নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

রমিত

মুক্তিযুদ্ধের সেই উত্তাল দিনুলোতে, অজস্র তরুণ কি অসম সাহসিকতা নিয়ে দেশমাতৃকাকে রক্ষা করেছিল!

রমিত

মুক্তিযুদ্ধের সেই উত্তাল দিনুলোতে, অজস্র তরুণ কি অসম সাহসিকতা নিয়ে দেশমাতৃকাকে রক্ষা করেছিল! ব্যাটা নিয়াজী বলেছিলো, “বাঙালী মার্শাল রেস না”। ২৫শে মার্চের পরপরই যখন লক্ষ লক্ষ তরুণ লুঙ্গি পরে হাটু কাদায় দাঁড়িয়ে অস্র হাতে প্রশিক্ষন নিতে শুরু করল, বাঙালীর এই রাতারাতি মার্শাল রেস হয়ে যাওয়া দেখে পাকিস্তানি শাসক চক্র রিতিমত আহাম্মক বনে যায়। সেই অসম সাহস সেই পর্বত প্রমাণ মনোবল আবার ফিরে আসুক বাংলাদেশের তরুণদের মাঝে। দূর হোক দুর্নীতি, হতাশা, গ্লানি, অমঙ্গল। আর একবার জয় হোক বাংলার অপরাজেয় তারুণ্যের।

রমিত › বিস্তারিত পোস্টঃ

নওরিন এসেছে

০৪ ঠা জুলাই, ২০২০ দুপুর ১:১৪

নওরিন এসেছে
----------------------------------রমিত আজাদ



নওরিন এসেছে - পর্ব ১
----------------------------------রমিত আজাদ

পাঁচ রঙের পাঁচটি কার্নেশন ফুল হাতে নিয়ে সেদিন ভীড় ও আঁধারে মিলিয়ে গিয়েছিলো নওরিন।
কোটি মানুষের বেদনায় সিক্ত দূষিত বাতাসের ঢাকা নগরীর কোন এক পথে দাঁড়িয়ে আমি তা দেখেছিলাম। মাথার উপরের তারাবিহীন আকাশে জ্বলা কিছু সোডিয়াম লাইটের নিচের টাইলস শোভিত ফুটপাথ ধরে নওরিন চলে গিয়েছিলো পশ্চিমে, আর আমি চলে গিয়েছিলাম পূবে। যেতে যেতে ভেবেছিলাম, 'নওরিন আমার সাথে দেখা করতে আসবে তো!!!???'

এরপর আমি নওরিনের কথা অনেকবার ভেবেছি। মাঝে মাঝে নিজেকে ছেলেমানুষ মনে হয়েছে। মনে পড়েছে সেই আঠারো বছর বয়সের কথা, যখন ল্যান্ড ফোন ছাড়া যোগাযোগের আর কোন মাধ্যম ছিলো না। সেসময় নারী-পুরুষের পরিচয় হতো ঐ ল্যান্ড ফোনে। একবার সমবয়সী এক তরুণীর সাথে ল্যান্ড ফোনে পরিচয় হয়েছিলো আমার। ফোনটা সেই করেছিলো, এ্যাজ ইফ রং নাম্বারে ফোন করে ফেলেছে! তারপর টুকটাক কথা বলে পরিচয়। পরদিন আবার সে ফোন করেছিলো, কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর মেয়েটি প্রশ্ন করেছিলো, "তুমি কি রাতে আমার কথা ভেবেছিলে?"

ঐ মেয়েটির কথা আমি আসলে কখনো ভাবিনি! তবে নওরিনের কথা ভেবেছিলাম। মানুষের আড়ালে মানুষ থাকে। আমার আড়ালে থাকা মানুষটি মনে মনে চেয়েছিলো, নওরিন যেন আমার সাথে দেখা করে। অপেক্ষা করেছিলাম ও এ্যাটলিস্ট একটা ফোন কল করুক। কিন্তু নওরিন তা করেনি। তারপর মনে হয়েছিলো, এটা তো ওর ব্যাপার, আমি যা চাই ওর মন যে তাই চাইবে, তাতো আর নয়। আমার ভূবন, ওর ভূবন তো আর এক নয়! আমার মতন ও-ও ঘরভাঙা সিঙ্গেল হলেও, ওর সাথে আমার বয়সের পার্থক্যও অনেক!

তারপর মনে হলো, যত স্মার্ট ও আধুনিকাই হোক না কেন, ও তো শেষ পর্যন্ত মেয়েই! বেশিরভাগ মেয়েই স্বপ্রবৃত্ত হয়ে এগিয়ে আসতে পারে না। যারা পারে তাদের সংখ্যা খুব কম। যেমন আকসানা পেরেছিলো। কয়েক বছর আগের কথা, দিন পনেরো অনুপস্থিত ছিলাম ইন্টারনেটে। হঠাৎ আননোন নাম্বার থেকে একটা ফোন পেলাম; ওপাশ থেকে কেউ অস্থির হয়ে বললো, "আমি আকসানা। আপনি সুস্থ আছেন তো? আপনাকে অনেকদিন নেটে দেখি না, তাই দুশ্চিন্তা করছিলাম!" আকসানা-র সাথে যোগাযোগ যা হওয়ার নেটেই হতো, ওর কাছে আমার মোবাইল নাম্বার ছিলো না। তাও সামহাউ নাম্বার যোগাড় করে সে ফোন করেছিলো। বুঝলাম, মনের টান থেকেই ফোন করেছে! নওরিনের কাছ থেকে সেরকম কোন কল না পেয়ে, নিজেই ওকে ফোন কল দেব ঠিক করলাম।

কিন্তু হিউম্যান সাইকোলজি একটা আশ্চর্য্য বিষয়! কেন যেন ওকে আর কল দিতে পারিনি! বহুবার মোবাইল হাতে নিয়েছিলাম ওকে কল দেব বলে। কিন্তু কল আর দেয়া হয় নি।

এদিকে হঠাৎ করেই বিপর্যয় নেমে এলো পৃথিবীতে। এমনটি আমার জীবদ্দশায় দেখেছি বলে তো মনে পড়ে না! খুব সম্ভবত গত বৎসর সেপ্টেম্বর মাসের দিকে আস্তে ধীরে ভেসে এলো সংবাদটি - কি এক ভাইরাসের কবলে পড়েছে চীন। তারপর জানা গেলো, উহান প্রদেশে অনেকেই মারা যাচ্ছে এই প্রাণঘাতি ভাইরাসে! সমাজতান্ত্রীক ও ডিক্টেটরশীপের দেশগুলোয় বাকস্বাধীনতা, প্রেস-ফ্রীডম না থাকার কারণে সংবাদ বের হয় খুব ধীরে ও দেরীতে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাংবাদিকতা করতে চায় না সবাই। অনেক সময় ইচ্ছা থাকলেও সুযোগ থাকে না! Allodoxaphobia বা জনমতভীতি এই সকল দেশগুলোর শাসকদের একটা বড় ধরনের সমস্যা। তবে যা হয় আর কি, গণহারে মৃত্যুর সংবাদ তো আর ঠেকিয়ে রাখা যায় না। সংবাদ বের হতে শুরু করলো নানা মাধ্যম দিয়ে। সেই সাথে শুরু হলো এর সম্ভাব্য কারণ সম্পর্কে নানান গুঞ্জন। Media Skepticism-এর কারণে জনগণ এখন আর এলিগার্খ নিয়ন্ত্রিত মেইনস্ট্রীম মিডিয়াগুলোকে বিশ্বাস করতে চায় না। সবাই দিনদিন ঝুঁকে পড়ছে সোশাল মিডিয়ার উপর। যার ফলাফল আরো ভয়াবহ! রাম-শাম-যদু-মধু সবাই পোস্টায়, কিছু সত্য নিউজের পাশাপাশি ভূয়া নিউজেরও ছড়াছড়ি! সোশাল মিডিয়ার বদৌলতে মত প্রকাশে মেট্রিক ফেলও বড় স্পেশালিস্ট!

আমি খুব একটা ভড়কাই নাই এই সংবাদে। এমন কতই তো শুনে আসছি সেই তিন দশক ধরে! কখনো সার্স, কখনো বার্ডস ফ্লু, কখনো সোয়াইন ফ্লু, কখনো ম্যাড কাউ ডিজিস, ইত্যাদি। ইভেন্টগুলো পানির মধ্যে বুদবুদের মত ফুস করে জেগে আয়তনে বড় হতে হতে দ্রুত গতিতে উপরে ওঠে তারপর পৃষ্ঠতলে এসে ঠাস করে ফেটে যায়! না, এইসব ঘটনাবলীকে কেন যেন আমার কাছে মহামারীর চাইতে রাজনীতিই বেশি মনে হয়েছে! মনে বারবার প্রশ্ন জেগেছে, এসবের লক্ষ্যবস্তু প্রতিবারই চীন কেন, বা সাউথ কেন? ইস্ট-ওয়েস্ট রাজনীতি গত হয়েছে রোম-পারস্য সাম্রাজ্যের বিলুপ্তির সাথে। তার সর্বশেষে বিলুপ্তি হয়েছে, বৃটিশ সাম্রাজ্যের ফিজিকাল পতনের সাথে। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে শুরু হয়েছে নতুন রাজনীতি -- নর্থ-সাউথ রেষারেষি রাজনীতি। সেই নতুন রেষারেষির ফল হয়তো এগুলো। আমার মনে পড়ে, বার্ড ফ্লুর সংবাদ ছড়ালে আমি স্বজনদেরকে চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেছিলাম, "বার্ড ফ্লু বলে কিছু নাই। এশিয়ার পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রী ধ্বংস করার জন্য পশ্চিমাদের এটা একটা অপপ্রচার!" তাদের দেখিয়ে দেখিয়ে আমি মুরগীর মাংস খেয়েছিলাম তখন।

যাহোক, করোনা ভাইরাস নামক নতুন গুঞ্জিত এই মহামারীটিকেও তেমন গুরুত্ব দেই নি। বন্ধু-বান্ধবের মধ্যে কথোপকথন এমন ছিলো, 'এটা কেন হলো?" 'চীনে হঠাৎ এমন ভাইরাস কেন এলো?' চীনারা যে কি করে!" 'চীনারা যে পরিমানে সাপ-ব্যাঙ-বাদুর-ইঁদুর ইত্যাদি হাবিজাবি খায়, এজন্যই তো এই দশা!" 'বিষাক্ত সাপ থেকে ছড়িয়ে পড়েছে এই ভাইরাস', 'বাদুর থেকে ছড়িয়ে পড়েছে এই ভাইরাস', 'নাউজিবিল্লাহ্! এইসব খায় বলেই আজ এই অবস্থা!' 'আরে, চীনারা কি, আজকে প্রথম খাওয়া শুরু করলো নাকি, এইগুলা? ওরা তো হাজার হাজার বছর ধরেই সাপ-ব্যাঙ-তেলাপোকা-টিকটিকি-আর্জিনা সবই খায়! তাহলে এখন হঠাৎ মহামারী হবে কেন?' 'আরে না, চীনাদের কোন দোষ নাই। আগের মতই এটা আমেরিকার রাজনীতি। ঐ যে সৈন্যদের অলিম্পিক গেমটা হলো, তারপরই তো মহামারীটা ছড়ি্য়ে পড়লো। মানে কি? মার্কিন সোলজাররা ওটা ছড়িয়ে এসেছে। নতুন বিশ্ব রাজনীতি!', 'কিভাবে বুঝলেন যে ওটা মার্কিনীদের কাজ?' 'না বোঝার কি আছে? দুইয়ে দুইয়ে মেলালে চারই তো হয়! কোথায় কোথায় ছড়িয়েছে দেখেন; চীন, ইরান ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে। তিনটাই যুক্তরাষ্ট্রের তিন রকমের শত্রু!' 'আরে না ভাই, কাজটা চীনাদেরই, লেভেল ফোর-এর একটা ল্যাবরেটরি আছে উহানে, ওটা লীক করেছে। চীনারা মহাশক্তি হয়েছে ঠিকই কিন্তু ওদের ল্যাবরেটরি ম্যানেজমেন্ট তো এখনো দুর্বল।' 'তাহলে ইরানে কেন করোনা ভাইরাস এত ছড়িয়ে পড়লো?' 'ইরানের সাথে চীনের স্ট্রং টাই। চীন-ইরান সব ফ্লাইট চালু ছিলো।' 'সেই ফ্লাইট চালু তো বাংলাদেশের সাথেও ছিলো, তাহলে বাংলাদেশে তখন ছড়ালো না কেন?' 'মনে হয় না, বাংলাদেশে কিছু হবে!', 'আসলে উহানে এখন অনেক শীত। এই শীতে ভাইরাস তাজা থাকে, গরমটা পড়ুক, ভাইরাস মরে যাবে। জাস্ট ওয়েট।' পজেটিভ-নেগেটিভ এমন অনেক কথাবার্তাই বাতাসে ভাসতে লাগলো। তবে সবাই ভাবছিলো, বাংলাদেশ পর্যন্ত আসবে না এই ঢেউ।

