নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

এফ আই রাজীব

এফ আই রাজীব › বিস্তারিত পোস্টঃ

ঐকিক

১৫ ই অক্টোবর, ২০১৫ সকাল ৯:৪২

সৌভিক গঙ্গোপাধ্যায়
আমার বয়স পঁচাশি। জীবনের কোনো পর্যায়েই কোনো ভাবেই কোনোদিনও সাহিত্যচর্চা করিনি। এমনকি নব যৌবনের অবধারিত লক্ষন হিসাবে বাঙ্গালির সন্তান হয়ে নিদেনপক্ষে একখানা কবিতা রচনারও সাহস দেখাইনি। কিন্তু আজ বাধ্য হচ্ছি লিখতে। পঁচাশি বছর বয়সে, যৌবনের অনুপার্জিত সাহস যে এই বয়সে সঞ্চয় করেছি তা নয়, আসলে এই নিঃসঙ্গ জীবনের অনেক কথাই অঙ্কুরে বিনষ্ট হয়ে যায়।
সত্যেন আমার ছেলে খারাপ নয়, বৌমাও বাড়ীর লক্ষ্মী। কিন্তু তবুও কোথাও যেন একটা সংকোচ, একটা সংশয়, একটা হতাশা সর্বদা আমায় গ্রাস করে। জীবনের প্রায় শেষ এক দশক এই স্ত্রীহীন সময়ের অনেক কথাই মনের মধ্যে পাক খায়, তা জটিল থেকে জটিলতর হয়, কিন্তু তা সঠিক দিশা খুঁজে নিয়ে মুখগহ্বর অবধি পৌছুতে পারে না। শত চেষ্টাতেও আমি সেই বাধাকে অতিক্রম করতে পারিনি। যুঝতে যুঝতে আজ আমি সেই লড়াই থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছি। যদিও রণকৌশলে সামান্য কিছু পরিবর্তন এনে এই শেষ চেষ্টা করছি। জীবনের একেবারে শেষ লগ্নে উপস্থিত হয়ে আমি যে চরম বাস্তবের মুখোমুখি হলাম, তার কথাই আজ লিপিবদ্ধ করবার উদ্দেশ্যে আমার এই আপাত অসম সাহসী পদক্ষেপ গ্রহন। মনের কথাটা লিখে হাল্কা হওয়ার আগ্রহেই এবার এই পরীক্ষা মূলক প্রস্তুতি।

এবার শুরু করা যাক-

অসিত, তপন, শ্যামল আর আমি - আমরা এই চার আভিন্ন হৃদয়ের বন্ধু। বয়সের ফারাক আমাদের মধ্যে খুব একটা নেই, নেই মনের ফারাকও।

অসিত ছিল আমার সহপাঠী। মজবুত গড়ন। ফর্সা রঙ। দীর্ঘদেহী, কোঁকড়ানো চুল - সব মিলিয়ে একেবারে যাকে বলে নায়কোচিত চেহারা। অবিবাহিত হওয়ায় ও ছিল আমাদের কাছে অনেকটাই সেই একই ক্লাসে পরপর ফেল করে থাকা ছাত্রের মতো। যার অকৃতকার্যতার প্রথম শর্তই হচ্ছে অপরিপক্কতা, অথচ তার কাছেই সদ্যোত্তীর্ণ সেই ক্লাসের নতুন ছাত্ররা আসন্ন মননশীল ঝোড়ো হাওয়ার পূর্বাভাস চায়। হয়তো আমারই অপরিপক্কতার ফলে উপমাটা ঠিকখাটলো না। মোট কথা হল - অবিবাহিত এই অসিতের কাছেই আমরা দাম্পত্য জীবনের সমস্যার কথা বলতাম। সেও বিচক্ষনের মত প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিত।

