নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আপনজনে ছেড়ে দূরে কোথাও অবস্থান করা কতটা কষ্টের সেটা ভূক্তভোগী ছাড়া অন্যকেহ সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারার কথা নয় । প্রিয়জন বিয়োগের সে সময়টা যদি দীর্ঘ পাঁচ বছর বা তারও বেশি সময়ের হয় তবে তো কষ্টের সীমা নাই । প্রতিক্ষনে আত্মীয় স্বজনের কথা স্মরণ করে চোখের পানি বিসর্জন ছাড়া কোন গত্যন্তরও নাই । যিনি তার আত্মীয় স্বজন থেকে দূরে থাকেন তিনি যেমন সীমাহীন কষ্টে ভোগেন তেমনি যাদেরকে ছেড়ে থাকেন তারাও সারাক্ষন দুশ্চিন্তায় কাটান । প্রতি মূহুর্তে আপনজনের মূখগুলো স্মৃতির মনি কোঠায় উঁকি দেয় । অতীতের কত স্মৃতি রোমন্থিত হয় অথচ নিরুপায় । ইচ্ছা থাকলেও জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে দীর্ঘকাল কাটাতে হবে বিদেশে বিভূঁইয়ে । উদ্দেশ্য যে কেবল নিজের আর্থিক স্বাবলম্বন তা কিন্তু নয় বরং তাদের শ্রম বিক্রির টাকায় উপকৃত হয় দেশের অর্থনীতি । সচল থাকে দেশের অর্থনীতির চাকা । তাদের প্রেরিত রেমিটেন্স ব্যবহার করে ব্যাংক তার রিজার্ভ বৃদ্ধি করে । যাদের শ্রমের বিনিময়ে একটি দেশের অর্থনীতি সম্মৃদ্ধিশালী হয় সেই শ্রমিকরা প্রবাস জীবনে কত অমানবেতর জীবন-যাপন করে তা আমাদের অনেকেরই অজানা । কখনো খোঁজ নেবারও প্রয়োজন মনে করি না । তাদের নিয়ে আমরা গর্ববোধ করি, তাদের পাঠানো টাকায় আয়েশি জীবন-যাপন করি অথচ তাদের দুঃখের ভাগীদার আমরা কতজন হতে পেরিছি ? দেশের দক্ষ, অর্ধদক্ষ কিংবা অদক্ষ শ্রমিকরা হাজার মাইল পাড়ি দেয় যাতে আত্মীয় স্বজন নিয়ে ভবিষ্যত জীবন নির্ভরতায় কাটানো যায় । তাদের লালিত সে স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে কত বাঁধার সম্মূখীন হয়ে বিরামহীন শ্রম দিয়ে দেশ ও দেশের মানুষকে বিশ্বের বুকে প্রতিষ্ঠা পাওয়াতে চেষ্টা করে অথচ তাদেরকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে আমরা অপমান, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করি, তাদেরকে বিভিন্ন স্থানে হয়রানির করা হয়, বিদেশে তাদের সমস্যাগুলো দেখার, সমাধান করার এমনকি তাদের সুখ দুঃখের অংশীদার হওয়ারও মানুষ খুঁজে পাওয়া যায় না । সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ শ্রম বিক্রির উদ্দেশ্যে বিদেশ পাড়ি দেয়ার পর সেখানে গিয়ে কোন দূর্ঘটনা কিংবা অন্যকোন কারনে মৃত্যুবরণ করে তখন তাদের লাশটিও সঠিক সময়ে দেশের বাড়িতে পৌঁছানোর ব্যাপারে হেলাফেলা করা হয় । নামকা ওয়াস্তে রাষ্ট্রীয়ভাবে সামান্য কিছু টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়া হলেও বিদেশ থেকে প্রাপ্ত ক্ষতিপূরনের টাকা লাপাত্তা হয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটে ।
