নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

এফ আই রাজীব

এফ আই রাজীব › বিস্তারিত পোস্টঃ

মুক্ত আত্মা

১৫ ই অক্টোবর, ২০১৫ দুপুর ২:৩৬


স্বামী বিবেকানন্দ

তো পূর্ব হইতেই ‘ব্রহ্ম’ আছেন। আপনাদিগকে ঈশ্বর হইতে হইবে বা পূর্ণ হইতে হইবে, এ কথা সত্য নয়। আপনারা সর্বদা পূর্ণস্বরূপই আছেন, আর যখনই মনে করেন—
আপনারা পূর্ণ নন, সে তো একটা ভ্রম। এই ভ্রম—যাহাতে আপনাদের বোধ হইতেছে, আমুক পুরুষ, আমুক নারী তাহা আর একটি ভ্রমের দ্বারা দূর হইতে পারে, আর সাধন বা অভ্যাসই সেই অপর ভ্রম। আগুণ আগুণকে খাইয়া ফেলিবে—আপনারা অপর একটি ভ্রম নাস করিবার জন্য অপর একটি ভ্রমের সাহায্য নিতে পারেন। একখণ্ড মেঘ আসিয়া অপর এই মেঘকে সরাইয়া দিবে, শেষে উভয়ই চলিয়া যাইবে। তবে এই সাধনাগুলি কি? আমাদের সর্বদাই মনে রাখিতে হইবে যে, আমরা যে মুক্ত হইব তাহা নয়; আমরা সর্বদাই মুক্ত। আমরা বদ্ধ এরূপ ভাবনামাত্রই ভ্রম; আমরা সুখী বা আমরা অসুখী—এরূপ ভাবনামাত্রই গুরুতর ভ্রম। আর এক ভ্রম আসিবে যে, আমাদিগকে মুক্ত হইবার জন্য সাধনা, উপাসনা ও চেষ্টা করিতে হইবে; এই ভ্রম আসিয়া প্রথম ভ্রমটিকে সরাইয়া দিবে; তখন উভয় ভ্রমই দূর হইয়া যাইবে।

মুসলমানেরা শিয়ালকে অতিশয় পবিত্র মনে করিয়া থাকে, হিন্দুরাও তেমনি কুকুরকে অশুচি ভাবিয়া থাকে। অতএব শিয়াল বা কুকুর খাবার ছুঁইলে উহা ফেলিয়া দিতে হয়, উহা আর কাহারও খাইবার উপায় নাই। কোন মুসলমানের বাটিতে একটি শিয়াল প্রবেশ করিয়া টেবিল হইতে কিছু খাদ্য খাইয়া পালাইল। লোকটি বড়ই দরিদ্র ছিল। সে নিজের জন্য সেদিন অতি উত্তম ভোজের আয়োজন করিয়াছিল, আর সেই ভোজ্যদ্রব্যগুলি শিয়ালের স্পর্শে অপবিত্র হইয়া গেল! আর তাহার খাইবার উপায় নাই। কাজে কাজেই সে একজন মোল্লার কাছে গিয়া নিবেদন করিল, ‘সাহেব’ গরিবের এক নিবেদন শুনুন। একটি শিয়াল আসিয়া আমার খাদ্য হইতে খানিকটা খাইয়া গিয়াছে, এখন ইহার একটা উপায় করুন। আমি অতি সুখাদ্য সব প্রস্তুত করিয়াছিলাম। আমার বড়ই বাসনা ছিল যে, পরম তৃপ্তির সহিত উহা ভোজন করিব। একটা শিয়াল আসিয়া সব নষ্ট করিয়া দিয়া গেল। আপনি ইহার যাহা হয় একটা ব্যবস্থা দিন। মোল্লা মুহূর্তের জন্য একটু ভাবিলেন, তারপর উহার একমাত্র সিদ্ধান্ত করিয়া বলিলেন, ইহার একমাত্র উপায়—একটা কুকুর লইয়া আসিয়া যে থালা হইতে শিয়ালটা খাইয়া গিয়াছে, সেই থালা হইতে তাহাকে একটু খাওয়ানো। এখন কুকুর শিয়ালের নিত্য বিবাদ। তা শিয়ালের উচ্ছিষ্টটাও তোমার পেটে যাইবে, কুকুরের উচ্ছিষ্টটাও যাইবে, এ দুই উচ্ছিষ্ট পরস্পর সেখানে ঝগড়া লাগিবে, তখন সব শুদ্ধ হইয়া যাইবে।’ আমরাও অনেকটা এইরূপ সমস্যায় পড়িয়াছি। আমরা যে অপূর্ণ, ইহা একটি ভ্রম; আমরা উহা দূর করিবার জন্য আর একটি ভ্রমের সাহায্য লইলাম—পূর্ণতা লাভের জন্য আমাদিগকে সাধনা করিতে হইবে। তখন একটি ভ্রম আর একটি ভ্রমকে দূর করিয়া দিবে, যেমন আমরা একটি কাঁটা তুলিবার জন্য আর একটি কাঁটার সাহায্য লইতে পারি এবং শেষে উভয় কাঁটাই ফেলিয়া দিতে পারি। এমন লোক আছেন, যাঁহাদের পক্ষে একবার ‘তত্ত্বমসি’ শুনিলে তৎক্ষণাৎ জ্ঞানের উদয় হয়। চকিতের মধ্যে এই জগৎ উড়িয়া যায়, আর আত্মার যথার্থ স্বরূপ প্রকাশ পাইতে থাকে, কিন্তু আর সকলকে এই বন্ধনের ধারণা দূর করিবার জন্য কঠোর চেষ্টা করিতে হয়।