ফেব্রুয়ারী মাসে একদিন আমার অফিসে একজন প্রবীন ডাক্তার এলেন। তিনি আবার 'পাবলিক হেলথ'-এরও একজন অধ্যাপক। উনাকে সবাই এই বিষয়ে নানান প্রশ্ন করতে থাকলো। তিনি খুব সুন্দর উত্তর দিলেন - এ ধরনের ঘটনা অতীতেও অনেকবার ঘটেছে, এগুলো কোনটা হয় 'লোকাল' আর কোনটা হয় 'ন্যাশনাল' আবার কোনটা হয় 'প্যানডেমিক'। 'ব্রেক আউট', 'এপিডেমিক', 'প্যানডেমিক', ইত্যাদি বিষয়ের ডাক্তারী কিছু বর্ণনা তিনি দিলেন। সেখানে একজন ইকনোমিস্টের সাথে সংজ্ঞাগত কিছু বিরোধ উনার হলো। যাহোক, ডাক্তার সাহেব উদাহরণ টানলেন, গত শতাব্দীতে হয়েছিলো স্প্যানিশ ফ্লু। তারপর তিনি বললেন, এই সমস্ত এপিডেমি সিচুয়েশনে সব চাইতে বেশী যেই সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়, তা হলো 'ম্যাস গ্যাদারিং' এভয়েড করা। কিন্তু সমস্যা হলো দেশ-সমাজের কর্তা রাজনীতিবিদরা 'পাবলিক হেলথ' যত না বোঝেন তার চাইতে বেশি বোঝেন রাজনীতি। উনাদের কাছে 'রাজনৈতিক ম্যাস গ্যাদারিং'-এর গুরুত্ব অন্য যেকোন কিছুর চাইতেই বেশী। সমাজতান্ত্রীক রাষ্ট্রগুলোতে জনতার কথা কোন কথাই না, স্পেশালিস্ট-সায়েন্টিস্টদের কথা কোন কথাই না, ওখানে কম্যুনিস্ট নেতাদের কথাই শেষ কথা। তাই কোন স্পেশালিস্ট-সায়েন্টিস্ট-দের কথার কোন গুরুত্ব না দিয়ে উহানে দুইটা ম্যাস-গ্যাদারিং করা হয়েছিলো, ফল যা হওয়ার তাই হলো, মহামারী দাবানলের মত ছড়িয়ে গিয়েছে। কেউ কেউ উনাকে প্রশ্ন করেছিলো, 'তাহলে বাংলাদেশে এখন কি করা উচিৎ?' তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশে এখনো তো আক্রান্তের কোন সংবাদ পাইনি, তবে ম্যাস-গ্যাদারিং অবশ্যই এভয়েড করা উচিৎ।

হঠাৎ একদিন নিউজে দেখা গেলো যে, কোন একটি আরব রাষ্ট্র এই মহামারী থেকে বাঁচতে বিভিন্ন দেশের সাথে ফ্লাইট বন্ধ করেছে, সেই তালিকায় বাংলাদেশের নামও আছে! আশ্চর্য্য! বাংলাদেশে তো এখনো কোন ভিক্টিমই পাওয়া যায় নাই, তাহলে ঐ তালিকায় বাংলাদেশের নাম কেন? তারপর একদিন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবেই মহামারী আক্রান্তের ঘোষণা দিলো। তখন আর কেউ সুস্থির থাকতে পারলো না। সবার মনেই ভয় ঘিরে ধরতে থাকলো। বাতাসে গুঞ্জন শোনা গেলো, সব দেশই যখন আক্রান্ত হচ্ছে, তখন বাংলাদেশ আর বাদ থাকবে কেন? করোনা ভাইরাস মহাসাগর অতিক্রম করেছে, আর বাংলাদেশ তো চীনের ঘরের কাছে!

আঠারোই মার্চ হঠাৎ করেই ঘোষিত হলো সাধারণ ছুটি (লক-ডাউন নয়)। আমাকেও অফিসের কার্যক্রম আপাততঃ স্থগিত রাখতে হলো। মাঝে মাঝে নিজের কিছু কাজে অফিসে যেতাম ও বাইরে বের হতাম। যদিও ফেইসবুক ও সোশাল মিডিয়ায় বারবার দেখানো হচ্ছিলো যে ঢাকায় লোকজন লক-ডাউন মানছে না। কিন্তু আমি উত্তর ঢাকার রাস্তাঘাট ফাঁকাই দেখেছি। তাহলে দক্ষিণ ঢাকা বা নগরীর সাধারণ এলাকাগুলোতে রাস্তা মানবপূর্ণ কেন? ভালো করে লক্ষ্য করলে বোঝা যায় যে, তারা কেউই সখে বের হচ্ছে না। বের হচ্ছে জীবনের তাগিদে। অভিজাত এলাকার মানুষের সঞ্চিত অর্থের অভাব নেই। পরিস্থিতির শুরুতেই প্যানিক বায়িং করে তারা ফ্রীজ-ডীপফ্রীজ ভরে ফেলেছে!
প্রয়োজনে তারা ঘরে বসেও বাজার-খাবার বুকিং দিতে পারে। কিন্তু দরিদ্র, নিম্ন-মধ্যবিত্ত-রা কি করবে? আসলে এ ধরনের ডিজাস্টার এলেই সমাজের মুখোশটা খুলে যায়!

আমার বড় বোনের ছেলেটা একদিন ফোন করলো। "মামা কেমন আছো?"
আমি: আছি মামা। আমি আপাতত ভালোই আছি। তবে দেশের মানুষ তো আর ভালো নেই!
ভাগ্নে: মামা, সামনে রমজান আসছে। মানুষ এই দুর্যোগে রমজান পালন করবে কি করে?
আমি: কষ্ট হবে রে মামা। ভীষণ কষ্ট হবে।
ভাগ্নে: মামা, তুমি ঈদে কি করবা?
আমি: আমি আর ঈদে কি করবো? একা মানুষ। ঘরে বসেই কাটিয়ে দেবো।
ভাগ্নে: আমাদের বাসায় আসবা না?
আমি: পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেয় কে জানে? হয়তো কারো বাসায়ই কেউ যেতে পারবে না।
এনিওয়ে থিংক পজেটিভ। আশা করি একদিন মেঘ কেটে যাবে।
ভাগ্নে: তুমি ভাইরাস ভয় পাও না?
আমি: একসময় ভয় পেতাম। আমার অল্পতেই ঠান্ডা লেগে যেত। এখন আর সেই সমস্যা নেই।
ভাগ্নে: কেন?
আমি: আমার একটা ভেষজ চিকিৎসা জানা আছে। ঐটা প্রয়োগ করলে বেঁচে যাই।
ভাগ্নে: কি চিকিৎসা?
আমি: বলবো আরেকদিন। তোর মা হয়তো আমার কথা হেসেই উড়িয়ে দেবে!
ভাগ্নে: কেন?
আমি: ছোট ভাই সে যতই লায়েক হোক না কেন, বড় বোন-রা তাকে সবসময়ই পুঁচকে মনে করে। হা হা হা!!!

নওরিন-এর কথা বলতে গিয়ে কত কথাই না বলে ফেললাম!

যাহোক, রমজান শেষ হয়ে ঈদ-উল-ফিতর আসলো। দিনটা ছিলো পঁচিশে মে (সোমবার), ২০২০ সাল। কি করা যায়? ঘরে বসে থেকে ভালো লাগে না! বিকাল বেলায় বেরিয়ে পড়লাম বাইরে। কোন যানবাহন ছাড়াই। এর আগেও অনেকবার বেরিয়েছি। দিনের এক চিত্র রাতের আরেক চিত্র! রাতে বেরোলে মনটা খারাপ হয়ে যায়, এই মহামারী দুর্যোগের মধ্যেও ঢাকার রাস্তায় মহাসমারোহে আলোকসজ্জা জ্বলছে! বিকালের শেষ দিকে বের হলাম, যাতে বিকাল ও সন্ধ্যা দু'টাই উপভোগ করতে পারি। মাস্ক সাথে নিয়ে বের হলেও, বেশিক্ষণ নাক ঢেকে রাখতে পারি না। দম বন্ধ হয়ে আসে। তাই ফাঁকা জায়গা পেলেই মাস্ক নামিয়ে ফেলি। রাস্তাঘাটে লোকজন খুবই কম। হাটতে হাটতে অনেক দূর লেকের পার পর্যন্ত গেলাম। একজন দরিদ্র ব্যাক্তি লেকের পাশে দাঁড়িয়ে ফ্লাক্সে করে চা বিক্রি করছে। এই মহামারীতে ওরাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সব চাইতে বেশি। ওদের অসহায় মুখগুলোর দিকে তাকালেই সব বোঝা যায়। ওর দিকে এগিয়ে গেলাম, "ওয়ান টাইম গ্লাস আছে?"
"জ্বী, আছে।"
"দাও তাহলে এক কাপ।"
লেকের শান্ত নির্জন জলের পাশে বসে নীরবে চায়ের স্বাদ উপভোগ করছিলাম। এখান থেকে নগরীর অভিজাত এলাকার উঁচু ও সুদৃশ্য দালানগুলো দেখা যায়। লেকের জলে তাদের প্রতিফলন পড়ে একটা চমৎকার দৃশ্যপট তৈরী করে। একটা জিনিস আজ খেয়াল করলাম উপরের আকাশটা এখন যেমন স্বচ্ছ ঘন নীল, তেমনি লেকের আশেপাশের গাছপালাগুলোও অদ্ভুত সবুজ ও সতেজ। ফুলগুলোও বেশ প্রাণবন্ত! স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় উপর্যুপরী পলিউশনে ওরা খুব বিধ্বস্ত থাকে। এখন ওরা যেন নতুন প্রাণ পেয়েছে, এই মহামারীতে প্রকৃতির মেরামত চলছে।

রাতে একটা ফোন কল পেলাম। দু'একজন মুরুব্বী আছেন, যারা আমাকে খুব পছন্দ করেন, উনারা আগামীকাল আলাপচারীতায় বসতে চান আমি শরীক হবো কিনা জানতে চাইলেন। রাজী হয়ে গেলাম, ঈদের মরসুম, কাজও নেই, বোরিং লাইফ। প্রাচীনতার প্রতি আকর্ষণ কিনা জানি না, আমার বয়স্ক মানুষদের সাথে বসে গল্পস্বল্প করতে ভালোই লাগে। উনারাও আমার সঙ্গ বেশ পছন্দ করেন।

