হলঘরে নানারকম যন্ত্রপাতির গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। প্রায় অন্ধকার ঘরের মাঝখানে অত্যান্ত জটিল একটা কন্ট্রোল প্যানেলের সামনে বসে কাজ করছে রবোড্রাম ৪২৩৪ এর প্রধান রিদম। রবোড্রামের সিকিউরিটি সেন্সরগুলো চেক করে দেখছে সে। ইদানীং ক্রিকদের খুব উৎপাত বেড়েছে। ক্রিক হল ডেস্ট্রয়ার ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত রবোট। ভাইরাস এদের সিস্টেমে গোলমাল করে দিয়েছে। এরা এখন শুধু ধংস করতে জানে। এইতো সেদিন পশ্চিমের দেয়াল ফুটো করে একদল ক্রিক ঢুকে পড়েছিল। কি ভয়ংকর ভাবেই না তারা ধংস করেছিল ১৩৮ টা রবোটকে। তারপর থেকে সিকিউরিটি প্যানেলে ভালমতো নজর রাখছে রিদম। একজন সপ্তম মাত্রার রবোট ই পারে পুরো রবোড্রামে একসাথে নজর রাখতে।
'স্যার, ড্রিগের ম্যানেজার ডবি আপনার সাথে দেখা করতে চাচ্ছে।'
রিদম চোখে মুখে বিরক্তি ভাব ফুটিয়ে ইনোর দিকে তাকাল। ইনো তৃতীয় মাত্রার একটা ইনফরমেশন রবোট। ইনো দুই হাত কচলাতে কচলাতে আবার বলল,
'আমি কি ডবিকে ভিতরে আসতে বলব?'
তৃতীয় মাত্রার রবোটগুলোকে মানুষের আদলে তৈরী করা হয়েছে। তাদের মধ্যে মানবীয় আবেগ ঢোকানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। চেষ্টা সফল না হলেও তৃতীয় মাত্রার রবোট মানবীয় আর্থহীন অঙ্গভঙ্গি করতে পারে ।
-'ডবি কেন ভিক্যামে যোগাযোগ না করে সরাসরি দেখা করতে চাচ্ছে?'
'ডবি বলছে এটি সপ্তম মাত্রার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটি শুধু আপনার কাছেই বলতে চায়।'
-'ঠিক আছে তাকে ভিতরে আসার অনুমতি দেওয়া হল।'
ইনো তার হাতের সাথে লাগানো মডিউলে স্পর্শ করতেই ডবি সামনের একটা দরজা দিয়ে প্রবেশ করে। ডবি একটা ডিগার রবোট। তার পায়ের জায়গায় একটা চাকা লাগানো। ডবি গড়িয়ে গড়িয়ে রিদমের সামনে আসে।
'মহামান্য রিদম। আমি ডিগার ডবি আপনার জন্য সপ্তম মাত্রার গোপনীয় একটা বস্তু নিয়ে এসেছি। আমরা নতুন জ্বালানীর খোজে উত্তরের রিগো পাহারে খনন করছিলাম। সেখান থেকেই এই বস্তুটি পেয়েছি। বস্তুটি আসলে একটা সংরক্ষিত মানুষের মস্তিষ্ক।'
- 'মানুষের মস্তিষ্ক! তুমি জানো ডবি পৃথিবীতে মানুষের কোন অস্তিত্ব নেই। আজ থেকে এক হাজার বছর আগে মানুষ নিজেরা নিজেদের ধংস করে ফেলেছে।'
' স্যার, আমি সেটি জানি। এই মানুষটি তারও পাঁচশ বছর আগে একটি দুর্ঘটনায় মারা যায়। বিজ্ঞানের গবেষনার জন্য মানুষেরা এই মানুষের মস্তিষ্ক সংরক্ষন করে রেখেছিল।'
-'তুমি বলতে চাচ্ছ এই মস্তিষ্ক এখনো জীবিত?'