অসিতের সঙ্গে আমার বন্ধুত্বের সুচনা হয় আমার বিয়েকে কেন্দ্র করেই। ব্যাপারটা এই রকম - পঁচিশ বছর বয়সে আমি যখন এম.এ. পাশ করে বি.এল. পড়ছি, তখন আমার পিতৃদেব বাগবাজারের চৌধুরীদের মেয়ের সঙ্গে আমার সম্বন্ধ করলেন। কিন্তু আমি ততদিনে যতীনের বোন ইন্দুকে আমার গৃহিনীর সম্মানটুকু ছাড়া প্রায় সবই দিয়ে বসে আছি। পিতৃ আজ্ঞাকে অমান্য করার রেওয়াজ সে যুগে ছিল না তা নয়, তবে আমার ক্ষেত্রে তা যতটা ছিল মনে, তার যৎসামান্যই ছিল মুখে। আমার সহপাঠী অসিত কুমার রায় আমার এই গুরুতর সমস্যার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয় এবং সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়। ছলে-বলে-কৌশলে অসিত প্রথমে আমাদের বাড়ীতে ঘনঘন যাতায়াত করতে থাকে। এমনকি আমি বাড়ীতে না থাকা কালীনও। ফলে খুব সহজেই ও বাড়ীর সকলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়ে। অবস্থা এমন পর্যায়েও দাঁড়ায় যে, প্রায় ফি রোববার অসিতের আমাদের বাড়ীতে পাত পড়ত। আমি তখন প্রায় বিবাগী, সদ্য শরৎবাবুর 'দেবদাস' পড়ে আমার অবস্থা তখন আরও শোচনীয়। আমার বাবার দুর্বলতা ছিল আমার মা। আবার আমার মায়েরও দুর্বলতা ছিলাম আমি। সুতরাং মনোমত পাত্রী না পেয়ে আমার বিপ্লবী হয়ে যাওয়ার মিথ্যা আশঙ্কা বাড়ীময় রতিয়ে অসিত খুব সহজেই ইন্দুর সঙ্গে আমার বিয়ের ব্যাপারটা ঠিকঠাক ভাবে সম্পুর্ন করতে পেরেছিল। আবশ্য এক্ষেত্রে আমাকেও কিছু অভিনয় করতে হয়েছিল। বাবার দুর্ভাগ্য আমার পাকা দেখার কয়েকদিন পরেই মাউন্টব্যাটেন মহাশয় ভারতকে স্বাধীনতা প্রত্যার্পনের পাকা কথা দেন। সামান্য কিছুদিন দেরি করার জন্য ওনাকে ধন্যবাদ জানাই। আসলে অসিতের আইন অমান্য, ভারতছাড়ো আন্দোলনের সঙ্গে কিঞ্চিৎ যোগাযোগ এই ভিত্তিহীন অভিযগের ভীতকে মজবুত করেছিল।

আমি কি বেশী প্রগলভ হয়ে পড়ছি? হতে পারে। গুছিয়ে লেখার অভ্যেস আমার প্রায় নেই বললেই চলে। আসলে ঘটনা বহুল এই জীবনের সমস্ত কিছুকে ক্রমানুসারে লেখা যে খুবই দুঃসাধ্য কাজ, আমি তা মানি। আমার ক্ষেত্রে তা বেশী মাত্রায় প্রযোজ্য। পঁচাশি বছর বয়সে বিবাহের পূর্বের ঘটনা মনে আছে দেখে নিজেই আশ্চর্য হচ্ছি। আসলে কিছু কিছু ঘটনা থাকে, যা সারা জীবনেও ভোলা যায় না।

যাই হোক, এবার শ্যামল আর তপনের কথায় আসা যাক। শ্যামল আমার বাল্যবন্ধু। চাটুজ্যেদের মাঠে এক্সঙ্গে ফুটবল খেলা থেকে শুরু করে দক্ষিন ঘাটের পুকুরে ডুব সাঁতারের লড়াই পর্যন্ত শ্যামল ছিল আমার নিত্যসঙ্গী। পড়াশুনায় খুব একটা ভালো ছিল না। যদিও তার দরকার ছিল না। বাপ ছিল জাঁদরেল মহাজন। সুদের উত্তরোত্তর বংশবৃদ্বিতে ওদের অন্নের অভাব কোনোকালেই ছিল না, কোনকালে হওয়ার সম্ভাবনাও ছিল না।