প্রথম প্রশ্ন এই : জ্ঞানযোগী হইবার অধিকারী কাহারা? যাহাদের নিম্নলিখিত সাধন-সম্পত্তিগুলি আছেল। প্রথমতঃ ‘ইহামুত্রফলভোগবিরাগ’—এই জীবনে বা পরজীবনে সর্বপ্রকার কর্মফল ও সর্বপ্রকার ভোগবাসনা ত্যাগ। যদি আপনিই এই জগতের স্রষ্টা হন, তবে আপনি যাহা বাসনা করিবেন, তাহাই পাইবেন; কারণ আপনি উহা স্বীয় ভোগের জন্য সৃষ্টি করিবেন। কেবল কাহারও শীঘ্র, কাহারও বা বিলম্বে ঐ ফললাভ হইয়া থাকে। কেহ কেহ তৎক্ষণাৎ উহা প্রাপ্ত হয়; অপরের পক্ষে অতীত সংস্কার সমষ্টি তাহাদের বাসনাপুর্তির ব্যাঘাত করিতে থাকে। আমরা ইহজন্ম বা পরজন্মের ভোগবাসনাকে সর্বশ্রেষ্ঠ স্থান দিয়া থাকি। ইহজন্ম, পরজন্ম বা আপনার কোনরূপ জন্ম আছে-ইহা একেবারে অস্বীকার করুন; কারণ জীবন মৃত্যুরই নামান্তরমাত্র। আপনি যে জীবনসম্পন্ন প্রাণী, ইহাও অস্বীকার করুন। জীবনের জন্য কে ব্যস্ত? জীবন একটা ভ্রমমাত্র, মৃত্যু উহার আর এক দিক মাত্রল সুখ এই ভ্রমের এক দিক, দুঃখ আর একটা দিক। সকল বিষয়েই এইরূপ। আপনার জীবন বা মৃত্যু লইয়া কি হইবে? এ-সকলই তো মনের সৃষ্টিমাত্র। ইহাকে ‘ইহামুত্রফলভোগবিরাগ’ বলে। তারপর ‘শম’ বা মনঃসংযমের প্রয়োজন। মনকে এমন শান্ত করিতে হইবে যে, উহা আর তরঙ্গাকারে ভগ্ন হইয়া সর্ববিধ বাসনার লীলাক্ষেত্র হইবে না।