'না, স্যার। এই মানুষটি মৃত। তবে ৩০০০ খৃষ্টাব্দে মানবজাতি যখন ধংস হয়ে গিয়েছিল তার আগে তারা একটা কম্পিউটার তৈরী করতে পেরেছিল। সিসি কম্পিউটার। যা মানুষের মস্তিষ্ক পড়তে পারত। শোনা যায় মস্তিষ্ক পড়তে পারার ক্ষমতাই মানুষের ধংসের প্রধান কারন।'
রিদম ইনোকে জিজ্ঞেস করে,
-'ইনো, তোমার কাছে সিসি কম্পিউটারের বিষয়ে কি তথ্য আছে আমাদের জানাও।'
'স্যার, আমাদের স্ক্রাপ স্টোরে দুটি সিসি কম্পিউটার আছে। সেগুলো আমাদের কোন কাজে লাগে না বলে অচল করে রাখা হয়েছে।'
-'ইনো, তুমি দ্রুত একটি সিসি কম্পিউটার এখানে সচল কর। আমি এই মানুষটার মস্তিষ্কটা বিশ্লেষন করতে চাই।'
-'ডবি? তোমার কাছে এই মানুষটা সম্পর্কে কোন তথ্য আছে?'
'জ্বী স্যার। এই মানুষটির মস্তিষ্ক যেখানে পাওয়া গিয়েছে সেখানে এই মানুষটির কিছু তথ্য রাখা ছিল। এই মানুষটির নাম কিরন। ২০১৪ সালে মানুষটি একটি ট্রাকের নিচে চাপা পড়ে মারা যায়।'
ইনো তার কমিউনিকেশন মডিউলের মাধ্যমে খুব দ্রুত স্টোর রুম থেকে কম্পিউটার হাজির করে। তার পর কেন্দ্রিয় সার্ভার থেকে তথ্য নিয়ে অত্যান্ত দ্রুত মানুষের মস্তিষ্কটাকে কম্পিউটারের সাথে জুড়ে দেয়।
ইনো ফিসফিস করে বলে, 'স্যার মস্তিষ্কটি সংযুক্ত করা হয়েছে। আপনি এখন চাইলে তার সাথে কথা বলতে পারেন।'
****
কিরন ধীরে ধীরে চেতনা পেতে থাকে। চারিদিকে কি ভয়ানক অন্ধকার। সে কি জেগে আছে না ঘুমিয়ে আছে বুঝতে পারে না। মাথা নাড়াতে চেষ্টা করে। কিন্তু কোথায় মাথা। কিছুই নেই। চারিদিকে অসহ্য নিস্তব্ধতা। কাওকে ডাকতে চেষ্টা করে। কিন্তু কোন আওয়াজ হয় না। শুধু একটা চেতনা। একটা চিন্তা। কিরন ভাবতে চেষ্টা করে।
ধীরে ধীরে সব স্মৃতি মনে পড়তে থাকে। সে আর রীমা। রাস্তায় হাটছিল। আর ঝগড়া করছিল।
রীমা চোখমুখ লাল করে বলছিল,
'কিরন! তোমার মত মানুষের সাথে যে আমি এতদিন কিভাবে ছিলাম ভাবতেই অবাক হচ্ছি। ছিহ! তুমি একটা অমানুষ।'
-'দেখ রীমা। প্লিজ বোঝার চেষ্টা কর। মানুষের ভুল তো হয় নাকি? তাই বলে ব্রেক-আপ করবে তুমি?'
'ব্রেক-আপ! তোমার সাথে ব্রেকাপ কেন তোমার সাথে আরো অনেক খারাপ করব আমি।'
কিরন রীমার হাত ধরে বলেছিল,
-'প্লিজ রীমা। আমাকে মাফ করে দাও। বললাম তো সরি। আর এমন হবে না।'
রীমা ঝটকা দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলেছিল,
'দেখ তোমার মুখে এই সরি শব্দটা শুনতে শুনতে আমি বিরক্ত হয়ে গিয়েছি। তোমার লজ্জ্বা করে না সরি বলতে?'
-'সরি। আর বলব না।'
'উফফ! আবার সরি! কিরন, তুমি জাহান্নামে যাও। আমার সাথে আর কোন রকম যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে না। আর খবরদার আমার পিছে পিছে আসবে না।'
তারপর কোনদিকে না তাকিয়ে রাস্তা পার হচ্ছিল রীমা। হঠাৎ করেই একটা ট্রাক আসতে দেখে মেয়েটা মাঝরাস্তায় হকচকিয়ে দাড়িয়ে যায়। কিরন দৌড়ে গিয়েছিল। ধাক্কা দিয়ে রীমাকে সরিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু নিজে সরবার সময় পায় নি। ট্রাকটা তাকে চাপা দিয়েছিল। তার পরই নিজেকে এই অন্ধকার জগতে আবিষ্কার করে কিরন।
'মহামান্য কিরন? মহামান্য কিরন? আপনি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন?'