পরদিন সকালে আবারো নওরিনের কথা মনে পড়লো। ভাবলাম ওকে কি কল দেবো? আজ একটা উপলক্ষ আছে। জাস্ট 'ঈদ মুবারক' দেয়ার অজুহাতেও কল দেয়া যায়। মোবাইলটা হাতে নিলাম। সার্চ করে বের করলাম 'নওরিন'। বাটন প্রেস করলাম, তিনবার রিং হওয়ার পর ওপাশ থেকে সারা পেলাম।
নওরিন: জ্বী, কেমন আছেন?
ওর কন্ঠস্বর শুনে বুকের ভিতরটা কেমন যেন করে উঠলো!
আমি: ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?
নওরিন: জ্বী, আছি মোটামুটি।
আমি: লক-ডাউন, তাই না?
নওরিন: জ্বী। লক-ডাউনে ঘরে বসে বসে বোর হয়ে যাচ্ছি।
আমি: তোমার অফিস তো বন্ধ তাই না?
নওরিন: হ্যাঁ, অফিস ফিজিকালি বন্ধ, তবে অনলাইনে কিছু কাজ করতে হয়।
আমি: তা ঈদে কি করলে?
নওরিন: তেমন কিছু না। আমাদের বিল্ডিং-এই একটু উপর-নীচ করলাম।
আমি: মানে?
নওরিন: মানে এই বিল্ডিং-এরই দুই একটা এ্যাপার্টমেন্টে বেড়াতে গিয়েছিলাম।
আমি: তাও তো ভালো।
নওরিন: আপনি কি করলেন?
আমি: আমি? হা হা হা! ঘর থেকে বেরিয়ে হাটতে হাটতে লেক পর্যন্ত গেলাম। রাস্তায় দাঁড়িয়ে চা খেলাম।
নওরিন: কোন লেক?
আমি: (লেকের নাম বললাম)
নওরিন: আহারে!
আমি: আহারে কেন?
নওরিন: আমার এত কাছে এলেন, অথচ একটা ফোন কলও করলেন না?
আমি একটু ভাবলাম। ও কি বলতে চাইছে বোঝার চেষ্টা করলাম। সেন্সেটিভ ব্যাপার, ভুল বোঝাবুঝি হলে ব্যাপারটা ভালো হবে না। ভেবেচিন্তে কথা বলতে হবে।
আমি: ও হ্যাঁ। ফোন তো করাই যেত। তা ফোন করেই বা কি হবে লক-ডাউন তো?
নওরিন: আপনি বললে আমি নীচে নেমে আসতাম। আমার বাসা থেকে কিছুদূর গেলেই তো লেক-টা।
নিজের কানকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিলো। আমি কি এই কথাগুলো শোনার জন্যই এই কয়টা মাস অপেক্ষা করেছিলাম?
আমি: ও হ্যাঁ, তাইতো। বিষয়টা ভেবে দেখিনি। এনিওয়ে আজও তো দেখা করা যায়। (অস্থির হয়ে বললাম)
নওরিন: আজ কখন?
আমি: উ। আজ আমার একটা মিটিং আছে, বিকালের দিকে। মিটিংটা শেষ করে তোমাকে একটা কল দেই?
নওরিন: কোথায় মিটিং?
আমি: দূরে নয়। তোমার বাসার কাছাকাছিই। ওখান থেকে তোমার বাসায় রিকশায় পৌঁছাতে বড় জোড় পনেরো মিনিট লাগবে।
নওরিন: আচ্ছা, তাহলে মিটিং শেষ করে কল দিয়েন। আমি অপেক্ষা করবো।
আমি: কোথায় দেখা করা যায়?
নওরিন: তাই তো! এখন তো ক্যাফে-ট্যাফেও সব বন্ধ! দেখি ক্যাফে 'সাউথ পোল'-টা খোলা থাকতে পারে।
আমি: কোথায় এটা?
নওরিন: কাছেই মেইন রোডের উপরেই। সমস্যা হবে না।
আমি: ওকে।

(চলবে)

(পূর্ব প্রকাশিত গল্প 'পথ চলিতে, যদি চকিতে'-এর ধারাবাহিকতা)
রচনতারিখ: ২৯শে জুন, ২০২০ সাল
সময়: সন্ধ্যা ৭টা ১৮ মিনিট
June 29 at 7:18 PM
-------------------------------------------------------------------------

নওরিন এসেছে - পর্ব ২
----------------------------------রমিত আজাদ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

ঈদের পর কয়েকদিন সবাই একটু ফুরফুরা মেজাজে থাকে। ছুটি থাকে, একটা সুন্দর উৎসবের পরে কোন কাজও নাই। বাড়ীতে মজার মজার খাবার-দাবার থাকে। আপনজনদের সাথে দেখা করাটাই মূল কাজ, এবং আনন্দের কাজ। তবে এবারের ঈদটা অমন নয়, অনেকটাই নিরানন্দ!

ঘরের বাইরে বেরিয়ে বাতাসের কোয়ালিটি অনুভব করে আমার মনে হলো গ্রামের কোন রাস্তা দিয়ে চলছি। এত বিশুদ্ধ বাতাস ঢাকায় বিগত কয়েক দশক পাইনি। খুব ছোটবেলায়, সিটি সেন্টার কমার্শিয়াল এড়িয়া গুলিস্তান-মতিঝিলে গেলে বাতাসে একটা ঝাঁঝালো গন্ধ পেতাম, যেটা অন্যান্য এলাকায় অতটা ছিলো না। তারপর ধীরে ধীরে সেই ঝাঁঝালো গন্ধটার রেডিয়াস বাড়তে থাকলো, বাড়তে বাড়তে তা মহাখালী, গুলশান পেরিয়ে উত্তরা পর্যন্ত পৌঁছে গেলো। শুধু রেডিয়াস না গন্ধটার তীব্রতাও বাড়লো। পরে বুঝতে পেরেছিলাম যে এটা মূলত বিভিন্ন যানবাহন থেকে বের হওয়া দূষিত ধোঁয়ার গন্ধ। তাছাড়া থ্রী-হুইলার থেকে বের হওয়া ধোঁয়ায় চোখও জ্বলতো! তারপর ২০০২ সালে টু-স্ট্রোক থ্রী-হুইলার ও সিনথেটিক শপিং ব্যাগ নিষিদ্ধ করায় পরিবেশ দূষণ যেমন কমেছিলো, তেমনি চোখ জ্বলাও বন্ধ হয়েছিলো। তবে বায়ু দূষণ ছিলো। ঐ ঝাঁঝালো গন্ধটাও ছিলো। আজ বাইরে বেরিয়ে আর সেই ঝাঁঝালো গন্ধটা পেলাম না। বাতাস খুব ফ্রেশ মনে হলো। এদিকে জ্যাম নামক জিনিসটাও আপাততঃ শীতনিদ্রায় গিয়েছে। একটা জায়গায় গিয়ে রিকশায় উঠলাম। রিকশায় বাতাস খেতে খেতে মনে হচ্ছিলো গ্রামের কোন রাস্তা দিয়েই যাচ্ছি।

লাঞ্চের পরে মিটিং ঠিক করা হয়েছিলো। মিটিং মানে গপ্পো-সপ্পো। সমবয়সী বয়ষ্ক ব্যাক্তিরা বসে গল্প করবেন আর আমার সেখানে হাসিমুখে বসে থাকা। মাঝে মধ্যে তারা আমাকে প্রশ্ন করবেন, "আর তুমি কি বলো?" আমি বলবো, "জ্বী, সব ঠিকই তো বলছেন। আমার তো ভুল কিছু মনে হচ্ছে না!" উনারা সবাই খুব খুশী হন। মতামতের সাথে একমত হলে সবাই-ই খুশী হয়। সমস্যা যত সব তো দ্বিমত ও ভিন্নমত নিয়ে। এই দ্বিমত ও ভিন্নমতের কারণে নির্বাসন, মৃত্যুদন্ড সবই হয় সর্বকালেই!

করোনা ভীতি ও সাধারণ ছুটির কারণে রাস্তাঘাট সবই ফাঁকা। নগরীর রাস্তায় কোন ট্রাক-বাস একবারেই চলছে না। দুইএকটা গাড়ী চলছে। প্রোবাবলি সেগুলো সেলফ-ড্রিভেন। কার ঔনারদের মধ্যে যারা হৃদয়বান ও সমর্থবান তারা ড্রাইভারদেরকে ছুটি দিয়ে দিয়েছে। আমি নিজেও আমার ড্রাইভারকে ছুটি দিয়ে দিয়েছি। কিন্তু যাদের সামর্থ্য কম এবং যাদের সামর্থ থাকা সত্ত্বেও হৃদয়বান নন, তারা তাদের বহু বছরের ড্রাইভারকেও চাকুরীচ্যুত করেছে! এটা খুবই হার্ট-ব্রেকিং! এই দুঃসময়ে চাকুরী গেলে তারা খাবে কি? গুটিকতক রিকশাচালক পথে বেরিয়েছে পেটের টানে। এদেশের বহু পেশাজীবি-ই ডে-লেবারার তারা দিন আনে দিন খায়। তিনদিন আয় বন্ধ থাকলেই তাদের আর ভাত জুটবে না।

রিকশায় যেতে যেতে ভাবলাম নওরিন-কে একটু জানাই যে আমি মিটিংয়ে যাচ্ছি। তা মোবাইল হাতে নিতেই অন্য একটা টেলিফোন কল এলো। আমার বন্ধু, অত্যন্ত ধনী ব্যাক্তি, বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক।

বন্ধু: দোস্ত কেমন আছিস?
আমি: আছিরে ভাই। এই করোনাকালে যেমন থাকে আরকি! তোর খবর কি?
বন্ধু: আমিও আছি। বাড়ীর দরজা-জানালা সব বন্ধ করে বসে আছি। কাউকে ঢুকতে দিচ্ছি না।
আমি: অত বাড়ী বাড়ীতে একা বসে আছিস? (তার পরিবার বিদেশে থাকে)
বন্ধু: উপায় কি? এখন এই সাবধানতা অবলম্বন করতেই হবে।
আমি: তা রান্নাবান্না?
বন্ধু: কেন? আমি কি রান্না করতে পারিনা?
আমি: ও হ্যাঁ! তোর রান্না তো খুবই সুস্বাদু। আমার মনে আছে। ছাত্র জীবনে যখন তোর রান্না খেতাম, সেই স্বাদ এখনও জিভে লেগে আছে!
বন্ধু: আসিস একদিন, সব ঠিক হয়ে গেলে। আবার রান্না করে খাওয়াবো। তুই এখন কোথায়?
আমি: বাইরে। রাস্তায়। এক জায়গায় যাচ্ছি।
বন্ধু: বলিস কি? এই সময়ে কেউ বাইরে বের হয়?
আমি: আমার অত ভয় লাগে না। আমি ভেষজ চিকিৎসা জানি।
বন্ধু: তোর স্টান্টবাজী চিরকালই ছিলো! যাহোক, তোর ফেইসবুক স্ট্যাটাস-টা দেখলাম, দিনমজুরদের উপর লিখেছিস।
আমি: হ্যাঁ। ওদের কষ্টের কথা কিছু তো বলা দরকার।
বন্ধু: তা ওদের জন্য কিছু করছিস?
আমি: আমার সামর্থ তো তোর চাইতে অনেক কম। এনিওয়ে, আমাদের কলেজের এক বড়ভাই ফোন দিয়েছিলেন ঐ স্ট্যাটাস পড়ে। তিনি কিছু আয়োজন করছেন, উনার সাথে আমি শরীক হবো।
বন্ধু: কি করেন ঐ বড় ভাই?
আমি: একটা মাঝারি ধরনের ব্যবসা আছে। তবে সেটা বড় কথা না। তিনি খুব পরহেজগার ও হৃদয়বান মানুষ। তিনি ইতিমধ্যেই রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কিছু সাহায্য করে যাচ্ছেন
বন্ধু: আমি এখন কোন সাহায্য দেব না। আরো কিছুদিন যাক। আমি বিশ্বাস করি না যে, গ্রামে একটা পরিবার ক্ষুধার্ত থাকলে বাকিরা তাকে খাওয়াবে না। যাহোক, কিছুদিন পরে অভাব প্রকট হলে, আমি সাহায্য দেয়া শুরু করবো, তবে আমি চালের বেশী কিছু দেব না। গ্রামে চাল হলে বাকিটা এম্নিই ম্যানেজ করা যায়। গ্রামে একটু ঘোরাঘুরি করলেই তো, শাক-পাতা-সব্জি এটা-সেটা পাওয়াই যায়।

বন্ধুর কথা শুনে আমার ভাষাণী হুজুরের কথাটা মনে পড়লো। কেউ একজন উনাকে প্রশ্ন করেছিলো, "হুজুর আপনার কাছে কেউ আসলেই আগে তাকে খেতে দেন, তারপর কথা বলেন, এটা করেন কেন?" উত্তরে তিনি বলেছিলেন যে, "আমার কাছে মানুষ অনেক দূর-দূরান্তর থেকে দেখা করতে আসে। কোন সময় কি খাইয়া বাইর হইছে কে জানে। তাই আগে খাইতে দেই। তোরা তো কষ্টের দিন দেখছ নাই, আমি দেখছি। মানুষেরে কচু-ঘেচু-জোয়ার-বাজরা খাইয়া থাকতে দেখছি।" ভাষাণী হুজুর সম্ভবত চার্চিল সৃষ্ট সেই কৃত্রিম দুর্ভিক্ষটির কথা বলেছিলেন যেখানে বাংলায় নিহত হয়েছিলো চল্লিশ লক্ষ মানুষ। চার্চিল সেই দুর্ভিক্ষ নিয়ে তামাশা করেছিলো ও বাঙালী-ভারতীয়দেরকে ইতর বলেছিলো! ঐ দুর্ভিক্ষ নিয়েই ছবি একেছিলেন কিংবদন্তি চিত্রকর শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন।
আমার বুকটা হঠাৎ ধড়াস করে উঠলো! সামনে কি তেমন কোন দিন আসছে?