মনকে স্থির রাখিতে হইবে, বাহিরের বা ভিতরের কোন কারণ হইতে উহাতে যেন তরঙ্গ না উঠে—কেবল ইচ্ছাশক্তি দ্বারা মনকে সম্পূর্ণরূপে সংযত করিতে হইবে। জ্ঞানযোগী শারীরিক বা মানসিক কোনরূপ সাহায্য লন না। তিনি কেবল দার্শনিক বিচার, জ্ঞান ও নিজ ইচ্ছাশক্তি—এই সকল সাধনেই বিশ্বাসী। তারপর ‘তিতিক্ষা’ —কোনরূপ বিলাপ না করিয়া সর্বদুঃখসহন। যখন আপনার কোনরূপ অনিষ্ট ঘটিবে, সেদিকে খেয়াল করিবেন না। যদি সম্মুখে একটি ব্যাঘ্র আসে, স্থির হইয়া দাড়াইয়া থাকুন। পালাইবে কে? অনেক লোক আছেন যাহারা তিতিক্ষা অভ্যাস করেন এবং তাহাতে কৃতকার্য হন। এমন অনেক লোক আছেন, যাঁহারা ভারতে গ্রীষ্মকালে প্রখর মধ্যাহ্নসূর্যের তাপে গঙ্গাতীরে শুইয়া থাকেন, আবার শীতকালে গঙ্গাজলে সারাদিন ধরিয়া ভাসেন। তাহারা এসকল গ্রাহ্যই করেন না। অনেকে হিমালয়ের তুষাররাশির মধ্যে বসিয়া থাকে, কোনপ্রকার বস্ত্রাদির জন্য খেয়ালও করে না। গ্রীষ্মই বা কি? শীতই বা কি? এ-সকল আসুক যাক—আমার তাহাতে কি? ‘আমি’ তো শরীর নই। এই পাশ্চাত্য দেশসমূহে ইহা বিশ্বাস করা কঠিন, কিন্তু লোকে যে এইরূপ করিয়া থাকে, তাহা জানিয়া রাখা ভাল। যেমন আপনাদের দেশের লোকে কামানের মুখে বা যুদ্ধক্ষেত্রের মাঝখানে লাফাইয়া পড়িতে সাহসিকতা দেখাইয়া থাকেন, আমাদের দেশের লোকও সেরূপ তাঁহাদের দর্শন-অনুসারে চিন্তাপ্রণালী নিয়মিত করিতে এবং তদনুসারে কার্য করিতে সাহসিকতা দেখাইয়া থাকেন। তাঁহারা ইহার জন্য প্রাণ দিয়া থাকেন। ‘আমি সচ্চিদানন্দ-স্বরূপ—সোহহং, সোহহম্।’

দৈনন্দিন কর্মজীবনের বিলাসিতাকে বজায় রাখা যেমন পাশ্চাত্য আদর্শ, তেমনি আমাদের আদর্শ—কর্মজীবনে সর্বোচ্চ আধ্যাত্মিক ভাব রক্ষা করা। আমরা ইহাই প্রমাণ করিতে চাই যে, ধর্ম কেবল ভুয়া কথা মাত্র নয়। কিন্তু এই জীবনেই ধর্মের সর্বাঙ্গ স্বপ্নরূপে কার্যে পরিণত করা যাইতে পারে। ইহাই তিতিক্ষা—সমুদয় সহ্য করা—কোন বিষয়ে অসন্তোষ প্রকাশ না করা। আমি নিজে এমন লোক দেখিয়াছি, যাঁহারা বলেন ‘আমি আত্মা-আমার নিকট ব্রহ্মাণ্ডের আবার গৌরব কি? সুখ-দুঃখ, পাপ-পুণ্য, শীতল-উষ্ণ—এ-সকল আমার পক্ষে কিছুই নয়।’ ইহাই তিতিক্ষা—দেহের ভোগসুখের জন্য ধাবমান হওয়া নয়। ধর্ম কি—ধর্ম মানে কি এইরূপ প্রার্থনা, ‘আমাকে ইহা দাও, উহা দাও’? ধর্ম সম্বন্ধে এ-সকল আহাম্মকি ধারণা! যাহারা ধর্মকে ঐরূপ মনে করে, তাহাদের ঈশ্বর ও আত্মার যথার্থ ধারণা নাই। আমার গুরুদেব বলিতেন, ‘চিল-শকুনি খুব উঁচুতে ওড়ে, কিন্তু তার নজর থাকে গো-ভাগাড়ে।’ যাহা হউক, আপনাদের ধর্মসম্বন্ধীয় যে সকল ধারণা আছে, তাহার ফলটা কি বলুন দেখি?—রাস্তা সাফ করা, আর ভাল অন্নবস্ত্রের যোগাড় করা? অন্নবস্ত্রের জন্য কে ভাবে? প্রতি মুহূর্তে লক্ষ লোক আসিতেছে, লক্ষ লোক যাইতেছে- কে গ্রাহ্য করে? এই ক্ষুদ্র জগতের সুখ-দুঃখ গ্রাহ্যের মধ্যে আনেন কেন? যদি সাহস থাকে, ঐ-সকলের বাইরে চলিয়া যান। সমুদয় নিয়মের বাইরে চলিয়া যান, সমগ্র জগৎ উড়িয়া যাক—আপনি একলা আসিয়া দাঁড়ান। ‘আমি নিরপেক্ষ সত্তা, নিরপেক্ষ জ্ঞান, ও নিরপেক্ষ আনন্দস্বরূপ সৎ-চিৎ—আনন্দ সোহহং, সোহহম্।’

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.