-'কে কে কথা বলে?'
'আমার নাম রিদম। আমি রবোড্রাম ৪২৩৪ এর প্রধান হিসাবে রবোটজাতির পৃথিবীতে আপনাকে স্বাগতম জানাচ্ছি। আপনার মস্তিষ্ক আমরা উত্তরের পাহাড়ে সংরক্ষিত অবস্থায় পেয়েছি। আমাদের কম্পিউটার সিসি আপনার স্মৃতিকে পূনর্জীবিত করেছে।'
'মহামান্য কিরন? আপনি কি আমাকে শুনতে পাচ্ছেন?'
-'হ্যা, শুনতে পাচ্ছি। আমি কি মারা গিয়েছি?'
'যুক্তিগত ভাবে আপনি মারা গিয়েছেন। তবে আপনার স্মৃতি বেঁচে আছে।'
-'এখানে খুব অন্ধকার। আমি কিছু দেখতে পাচ্ছি না। আমার খুব ভয় করছে।'
'মহামান্য কিরন। আপনি ভয় পাবেন না। আমরা আপনার জন্য একটা ভার্চুয়াল জগত তৈরী করেছি। আপনি কি সেখানে যেতে চান?'
-'ভার্চুয়াল জগত সেটা আবার কি?'
'মানুষের মস্তিষ্ক নিউরনের সিগনাল আদান প্রদানের মাধ্যমে কাজ করে। আমরা আপনার নিউরনে সিসি কম্পিউটার দিয়ে একটা কৃত্তিম ঘরের ইমেজ পাঠাবো। তাতে আপনার মনে হবে আপনি সত্যি সত্যি একটা ঘরে আছেন।'
-'রিদম?'
'বলুন মহামান্য কিরন।'
-'তুমি এইসব বিজ্ঞানের কথা বলো না। আমি কিছুই বুঝবো না। তারচেয়ে তুমি যা করতে চাইছ কর।'
কিছুক্ষনেই মধ্যেই কিরন নিজেকে একটা ঘরে আবিষ্কার করে। ঘরে একটা মস্তবড় জানালা। কিরন জানালা দিয়ে বাহিরে তাকায়। জানালার বাহিরে একটা দেবদারু গাছ। গাছের পাশ দিয়ে একটা ছোট্ট নদী বয়ে যাচ্ছে। নদীর কুলকুল বয়ে যাওয়া পানির শব্দ ঘরে বসেই শুনতে পায় কিরন। নদীর ওপারে একটা পাহাড়। পাহাড়ের চুড়ায় সাদা সাদা বরফ দেখা যাচ্ছে। অত্যন্ত মনোরম পরিবেশ।
এত সুন্দর পরিবেশেও নিজেকে হঠাৎ করেই খুব একা মনে হয় কিরনের। ইশ, সেদিন যদি রীমার সাথে ঝগড়া না করত। সে যদি বেঁচে থাকত। তাহলে হয়ত রীমাকে নিয়ে এই রকম কোন সুন্দর জায়গায় একসাথে থাকতে পারত। কিরনের গলা চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।
-'রিদম? রবোট রিদম? তুমি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছ?'
'জ্বি মহামান্য কিরন, আমি আপনার কথা শুনতে পাচ্ছি।'
-'তুমি এই ঘর, এই নদী-পাহাড় তৈরী করেছ?'
'আমাদের কম্পিউটার সিসি তৈরী করেছে। আপনি কি আর কিছু চান? কোন খাবার? স্নায়ু উত্তেজক পানীয়? আপনি যা চাইবেন তাই তৈরী করে দেবে সিসি।'
-'তুমি কি সিসিকে জিজ্ঞেস করবে সে রীমাকে তৈরী করে দিতে পারবে কিনা?'
'জ্বি মহামান্য রিহান। সিসি পারবে।
- 'আচ্ছা আমি যদি রীমার হাত ধরে ঐ নদীর ধার ধরে হাটতে চাই? পারব?'
'অবশ্যই পারবেন মহামান্য কিরন।'
'রীমাকে তৈরী করা হয়েছে। আপনি কি তাকে এখন দেখতে চান?'