বাংলাদেশ থেকে ১৭৭৬ সালে সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিকভাবে জনশক্তি বিনিময় শুরু হয় । পরবর্তীতে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাসনামালে এ কার্যক্রম ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত রুপ লাভ করে । সরকারি হিসেবে মতে, ১৯৭৬ সাল থেকে শুরু করে ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রায় ৮৭ লাখ ১৭ হাজার বাংলাদেশী বৈধভাবে বিদেশে কর্মরত আছে । তবে বেসকারী হিসেবে বিদেশী কর্মরত বৈধ এবং অবৈধ শ্রমিকের সংখ্যা ১ কোটির্ উপরে । এ শ্রমিকদের মধ্যে প্রায় ৮৫ শতাংশ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে কর্মরত । এছাড়াও মালয়েশিয়া, মিশর, সিঙ্গাপুর, দক্ষিন কোরিয়া, দক্ষিন আফ্রিকা, ইতালীসহ প্রায় অর্ধশতাধিক দেশে বাংলাদেশের দক্ষ, অর্ধদক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিকরা কর্মরত । ২০১৩ সালের প্রায় অর্ধেকটা জুড়ে দেশব্যাপী রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করলেও অর্থনৈতি অবস্থা সচল ছিল । বিশেষজ্ঞদের ধারনা, দেশে রাজনৈতিক যে অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল তাতে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা বিকল হয়ে যেত যদি-না বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশীদের রেমিটেন্স না আসত । বর্হিবিশ্বে কর্মরত বাংলাদেশীদের পাঠানো রেমিটেন্স অর্থনৈতিক সেক্টরে এক নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছে । বাংলাদেশ ব্যাংক প্রদত্ত তথ্য মতে, সাম্প্রতিক বৈদেশিক মুদ্রার মজুত ২ হাজার ১০০ কোটি ( ২১ বিলিয়ন) ডলার ছাড়িয়েছে । যা বাংলাদেশ সৃষ্টির পরবর্তী সময়ে নতুন রেকর্ড । বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র আরও জানিয়েছে, চলতি অর্থবছরে গত ১১ মাসে প্রবাসীরা দেশে পাঠিয়েছে ১ হাজার ২৯২ কোটি ডলারের বেশি । জুন মাসের ১৫ দিনে প্রায় ৬০ কোটি ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছে প্রবাসীরা । তাদের প্রেরিত রেমিটেন্স বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ১৩% এর বেশি অবদান রাখছে । যা দেশের অর্থনৈতিক অগ্রসরতার জন্য ইতিবাচক দিক । প্রবাসীদের পাঠানো টাকার এ ধারা চলতে থাকলে অচিরেই দেশ অর্থনৈতিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে সক্ষম হবে ।
সকল মৃত্যুই কষ্টকর । তবে আত্মীয় স্বজনের উপস্থিতিতে মৃত্যু আর একাকী মৃত্যুর মধ্যে রযেছে বড় বেশি দূরত্ব । স্বাভাবিক মৃত্যুর চেয়ে অস্বাভাবিক মৃত্যু আত্মীয়-স্বজন পাড়া-পড়শীসহ সকলকেই বেশি কষ্ট দেয় । যাদের কল্যানে দেশ অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর হওয়ার পথে যাত্রা শুরু করেছে সেই তাদের মৃত্যু হার অস্বাভাবিক ভাবে বাড়ছে । মৃত্যুবরণকারী এসকল শ্রমিক ভাই-বোনদের অধিকাংশে মৃত্যু হয়েছে বিভিন্ন দূর্ঘটনায় । গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় শ্রম ও প্রবাসী কল্যান মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন ২৯শে জুন জাতীয় সংসদে প্রশ্নত্তোরের সময় জানিয়েছেন, গত পাঁচ বছরে বিদেশে কর্মরত অবস্থায় মারা যাওয়া প্রায় ১৫ হাজার অভিবাসী শ্রমিকের মৃতদেহ দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে । বেসরকারী জরিপ মতে, গত ৫ বছরে প্রায় ১৯ হাজার শ্রমিক বিভিন্ন দেশে মৃত্যুবরণ করেছে বলে উল্লেখ করেছে । অধিকাংশ সময় শ্রমিকদের মৃত্যুর কারন হিসেবে ‘হার্ট এ্যাটাকের’ কথা উল্লেখ করা হয় । তবে অভিবাসী শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করে এমন একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা সাকীউল মিল্লাত মোর্শেদের মতে, মেডিকেল পরীক্ষায় উন্নীত যে সকল সুস্বাস্থ্যের অধিকারী যুবক-যুবতীরা বিভিন্ন কাজের খোঁজে বিদেশে যায় তাদের অভিবাসী অবস্থায় কেন, কি পরিস্থিতিতে তাদের মৃত্যু হয়, তার সঠিক কারন জানা সম্ভব হয় না । তবে বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের মতে, শ্রমিকদের মৃত্যুর কারন হিসেবে হার্ট এ্যাটাক উল্লেখ করা হলেও এটা সম্পূর্ণ সঠিক নয় । কিছু সংখ্যক শ্রমিক হ্যাট এ্যাটাক জনিত কারনে মৃত্যুবরন করলেও বেশিরভাগ শ্রমিকের মৃত্যু হয় অস্বাস্থ্যকর বা অনিরাপদ পরিবেশে কাজ করার কারনে ।
যাদের অক্লান্ত চেষ্টা, ঘাম জড়ানো পরিশ্রমের টাকায় দেশের অর্থনীতির চাকা সচল আছে তারা প্রবাসে কেমন আছে, তাদের কোথায় কোথায় সমস্যা আছে, সেগুলোকে চিহ্নিত করে তার সমাধানের আশু পদক্ষেপ গ্রহন জরুরী । প্রায়ই শোনা যায়, বিদেশে বাংলাদেশীদের বিভিন্নভাবে হয়রানি করা হয় । এটা কাম্য নয় । বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের দুতাবাসে যে সকল রাষ্ট্রদুতবৃন্দ কর্মরত আছে তাদেরকে উদ্যোগী হতে হবে । যে সকল দেশে বাংলাদেশের শ্রমিকরা কাজ করে সে সকল দেশের কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান খুঁজতে হবে । প্রয়োজনে দ্বি-পাক্ষীয় চুক্তি করা যেতে পারে । ভূল বোঝাবুঝির কারনে যে সকল দেশের শ্রম বাজার বাংলাদেশীদের জন্য বর্তমানে বন্ধ আছে তা খোলার জন্য চেষ্টা চালাতে হবে । অধিক জনসংখ্যা কবলিত দেশ হওয়ার কারনে দেশে বেকার সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে । গবেষণার তথ্য মতে, আমাদের দেশে মোট জনশক্তির ৩০% বেকার । যা সংখ্যায় প্রায় ৯৬ লাখ । কোন অবস্থাতেই এ সংখ্যক বেকারের কর্মস্থল বাংলাদেশে করা সম্ভব নয় । কাজেই সরকারকে উদ্যোগী হয়ে শীঘ্রই বিভিন্ন দেশের সরকারের সাথে আলোচনা করে আন্তর্জাতিক শ্রম বাজারকে নিজেদের জন্য উম্মূক্ত করার ব্যবস্থা করতে হবে । দক্ষিন কোরিয়াসহ যে সকল দেশে পূর্বে বাংলাদেশীদের জন্য শ্রম বিক্রির সুযোগ ছিল যা বর্তমানে বন্ধ আছে সেগুলো খোলার ব্যবস্থা এবং যে দেশগুলো এখনো বাংলাদেশের শ্রমিকদের জন্য শ্রম বাজার উম্মুক্ত করে নি তাদের সকলের সাথে আলাপ করতে হবে । দেশ এবং জাতির প্রয়োজনে এ পদক্ষেপ গ্রহন করা প্রয়োজন । দেশের অধিক জনসংখ্যাকে জনসম্পদের রুপান্তরিত করার ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে । বিভিন্ন প্রকার কর্মমূখী শিক্ষা প্রচলনের উপর গুরুত্বারোপ করতে হবে । বাংলাদেশের কোন শ্রমিক যেন অদক্ষ কিংবা অর্ধদক্ষ না থাকে তার ব্যবস্থা রাষ্ট্রকেই নিতে হবে । বিভিন্ন প্রশিক্ষনের মাধ্যমে সকল শ্রমিককে দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে । সকল শ্রমিককে দক্ষ করে বিদেশে প্রেরণ করতে পারলে তাদের আয়ের পরিমান বহুগুনে বৃদ্ধি পাবে । শ্রমিকের এ উন্নতির সুফল যেমন শ্রমিক ভোগ করবে তেমনি রাষ্ট্রও লাভবান হবে । বিশেষ করে বর্তমানে যে শ্রমিকর বিভিন্ন দেশে কর্মরত আছে তাদের স্বার্থরক্ষার জন্য সরকারের উদার দৃষ্টি ভঙ্গি এবং কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহন আশু আবশ্যক ।
রাজু আহমেদ । কলাম লেখক ।
©somewhere in net ltd.