রিকশাটা ডানে মোড় নিতেই একটা মসজিদের সামনে এলাম, দেখলাম কেউ একজন পিকআপ ভরে রান্না খাবার নিয়ে এসেছে, তাই গরীবের মধ্যে বিলাচ্ছে। কয়েকজন তরুণ সাহায্য করছে, মসজিদ থেকে দুজন হুজুরও বেরিয়ে এসে কাজে সাহায্য করতে শুরু করলেন। এভাবেই একদল হৃদয়বান মানুষ ও সাহসী তরুণরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো ১৯৭১ সালে। তারা নিজেদের জীবন বা অন্য কোন কিছুর তোয়াক্কা করে নাই, তাদের কাছে দেশপ্রেম ও মানবপ্রেমই ছিলো বড়! অথচ পরবর্তিতে অন্যেরা তার ক্রেডিট নেয়ার চেষ্টা করেছে!

রিকশাওয়ালা আমাকে বললো, "স্যার, আমারে একটু সময় দিবেন? আমি ঐখান থেইকা একটা প্যাকেট নিয়া আসি?" আমি বললাম, "অবশ্যই, যাও তুমি, আমি দাঁড়ালাম।" কয়েকদিন আগেও এরকম দেখেছিলাম, কেউ একজন লাইনে দাঁড়ানো সবাইকে একশত টাকা করে বিলি করছে।

রিকশাওয়ালা খাবারের প্যাকেট নিয়ে ফিরে আসলো। আমি প্রশ্ন করলাম, "তুমি কি বাকি পথটা চেনো?" রিকশাওয়ালা বললো, "জ্বিনা, এইদিকে চিনি না। আপনি চিনাইয়া দিয়েন।"
আমি: তুমি কি এইদিকে রিকশা চালাও না?
রিকশাওয়ালা: আমি আসলে রিকশাই চালাই না।
আমি: মানে কি?
রিকশাওয়ালা: আমি 'ব' সোসাইটিতে পিয়নের চাকরী করি। আমাগো এখন ছুটি, আটজন রাখছে, আটজনেরে ছুটি দিছে। বইসা থাকার চাইতে কাম করা ভালো। তাই আমি রিকশা চালাইতাছি।
দুইএকদিন আগে বাজারে এরকম একজনকে দেখেছিলাম, যে আসলে কাঠমিস্ত্রী কিন্তু এখন সে বাজারে বসে লেবু বিক্রি করছে।

এতসব ভাবতে ভাবতে ঐ বাড়ীর সামনে চলে এলাম। একজন মুরুব্বী বাইরেই দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি আমাকে দেখে বললেন, আরে আসো আসো, তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। চলো ভিতরে যাই।

আমি মনে মনে ভাবছিলাম। মিটিংটা কতক্ষণ চলতে পারে? নওরিন তো অপেক্ষা করবে!

(চলবে)

রচনতারিখ: ০১লা জুলাই, ২০২০ সাল
সময়: রাত ১২টা ৫৫ মিনিট

নওরিন এসেছে - পর্ব ৩
----------------------------------রমিত আজাদ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

যে ঘরটায় আমরা বসলাম সেটা আসলে একটা অফিসকক্ষ। সবার যিনি মুরুব্বী তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, পাশাপাশি একজন ভালো লেখক। একাধিক বই লিখেছেন বিভিন্ন বিষয়ের উপর। তবে বেশিরভাগই স্মৃতিচারণমূলক। মেধাবী হিসাবে উনার সুনাম ছিলো স্কুল জীবন থেকেই। উনার সাথে কথা বললে অনেক কিছুই শেখা যায়। আমি নিজে যদিও অনেক লেখাপড়া করি, এবং নিজেকে একসময় অনেক জাননেওয়ালা ভাবতাম, কিন্তু এই মুরুব্বীগ্রুপটির সংস্পর্শে এসে বুঝলাম, পৃথিবীতে জানার শেষ নাই। আসলে বয়সের অভিজ্ঞতা বলেও একটা বিষয় থাকে! আমার যে সময়টা দেখা এখনো বাকী আছে, উনারা সেই সময়টা অনেক আগেই পার করেছেন!

পাঁচ ছয়জন মুরুব্বী বসেছেন। তাদের কেউ প্রাক্তন কূটনৈতিক, কেউ প্রাক্তন সেনা কর্মকর্তা, কেউ রিটায়ার্ড আমলা, কেউ বা অধ্যাপক। বীর মুক্তিযোদ্ধা লেখক সারের নিজের বাড়ী এটা। এর একটা তলায় তিনি থাকেন, অন্যান্য তলা গুলো ভাড়া দিয়েছেন। আর নীচের তলার অর্ধেক গ্যারেজ ও বাকী অর্ধেক অফিস হিসাবে ব্যবহার করেন তিনি। এই বয়সেও কিছু সোশাল ওয়ার্ক করেন। দেশের প্রতি টান থেকেই করেন।

অন্যান্য দিনের সাথে আজকের মিটিংয়ের একটা মৌলিক পার্থক্য আছে। আজ সবাই মাস্ক পড়ে এসেছে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে সবাই একটু দূরে দূরে বসলাম। টার্মটা 'সামাজিক দূরত্ব' হবে নাকি 'শারিরীক দূরত্ব' হবে সেটা একটা প্রশ্ন বটে! মূল বিষয়টা হলো, একজনার শরীর থেকে আরেকজনার শরীর যেন কিছুটা দূরে থাকে যাতে সংক্রমণের ঝুঁকি না থাকে। সেই অর্থে আসলে টার্মটা 'শারিরীক দূরত্ব' হলেই যথাযথ হবে। কিন্তু 'শারিরীক দূরত্ব' বললে শুনতে অশালীন লাগে বোধহয়!

আমাদের বাংলাদেশীদের আলোচনাগুলো শুরু হয় মামুলিভাবে, তারপর আলাপ জমতে থাকে আলোচনার সবশেষ টপিক হয় রাজনীতি, আর ঐ পর্যায়ে আলোচনা হয়ে ওঠে জমজমাট! মুরুব্বীরা ওভাবেই আলোচনা শুরু করলেন। কার কি অবস্থা, কেমন হলো এই করোনাময় ঈদ, কার পরিবার কেমন আছে, আশেপাশের অবস্থা কি, সামনে কি দিন আসতে পারে, ইত্যাদি। যেই টপিক আসলো সামনে সামনে কি দিন আসতে পারে, অনেকেরই মুখ অন্ধকার হয়ে এলো। অধ্যাপক স্যার বললেন, আমি তো রিটায়ার করেছি অনেক আগে, সম্পদ বলতে নিজের দুইটা ফ্ল্যাট, একটায় আমি পরিবার নিয়ে থাকি, আরেকটা ভাড়া দিয়েছি; আর একটা সদ্য প্রতিষ্ঠিত বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে পার্ট টাইম শিক্ষকতা করি। এখন নতুন ঐ বিশ্ববিদ্যালয় আর বেতন দিতে পারছে না। তবে তাদের অনলাইন ক্লাস চলছে। এদিকে আমার ভাড়াটিয়াও নোটিশ দিয়ে দিয়েছে যে, তিনি আর ভাড়া থাকবেন না। এখন তো আমার শ্যাম কূল দুই-ই গেলো। ইনকামের দুটা উৎসই তো বন্ধ হয়ে গেলো! উনার কথা শুনে সবার মুখই অন্ধকার হয়ে গেলো। একজন বললেন, আজকাল রাস্তায় বের হলেই দেখা যায়, ট্রাক ভরে মালামাল নিয়ে ঢাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছে নিম্ন-মধ্যবিত্তরা। ১ম জন বললেন: হ্যাঁ, এরপর ঢেউটা আসবে মধ্য ও উচ্চ মধ্যবিত্তদের মধ্যে।
২য় জন: আপনাদের কি মনে হয়। এই সংকট কি দেশ মোকাবেলা করতে পারবে?
৩য় জন: কি জানি! পরিস্থিতি তো ভয়াবহ! তাছাড়া কেউ লক-ডাউনও মানছে না! আরে বাঙ্গালী না???
এই পর্যায়ে আমি ইন্টারফেয়ার করলাম।
আমি: স্যার। এভাবে বলা ঠিক না! ফেইসবুকেও দেখি জাত তুলে গালি দিতে পারলে সবাই খুশী হয়। অথচ আমি ইন্টারনেট ঘেটে পত্র-পত্রিকা ঘেটে পড়ে দেখেছি। লক-ডাউন অমান্য করার ঘটনা সব দেশেই ঘটেছে! বাঁচার জন্য শহর থেকে দলে দলে লোক গ্রামে পালিয়ে গিয়েছে এমন ঘটনাও ঘটেছে চীন থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত। গরীব দেশগুলোতে মানুষ পেটের দায়ে বাইরে না বেরিয়ে পারে না! অর্থনীতিবিদ ড. অভিজিৎ-তো ঠিকই বলেছেন, 'খেতে দিন। সবাই লক-ডাউন মানবে।'
এরপর মুরুব্বীরা চুপ মেরে গেলেন, কেউ ঠিক বুঝতে পারছে না; এই পরিস্থতিতে কি করণীয়!

গুমোট পরিবেশটা হালকা করতে একজন আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, "আরে তুমি তো দেখছি দাঁড়ি রেখে ফেলেছ!"
আরেকজন বললেন, "ইচ্ছে করে কি আর রেখেছে? করোনার মধ্যে সেলু-টেলুন তো সব বন্ধ!" সবাই হেসে উঠলেন।
আমার মনে পড়লো আমার এক ভাগ্নের কথা। ব্রিলিয়ান্ট ভাগ্নেটি ইউনিভার্সিটির এ্যাসিসটেন্ট প্রফেসর। ওকে হঠাৎ একদিন দেখি মুখভর্তি দাঁড়ি। আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালে ও বললো, "দাঁড়ি রাইখা ফালাইছি মামা।"
আমি: কেন?
ভাগ্নে: এমবিএ ক্লাসে পড়াই মামা। অনেক বয়ষ্ক স্টুডেন্ট আছে। আমারে ইয়াং দেইখা পাত্তা দেয়না! তাই বাধ্য হয়ে রাখলাম দাঁড়ি, যাতে একটু ভারিক্কী লাগে।

আমাদের আলাপের মধ্যে ২য় জন একটা ফোন কল পেলেন অস্ট্রেলিয়া থেকে। উনার মেয়ের ফোন, "বাবা তুমি কোথায়?"
আপনজনের সুস্বাস্থ্য নিয়ে সবাই শংকিত!

