নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি একজন ভাল মানুষ বলেই নিজেকে দাবী করি। কারো দ্বিমত থাকলে সেটা তার সমস্যা।
১৮৯১ সালে কবি এলেন পদ্মাপাড়ে জমিদারি তদারক করার জন্য। কবির সামনে এক নতুন পৃথিবী উঠে এলো। পদ্মাপাড়ের প্রকৃতি ও মানুষ রবীন্দ্রনাথকে নতুনভাবে অনুপ্রাণিত করল। সেখান থেকে তার গল্পের হাতও খুলে গেল। অধিকাংশ গল্পই লিখেছেন পূর্ববঙ্গের পদ্মাতীরে বসে।
রবীন্দ্রগল্পে পাই আবহমান গ্রামবাংলা ও নগর জীবনের দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত মানুষের পরিচয়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, মানুষের অন্তরের সঙ্গে তার নাড়ির বন্ধন, স্নেহ-প্রেম-ভালোবাসা। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের একাত্মতার রূপটি প্রাণবন্ত হয়ে ধরা পড়েছে 'ছুটি', 'বলাই', 'অতিথি', 'সুভা' গল্পে। ছুটি গল্পে ফটিক শহরে এসে বারবার ফিরে যেতে চায়! মায়ের স্নেহের আঁচল জড়ানো ছায়ানিবিড় গ্রামে, বন্ধুদের নিয়ে আবার হল্লা করতে চায়। ছুটি সে পেল বটে, একেবারে জীবন থেকে ছুটি। 'সুভা' গল্পের বোবা মেয়ে সুভা প্রকৃতির মতোই নির্বাক, কিন্তু প্রাণময়ী। একদিন তার বিয়ে ঠিক হলো। তাকে কলকাতা নেওয়ার যখন ব্যবস্থা হচ্ছে 'সুভা' দু'হাতে পৃথিবীর মাটিকে জড়িয়ে ধরে যেন বলতে চাইল 'তুমি আমাকে যাইতে দিয়ো না মা। আমার মতো দুটি বাহু বাড়াইয়া তুমিও আমাকে ধরিয়া রাখো'।
প্রতিটি গল্পের মধ্যে যেমন কাহিনীর আকর্ষণ, বলিষ্ঠ চরিত্র, তেমনি চমৎকার ভাষাশৈলী। 'খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন', 'কাবুলিওয়ালা', 'কঙ্কাল', 'ক্ষুধিত পাষাণ', 'জীবিত ও মৃত', 'শাস্তি', 'সমাপ্তি' 'মধ্যবর্তিনী', 'মহামায়া', 'ব্যবধান', 'নষ্টনীড়', 'স্ত্রীর পত্র' 'পোষ্টমাস্টার' শুধু গল্পই নয়, গল্পের মধ্য দিয়ে বিরাট মানবজীবনের চিরন্তন অনুভূতির প্রকাশ ঘটেছে। রবীন্দ্রনাথের পক্ষেই সম্ভব এখন সৃষ্টি হয়েছে।
বইটির নাম গল্পে গল্পে রবীন্দ্রনাথ। বইটির প্রতিটি পাতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ঠাকুর বাড়ী, পদ্মা নদী, কুঠি বাড়ি, শাহজাদপুর, নওগাঁ, শান্তি নিকেতনের ছবিসহকারে কবিতা ও গল্পে লেখা। বইটির প্রথম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দুইটি কবিতা দিয়ে লেখক শুরু করেছেন। একটি—আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে, অপরটি-তালগাছ এক পায় দাঁড়িয়ে। ছোটদের সবারই প্রিয় কবিতা। এরপর লেখক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট বেলা থেকে শুরু করে নোবেল পুরস্কার পাওয়া পর্যন্ত গল্পে ও ছবি সহকারে সুন্দরভাবে বর্ণনা করছেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন বলে একটি অপপ্রচার রয়েছে। কিন্তু এটা নিছকই অপপ্রচার।রবীন্দ্রনাথ যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠারই বিরোধিতা করবেন—রবীন্দ্রনাথকেই এই বিশ্ববিদ্যলয় প্রতিষ্ঠার মাত্র পাঁচ বছর পরে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গনেই তিনি বিপুলভাবে সংবর্ধিত হন কিভাবে?১৯২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকা আসেন ।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম তিনটি হল থেকে রবীন্দ্রনাথকে সংবর্ধণা জানানোর আয়োজন করা হয়েছিল। কিন্তু অসুস্থতার কারণে রবীন্দ্রনাথ কেবন মুসলিম হলের সংবর্ধণা সভায় যোগদান করতে পেরেছিলেন।
