![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
মিতু অত্যান্ত মাথা ব্যাথা নিয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। গায়ের উপর একটা হালকা কম্বল টেনে দেওয়া। লাইট অফ করে চোখ বন্ধ করে বিছানায় পড়ে আছে। মাথা ব্যাথা বাড়লে মিতুর আলো সহ্য হয় না। সব কিছুই অসহ্য লাগে। রান্না ঘর থেকে মা সুর করে মিতুর নাম ধরে ডাকছেন।
'মিতু মা, একটু শুনে যা তো।'
মিতুর রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে। ইচ্ছে হচ্ছে মাকে গিয়ে বলে, 'মা তুমি আমার মা না শত্রু? আমাকে একটু শান্তিতে থাকতে দাও না।' মানুষের যখন মাথা ব্যাথা শুরু হয় তখন সব কিছুই অসহ্য লাগে। তখন অতি কাছের মানুষের মধুর গলাও কুৎসিত লাগে শুনতে।
মিতুর মার স্বভাব হল মিতুকে ডাকতেই থাকবেন যতক্ষন না মিতু আসে। খুব কড়া কিছু বলার জন্য রান্না ঘরে আসার সময় বসার ঘরের দিকে তাকাতেই মিতুর রাগ পড়ে গেল। বসার ঘরে সুমন ভাইয়া বসে আছেন। মিতুর বড় ভাই মতির বেস্ট ফ্রেন্ড।
মা বললেন, 'মিতু তুই একটু সুমনের সাথে বসে গল্প কর। তোর ভাইয়া বাসায় নেই। বেচারা একা একা বসে আছে। আমি চা বানিয়ে আনছি।
-মা, সুমন ভাই এমন কেউ না যে তাকে চা করে খাওয়াতে হবে। তাকে বিদেয় হয়ে যেতে বল।
অভদ্রের মত কথা বলবি না। ভাই এর মত দিন দিন মেয়েটাও অভদ্র হয়ে যাচ্ছে।
-দেখ মা , আমার প্রচন্ড মাথা ধরেছে, আমি কারো সাথে দেখা-টেখা করতে পারব না। তুমি প্লিজ আমাকে একটু শান্তিতে ঘুমুতে দাও।
দেখা করতে পারব না বলেও মিতু বসার ঘরে গেল। সুমন একটা ম্যাগাজিন হাতে নিয়ে বসে আছে। পড়ছে না। শুন্য দৃষ্টিতে সিলিং এ ঝোলানো ফ্যানের দিকে তাকিয়ে আছে। মিতুর বুকে ধক করে লাগে। কোন সমস্যায় পড়েনিতো মানুষটা।
-কি জন্য এসেছেন?
কারো সাথে প্রথম দেখা হলে মানুষ কুশল জিজ্ঞেস করে। তুমি তা না করে জিজ্ঞেস করলে কেন এসেছেন? মতির কাছে এসেছিলাম। ওর একটা বই ধার নিয়েছিলাম। ফেরত দিতে এসেছি।
-তো দিন। দিয়ে বিদেয় হোন। ভাইয়া বাসায় নেই। নারায়নগঞ্জ গেছেন। দুই দিন পর আসবেন।
আন্টি চা খেয়ে যেতে বললেন। চা খেয়েই বিদেই হচ্ছি। তুমি বস না, তোমার সাথে অনেক দিন কথা হয় না।
-আপনার সাথে বসে কথা বলার কোন ইচ্ছে আমার নেই। আপনাকে দেখলেই আমার সিম্পাঞ্জির কথা মনে হয়। চা খেতে হবে না। আপনি বিদেয় হোন। মাকে আমি বলে দিব আপনার বিশেষ কাজ পড়ায় আপনি চলে গিয়েছেন।
আচ্ছা মিতু তোমার সাথে কি আমার কোন কালে কোন শত্রুতা ছিল?
-কেন বলুন তো?
তোমার সাথে যখনই দেখা হয় তুমি রেগে থাক। ব্যাপারটা কি বল তো?