১ম জন: কি ব্যাপার?
২য় জন: দেখেন তো! আমি বাইরে বেরিয়েছি, আমার ছেলে অস্ট্রেলিয়া-তে তার বোনকে ফোন করে বলে দিয়েছে। মেয়ে ভয় পেয়ে ফোন করেছে আমি কোথায় গেলাম, বাইরে বেরিয়ে আবার না করোনা আক্রান্ত হয়ে যাই! যাহোক আমি ওকে বুঝিয়ে বলেছি যে, আমরা সামাজিক দূরত্ব মেনে বসেছি।

৪র্থ জন: শুনেছেন নাকি, শালুম গ্রুপের দুই ভাই করোনায় আক্রান্ত হয়ে বড় ভাইটা মারা গেছে?
১ম জন: প্রচুর টাকার মালিক! সোজা পথে তো আর এত এত টাকার মালিক হয় নাই! তাদেরই তো দায়িত্ব ছিলো যে, বাংলাদেশে ভালো একটা হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা। অথচ সময় থাকতে তারা তা করেনি! আজ এক ভেন্টিলেটর দিয়ে দুই মিলিয়নিয়ার-কে নিশ্বাস নিতে হলো!
৩য় জন: কথায় কথায় সিঙ্গাপুর দৌড়ানো এখন বন্ধ! এখন হয়তো তারা বুঝবে যে, নিজ দেশে ভালো স্বাস্থ্য ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা কতটাই জরুরী।

কিছুক্ষণ পর শুরু হলো নিউ জেনারেশন-এর বেপোরোয়া জীবন যাপন সম্পর্কে আলাপ।
১ম জন: ঐদিন শুনলাম একটা ঘটনা। আরে এক ছেলে ঢাকায় কোন এক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তো। এই করোনার ছুটিতে গ্রামে নিজ বাড়িতে গেলো। ওখানে বাপ-মা তার বিয়ে ঠিক করেছে। ছেলেও রাজী। হঠাৎ ঢাকা থেকে এক মেয়ে গিয়ে উপস্থিত। মেয়ে দাবী করলো যে, সেই-ই ছেলেটির বৌ। সবাই অবাক, মানে কি? মেয়েটা প্রমাণ করলো যে ঢাকাতে গত দুই বছর যাবৎ তারা একই ফ্লাটে থেকে ঘর-সংসার করছে; তাহলে বৌ হওয়ার আর বাকী আছে কি?
অতঃপর কি আর করা তাদের বিয়ে দিয়ে দেয়া হলো।
মুরুব্বীরা সব হায় হায় করে উঠলেন। এ কি অবস্থা? পাশ্চাত্য সমাজ শুরু হয়ে গেলো নাকি? রীতিমত লীভ টুগেদার শুরু হয়ে গিয়েছে!
আমি আমার ভারতীয় বন্ধুদের কাছ থেকে শুনেছি যে ওখানে বহু আগে থেকেই 'লীভ টুগেদার' চলছে।
কিছু পুরুষ মানুষ যখন একত্রে হয়, তখন কোন এক সময়ে এইসব রসালো আলাপ শুরু হয়ে যায়! তা সে তারা যেই বয়সেরই হোক না কেন!
আলাপ যে ভাবে শুরু হলো, আমি এখন চিন্তায় পড়ে গেলাম; আজ নওরিনের সাথে দেখাটা কি হবে?
আমাকে বারবার ঘড়ির দিকে তাকাতে দেখে একজন জিজ্ঞাসা করলেন, "কি ব্যাপার উসখুশ করছো যে?"
আমি বললাম, "জ্বী অনেকক্ষণ হয়ে গেলো।"
১ম জন: তাইতো। কথায় কথায় কত সময় পেরিয়ে গেল! আমরা তাহলে আজ শেষ করি।
একে অপরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। তখনও সন্ধ্যা হয় নি।

উনাদের থেকে একটু দূরে গিয়ে। আমি মোবাইলটা হাতে নিলাম। নওরিনের নাম্বারে দু'বার রিং হতে ও ধরলো।
আমি: নওরিন।
নওরিন: জ্বী।
আমি: (দুরু দুরু বুকে) আমার মিটিংটা মাত্র শেষ হলো। তুমি কি আসবে? আমি কি তোমার বাসার দিকে রওয়ানা হবো। (আমার মনে ভয় হচ্ছিলো। নওরিন না বলবে। হয়তো বলবে, 'অনেক দেরী হয়ে গিয়েছে, আজ থাক।' এতগুলো মাস পড়ে একটা সাক্ষাৎ ঠিক করলাম, সেটা কি বাতিল হবে?!)
নওরিন: আপনি এখন কোথায় আছেন?
আমি: (জায়গাটার নাম বললাম) তোমার বাসায় আসতে বড় জোড় পনেরো মিনিট সময় লাগবে! (আমার কন্ঠে আকুতি ছিলো)
নওরিন: আসুন। আমি আছি।
আমি: তুমি তৈরী থেকো তাহলে। (আমার মনটা নেচে উঠলো)
নওরিন: জ্বী, আমি তৈরী থাকবো।
আমি: আরেকবার তোমার বাসার নাম্বার, আর রোড নাম্বারটা বলো তো।
নওরিন তার বাসার নাম্বার, আর রোড নাম্বারটা বললো।

আমি দ্রুত হাটতে শুরু করলাম। মেইন রোডে গিয়ে একটা রিকশা নিতে হবে।

ফাঁকা ফুটপাত দিয়ে হাটতে হাটতে হঠাৎ একজন মানুষ আমাকে অতিক্রম করলো। আমি দু'কদম গিয়েই চমক খেলাম! আরে চেনা মানুষ তো!
আমি: এই মঈজ ভাই?
তিনি ঘুরে তাকালেন।
আমি: আরে মঈজ ভাই-ই তো। আপনি আমাকে দেখেননি?
মঈজ ভাই: দেখেছি। চিনেছি।
আমি: তাহলে ডাকলেন না কেন?
মঈজ ভাই: না মানে ভাবলাম তুমি ব্যাস্ত কিনা!
আমি: ব্যাস্ত হই আর না হই। ভাইয়ের সাথে কি দু'মিনিট কথা বলতে পারবো না!
মঈজ ভাই: তা ঠিক।
আমি: দেখেন তো। কতগুলো বছর পরে দেখা। তারপরেও কথা না বলি কিভাবে! একটু আগে পরে হলেই তো আর দেখা হতো না। (মনে পড়লো যে, কয়েক মাস আগে নওরিনের সাথে ঠিক এভাবেই ইনসিডেন্টালি দেখা হয়েছিলো আনএক্সপেকটেড একটা জায়গায়) বাই দ্যা ওয়ে, এই অবেলায় এই অজায়গায় আপনি কি করেন? আপনার বাসা তো নগরীর শেষ মাথায়? (তারপর ভাবলাম কথাটা জিজ্ঞেস করা ঠিক হয়নি। উনারও যদি আমার মত কারো সাথে দেখা-সাক্ষাতের ধান্দা থাকে তাহলে লজ্জায় পড়ে যাবেন)
মঈজ ভাই: আমার অফিস তো এখানে।
আমি: এই এলাকায় আপনার অফিস? জানতাম না তো! আমি তো এখানে প্রায়ই আসি।
মঈজ ভাই: কোথায় আসো? আজই বা কোথায় এসেছিলে?
আমি: হুম, বলা যাবে না।
তিনি আমার দিকে তাকালেন।
আমি: (রহস্য করে বললাম) একা মানুষ। আমার কি প্রেমিকা-ট্রেমিকা থাকতে পারে না?
তিনি লাজুক হাসলেন।
আমি: নাহ। এখানে কোন প্রেমিকার কাছে আসিনা। একজন মুরুব্বীর বাসায় এসেছিলাম।
মঈজ ভাই: এখন কোথায় যাচ্ছ?
আমি: এখন তো প্রেমিকার কাছেই যাচ্ছি।
বিশাল ধনী ব্যবসায়ী মঈজ ভাই আবারো হাসলেন। এই হাসিটা অবিশ্বাসের। বোধহয় আমার কথা বিশ্বাস করলেন না। না বিশ্বাস করলেই ভালো।
আমি ইচ্ছে করেই হেয়ালীটা করেছি।
আমার একটা সাইকোলজিকাল ক্ষমতা আছে। আমি চাইলে কাউকে আমার প্রয়োজনমত প্রভাবিত করতে পারি। লোকটা সেটা টেরও পাবে না! মঈজ ভাইয়ের মত অত ঝানু ব্যবসায়ীও না।

উনার সাথে এর আগে আমার সর্বশেষ দেখা হয়েছিলো বিদেশে। কি একটা কাজে তিনি সেখানে গিয়েছিলেন, আমিও সেখানে ছিলাম, আমার সেখানে কানেকশন ভালো ছিলো, আমি উনাকে কিছু লোকের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম। আজ মঈজ ভাইকে মনে হলো, আমার থেকে একটু দূরে দূরে থাকলেন। বোধহয় করোনার ভয়ে! এবার আমি মনে মনে হাসলাম। একটা লোকের জীবনের সব পাওয়াই বোধহয় হয়ে গিয়েছে, পরিবার, অর্থ, সম্পদ, সামাজিক অবস্থান, কিছুই পাওয়া উনার জীবনে আর বাকি নেই; তারপরেও এত মৃত্যুভয়?!

মেইন রোডে উঠে একটা রিকশায় চড়লাম। সোজা রাস্তার শেষ মাথার কাছে গিয়ে একটা চেকপোস্ট দেখলাম। রিকশাওয়ালা বললো, "স্যার, আর মনে হয় যেতে দেবে না। এখানেই নামতে হবে।" করোনার জন্য নগরীর বিভিন্ন জায়গায় এরকম পথ আটকে দেয়া হয়েছে। এতে কি লাভ হয় আমি জানি না। মানুষ তো বাহন থেকে নেমে ঠিকই হেটে ভিতরে ঢুকবে! যাহোক, পথ বেশি বাকি ছিলো না। আমি রিকশা থেকে নেমে হাটতে শুরু করলাম। আরেকটু সামনে গিয়ে আবার নওরিনকে ফোন দিলাম।

আমি: নওরিন, তুমি রেডী?
নওরিন: আপনি এখন কোথায়?
আমি: তোমার বাসার খুব কাছেই, বড় জোড় আর পাঁচ মিনিট লাগবে। তুমি তোমার বিল্ডিংয়ের নীচে নামো।
নওরিন: আচ্ছা আমি নীচে নামছি।

আমি ওদের বিল্ডিয়ের গেটের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমার ধারনা ছিলো, নওরিন এতক্ষণে নীচে নেমে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। কিন্তু আমি সেখানে কাউকে পেলাম না। আমি গেটের কাছাকাছি গিয়ে, নেমপ্লেটে বাসার নাম্বার আর রোড নাম্বারটা মিলালাম। সব ঠিকই আছে। তাহলে ও গেটের সামনে নেই কেন?
আমি ওর মোবাইলে কল করলাম। নওরিন ফোন ধরলো।
আমি: তুমি কোথায়?
নওরিন: আপনি কোথায়?
আমি: আমিতো তোমার বাসার সামনেই দাঁড়ানো।
নওরিন: আপনি দাঁড়ান, আমি নামছি।

এরপর আরো পনেরো মিনিট পেরিয়ে গেলো। কিছু বুঝলাম না। বিশতলা থেকে নামতেও তো এত সময় লাগে না! আর এতো অল্প কয়েকটা তলা!
আমি আবার কল দিলাম। এবার আর ও ফোন ধরলো না। তিন-চার মিনিট পর আমি আবারও কল দিলাম। এবার ও ফোন ধরলো
আমি: তুমি কি নেমেছ?
নওরিন: আমি নামছি (তবে খুব চাপা স্বরে বললো। অনেকটাই ফিসফিসিয়ে বলার মত। ও এরকম করছে কেন বুঝলাম না!)
আমি: ওকে। আমি অপেক্ষা করছি।
আমি আরো পনেরো মিনিট অপেক্ষা করলাম। ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমে অনেক সময় পার হয়ে গিয়েছে। রাস্তাঘাট একদম ফাঁকা। এই ফাঁকা নির্জন রাস্তায়, একটা লোক এতক্ষণ কি করছে, অনেকের মনেই এই প্রশ্ন জাগতে পারে। রাস্তায় লোকজন না থাকলেও, এই অভিজাত এলাকায় প্রতিটি বাড়ীতেই একতলায় গ্যারেজে একাধিক লোক দাঁড়িয়ে বসে থাকে। কোন কোন বাড়ীর মেইন গেইট গ্রীলের, ভিতর থেকে বাইরে সবই দেখা যায়। তারা এখন আমাকে দেখে কি ভাববে?
আমি একটু এদিক-ওদিক হাটতে শুরু করলাম। একবার মনে হলো, আমি কি ওকে তৈরী হওয়ার পর্যাপ্ত সময় দিইনি। ও কি মেকআপ করতে সময় নিচ্ছে? আবার ভাবলাম হিজাবী মেয়ে এত কি মেকাপ করবে?
আবার তাকে ফোন কল করলাম। এবার ও ফোন ধরলো না। কিছু সময়ের ব্যবধানে পর পর তিনবার ফোন দিলাম, নওরিন ফোন ধরলো না!!!