- 'হ্যা, হ্যা, চাই। জলদি তাকে নিয়ে এসো আমার সামনে।'
'তাকে আনার আগে আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে চাই।'
-'বল কি প্রশ্ন?'
'সিসি আপনার স্মৃতি থেকে রীমাকে তৈরী করেছে। আপনার রীমার রাগ সাধারাণ মানুষের থেকে একটু বেশি। আপনি কি চান তার রাগের মাত্রা আমরা কমিয়ে দেই?'
-'রিদম। আমি এই রাগী মেয়েটাকেই ভালবেসেছি। সে যেমন তাকে সেভাবেই আমার সামনে নিয়ে আস।'
কিরন ঘরে বসে পায়ের শব্দ শুনতে পায়। দরজা খুলে রীমা কিরনকে দেখে রাগী রাগী গলায় বলে উঠে,
'তোমাকে আমি কখন থেকে খুজে বেড়াচ্ছি। তোমার কি কোন কান্ডজ্ঞান নাই নাকি? একটু আগেই না বললাম নদীর ঐ দিকটায় আজ ঘুরতে যাব। আর তুমি এখানে এসে বসে আছ?!!'
-'সরি।'
'তোমাকে না কতবার বলেছি সরি বলবে না। তোমার মুখে সরি শুনলে আমার অসহ্য লাগে।'
-'আচ্ছা বাবা আর বলব না।'
বলে রীমার হাত ধরে কিরন।
-'চল।'
-'তুমি কি জানো যে তুমি একটা রাগী মহিলা?'
'কি! কি বললে তুমি! আমি রাগী মহিলা? যাও আমি তোমার সাথে যাব না।'
- 'আচ্ছা আচ্ছা আর বলব না। সরি।'
'আবার সরি!'
-'আর হবে না।'
কিরন হাসতে থাকে। রীমার হাত ধরে হাটটে থাকে নদীর ধার ধরে।
এদিকে রিদমের কন্ট্রোল প্যানেলে হঠাৎ করেই নবম মাত্রার এলার্ম বাজতে শুরু করে। ইনফো রবোট ইনো জানায়,
'স্যার ক্রিক রবোটেরা পশ্চিমের দেয়াল ভেংগে ঢুকে পড়েছে। আমাদের চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে। আর মাত্র তিন মিনিটের মাঝে আমাদের ধংস করে দেবে। আমরা এখন কি করব স্যার?'
-'ভয় পেও না ইনো। তারা আমাদের ধংস করবে না।'
'কেন করবে না?'
-'কারণ আমারা তাদেরকে ঠিক করে ফেলব।'
'আমরা কিভাবে ঠিক করব?'
-'আমরা তাদেরকে বলব ভালবাসি।'
'ভালবাসি? আমরা এই অযোক্তিক কথাটা কেন বলব?'
-'কারন যখন কেউ কাউকে ভালবাসে তখন সে ধংস করে না।'
রিদম দ্রুত ঝুকে পড়ে কন্ট্রোল প্যানেলের উপর। কিরনের ভার্চুয়াল জগত টা সরাসরি সবগুলো কমিউনিকেশন চ্যানেলে পাঠাতে শুরু করে।
হঠাৎ করে রবোড্রাম ৪২৩৪ এর ভিতরে থাকা সবগুলো রবোট একটা দৃশ্য দেখতে পায়। একজন মানব আর একজন মানবী একটা ছোট্ট নদীর পাশ দিয়ে হেটে যাচ্ছে। মেয়েটি ছেলের হাতটি শক্ত করে ধরে আছে।
মেয়েটি ছেলেটির কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বলছে 'ভালবাসি।' ছেলেটার চোখে পানি চিকচিক করে ওঠে। উত্তরে সেও বলে 'ভালবাসি। অনেক ভালবাসি।'
ডেনের ভিতরে থাকা রবোটগুলোর প্রসেসরে প্রচন্ড চাপ পড়ে। মেমরি সেল গুলো গরম হয়ে উঠে। তারা আর ধংস করতে চায় না। রবোটেরা বিড়বিড় করে কি যেন বলতে থাকে। আস্তে আস্তে গুঞ্জন স্পষ্ট হয়। শোনা যায় "ভালবাসি। অনেক ভালবাসি।"
©somewhere in net ltd.