-আপনার চেহারাটা হচ্ছে রাগ লাগার মত চেহারা। আপনার বাসায় আয়না আছে? না থাকলে আজ ফেরার পথে একটা আয়না কিনে নিয়ে যাবেন। চুল-দাড়ি রেখে চেহারার যে অবস্থা করে রেখেছেন তাতে যে কোন সভ্য মানুষের ই রাগে গা জ্বলে যাবে। আমার মাথা প্রচন্ড ব্যাথা করছে। মন মেজাজ ভাল নাই। আপনি যান। আমি ঘুমুব।
চলে যেতে বলছ?
- হু চলে যান। না থাক। মা চা আনছেন, চা খেয়ে তারপর বিদায় হোন। আমি মা কেউ চা খাই না। আপনি চলে গেলে নষ্ট হবে। আর মা আসলে বলবেন আমি ঘুমুচ্ছি আমাকে যেন বিরক্ত না করে।
কথা কটা বলতেই মিতুর চোখে কেন যেন পানি চলে আসে। মিতু ছুটে নিজের ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে দেয়। সুমনের সাথে মিতু এমন ব্যাবহার কেন করে সে নিজেও জানে না। প্রত্যেক বার সুমন যখন কথা শুনে মুখ কাল করে ফেলে তখন মিতুর খুব কষ্ট হয়। ইচ্ছে হয় ছাদে গিয়ে লাফ দিয়ে নিজের জীবনটা শেষ করে দেয়। মিতুর বলতে ইচ্ছে করে আপনি যাবেন না। আপনি আমার পাশে এসে বসুন। আমি আপনার কোলে মাথা রেখে একটু ঘুমুব। আপনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিবেন। আপনি হাত বুলিয়ে দিলে আমার মাথা ব্যাথা ভাল হয়ে যাবে। মিতু এই কথা গুলো কোনদিন বলতে পারবে না। কিছু কিছু আবেগের কথা বলা যায় না। লুকিয়ে রাখতে হয়। দূর থেকে ভালবাসার মধ্যে এক ধরনের কষ্ট আছে। সেই কষ্টের মাঝে লুকিয়ে থাকে সুখ।
সুমনের শরীরটা খুব খারাপ। খালিপেটে চা খাওয়া ঠিক হয়নি। আসলে মতির বাসায় গিয়েছিল কিছু টাকা ধার চাইতে। ডাক্তার যে সব ওষুধ কিনতে বলেছে সেগুলো জন্য অনেক টাকা দরকার। সুমনের লিভারের অবস্থা খুব খারাপ।
ডাক্তার দেখে বলেছে, 'আপনার লিভারটা তো একদম শেষ করে ফেলেছেন। ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করেন না নাকি? এই ওষুুধ গুলো ঠিকমত খাবেন। মিস দিবেন না।
-মিস দিলে কি হবে?
'মিস দিলে আপনার লিভার শেষ। তখন অপারেশন ছাড়া কোন গতি থাকবেনা। লিভারের অপারেশন অনেক ব্যায়বহুল। দেখা যাবে লিভার পচে গিয়েছে। লিভার ট্রান্সপ্লান্ট করা লাগবে। দেশে এই চিকিৎসা নাই। সিংগাপুর যাওয়া লাগবে। কি সিংগাপুর যেতে চান নাকি।'
বলেই ডাক্তার সাহেব হা হা করে হাসতে লাগলেন। যেন খুব একটা মজার কথা বলে ফেলেছেন।
মতি খুব হন্তদন্ত হয়ে রেডি হচ্ছে। বাইরে যাবে।
'ভাইয়া কোথাও যাবে নাকি?' মিতুর প্রশ্ন।
-তোর সুমন ভাই খুব অসুস্থ।
হাসপাতালে ভর্তি। দেখতে যাচ্ছি।
ভাইয়া আমিও যাব।
-তুই যাবি ! আমিতো জানতাম তুই সুমনকে একদম দেখতে পারিস না।
তো কি হয়েছে। একজন মানুষকে দেখতে যাওয়া কি পাপ?