(চলবে)

রচনাতারিখ: ০২রা জুলাই, ২০২০ সাল
সময়: রাত ১২টা ৫২ মিনিট
-----------------------------------------------------------------

সত্য ভালোবাসাও ছেড়ে যায়!
ছেড়ে যায় নানা কারণে,
ফিরতে চেয়েও পারেনা।
গভীর দুঃখে বেছে নেয় স্বেচ্ছামৃত্যু!

শুধু গাঢ় ঘুম বারবার ভেঙে যায়,
বুকের আকস্মিক বজ্রপাতে!
নিশুতি আঁধারে চারপাশে তাকিয়ে দেখে,
কেউ নেই, কেউ নেই, কেউ নেই!

----------------------- রমিত আজাদ
০১লা জুলাই, ২০২০ সাল


বন্ধু আমায় আর ডেকোনা তোমার পথের মাঝে!
তোমার কথা ভাবতে গিয়ে কান্না চেপে আসে!
দুইটি হৃদয় দুইটি পথেই থাকনা যেমন আছে,
দরকার কি দুই হৃদয়ের একটি পথে মিশে?

--------------------------------- রমিত আজাদ
০২রা জুলাই, ২০২০ সাল





নওরিন এসেছে - পর্ব ৪
----------------------------------রমিত আজাদ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)


এই লক-ডাউনে দূষিত নগরী ঢাকার রূপ কিছুটা হলেও বদলেছে। ঘন নীল নির্মল আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে গাঢ় সবুজ গাছ দেখা যায়, গাছে ফুটে থাকা ফুলগুলির হাসি এখন অনেক বেশি রঙিন, ইদানিং পাখিদের কলকাকলিও শোনা যায়। লক্ষীপ্যাঁচা বা এই জাতীয় রাত পাখীদের কলরব শোনা যায় কিনা জানি না। কান পাতলে শোনা যেতেও পারে!

আপাতত: আমি অপেক্ষা করছি অন্য এক বিহঙ্গের। ঘটনাক্রমের এই পর্যায়ে তো একটা নাটকই হয়ে গেলো। একেবারে ঘরের সামনে এসে কি ফিরে যাবো? সময় দেখতে হবে, মোবাইল এসে সব খেয়েছে হাতের ঘড়িটাও খেয়েছে। পকেট থেকে আবার মোবাইল ফোনটা বের করলাম, নওরিন-কে ফোন করার জন্য নয়, সময় দেখার জন্য। দেখলাম এর পরেও বেশ কিছু সময় পার হয়ে গিয়েছে। আমার মনে হয় আজ আর নওরিন আসবে না। কেন আসবে না, তা জানি না। আমাকে এই পর্যন্ত টেনে এনে, এমন নাটক করার কি প্রয়োজন ছিলো তাও বুঝলাম না! নাকি আমাকে ওর মূল্য বোঝানোর জন্য এটা একটা 'প্রণয় স্ট্রাটেজি'? যাই হোক, ঠিক করলাম ঘরে চলে যাবো।

যাওয়ার আগে ওর বিল্ডিংয়ের গেটের দিকে আরেকবার তাকালাম। হঠাৎ দেখলাম কেউ একজন খুব দ্রুত মেইন গেইটের পকেট গেট দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। ছায়া ছায়া নারীমূর্তী! আকৃতিতে নওরিনের মতই। নারীমূর্তীটি বাইরে বেরিয়েই খুব দ্রুত হাটতে শুরু করলো। কাছাকাছি আসতেই আমি দেখলাম যে, এটা নওরিন। আধো আলোয় মনে হলো, আজ সে প্রসাধন বেশিই করেছে! এই প্রসাধনের জন্যই কি তার এত দেরী হলো? তাহলে সে ফোন ধরলো না কেন? অথবা, ফোনেই তো বলতে পারতো যে, 'আপনি আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন'।

নওরিন খুব দ্রুত হাটছে। ওর ভাব দেখে মনে হচ্ছে দৌড়াতে পারলে ও আরো বেশি খুশী হতো! ওর সাথে তাল মিলাতে আমিও দ্রুত হাটতে লাগলাম। কিছুদূর গিয়ে ও তিন রাস্তার মোড়ে এসে বামে ঘুরে আরেকটি রাস্তায় ঢুকে পড়লো। এবার সে হাটার গতি কমালো। আমি বললাম, "কেমন আছো নওরিন?" আমার অজান্তেই আমার কন্ঠস্বরে সোহাগ ঝরে পড়লো! নওরিন এবার কথা বলতে শুরু করলো,

নওরিন: বুঝলেন এই বিল্ডিংটাতে আমরা অনেকদিন যাবৎ আছি। আমি ছোটবেলা থেকেই এখানে থাকি। আমাদের নিজস্ব এ্যাপার্টমেন্ট। এই বিল্ডিং-এ যারা থাকে তারা সবাই নিজ নিজ ফ্লাটের মালিক। এখন এমন অবস্থা হয়েছে যে, সবাই সবার আত্মীয়ের মত হয়ে গিয়েছি। তাছাড়া তিনটা ফ্লাটে আবার আমাদের আত্মীয়রাই থাকে।
আমি: ও আচ্ছা!
দেরী হওয়ার জন্য ওকে ভর্ৎসনা করা যেত, এ্যাট লিস্ট জিজ্ঞেস করা যেত যে, কেন দেরী হলো। কিন্তু আমার মন সেটা চাইলো না। এটাও একটা হিউম্যান সাইকোলজি, যার জন্য মন পোড়ে তার অপেক্ষা করতে করতে মেজাজ চড়ে যায়, কিন্তু তাকে দেখলেই আবার মন খুশী হয়ে যায়, অপেক্ষার সব যন্ত্রণা ভুলে যায় মন! তখন হয়তো সঙ্গসুখটাই সব ভুলিয়ে দেয়!
নওরিন আবারো বললো, "আমার দেরী হলো বলে কিছু মনে করবেন না। আমি সিঁড়ি ভেঙে নামছিলাম, তিনতলায় আসতে ফ্লাটের দরজা খোলা দেখতে পেলাম, ঐ ফ্লাটের আঙ্কেলের কন্ঠস্বর শুনতে পেলাম বসার ঘরে। লোকজন ছিলো বোধহয়। এমন হতে পারে যে, দরজা দিয়ে তাকালে তিনি সরাসরি আমাকে দেখতে পাবেন। আমি সেটা চাচ্ছিলাম না। আঙ্কেল আমাকে ছোটবেলা থেকেই চেনেন। আমার বিবাহজনিত দুর্ঘটনাটা তো সবারই জানা। আজ এই লক-ডাউনের মধ্যে এই সন্ধ্যায় বাইরে বেরুতে দেখলে, পরে নানান প্রশ্ন করতে পারেন। তাই সিঁড়ির ঐ জায়গাটায় আমি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম। আপনার কল মোবাইলে বাজছিলো, তাও আমি ধরতে পারিনি। সরি!

এতক্ষণে রহস্য ভেদ হলো! আমি বললাম, "চলো তাহলে।"
নওরিন: কোথায় যাবেন?
আমি: তুমি না কোথায় বসতে চাইলে?
নওরিন: হ্যাঁ, 'সাউথ পোল' ক্যাফেতে।
আমি: কোথায় এটা।
নওরিন: সামনে চলুন।
এবার নওরিন মোড় ঘুরে এ্যাভিনিউতে উঠে গেলো। এই এ্যাভিনিউ-এর দুইপাশে চওড়া পরিচ্ছন্ন ফুটপাত আছে। হাটতে কোন সমস্যা নাই। আমি ওর পাশে পাশে হাটছিলাম। পথে লোকজন প্রায় নাই। মাঝে মাঝে কিছু গাড়ী ছুটে ছুটে যাচ্ছিলো। এ্যাভিনিউ-এর দুইপাশের মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিংগুলোর ঝলমলে আলো আর জ্বলছে না। লক-ডাইনের কারণে অল্প কিছু টিমটিমে আলো জ্বলছে। তবে ল্যাম্পপোস্টগুলোতে আলোকসজ্জার ছটা রয়েছে যাথারীতি! এরা বোধহয় মহামারীর দীপাবলী!

সন্ধ্যার আলো আঁধারীতে অভিজাত এলাকার অব্যস্ত এ্যাভিনিউ, টিমটিমে আলো জ্বলা আপাতঃ জৌলুস হারানো বৃহদাকার দুঃখী বাহারী দালানের সারি, মহামারীর দীপাবলী, এ্যাভিনিউ-এর ফাঁকা ফুটপাত, আর সেই ফুটপাতে মন খুলে গল্প করতে করতে হেটে যাওয়া দুজন নারী-পুরুষ! কোন সৃজনশীল চিত্রকর দৃশ্যটা দেখতে পেলে নির্ঘাত তৈলচিত্রে ফুটিয়ে তুলতো। কোন কবি দেখতে পেলে, কবিতা না লিখে পারতো না!

আঁধারে ওর মুখশ্রী খুব ভালো দেখা যাচ্ছিলো না। একটি ল্যাম্পপোস্টের কাছাকাছি আসতে সোডিয়াম লাইটের সুতীব্র আলোয় আমি আরেকবার ওর মুখের দিকে চাইলাম। কি সুশ্রী ও নিষ্পাপ একটি মুখাবয়ব! তখন আমার মনে হয়েছিলো যে, নওরিন কড়া মেকআপ করেছে। এখন দেখলাম, না, একদম না, হালকা প্রসাধন। আসলে ওর রূপই ওর প্রসাধন! আমার বুকের ভিতর একটা দীর্ঘশ্বাস চাপলো, এত চমৎকার একটা স্ত্রীকে ত্যাগ করতে পারে, এ কোন নিঠুর স্বামী?!

আমি: নওরিন, তুমি তো এই এলাকায় ছোটবেলা থেকেই আছো। আমি ছোটবেলায় থাকতাম দক্ষিণ ঢাকায়। তবে এখানে আমি মাঝে মাঝে আসতাম। তাই এই এলাকার সাথে আমারও ছেলেবেলার স্মৃতি বিজড়িত। সব চাইতে ইন্টারেস্টিং স্মৃতি হলো, আমি যখন বিদেশে যাই। সেটা খুব অল্প বয়সে ছিলো। আমি ভিসা নিতে এই এলাকায় এসেছিলাম। আমার বড় বোন, আমাকে গাড়ীতে করে নামিয়ে দিয়ে গেলেন। আমাকে তিনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন, "এদিকে কেন এসেছিস?" আমি আসলে জানতাম যে আমার ভিসা হয়ে গেছে। কিন্তু আমি উনাকে কিছু বলিনি।
নওরিন: কেন বলেননি?
আমি: আমি একটা নীতি মেনে চলি। কোন কিছু চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত বলিনা।
নওরিন: ইন্টারেস্টিং!
আমি: এ্যাম্বেসীতে গিয়ে আমি পাসপোর্ট-টা তুললাম। ভিসার পাতা দেখে নিশ্চিত হলাম। তারপর বাসায় ফিরে গিয়ে সবাইকে দেখালাম।
নওরিন: তারপর আপনার বড় বোন কি বললেন?
আমি: তিনি খুশী হওয়ার পাশাপাশি কিছুটা ক্ষেপেছিলেনও। বললেন, "তুই জানতি অথচ কিছু বললিও না?" আমি বলেছিলাম, টেলিফোনে শুনেছি, ওটার কি নিশ্চয়তা আছে? নিজ চোখে দেখে তখন বিশ্বাস করলাম।
নওরিন: বেশ ইন্টারেস্টিং ঘটনা তো!
আমি: এই এলাকাটা ঐ কারণে বেশি মনে পড়ে। পাসপোর্ট-ভিসা হাতে পাওয়ার পর আমি কি করলাম জানো?
নওরিন: কি করলেন?
আমি: কোন যানবাহনে চড়লাম না। প্রথমে এই এলাকার রাস্তায় বিভিন্ন জায়গায় হাটলাম। মোটামুটি পরিচ্ছন্ন চওড়া পথঘাট, বাগান সম্বলিত প্রতিটি বাড়ী, আমার ভালোই লাগতো। তারপর হেটে হেটেই অতদূরে আমাদের নিজস্ব বাড়ীতে গেলাম।
নওরিন: আমারও ছেলেবেলার স্মৃতি আছে দক্ষিণ ঢাকায়।
আমি: তাই? কোথায়?
নওরিন: পহেলা বৈশাখে পুরাতন যাদুঘর এলাকায় যেতাম। আব্বা পরিবারের সবাইকে নিয়ে যেতেন।
আমি: পুরাতন যাদুঘর? তোমার মনে আছে?
নওরিন: (অবাক হয়ে) হ্যাঁ। ঐ যে শাহবাগ এলাকায়।
আমি: আরে না না। ওটা তো নতুন যাদুঘর। পুরাতন যাদুঘর ভিন্ন জায়গায় ছিলো।
নওরিন: আরে ঢাকা ইউনিভার্সিটির কাছে। ঐ যে গম্বুজগুলো এরকম এরকম।
ও হাত দিয়ে কিছু অর্ধবৃত্ত দেখালো।
আমি: ঠিকই আছে। ওটাই নতুন যাদুঘর। আর্কিটেক্ট মঈনুল-এর করা। ঐ যে মঈনুল, যে কিনা সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধ-এর স্থপতি। আর পুরাতন যাদুঘর ছিলো অন্য জায়গায়, যতদূর মনে পড়ে লাল রঙের ছোট্ট একটা দালান।

নওরিন আমার দিকে তাকালো। এ পর্যায়ে আমার মনে হলো। আহারে, ওর সাথে আমার বয়সের পার্থক্য তো অনেক! আমার যখন ছেলেবেলা, ওর তো তখন জন্মই হয় নি। আর ওর যখন জন্ম হয়েছে আমি তো তখন মোটামুটি ইয়াংম্যান। হয়তো ঐ সময়েই ডালিয়ার সাথে আমার প্রথম প্রেমটা হয়েছিলো!

