নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সংবিধান স্বাধীন রাষ্ট্রের চালিকা শক্তি । একটি দেশের সংবিধান যত উত্তম হবে দেশের উন্নয়ণ ততো বেশি ত্বরান্বিত হবে । সাংবিধানিকভাবে যদি রাষ্ট্রের সকল বিভাগ পরিচালিত হয় তবে রাষ্ট্রের সকল দায়িত্বশীলরা যেমন তাদের কর্তব্য পালনে বাধ্য থাকে তেমনি জনগণও রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনে উৎসাহী হয় । সংবিধানের সংজ্ঞায় বলা যায়, সংবিধান হচ্ছে যে কোন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন, যা অন্যান্য আইন এবং সরকারকে নিয়ন্ত্রন ও পরিচালনা করে । একটি রাষ্ট্রের উত্তম সংবিধানের মাধ্যমে জনগণের ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটে এবং শাসক ও শাসিতের সম্পর্ক নির্ণীত হয় । বাংলাদেশের সংবিধান উত্তম তবে এ সংবিধানকে বারবার সংশোধন করার মাধ্যমে জনগণের অধিকার কতটুকু সংরক্ষিত রাখা হচ্ছে তা নিয়েই যত প্রশ্ন । ১৯৭২ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশের সংবিধান কার্যকরী হওয়ার পরে মাত্র ৪৩ বছরে ১৬ বার সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে । সাংবিধানিকভাবে সরকার সংসদীয় আসনের দুই-তৃতীয়াংশ আসন লাভ করলে সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতা লাভ করে কিন্তু বর্তমান সংসদ কতটুকু গণতান্ত্রিক এবং আন্তর্জাতিক বিশ্বের কাছে কতটুকু গ্রহনযোগ্য সেটা নিয়েই যত প্রশ্ন ? স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে সংবিধান প্রনয়ণের পরে এখন পর্যন্ত যে ১৬ বার সংবিধান সংশোধন হয়েছে তার মধ্যে মাত্র কয়েকবার জনগণের কল্যানে সংবিধান সংশোধণ করা হলেও অধিকাংশ সময়ে সংবিধান সংশোধনে তাড়াহুড়া কিংবা জনগণের মতামতের তোয়াক্কা না করে সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে । সংবিধানের ১৫তম সংশোধনীর কিছু অংশতে এবং ১৬তম সংশোধনীর পূর্ণ অংশে দেশের সিংহভাগ মানুষ ভিন্নমত পোষণ করলেও সরকার তাতে মোটেও কর্ণপাত না করে তাদের মনোবাসনা পূর্ণ করেছে ।
সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. কামাল হোসেন চৌধুরীর নেতৃত্বে রচিত সংবিধান ১৯৭২ সালের ৪ঠা নভেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে সংবিধান প্রণীত হয় এবং একই বছরের ১৬ই ডিসেম্বর থেকে তা কার্যকরী হয় । ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ১৬তম সংশোধনীসহ এটির মোট ১৬ বার সংশোধনী হয়েছে । সংবিধানের প্রথম সংশোধনী হয় ১৯৭৩ সালের ১৭ই জুলাই । এ সংশোধনের উদ্দেশ্য ছিল যুদ্ধাপরাধীসহ অন্যান্য গণবিরো্ধীদের বিচার নিশ্চিত করা । দ্বিতীয় সংশোধনী ২২শে সেপ্টেম্বর ১৯৭৩, তৃতীয় সংশো্ধনী ২৭শে নভেম্বর ১৯৭৪, চতুর্থ সংশোধনী ২৫শে জানুয়ারী ১৯৭৫ । সংবিধানের চতুর্থ সংশোধণীর উদ্দেশ্য ছিল সংসদীয় শাসন পদ্ধতির পরিবর্তে রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসন পদ্ধতি চালু এবং বহুদলীয় রাজনীতির পরিবর্তে