যদি বাংলাদেশের লাখে লাখো রবীন্দ্রপ্রেমিককে বলা হয় রবীন্দ্রনাথের নামে বিশ্ববিদ্যালয় কোথায় হবে_ আমি নিশ্চিত নব্বই ভাগ মানুষই শিলাইদহের কথা বলবেন। যদি রবীন্দ্রনাথ এসময় বেঁচে থাকতেন তিনিও শিলাইদহকেই প্রাধান্য দিতেন বলে আমার বিশ্বাস। কারণ রবীন্দ্র-সৃষ্টির নাড়ি বাঁধা আছে শিলাইদহে।বঙ্গবন্ধুর আকাঙ্ক্ষা ছিল শিলাইদহেই রবীন্দ্রনাথের নামে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার। রবীন্দ্রনাথের নামে বিশ্ববিদ্যালযটি শিলাইদহে প্রতিষ্ঠা করা হলে এ নিয়ে আর কোন বিতর্কের অবকাশ থাকবে না এবং দেশ-বিদেশের রবীন্দ্রগবেষক ও ভক্তরাও খুশি হবেন। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট সকাল ১০ টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চ্যান্সেলর রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের আনুষ্ঠানিক ভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন এবং টিএসসিতে শিক্ষকদের উদ্দেশে ভাষণ প্রদানের কথা ছিল। কিন্তু তার কয়েক ঘণ্টা পূর্বে শেখ মুজিবুর রহমান তার ৩২ নং ধানমন্ডি রোডের বাড়িতে সপরিবারে নিহত হন।
শিলাইদহ, শাহজাদপুর এবং পতিসর_ এই তিন রবীন্দ্র তীর্থস্থানকে কোন বাঙালির ছোট করে দেখার অবকাশই নেই। রবীন্দ্রনাথ ১৮৮৯ সালের ২৫ নভেম্বর জমিদারি দেখাশোনার দায়িত্ব নিয়ে শিলাইদহে আসেন এবং এখানে আসার পর বিস্তৃত জনমানুষের সঙ্গে তার পরিচয় হয় এবং তার সৃজনপ্রতিভায় যোগ হয় নতুন মাত্রা। এখানে এসে তিনি প্রথমবারের মতো প্রকৃতির লীলারস, সৌন্দর্য এবং নদীবিধৌত বাংলার অপরূপ রূপের সানি্নধ্যে আসেন এবং মুগ্ধ রবীন্দ্রনাথ ইন্দিরা দেবীকে লেখেন_ 'পৃথিবী যে বাস্তবিক কী আশ্চর্য সুন্দরী তা কলকাতায় থাকলে ভুলে যেতে হয।' (ছিন্নপত্রাবলী, চিঠি-৪)। শিলাইদহে তিনি পরিবারসহ বসবাস করেছেন অনেকদিন এবং শাহজাদপুর, পতিসরে বারবার যাওয়া-আসা করলেও তার মূল অবস্থানটা ছিল শিলাইদহেই। এখানে তিনি লালন শাহ, গগন হরকরা, মদন ফকিরসহ অনেক বাউলের সানি্নধ্যে এসে রবীন্দ্র বাউলে রূপান্তরিত হন।
শৈলজারঞ্জন মজুমদার লিখেছেন_ 'বাংলাদেশ নামে যে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র আজ সদ্য ভূমিষ্ঠ হয়ে বিশ্বের জাতিগুলোর মধ্যে আসন নিয়েছে প্রথম জীবনে পদ্মায় বোটে করে ভেসে যেতে যেতে রবীন্দ্রনাথ এ দেশের স্বরূপ দেখেছিলেন। তার মুগ্ধ দৃষ্টির সম্মুখে বাংলাদেশের মনোহরণ মূর্তি খুলে যায়। সেই অপরূপ, স্নেহঘন মাতৃমূর্তির দিকে চেয়ে চেয়ে তিনি গান বাঁধেন, আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি। নদীমাতৃক বাংলার দিগন্তবিহার জলরেখা আর শস্যভরা ক্ষেতের প্রসন্ন হাসি, তার হাট-বাট, পল্লীর নিভৃত সৌন্দর্য,বাঙালির সহজ-সরল জীবনগাঁথা, এমন মধুর হয়ে আর কোন গানে ফুটেছে? সেই কল্যাণরূপিণী মাতৃমূর্তির দিকে চেয়ে কবি যে স্তব রচনা করেন পল্লীগীতির মধুমাখা সুরে, তাই আজ বাঙালির জাতীয় সংগীত (রবীন্দ্রসংগীত প্রসঙ্গ)।
( চলবে )
©somewhere in net ltd.