আমি: নওরিন।
নওরিন: জ্বী?
আমি: তোমার বয়স কত?
নওরিন আমার দিকে তাকিয়ে লাজুক ও মিষ্টি করে হাসলো! বুঝলাম, ও নিজের বয়স বলতে চাচ্ছে না। যাহোক আমি তো ওর বয়স এ্যাপ্রোক্সিমেটলি জানিই। কিন্তু লাজুক হাসলে যে ওকে এত বেশী সুন্দর লাগে তা আগে তো কখনো খেয়াল করিনি!

ও আমাকে একটা দালান দেখালো। আমি বললাম, "ও আচ্ছা ভালো।" তারপর সামনে হাটতে শুরু করলাম। আমি আসলে বুঝিনি, ও কি দেখাতে চাইছে। তবে ঐ দালানটা আমার চেনা। ওখানে একবার ব্যবসার কাজে গিয়েছিলাম।

হাটতে হাটতে গল্প করতে করতে আমরা অনেক দূর গেলাম। এর আগে ওর সাথে হেটে এতটা পথ আমি আর কখনোই আসিনি। আমার খুব ভালো লাগছিলো, এই বয়সেও এমন রোমাঞ্চ অনুভব করা যায় আমি বুঝিনি। গতকাল ঈদের দিনটা আমার নিরানন্দ কেটেছে। আমার মনে হলো, আজই আমার ঈদ উৎসব পালিত হচ্ছে!

ঐদিকে কোথাও কোন ক্যাফে খোলা পেলাম না। বললাম নওরিন তাহলে চলো, লেকের ঐপারে যাই। নওরিন বললো, "চলেন।" এবার আমরা মেইন রোড ছেড়ে, লেকের রোডে ঢুকলাম। এখানকার প্রসস্ততায় খোলা আকাশ দেখা যায়। লক্ষ্য করলাম আকাশ কিছুটা মেঘলা হয়ে এসেছে! লেকের পাশ দিয়ে হেটে হেটে যেতে লাগলাম। ইদানিং এখানে কিছু বেঞ্চি দিয়েছে সিটি কর্পোরেশন। সেই বেঞ্চিতে পরম আবেশ বসে থাকে কপোত-কপোতী।
ভাবলাম, ওকে নিয়ে বসবো নাকি কোন একটা বেঞ্চিতে? পরমুহূর্তেই মনে হলো। এটা একটা ছেলেমানুষী হয়ে যাবে।
তার চাইতে দেখি কোন একটা ক্যাঁফে খোলা পাওয়া যায় কিনা। এত বড় ঢাকায় আমাদের দুজনার বসার জন্য কি একটি জায়গাও পাওয়া যাবে না?
---------------------------------------------------
রচনাতারিখ: ২রা জুলাই, ২০২০ সাল
সময়: রাত ০৮টা ১১ মিনিট

মেঘের যেমন রঙ রয়েছে, বদলে যাওয়া রঙ,
মনের তেমনি ঢং রয়েছে, উথাল পাথাল ঢং!
কখনো তায় শীতের কাঁপন, কখনো বা বাসন্তী ফুল,
মুক্ত কেশের কেতন ওড়ে, মন মহলা হয় যে আকুল!


-----------------------------------------------------------------

নওরিন এসেছে - পর্ব ৫ (শেষ পর্ব)
----------------------------------রমিত আজাদ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

লেকের ওপাশে গিয়ে একটা ক্যাফে খোলা পাওয়া গেলো। দুজনে মিলে উঠে গেলাম দোতলায়। একটা উইনডোতে আইসক্রীম বিক্রি হচ্ছে। এই করোনাকালে কেউ আইসক্রীম খেতে চায় না। তাই ক্রেতাও নেই। ছুটকা দুতিন জন দাঁড়িয়ে আছে। নওরিন বললো, "আমি ক্যাফেটা চিনি এখানে বসার জায়গা আছে।" আমি বললাম, "ভালো হলো, আমরা তো বসার জায়গাই খুঁজছি।"

উইনডোর কাছে গিয়ে আমি বললাম, "কিছু আছে?"
সেলসম্যান: শুধুই আইসক্রীম।
আমি নওরিনের দিকে তাকালাম। ওর চোখের এক্সপ্রেশন দেখে মনে হলো, যা কিছু একটা হলেই চলবে। খাওয়াটা তো উপলক্ষ, আমরা তো এসেছি বসতে।
আমি দোকানীকে বললাম, "ঠিকআছে, নেব আইসক্রীম। আমরা কোথায় বসতে পারি?"
এক জায়গায় তাকিয়ে দেখলাম কিছু চেয়ার টেবিলের উপর তুলে উল্টো করে রাখা আছে। সেলসম্যান বললো, "সরি স্যার, বসা যাবে না। শুধু সেলস আছে, করোনাভীতিতে বসার ব্যবস্থা বন্ধ।"
হায়রে! যা একটু খোলা পেলাম, তাও বসার ব্যবস্থা নাই!?
নিচে নেমে আমরা আবার হাটতে শুরু করলাম। নওরিন-কে বললাম, "নওরিন, আজ বোধহয় আমাদের আর বসার ভাগ্য নেই!"

নওরিন: তাই তো মনে হচ্ছে!
আমি: তুমি না 'সাউথ পোল' ক্যাফেতে বসতে চাইলে?
নওরিন: আমি তো আপনাকে তখন দেখালামই ক্যাফেটা, আপনি তো হেটে সামনে চলে গেলেন।
বুঝলাম কম্যুনিকেশন গ্যাপ হয়েছে। ও একটা দালান আমাকে দেখিয়েছিলো, আমি বুঝতে পারিনি। অথবা, ও-ই হয়তো আরো কিছুটা পথ আমার সাথে হাটতে চাইছিলো!

আরেকটু হেটে হাতের ডানে একটা ক্যাফে মত কিছু চোখে পড়লো। দ্রুত ঢুকে গেলাম ভিতরে। বাহ! যা চেয়েছিলাম তেমনই পেলাম। ছোট্ট ছিমছাম ক্যাফে। লোকজন কম। উঁচু পার্টিশন দিয়ে আলাদা আলাদা টেবিল, যেখানে দুই থেকে চারজন বসা যায়। আমরা কর্নারে শেষ টেবিলটা বেছে নিলাম। দু'জন মিলে কাউন্টারে গেলাম। কফি ও স্ন্যাকস-এর অর্ডার দিলাম। টেবিলের উত্তর দিকে আমি বসলাম, দক্ষিণ দিকে বসলো নওরিন। আমি হাসিমুখে গল্প শুরু করলাম, "যাহোক, শেষমেশ বসার জায়গা পেলাম।"
দেখলাম নওরিন রুমাল দিয়ে ঘাড় মুচছে।
আমি বললাম, "কি হলো?"
নওরিন: আমার গরম লাগছে।
আমি: ওহ! সরি। তাহলে তুমি এই দিকটায় বসো। এখানে মাথার উপরে এসি পাবে। আমি টেবিলের ঐদিকে বসি। আমরা দিক পাল্টালাম। এবার আমি সমস্যায় পড়লাম। এতটা পথ হেটে গা ঘামে ভিজে গিয়েছে। এসির বাতাস সরাসরি আমার গায়ে এসে লাগছে। এভাবে আমার ঠান্ডা লেগে যেতে পারে।
আমি: নওরিন। আমার এসির বাতাস সরাসরি সহ্য হয় না। আমিও ওপাশটাতে বসি?
তারপর আমি একটু দূরত্ব রেখে ওর পাশেই বসলাম। এই পর্যায়ে নওরিনের সাথে সামাজিক দূরত্ব রাখা আর হলো না। নওরিন একবার আমার দিকে তাকালো, আবার চোখ নামিয়ে নিলো। তারপর ঝলমল করে হেসে উঠলো।
হঠাৎ ক্যাঁফের সাউন্ডবক্সে গান বেজে উঠলো, "এ জীবন ছিলো, নদীর মতন দিশেহারা গতিহারা, ওগো তোমার আকাশ দুটি চোখে আমি হয়ে গেছি তারা।" আমি নওরিনের দিকে তাকালাম। নওরিনের দৃষ্টি কেঁপে উঠলো।

নওরিন: এত জমজমাট জায়গাটা করোনার ভয়ে কেমন ম্লান হয়ে আছে! আচ্ছা করোনা শেষ হবে কবে?
আমি: ভাইরাসের গ্রোথটা এক্সপোনেনশিয়াল। তোমার কি মনে পড়ে যখন ইন্টার্নশিপ করেছিলে আমি তোমাকে এক্সপোনেনশিয়াল গ্রোথ ও তার কার্ভ সম্পর্কে কিছু আইডিয়া দিয়েছিলাম?
নওরিন: হ্যাঁ মনে আছে তো। এক্সপোনেনশিয়াল গ্রোথ - যা অল্প সময়েই খুব দ্রুত বাড়ে। কার্ভটা কি ফ্লাট হবে না?
আমি: কিছু মানুষের শরীরে ইমুনিটি বেশি থাকে তারা বেঁচে যাবে। কিছু মানুষ টেকনিক জানে, যেমন শরীরের তাপমাত্রা বাড়লে ভাইরাস মারা যায়, ডাক্তার বলেছে। ভাইরাল ফ্লু হলে হট শাওয়ার খুব হেল্প করে। তবে সাবধান, আবার বেশি তাপমাত্রায় ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। জ্বালা-যন্ত্রণা কম না!
নওরিন: এই ভাইরাসটা মরবে কিভাবে?
আমি: ভাইরাসের একটা লাইফটাইম আছে সেটা শেষ হয়ে গেলে গ্রোথ কার্ভ ফ্লাট হয়ে যেতে পারে। কিন্তু সমস্যা হলো যে, ভাইরাস একজনার শরীর থেকে আরেকজনার শরীরে যায়, এভাবে তো চলতেই থাকে।
নওরিন: তাহলে এটা অনন্তকাল থাকবে?
আমি: থিওরেটিকালী তাই। আবার সেই ক্ষেত্রে ভরসা হলো ভ্যাকসিন। যদি বিজ্ঞানীরা করোনার ভ্যাকসিন আবিষ্কার করে ফেলেন, তাহলে বাঁচা গেলো!
নওরিন: বিজ্ঞানীরা ভ্যাকসিন আবিষ্কার করছে না কেন?
এবার আমি হেসে ফেললাম।
আমি: নওরিন, আবিষ্কারটা এত সহজ নয়। আবিষ্কার কঠিন বলেই জগদীশ চন্দ্র বসুরা স্যার উপাধি পান, ইবনে সিনা, আকশামসউদ্দীন-রা অনন্তকাল বেঁচে থাকেন মানুষের হৃদয়ে।
নওরিন: ইবনে সিনা-কে তো চিনি। আকশামসউদ্দীন কে?
আমি: মুসলিম বিজ্ঞানী। তিনিই প্রথম জীবাণু বা অণুজীব আবিষ্কার করেছিলেন।
নওরিন: আলেকজান্ডার ফ্লেমিংরা কোথায় আজ?
আমি: এই জমানায় ফ্লেমিং আসাটা কঠিন হবে। ঐ যে জনৈকা স্প্যানিশ বিজ্ঞানী বলেছিলেন, "একজন ফুটবল খেলোয়ার বা একজন চিত্রাভিনেতা এক সিজনে বা এক সিনেমায় যে টাকা পায়, একজন বিজ্ঞানী সারাজীবন গবেষণা করেও ঐ টাকা পায়না। তাহলে বিজ্ঞানীরা মাথা খাটাবে কেন, মেধা চর্চায় মানুষ আগ্রহী হবে কেন?
নওরিন: আমার ভয় লাগছে।
আমি: কিসের ভয়?
নওরিন: আমার মেয়েটা আমেরিকায় আছে, আমার প্রাক্তন স্বামীর সাথে। ওর যদি কিছু হয়!
এবার আমার মন খারাপ হয়ে গেলো। কিছুদিন আগে আমেরিকা প্রবাসী আমার এক বন্ধু করোনায় আক্রান্ত হয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। কিন্তু এই কথা বললে তো নওরিন ভয় পেয়ে যাবে।
আমি: আরে নাহ। কিচ্ছু হবে না। ভয় পেয়ো না। সব ঠিক হয়ে যাবে।
নওরিন: আমার স্বামী যে এমন করবে আমি কোনদিনও ভাবিনি! জানেন প্রথম এক বৎসর আমাদের মধ্যে এত ভালো সম্পর্ক ছিলো!
এই আলোচনাটা আমার ভালো লাগে না। আমি লক্ষ্য করেছি, বাংলাদেশে যখনই কোন বিবাহ বিচ্ছেদ হওয়া নারীর সামনে আলাপ শুরু হয়, কেউ না কেউ ইচ্ছে করেই তার বিবাহ বিচ্ছেদ নিয়ে আলাপ তোলে। এতে মেয়েটা মনে কষ্ট পেতে শুরু করে!
আমি কথা ঘোরাতে চাইলাম। থাক ওসব কথা, পাস্ট ইজ পাস্ট। আমি চাই তোমার বাকী জীবনটা আনন্দে ভরে উঠুক!
নওরিন আমার দিকে তাকালো!