একদলীয় রাজনীতি প্রবর্তন । সংবিধানের ৫ম সংশোধনী হয় ১৯৭৯ সালের ৪ঠা এপ্রিল । পঞ্চম সংশোধনের উদ্দেশ্য ছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্টের সামরিক অভ্যূত্থানের পর থেকে ১৯৭৯ সালের ৫ই এপ্রিল পর্যন্ত সামরিক সরকারের যাবতীয় কর্মকান্ডের বৈধতা দান । সংবিধানের ৬ষ্ঠ সংশোধনী হয় ১৯৮১ সালের ৯ই জুলাই, ৭ম সংশোধনী হয় ১৯৮৬ সালে ১০ই নভেম্বর, ৮ম সংশোধনী হয় ১৯৮৮ সালের ৯ই জুন, ৯ম সংশোধনী হয় ১৯৮৯ সালের ১১ই জুলাই, ১০ম সংশোধনী হয় ১৯৯০ সালের ২৩শে জুন, ১১তম সংশোধনী হয় ১৯৯১ সালের ১০ই আগষ্ট । সংবিধানের ১২তম সংশোধনী হয় ১৯৯১ সালের ১৮ই সেপ্টেম্বর । এ সংশোধনের উদ্দেশ্য ছিল, সংসদীয় পদ্ধতির পূণঃপ্রবর্তন ও উপরাষ্ট্রপতির পদ বিলুপ্তি । সংবিধানের ১৩তম সংশোধনী আনা হয় ১৯৯৬ সালের ২৮শে মার্চ । এ সংশোধনীর উদ্দেশ্য ছিল, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নিরপেক্ষ-নির্দণীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন । ১৪তম সংশোধনী আনা হয় ২০০৪ সালের ১৭ই মে । সংবিধানের সবচেয়ে আলোচিত-সমালোচিত সংশোধনী আনা হয় ২০১১ সালের ৩রা জুন । সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর উদ্দেশ্য ছিল, বিল ২০১১ প্রস্তাবনার সংশোধন, ১৯৭২ এর মূলনীতি পূর্নবহাল, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্তিকরণ ১/১১ পরবর্তী দ্বিতীয় তত্ত্ববধায়ক সরকার নিয়ম বহিভূর্তভাবে ৯০ দিনের অধিক ক্ষমতায় থাকার বিষয়টি প্রমার্জ্জনা, নারীদের জন্য ৫০ আসন সংরক্ষণ, নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা বৃদ্ধি ইত্যাদি আইন । সংবিধানের ১৬তম সংশোধনী হয়েছে ১৭ই সেপ্টেম্বর ২০১৪ ।
সংবিধানের ১৬তম সংশোধনে বিচারপতিদের অভিসংশনের ক্ষমতা সংসদের কাছে ন্যস্ত করা হয়েছে । এ নিয়ে দেশব্যাপী হরতাল পালনসহ বিভিন্ন আন্দোলন কর্মসূচী পালন করা হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি । স্বয়ং বিচারকদের একাংশ আশঙ্কা করছেন, বিচারকদের অভিসংশনের ক্ষমতা সংসদের হাতে প্রত্যাবর্তনের ফলে ন্যায় বিচার চরমভাবে ব্যাহত হবে । বিচারকরা প্রত্যেকটি রায় দেয়ার পূর্বে তাদের অবস্থানের ভবিষ্যত নিয়ে ভাবতে বাধ্য হবেন । কাজেই সংবিধানের সংশোধন ক্ষমতা সাংসদদের কাছে থাকলেও সংবিধানের ১৬তম সংশোধন দেশের বিচার বিভাগের জন্য মারাত্মক হুমকির হবে । সংবিধানের ১৬তম সংশোধনীর ক্ষেত্রে তাড়াহুড়া করার কারনে জনমনে ব্যাপক প্রশ্ন দানা বেঁধেছে । ৭ই সেপ্টেম্বর বিল উত্থাপণের মাত্র ১০ দিনের মাথায় অর্থ্যাৎ ১৭ই সেপ্টম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশো্ধনী পাশ হয়ে গেল ।
সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের সংবিধান এতটা ত্রুটিযুক্ত নয়, যে কারনে বাংলাদেশের সংবিধান মাত্র ৪৩ বছরে ১৬ বার সংশোধন করতে হল । স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের কোন সরকারই পূর্ণাঙ্গ জনমতের উপর প্রধান্য দিয়ে সংবিধান সংশোধন করে নি । কোথাও না কোথাও শাসক দলের স্বার্থ লুকায়িত ছিল । একটি উত্তম সংবিধান হিসেবে সংবিধানের যে বৈশিষ্ট্যগুলো থাকা দরকার অর্থ্যাৎ সুস্পষ্টতা, সংক্ষিপ্ততা, স্থায়ীত্ব, ব্যাপকতা, লিখিত রুপ, মৌলিক অধিকার নিশ্চিতকরণ, উত্তম সংশোধন পদ্ধতি, সময়োপযোগী, ভারসাম্য রক্ষা, জনমতের অগ্রাধিকার, স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা, গণতন্ত্র কিংবা আইনের অনুশাসন থাকার পরেও কেন যথেচ্ছ বিতর্ক সৃষ্টি করে কিছু মানুষের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য সংশোধনী আনা হচ্ছে তা নিয়েই যত প্রশ্ন । বিশ্বের অন্যান্য উন্নত এবং স্থির গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায় বাংলাদেশ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন রুপ । বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান ১৭৮৯ সালে কার্যকরী হওয়ার পরে তা অদ্যাবধি বেশ ভালো ভাবেই চলছে । অথচ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সংবিধানের ২২৫ বছরের ইতিহাসে সংশোধন করতে হয়েছে মাত্র ২৬ বার । বাংলাদেশের সংবিধানের ১৬তম সংশোধনী আনতে সময় লেগেছে মাত্র ১০ দিন অথচ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের ২২তম সংশোধনী আনতে সময় লেগেছিল ৩ বছর ৩৪০ দিন । তাদের সংবিধান সংশোধনে প্রতিবার জনমত প্রধান্য পেয়েছে অথচ আমাদের সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে ?
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক এরিস্টটল সংবিধানে সংজ্ঞায় বলেছেন, ‘Constitution is the way of life the state has chosen for itself.’ সুতরাং রাষ্ট্রের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে কতিপয় মানুষের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য বার বার সংবিধানের সংশোধনী এনে সংবিধানকে প্রশ্নবিদ্ধ করার কোন অর্থ নেই । বিশেষ প্রয়োজন অর্থ্যাৎ রাষ্ট্রের সকল মানুষের স্বার্থ রক্ষায় যদি সংবিধান সংশোধন করতেই হয় তবে সংবিধান প্রনয়ণে যারা কাজ করেছিল তাদের মধ্যে যারা বেঁচে আছে তাদের এবং নিরপেক্ষ ব্যক্তিবর্গের পরামর্শ নিয়ে সংবিধান সংশোধন করা উচিত । বাংলাদেশের সংবিধান বার বার অধ্যয়ণ করে মনে হয়েছে বিশ্বের মধ্যে কোন রাষ্ট্রের যদি একটি উত্তম সংবিধান থেকে থাকে তবে সেটি বাংলাদেশের । সুতরাং এ সংবিধানকে সংশোধনের নামে এমন কোন পরিবর্তন আনা উচিত হবে না যার কারনে সংবিধানের প্রতি রাষ্ট্রের জনগণের প্রশ্ন জাগে এবং শাসক শ্রেণীর উপর বিরক্তি জন্মে । কোন ব্যাপারে ক্ষমতা থাকলে তা যত্রতত্র প্রয়ো্গ করা বুদ্ধিমানের কাজ হতে পারে কী ? ৪৩ বছরে মাত্র ১৬বার কেন প্রয়োজনে আরও অধিকবার সংবিধান সংশোধন করা যাবে যদি তা রাষ্ট্রের প্রয়োজনে হয় কিন্তু ব্যক্তি স্বার্থে কিংবা ক্ষমতা স্থায়ী করার জন্য একবারও সংবিধান সংশোধন করা উচিত নয় ।
রাজু আহমেদ । কলামিষ্ট ও সাংবাদিক ।
[email protected]
©somewhere in net ltd.