![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
চলমান সময়ে গান-বাজনা ও বিভিন্ন ধরনের বাদ্যযন্ত্র আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের সঙ্গে বিভিন্নভাবে জড়িত। আমাদের প্রতিটি দিনের অনেকটা সময় এই গান ও বাদ্যযন্ত্রের সাথেই কেটে যায়।
গান ও বাদ্যযন্ত্র সম্পর্কে ধর্মের বিধানের কথা তোয়াক্কা না করেই জীবন পার করে দিচ্ছি। অনেকে হয়ত জেনে কাজগুলো করছি আবার অনেকে হয়ত না জেনে। আর তাই এই বিষয় সম্পর্কে জানানোর লক্ষে আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় ইসলামের দৃষ্টিতে গান ও বাদ্যযন্ত্র সম্পর্কে বিধি নিষেধ।
ইসলামে গান ও বাদ্যযন্ত্রের বিধান সম্পর্কে কোরআন ও হাদিসে উল্লেখ রয়েছে। মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআন মাজীদে বলেছেন যে, "আর মানুষের মধ্য থেকে কেউ কেউ না জেনে আল্লাহর পথ থেকে মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য বেহুদা কথা খরিদ করে, আর তারা সেগুলোকে হাসি-ঠাট্টা হিসেবে গ্রহণ করে; তাদের জন্য রয়েছে লাঞ্ছনাকর আজাব।" (সূরা: লুকমান, আয়াত নং: ০৬-০৭)
উক্ত আয়াত দ্বয়ের শানে নুযূলে বলা হয়েছে যে, নযর ইবনে হারিস বিদেশ থেকে একটি বাঁদী (গায়িকা) খরিদ করে এনে তাকে গান-বাজনায় নিয়োজিত করল। কেউ কোরআন শ্রবণের ইচ্ছা করলে তাকে গান শোনানোর জন্য সে গায়িকাকে আদেশ করত এবং বলত মুহাম্মাদ তোমাদেরকে কোরআন শুনিয়ে নামাজ, রোজা এবং ধর্মের জন্য প্রাণ বিসর্জন দেওয়ার কথা বলে। এতে শুধু কষ্টই কষ্ট। তার চেয়ে বরং গান শোন এবং জীবনকে উপভোগ কর। (মাআরিফুল কুরআন ৭/৪)
কোরআন মাজীদের অন্য আয়াতে আছে, ইবলিস-শয়তান আদম সন্তানদের ধোঁকা দেওয়ার আরজী পেশ করলে আল্লাহ তায়ালা ইবলিসকে বললেন, “তোর আওয়াজ দ্বারা তাদের মধ্য থেকে যাকে পারিস পদস্খলিত কর।” (সূরা: আল-ইসরা, আয়াত নম্বর: ৬৪)
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, যে সকল বস্তু পাপাচারের দিকে আহ্বান করে তার সবই ইবলিসের আওয়াজ। বিখ্যাত তাবেয়ী মুজাহিদ (রাহ.) বলেন, ইবলিসের আওয়াজ বলতে এখানে গান ও বাদ্যযন্ত্রকে বোঝানো হয়েছে। আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রাহ.) বলেন, এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, যেসব বস্তু পাপাচারের দিকে আহ্বান করে তার মধ্যে গান-বাদ্যই সেরা। এজন্যই একে ইবলিসের আওয়াজ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। (ইগাছাতুল লাহফান-১/১৯৯)
অপরদিকে গান ও বাদ্যযন্ত্র সম্পর্কিত অসংখ্য হাদিস বর্ণিত হয়েছে:
গান-গায়িকা এবং এর ব্যবসা ও চর্চাকে হারাম বলে রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, "তোমরা গায়িকা (দাসী) ক্রয়-বিক্রয় কর না এবং তাদেরকে গান শিক্ষা দিও না। আর এসবের ব্যবসায় কোনো কল্যাণ নেই। জেনে রেখ, এর প্রাপ্ত মূল্য হারাম।" (জামে তিরমিযী হাদিস: ১২৮২; ইবনে মাজাহ হাদীস: ২১৬৮)
নাসাঈ ও সুনানে আবু দাউদে বর্ণনা করা হয়েছে যে, একদিন হজরত আয়েশা (রা.) এর নিকট বাজনাদার নূপুর পরে কোনো বালিকা আসলে আয়েশা (রা.) বললেন, খবরদার, তা কেটে না ফেলা পর্যন্ত আমার ঘরে প্রবেশ করবে না। অতঃপর তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন যে, "যে ঘরে ঘণ্টি থাকে সেই ঘরে রহমতের ফেরেশতা প্রবেশ করে না।" (সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ননম্বর: ৪২৩১, সুনানে নাসাঈ, হাদীস নম্বর: ৫২৩৭)
সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, "ঘণ্টি, বাজা, ঘুঙুর হলো শয়তানের বাদ্যযন্ত্র।" (সহীহ মুসলিম, হাদীস নম্বর: ২১১৪)