-না পাপ না । তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে।
সুমন হাসপাতালের বেড এ চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। নাকে বেলী ফুলের গন্ধ লাগছে। গন্ধের উৎস খুজতে চোখ খুলতেই দেখে মিতু সামনে দাড়িয়ে আছে। হাতে বেলী ফুলের মালা। মিতু ভাইয়ের সাথে আসেনি। রাস্তায় বের হয়ে বলেছে, 'আমার যেতে ইচ্ছে করছে না তুমি যাও।' কায়দা করে মতির কাছ থেকে হাসপাতালের নামটা জেনে নিয়ে একা এসেছে।
-সুমন ভাই কেমন আছেন।
ভাল আছি। তুমি কেমন আছ? তোমার হাতে কি বেলী ফুলের মালা?
- হু। শুনলাম লিভার পচিয়ে ফেলেছেন। কয় দিন পর মরে যাবেন। তাই মালা নিয়ে আসলাম। মানুষ কোন স্পেশাল কাজ করলে তার গলায় মালা পরানো হয়। আপনি মারা গিয়ে একটা খুবই স্পেশাল কাজ করতে যাচ্ছেন, তাই আপনাকে মালা পরাতে আসলাম।
আচ্ছা।
- আচ্ছা বলবেন না। আমার মন বলছে আপনি দুই এক দিনের মধ্যে মারা যাবেন। আমার খুব শখ আমি দেখব আমার দেয়া মালা গলায় দিয়ে খাটিয়ায় শুয়ে আপনি গোরস্থান যাচ্ছেন।
মিতু খিলখিল করে হাসছে। সুমনের খুব কষ্ট লাগছে। একটা মেয়ে এত নিষ্ঠুর কথা কিভাবে বলতে পারে।
আপনি কি আমার কথায় মন খারাপ করলেন? আমি মজা করছিলাম।
- না আমি মন খারাপ করি না।
সফিক কথটা বলে মলিন হাসে। তার চোখে ভসে শুন্যতা। যে চোখ আর কিছু চায় না। শুধু অপেক্ষা করে একটা ঠান্ডা মৃত্যুর।
-আমি আপনার মন ভাল করে দিতে পারি।
কিভাবে?
-আমি আপনাকে এখন এমন একটা কথা বলব যাতে আপনার মন ভাল হয়ে যাবে। শুধু ভাল হবে না আপনার পৃথিবীতে আরো কিছুদিন বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করবে।
কি সেই কথা?
-আমি আল্লাহর কাছে একটা দোয়া করেছি।
কি দোয়া?
-আমি সেটা বলব না। বললে দোয়ায় কাজ হয় না।
তবুও বল।
-আচ্ছা কথাটা বলে আমি ঘর থেকে বের হয়ে যাব। আপনি কিছু মনে করবেন না।
আচ্ছা।
-আমি দোয়া করেছি যে..
যে?
-আল্লাহ যেন আপনার এই অসুখটা খুব তাড়াতাড়ি ভাল করে দেন। আর যদি ভাল করে না দেন তাহলে যেন অসুখটা আমাকে দিয়ে দেন।
কথাটা বলেই দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে যায় মিতু। মিতুর চোখে পানি চলে এসেছে। ভালবাসার মানুষকে চোখের পানি দেখাতে হয় না, মুখের হাসি দেখাতে হয়।
সুমনের ব্যাপারটা বুঝতে কিছুটা সময় লাগে। যতক্ষনে বুঝতে পারে ততক্ষনে মিতু চলে গিয়েছে। সুমন জীবনে খুব কম ভালবাসা পেয়েছে। তার মনে হচ্ছে শেষ মুহুর্তে সৃষ্টিকর্তা তার জন্য একটা অসাধারণ উপহার দিয়েছেন। একটি মেয়ের অসাধারণ ভালবাসা। ভালবাসা এমন একটা জিনিস যা কাউকে মৃত্যুর দূয়ারে টেনে নিয়ে যায় আবার কাউকে মৃত্যুর দূয়ার থেকে ফিরিয়ে আনতে পারে।
©somewhere in net ltd.