তপন ছিল বইয়ের পোকা। প্রতি রোববার অর্থাৎ যেদিন ছিল আমাদের নির্ভেজাল আড্ডা দেওয়ার দিন, সেদিন ছিল তপনের বই খোঁজার পালা। সারা কলকাতা চষে রাত আটটা-ন'টার সময় যখন ও বাড়ী ঢুকতো তখনও গাদাগাদা বইয়ের নাম ওর মাথায় ঘুরঘুর করতো। তপনকে আমি বেশ কিছুদিন লক্ষ করেছি। ও সব সময় কি যেন একটা চিন্তা করতো, হাতের আঙ্গুলগুলো সর্বদা ব্যাস্ত থাকতো কিছু একটা খুঁজতে, চোখের দৃষ্টি ছিল চঞ্চল, মণিগুলো প্রতিনিয়ত ছটফট করতো। পান্ডিত্য থাকার ফলে আমরা সবসময় ও কে একটু সমীহ করে চলতাম। মনে পড়ে, কল্লোল এ তপন একটা গল্প লিখেছিল - 'অকস্মাৎ'। বর্তমানের নিরিখে হয়তো বিষয়বস্তু ছিল খুবই সাদামাটা - এক প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার মেয়ের বেশ্যায় পরিণত হওয়ার কাহিনী। কিন্তু তখনকার দিনে এ গল্প পাঠকসমাজে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল, তা মনে আছে। কিন্তু ঐ পরিচিতিই ওর কাল হল। আধুনিকতার ঝোঁকে মাত্রাজ্ঞান আর রইল না। কোনো একটা পত্রিকায় তপনের 'চার অধ্যায়' এর সমালোচনামুলক একটা প্রবন্ধ প্রকাশিত হল। রবি তখন পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়েছে, 'কল্লোল'-এর ঝাপটায় ক্ষতবিক্ষত। কিন্তু তখনও তিনি বাঙ্গালীর বিশ্বকবি, বাঙালির আশ্রয়স্থল। রবীন্দ্রসৃষ্টি তখন প্রকাশ হওয়া মাত্রই জনপ্রিয়তার শীর্ষে। এই সময়ে তপন মজুমদারের 'চার অধ্যায় - রবীন্দ্র সাহিত্যের নিকৃষ্টতম উপন্যাস' কে অনেকেই ভাল চোখে দেখেননি। রবীন্দ্র অনুরাগীরা হামলা করেছিল তপনের বাড়ীতে। প্রাননাশেরও হুমকি দিয়েছিল। যতদুর মনে পড়ে, বুদ্ধদেব বসু এ ব্যাপারে বিরুপ মন্তব্য করে তপনকে একটা চিঠিও লেখেন। শেষে অবস্থা সামাল দেয় অসিত। তবে অসিতের শর্ত ছিল একটাই, তপন আর কোনোদিনও লিখবে না। পরিস্থিতির চাপে তপন তা মেনে নিয়েছিল।

দিন যতই গড়িয়েছে, বন্ধুত্ব ততই গাড়তর হয়েছে, নৈকট্য বেড়েছে আরও। স্বাধীনতার পর অসিত নিজেকে খুঁজে পেল এক অসীম রিক্ততার মাঝে। সেখানে রাজনৈতিক আদর্শ, দেশসেবা বলে কিছু নেই। আছে শুধু স্বার্থান্বেষীদের দলাদলি আর রাজনীতিকদের ফাঁকা বুলি। তীব্র হতাশাচ্ছন্ন হয়েই যুগের সঙ্গে তাল মেলাল অসিত। মিথ্যেকে আষ্টেপৃষ্ঠে নিজের সঙ্গে বেঁধে নিয়ে সে ওকালতিকেই পেশা হিসাবে বেছে নিল, আমার মতো। ওদিকে সুদের টাকা আর বড়লোক শ্বশুরের একমাত্র মেয়েকে বিয়ে করে শ্যামলের দিনাতিপাত বেশ স্বচ্ছন্দেই হচ্ছিল। কিন্তু নিঃসন্তান হওয়ার জ্বালা শ্যামল আর মানসী - উভয়েই বেশ টের পেয়েছিল। এর কোন সমাধান অসিত রায় করতে পারেনি। মানসীর আত্মহত্যার চেষ্টার পর প্রায় মাসখানেক যমে-মানুষে টানাটানির ঘটনা মনে করলে এখনও আমার গায়ে কাঁটা দেয়। তপন সর্বদাই আমাদের থেকে আদর্শগত ভাবে পৃথক ছিল। পড়াশুনা করত প্রচুর। আর মানুষকে ভালো বোঝাতে পারত। এই দুটো গুন যার মধ্যে বর্তমান, সে শিক্ষকতা ছাড়া আর কিই বা করতে পারে? ঠাট্টা করছি না। যেদিন ও আমায় বললো, কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান হয়েছে, সেদিন কেন যে অকারনে আমার দু'চোখ বেয়ে জলের ধারা নেমে এসেছিলো, তা আমি আজও বুঝে উঠতে পারিনি। মাঝে তপন প্রতিজ্ঞাভঙ্গ করায় অসিতের সঙ্গে কিছু মনোমালিন্যের সৃষ্টি হয়। কিন্তু 'চলন্তিকা' পরতিকার সম্পাদক তপন মজুমদারের গুনে পরতিকার জনপ্রিয়তা শেষ পর্যন্ত অসিতকে আর রাগায়নি।