রাসূলুল্লাহ (সা.) আরো ইরশাদ করেন, “আমার উম্মতের মধ্য হতে একদল লোক এমন হবে যারা ব্যভিচার, রেশমি বস্ত্র পরিধান, মদ পান এবং বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার ইত্যাদি হালাল মনে করবে। এবং কিছু লোক এমন হবে যারা একটি পর্বতের নিকটে অবস্থান করবে এবং সন্ধ্যাবেলায় তাদের মেষপালক তাদের নিকট মেষগুলো নিয়ে আসবে এবং তাদের নিকট কিছু চাইবে, কিন্তু তারা বলবে, ‘আগামীকাল ফেরত এসো’। রাতের বেলায় আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে ধ্বংস করে দিবেন এবং তাদের ওপর পর্বত ধসিয়ে দিবেন, বাকি লোকদেরকে তিনি বানর ও শূকরে পরিণত করে দিবেন এবং শেষ বিচারের দিন পর্যন্ত তারা এই অবস্থায় থাকবে”। (সহীহ বুখারী, ভলিউম ৭, বুক ৬৯,সংখ্যা৪৯৪)
উপরোক্ত বাণীর সত্যতা এখন দিনের আলোর ন্যায় পরিষ্কার। গান-বাজনার ব্যাপক বিস্তারের ফলে মানুষের অন্তরে এই পরিমাণ নিফাক সৃষ্টি হয়েছে যে, সাহাবীদের ইসলামকে এ যুগে অচল মনে করা হচ্ছে এবং গান-বাদ্য, নারী-পুরুষের মেলামেশা ইত্যাদিকে বিভিন্ন ভ্রান্ত যুক্তির মাধ্যমে হালাল মনে করা হচ্ছে
বিখ্যাত তাবেয়ী হজরত নাফে (রাহ.) থেকে সহীহ সনদে বর্ণিত, তিনি বলেন, একবার চলার পথে আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বাঁশির আওয়াজ শুনলেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি দুই কানে আঙ্গুল দিলেন। যেনো কিছু শোনা না যায় এবং কিছু দূর গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, হে নাফে! এখনো কি আওয়াজ শুনছ? আমি বললাম 'হ্যাঁ'। অতঃপর আমি যখন বললাম, এখন আর আওয়াজ শোনা যাচ্ছে না তখন তিনি কান থেকে আঙ্গুল বের করলেন এবং বললেন, একদা রাসূলুল্লাহ (সা.) চলার পথে বাঁশির আওয়াজ শুনে এমনই করেছিলেন। (মুসনাদে আহমদ, হাদিস নম্বর: ৪৫৩৫; সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নম্বর: ৪৯২৪ বিখ্যাত তাবেয়ী মুজাহিদ (রাহ.) থেকেও এমন একটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। ইবনে মাজাহ হাদিস: ১৯০১)
গান ও বাদ্যযন্ত্রের ব্যাপারে বিখ্যাত চার মাজহাবের চারজন ইমাম যথা : ইমাম আবু হানীফা (রাহ.), ইমাম মালেক (রাহ.), ইমাম শাফেয়ী (রাহ.)ও ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রাহ.) অভিন্ন সিদ্ধান্ত প্রদান করেছেন। সকলেই গান-বাদ্যকে হারাম বলে আখ্যায়িত করেছেন।
ইমাম মালেক (রাহ.)-কে গান-বাদ্যের ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, "কেবল ফাসিকরাই তা করতে পারে।" (কুরতুবী ১৪/৫৫)
ইমাম শাফেয়ী (রাহ.) বলেছেন যে, “গান-বাদ্যে লিপ্ত ব্যক্তি হলো আহমক।” তিনি আরো বলেন, “সর্বপ্রকার বীণা, তন্ত্রী, ঢাকঢোল, তবলা, সারেঙ্গী সবই হারাম এবং এর শ্রোতা ফাসেক। তার সাক্ষ্য গ্রহণ করা হবে না।” (ইগাছাতুল লাহফান ১/১৭৯; কুরতুবী ১৪/৫৫)
হাম্বলী মাযহাবের প্রখ্যাত ফকীহ আল্লামা আলী মারদভী লেখেন, “বাদ্য ছাড়া গান মাকরূহে তাহরীমী। আর যদি বাদ্য থাকে তবে তা হারাম।” (আহসানুল ফাতাওয়া ৮/৩৮৮)
ইমাম শাফেয়ী (রাহ.) শর্তসাপেক্ষে শুধু ওলীমা অনুষ্ঠানে দফ বাজানোর অবকাশ আছে বলে মত দিয়েছেন। কেননা বিয়ের ঘোষণার উদ্দেশ্যে ওলীমার অনুষ্ঠানে দফ বাজানোর অবকাশের বর্ণনা হাদীসে রয়েছে। (জামে তিরমিযী হাদীস : ১০৮৯; সহীহ বুখারী হাদীস: ৫১৪৭, ৫১৬২)
মনে রাখতে হবে, এখানে দফ বাজানোর উদ্দেশ্য হলো বিবাহের ঘোষণা, অন্য কিছু নয়। (ফাতহুল বারী ৯/২২৬)
পরিষেশে বলা যায় যে, উল্লেখিত কোরআন ও হাদীসের আলোকে এ কথা স্পষ্ট যে, গান বাজনা ও মদপান ইত্যাদির মধ্যে কোনো পার্থক্য নাই। যেমনিভাবে মদ পান করলে মানুষে স্বাভাবিক জ্ঞানবুদ্ধি লোপ পায় তেমনিভাবে গান বাজনাও মানুষকে পথভ্রষ্ট করে এবং মানুষের মধ্যে নিফাকের সৃষ্টি করে। তাই গান ও বাদ্যযন্ত্র ইসলামের দৃষ্টিতে পরিত্যাজ্য।
©somewhere in net ltd.