হঠাৎ করে একজন লোক কাউন্টারের দিকে এগুলো। মাঝ বয়সী লোকটাকে আমার চেনা চেনা মনে হলো। আমি একটু পিঠ সোজা করলাম। নওরিন একপাশে সরে মাথাটা নিচু করে ফেললো। দেখলাম লোকটা আমাকে খেয়াল করেনি। কিছুটা কাছে আসতে মনে হলো তাকে আমি চিনি না।

আমি: লোকটাকে চেনা চেনা মনে হচ্ছিলো।
নওরিন: আমারও।

বুঝলাম নওরিন আজকের সাক্ষাৎটিকে অভিসারের মতই নিচ্ছে। পরিচিত কেউ আমাদের দেখুক তা ও চায় না। এটা আমাদের কালচারের একটা দিক। নারী সে যত বয়ষ্কই হোক না কেন, যত স্মার্টই হোক না কেন, সমাজের ভয়ে কিছুটা জড়তা থেকেই যায়। আজকে যেমন ও বিল্ডিংয়ের সবার চোখ এড়িয়ে বাইরে এসেছিলো। কথিত আছে যে, ঢাকা নগরীর অভিজাত এলাকার ফ্লাট বাড়ীগুলোতে, পাশ্চাত্যের মত কেউ কারো দিকে তাকায় না, কেউ কারো কাজে নাক গলায় না। কিন্তু কথাটা আসলে পুরোপুরি ঠিক নয়। নতুন নতুন যখন এ্যাপার্টমেন্ট কালচার চালু হয়েছিলো, তখন অমনই ছিলো, কারণ কেউ কাউকে চিনতো না। কিন্তু একটা দালানে চেনাজানা হয়ে গেলে আবারো ঐ শুরু হয়ে যায়! জাতীয় চরিত্র খুব সহজে বদলায় না।

নওরিন: আমি কিন্তু গান গাইতে পারি।
আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালাম।
আমি: তাই? তুমি গানও গাইতে পারো?
নওরিন: পারিতো। ইউনিভার্সিটিতে থাকতে স্টেজে কতবার গেয়েছি।
আমি: কোন ধরনের গান? নজরুল গীতি?
নওরিন: জ্বী, সবই গানই পারি। তবে নজরুল গীতি বেশী গাই।
আমি: নজরুল গীতি আমার ফেভারিট। আমাকে শোনাবে একদিন তোমার গান?
নওরিন আমার দিকে তাকালো। ওর চোখের এই এক্সপ্রেশনটার মানে আমি বুঝি না। কি আছে ঐ এক্সপ্রেশনে? থাক, না বোঝাই থাক। একটা মানুষকে পুরোপুরি জানলে, আর কোন আকর্ষণ থাকে না।
নওরিন: আমার গান শুনতে চান? ঠিক আছে শোনাবো একদিন।

নওরিন: আচ্ছা আমি যখন আপনার অফিসে ইন্টার্নশীপ করতাম তখনকার আমাকে আপনার মনে আছে?
আমি: হুম। মোটামুটি সবই মনে আছে। প্রথম দিন তুমি একটা পিংকা কালারের সালোয়ার-কামিজ পড়ে এসেছিলে।
নওরিন: ও বাব্বা! আপনি জামার রংও মনে রেখেছেন?
আমি: আমার স্মৃতিশক্তি ভালো। তবে একটা খুঁত আছে।
নওরিন: কি খুঁত?
আমি: আমি কোন মেয়ের চুলের দৈর্ঘ্য মনে রাখতে পারিনা। বাই দ্যা ওয়ে, তোমার চুল লম্বা না ছোট? (হিজাবের কারণে চুল দেখা যায় না)
নওরিন: আপনি যখন আমাকে প্রথম দেখেছিলেন, আমার চুলের লেংথ তখন নানান রকম ছিলো, কখনো লম্বা কখনো ছোট। আমি চুল নিয়ে অনেক রকম এক্সপেরিমেন্ট করেছিলাম।
আমি: এখন তোমার চুলের লেংথ কেমন?
নওরিন: মাঝারি লেংথ, বেশি লম্বাও না ছোটও না।

আমাদের কফি ও স্ন্যাকশ শেষ হয়ে এলো। নওরিন ওর ব্যাগে হাত দিলো বিল দেয়ার জন্য। কাজটা একদম ঠিক হবে না। "নওরিন, আমি বিল দিচ্ছি।" বলে আমি ওর হাতটা চেপে ধরলাম। ওর সাথে আমার হাতের স্পর্শ এই প্রথম! নওরিন, আবার আমার দিকে তাকালো।

আমরা দুজন ক্যাফের বাইরে বাইরে বেরিয়ে এলাম।
আমি: নওরিন, থ্যাংকস ফর দিস ইভিনিং! আই হ্যাড এ ভেরী নাইস টাইম।
নওরিন: হুম!
আমি: তোমার যদি আবার কখনো বসতে ইচ্ছে করে। গল্প করতে ইচ্ছে করে, বলো। ডোন্ট হেজিটেট।
নওরিন: ঠিকআছে। আমি ফোন করবো।

তেমন কোন রাত নয়। স্বাভাবিক সময় হলে এখনই শহর জমে উঠতো। আর আজ একেবারে ভুতুরে পরিবেশ! রাস্তায় জনমনুষ্যি নেই। আমি এদিক-ওদিক তাকালাম যদি কোন রিকশা পাই।
কোন রিকশা পেলাম না। এদিকে মৃদু বৃষ্টিপাত শুরু হয়েছে।
নওরিন বললো, "এখন কোন রিকশা পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। হেটেই যেতে হবে। আপনি বরং বাসায় চলে যান, আমি এখান থেকে হেটে আমার বাড়ীতে যেতে পারবো।"
আমি: কি যে বলো? এই পরিস্থিতিতে তোমাকে একা যেতে দিতে পারি? আগে তোমাকে ঘরে পৌঁছে দেই।

হালকা বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে দুজনা হেটে চলললাম।

কোলাহল ও দূষণমুক্ত কিন্তু আতংকিত শহরের একটি নির্জন পথ বেয়ে আমরা চলছি, পাশাপাশি দু'জনা। এবারের পথ চলায় আমাদের কারো মুখে কোন কথা নেই। শহর ও পথটা এতটাই নির্জন যে আমাদের পায়ে চলার শব্দ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। এই পথে কয়েকটি কদম গাছ আছে। আমার সুযোগ থাকলে আমি নওরিনকে বৃষ্টিভেজা কিছু তাজা কদমফুল উপহার দিতাম। চলতে চলতে আমার মনে হলো, ওর জন্ম কেন হয়নি অনেকগুলো বছর আগে? অথবা আমার জন্ম কেন হয় নি অনেকগুলো বছর পরে? নাকি এই ভালো? বয়সের এই এতটা ব্যবধানই হয়তো আমাদের মধ্যে সৃষ্টি করছে রোমান্টিকতার অন্য এক মাদকতা!
-----------------------------------------------------------------
রচনাতারিখ: ৩রা জুলাই, ২০২০ সাল
সময়: রাত্রী ০১টা ০৪ মিনিট

কার নয়নের চাউনি
------------------------------- রমিত আজাদ

কার নয়নের চাউনি আজি দুলিয়ে দিলো মন,
তাইতো হৃদয় আকুল হলো, অধীর সারাক্ষণ!
কান্না হাসি বুকের মাঝে ছলাৎ ছলাৎ ছলে,
এমন মধুর বিধূর কথা কাহার কাছে বলে?

মনের কথা মনেই থাকে বরফ না আর গলে,
সব বেদনা আগুন হয়ে বুকের মাঝে জ্বলে।
ইচ্ছে জাগে তার তরে আজ ঘরছাড়া হই বনে,
ছটফটানি দেখুক আকাশ, ঝড় তুলে ফাল্গুনে।

ফাগুন যদি আগুন না হয় কৃষ্ণচূড়ার রঙে,
কোন পলাশে ফুটবে হাসি মনের বাতায়নে?
দূরের মানুষ কাছের হবে এই তো ভবের খেলা,
পরকে আপন করে নিয়েই অনন্ত পথচলা!
----------------------------------------------------------

রচনা তারিখ: ০২রা জুলাই, ২০২০ সাল
সময়: রাত ৯টা ১১ মিনিট
(খসড়া রচনা: ২৯শে জুন, ২০২০ সাল)

মন্তব্য ৭ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৭) মন্তব্য লিখুন

১| ০৪ ঠা জুলাই, ২০২০ দুপুর ২:৩৫

আর্কিওপটেরিক্স বলেছেন: নওরিন তাহলে এলো অবশেষে!

পড়তে ভালোই লাগলো।

০৬ ই জুলাই, ২০২০ দুপুর ১২:৫১

রমিত বলেছেন: আপনাকে ধন্যবাদ।

২| ০৪ ঠা জুলাই, ২০২০ বিকাল ৩:০১

নেওয়াজ আলি বলেছেন: ভালো লাগলো লেখাটি I

০৬ ই জুলাই, ২০২০ দুপুর ১২:৫১

রমিত বলেছেন: আপনাকে ধন্যবাদ।

৩| ০৪ ঠা জুলাই, ২০২০ বিকাল ৫:০৯

রাজীব নুর বলেছেন: নওরিন আবার চলে যাবে। কেউই দীর্ঘদিন থাকে না।

০৬ ই জুলাই, ২০২০ দুপুর ১২:৫২

রমিত বলেছেন: আপনাকে ধন্যবাদ।

জ্বী, এই আসা যাওয়াই জীবন!

৪| ১০ ই জুলাই, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:১১

প্রোফেসর শঙ্কু বলেছেন: এভাবে আলাদা পর্ব করে দেয়ার কোন নির্দিষ্ট কারণ আছে কি? গল্পের ফ্লো আরেকটু বেটার হতো একসাথে রেখে এডিট করলে।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.