দিন বয়ে গেছে, সময় কেটে গেছে, চুলে পাক ধরেছে, ক্রমে সাদা হয়েছে, চোখে চশমা উঠেছে, হাতে লাঠি এসেছে, যৌবনের তারুন্য লুপ্ত হয়ে বার্ধক্যের মন্থরতা আজ দ্বারে কড়া নাড়ছে। কিন্তু এত পরিবর্তন সত্ত্বেও মনের কোনে বিরাজমান বন্ধুপ্রীতির স্বরুপ বদলায়নি। এরি মধ্যে শ্যামলের একটা হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেছে, তপনের স্ত্রী জয়া মারা গেছে, অসিত ওকালতি ছেড়ে জমানো টাকায় খাচ্ছে আর আমি বাতের ব্যাথায় প্রায় পঙ্গু হয়ে হাঁটাচলা বন্ধ ঘরের বিছানায় বসে বসে শেষ জীবনের চরম শাস্তি ভোগ করছি।

আমার মেয়ে শিবানীর বিয়ে হয়েছিল গিরিডিতে। স্বামী ওখানকার উঠতি ডাক্তারদের মধ্যে বেশ নামকরা। ইন্দু মারা যাওয়ার দু-তিন বছরের মধ্যে আমার শরীরে যেন রোগের হাট বসলো। তার ওপর বাতের ব্যাথা তো ছিলই। ডাক্তারের পরামর্শে, ছেলের অনুরোধে আর মেয়ের অভিমানের চাপে পড়ে গিরিডি যেতে বাধ্য হলাম। আমার আপত্তি ধোপে টিকলো না। যাবার দিন অসিত, তপন আর শ্যামল ষ্টেশনে এসেছিল আমায় তুলতে। সেদিন ওরা কথা বলেছিল কম, চোখ মুছেছিল বেশি। সত্যি কথা বলতে কি, আমার বুকটাও ভেঙ্গে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল ছুটে গিয়ে ওদের জড়িয়ে ধরি, ফিরে যাই চল্লিশের কলকাতায়।

যাই হোক, পৌঁছলাম গিরিডি। জায়গাটিও স্বাস্থকর আর জামাইও ডাক্তার, রথ দেখা কলা বেচা - দুইই হবে। বেশ কিছু দিন কেটে গেল। এতক্ষন পর্যন্ত তাও ঠিক ছিল। অসিতদের থেকে দুরে থাকলেও চিঠিপত্রের মাধ্যমে সত্যেনের কাছ থেকে ওদের খবরাখবর পেতাম। ওদের তিন জনেরই যে এই বয়সে নতুন করে আমায় চিঠি লেখার ধৈর্য নেই, তা বুঝতে পারতাম। দুরত্ব থাকলেও তা দুর্লঙ্ঘ্য ছিল না। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যে সত্যেনের দেওঘরে বদলি হয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে আমি একেবারে ভেঙ্গে পড়লাম। দিদি-ভাইয়ের নিকট সহাবস্থান ওদের কাছে আনন্দময় হয়ে উঠলেও, তা আমার কাছে হয়ে উঠল তীব্র বিষাদপুর্ণ। তীব্র হতাশা আর বার্ধক্য আবার আমায় চেপে ধরল, আমি আবার অসুস্থ হয়ে পড়লাম।

চিঠি তখনও আসত, এখনও আসে। সত্যেনের চিঠিতে অসিতের পা ভাঙ্গার খবরে মন কেঁপে উঠতো, আর এখন কেয়ারটেকার চিঠিতে লেখে, "সত্যেনবাব্য, এ মাসের ইলেকট্রিক বিল, টেলিফোন বিল, কলিংবেল সারানোর খরচ, বাড়ীর ঝি ও আমার বেতন সহ সবকিছু ধরে মোট দু'হাজারের কাছাকাছি হয়েছে, শীঘ্র পাঠাবেন" - পার্থক্য এইটুকুই।

মানুষ পরিস্থিতির দাস। আমি যখন কলকাতা ছেড়েছিলাম, ভেবেছিলাম দু' সপ্তাহেই মারা পড়ব। কিন্তু চার পাঁচ বছরের মধ্যেও মৃত্যুর পূর্বাভাসটুকুও পেলাম না। ছেলে-মেয়ে, জামাই-বৌমা,নাতি-নাতনীদের নিয়ে দিন ভালোই কাটতে লাগলো। কিন্তু মনটা আবার মোচড় দিল যখন শুনলাম এবার পূজোয় কলকাতা যাওয়া হবে সদলবলে। জামাই এবার হাসপাতাল থেকে বহুকষ্টে পাঁচদিনের ছুটির বন্দোবস্ত করেছে কলকাতায় পূজো দেখবে বলে। আমার চোখের সামনে তখন একের পর এক ভেসে উঠতে লাগল- বাগবাজার সর্বজনিন, কুমোরটুলী পার্ক, কলেজ স্কোয়ার, মহাম্মদ আলি পার্ক।

কিন্তু সত্যেন রাজি নয় আমায় কলকাতায় নিয়ে যেতে। ওর যুক্তি - এই বয়সে এই শরীর নিয়ে আমার পক্ষে এত ধকল সামলানো নাকি কষ্টকর। কিন্তু আমি জানি, কলকাতা যাত্রার জন্য আমি এখন পূর্বাপেক্ষা যথেষ্ট সচল, সবল এবং সজীব। অন্তত শারীরিকভাবে না হলেও মানসিকভাবে তো বটেই। বন্ধুত্বের মানে সত্যেন কি বুঝবে? অসিত, তপন, শ্যামলের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা কি বন্ধুত্বের মাপকাঠিতে কি মাপা সম্ভব? নাকি মাপা যায় ? মনে আমার প্রশ্ন ঘুরতে লাগল - অসিতেরা কি এখনও আমায় সেরকমই ভালোবাসে ? এখনও কি বিজয়ায় মানসীর হাতের ঘুঘনি খেয়ে অসিত বলে মানু বৌঠান "ইউ আর গ্রেট" ? জানি না। আমি যাবই। যেতে আমাকে হবেই। সেরকম হলে সত্যেনকে অগ্রাহ্য করেই যাব।

তখনও আমার যাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা ছিল। সেদিন আবার সত্যেনের সঙ্গে একচোট ঠান্ডা লড়াইও হয়ে গেছে। ইদানিং আমার কেন জানি না মনে হচ্ছে, সত্যেনের যুক্তিগুলো সব বিশ্বাসহীনতায় ভোগে, আর সত্যেন তার ওপর আবেগের প্রলেপ চড়াতে চায়, ব্যার্থ হয়। লড়াইয়ে আমি অপরাজিত থাকি। সেদিনই সন্ধ্যেবেলায় শিবানী-সত্যেনরা পূজোর কেনাকাটা করতে গেছে বাড়িতে কেউ নেই। কেবল আমি আর আমার নষ্টালজিয়া। মানসপটে স্মৃতির প্রজেক্টারের সাহায্যে একেকটা ছবি ভেসে উঠেছে আর আমার দীর্ঘস্বাস পড়ছে। আমার কাছে বন্ধুত্বের শীলমোহর মারা যৌবনের কিছু আমদানি-রপ্তানিকারক চিঠি দিল। ঘোরের মধ্যে সেগুলোর প্রতি আকৃষ্ট হলাম। টলোমলো পায়ে দেরাজের সামনে গেলাম। বহুদিন এই দেরাজটা খোলা হয়নি। চিঠি গুলোও দেখিনি। বুকটা ফাঁকা ফাঁকা লাগতো। সেদিন কি যে হল...। তবে এক হিসাবে তা ভালোই হয়েছিল। কম্পিত হস্তে দেরাজটা খুললাম। সেই চিঠিগুলো। প্রান ভরে হাত বোলাতে লাগলাম। নতুন পাতার গন্ধ তাতে নেই, কিন্তু স্মৃতির টাটকা সৌরভ এখনও বর্তমান। কত সুখ-দুঃখ-হাসি-কান্না-মান-অভিমান, আনন্দ-বিষাদ ঘিরে রয়েছে এই চিঠিগুলোকে; হটাৎ দেরাজের মধ্যে চোখটা আটকে গেল। তিনটে সাদা-খাম। একেবারে নতুন। বের করলাম। তিনটেতেই জামাইয়ের নাম লেখা ঠিকানাসহ।

খাম তিনটের ভেতরে অসিত, তপন, শ্যামলের শ্রাদ্ধের কার্ড ছিল।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.